দুম দুম দুম!
মাঝরাতে দরজায় এত জোরে শব্দ হলো যে আমি তড়াক করে উঠে বসলাম। মনে হলো চোখ খোলার আগে আমার দরজা খোলা দরকার। বাড়িতে একা থাকি। অন্য কেউ দরজা খুলে দেবে, সে ভরসায় থেকে লাভ নেই।
‘কে?’ প্রশ্ন করে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল। ঘুমের রেশ কাটেনি বলে বোধ হয় মাথা ঠিকভাবে কাজ করছিল না। আমি বোকার মতো দরজা খুলে দিলাম। আর হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লেন এক নারী। অফিস ছুটির হুড়োহুড়ির সময়ে ফার্মগেটে ‘গেট লক’ বাসগুলোর দরজা সামান্য খোলা পেলেই যাত্রীরা যেমন ফুড়ুৎ করে উঠে পড়ে, অনেকটা সে রকম।
বাতি জ্বালালাম।
নারীর সঙ্গে একটা বড় আর একটা ছোট লাগেজ। ঘরে ঢুকেই তিনি ছোট লাগেজটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। লাগেজের ওপর নানা রকম তাবিজ–কবচ, লতাপাতা, দড়ি জড়ানো।
‘একটা কাঁচি দেবেন, প্লিজ? জলদি!’
তার গলার স্বরে একধরনের কর্তৃত্ব ছিল। মনে হলো তিনি আদেশ দিয়ে অভ্যস্ত। ‘আপনি কে? কেন এসেছেন? কী চাই?’ এসব বলার সুযোগ আমি পেলাম না। কাঁচি এনে দিলাম। মহিলা বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে লতাপাতা, দড়ি কাটতে লাগলেন। মনে হলো তার হাতে সময় খুব কম।
ভেতরে টাইম বম্ব টাইপের কিছু আছে কি না, কে জানে।
আমি চোখ ডলতে ডলতে বললাম, ‘আপনাকে কি আমি চিনি?’ নিজের গলার নিরুত্তাপ ভাব শুনে নিজেই চমকে গেলাম। মাঝরাতে এক নারী ঘরে ঢুকে পড়েছেন। তাতেও আমার খুব বিচলিত বোধ হচ্ছে না। অদ্ভুত।
তবে ভদ্রমহিলা লাগেজটা খুলে ফেলার পর আমাকে চমকাতে হলো। ‘আমার সোনা, আমার বাবু...’ বলতে বলতে তিনি লাগেজের ভেতর থেকে যে বস্তুটা বের করলেন, সেটা একটা মানবশিশু! বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে তিনি পাগলের মতো চুমু খেতে শুরু করলেন আর আদর করতে থাকলেন।
মিনিট দুয়েক পর আমার দিকে তার নজর পড়ল। ‘সরি ভাইয়া, আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। মাঝরাতে আপনাকে বিপদে ফেলে দিয়েছি। আমি সত্যি খুব সরি। আসলে লুসির জন্য খুব টেনশন হচ্ছিল। তা ছাড়া ১৬ ঘণ্টা জার্নি করে এসেছি। মাথা কাজ করছিল না। এয়ারপোর্টে বসে যে রাতটা পার করে দেব, সে উপায়ও নেই। ওকে তো লাগেজ থেকে বের করতে হবে...’
লাগেজের ওপর লাগানো ট্যাগগুলো দেখে বুঝলাম, মহিলা আজই এ দেশে পা রেখেছেন। একটা ছোট বাচ্চাকে কেন তিনি লাগেজে ভরে এনেছেন, ইমিগ্রেশন কীভাবে পার হয়েছেন, সেসব প্রশ্নে আমি গেলাম না। বললাম, ‘কিছু খাবেন?’
‘আমি কিছু খাব না। কিন্তু আমার বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়ানো দরকার। একটু গরম পানি দেবেন?’
আমি দ্বিতীয়বারের মতো তার আদেশ পালন করলাম।
বাচ্চাটার বয়স সম্ভবত সাত–আট মাস, একটু কমও হতে পারে। এইটুকুন বাচ্চা কীভাবে এতক্ষণ না খেয়ে ছিল, সেটাও এক বিস্ময়। নেহাত আমার বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা কম বলে আমি চুপচাপ বসে বসে মা–ছেলের কর্মকাণ্ড দেখতে থাকলাম।
বাচ্চাটার মুখে ফিডার ধরে একটা বই খুলে বসলেন মা। ইংরেজি বর্ণপরিচয়ের বই। এইটুকুন বাচ্চাকে পড়ালেখা শেখাতে হবে কেন? ভদ্রমহিলা বোধ হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারলেন। হেসে বললেন, ‘ছবি না দেখে খেতে চায় না...কী যে ঝামেলা! বাই দ্য ওয়ে, সরি, আমার নামটা বলা হয়নি। আমি তিথি।’
২
তিথি নামের এই মাঝরাতের আগন্তুক আমাকে যা বললেন, সেটা এ রকম: ৫ বছর হলো তিনি স্বামীর সঙ্গে নিউইয়র্কে থাকেন। হাসিখুশি সংসার ছিল। বিপদটা হলো লুসির জন্মের পর থেকে। এইটুকুন ছেলের নাকি একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। এক জায়গা থেকে সে আরেক জায়গায় চলে যেতে পারে।
‘আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনার ছেলেটা এই বয়সেই হাঁটতে শিখে গেছে?’ বললাম আমি।
তিথি হাসলেন। ‘আপনি আমার কথা বুঝতে পারেননি। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি দেখাচ্ছি।’
লুসিকে সোফার ওপর শুইয়ে দিলেন তিনি। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো, কোনো জাদু দেখাবেন। জাদুশিল্পীকে আমি বাধা দিলাম না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম।
এক মিনিট গেল, দুই মিনিট গেল। ঠিক কিসের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি, বুঝতে পারছিলাম না। ঘুমে আমার প্রায় চোখ লেগে এল। বাচ্চাটাকেও খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে সে এমনভাবে হাসছে, মনে হচ্ছে খুব মজার একটা কিছু হচ্ছে। কিন্তু এরপরই যে ঘটনাটা ঘটল, সেটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
হঠাৎ বাচ্চাটা চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল এবং পরক্ষণেই তার হাসির শব্দ শোনা গেল পাশের ঘর থেকে। আমি ছুটে গিয়ে দেখলাম, সে দিব্যি আমার বিছানায় শুয়ে হাসছে।
‘এবার বুঝতে পেরেছেন?’ তিথি যখন আমার পাশে দাঁড়িয়ে কথাটা বললেন, তখন সব বিষয়ে প্রায় নির্বিকার থাকা এই আমার মুখও বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে।
৩
প্রথমবার একটু সময় লেগেছে। কিন্তু এরপর থেকে বাচ্চাটা বারবার জায়গা বদল করতে শুরু করল। সোফা থেকে ডাইনিং টেবিল, ডাইনিং টেবিল থেকে মেঝে, মেঝে থেকে খাট...বারবার জায়গা বদল হচ্ছে, আর সে খিলখিল করে হাসছে। শুরুতে অবাক হয়েছিলাম। এখন আমার একটু ভয় ভয় করতে শুরু করল।
বোধ হয় মনের কথা বুঝতে পেরেই তিথি বললেন, ‘আমার স্বামীর বাড়ির লোকজনও লুসিকে ভয় পায়। দূরে কোথাও দিয়ে আসতে চায়। আমার দেবর...ওয়ানস হি ট্রাইড টু কিল মাই সান!’ বলতে বলতে খুব সাবধানে চোখ মুছলেন তিনি। ‘সব সময় ওকে লুকিয়ে রাখতে হয়। আমি আর পারছি না।’
‘কিন্তু আপনি আমার কাছে এসেছেন কেন?’
তিথি একটু সময় নিলেন, ‘আমি শুনেছি আপনার টেলিপ্যাথিক পাওয়ার আছে। আপনি মানুষের মনের কথা পড়তে পারেন। আপনি কি আমার ছেলের সঙ্গে একটু কথা বলবেন? প্লিজ?’
‘এইটুকু বাচ্চার সঙ্গে কথা বলব কী করে?’
‘প্লিজ...একবার চেষ্টা করে দেখুন। মুখে বলতে না পারলেও, মনে মনে ও নিশ্চয়ই বলবে।’
আমি ভদ্রমহিলাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘আপনি যা ভাবছেন, ব্যাপারটা তা না। আমার টেলিপ্যাথি সব সময় কাজ করে না।’
তিথি তবু মানলেন না, ‘দেখুন, আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। অনেক খোঁজখবর নিয়েছি আপনার সম্পর্কে। কেউ বলেছে আপনি পাগল। কেউ বলেছে সব মিথ্যা কথা। তবু কতটা অসহায় হলে একজন মা এত দূর আসে, একবার ভাবুন। প্লিজ! আপনার মাধ্যমে আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’
অগত্যা আমাকে রাজি হতে হলো।
৪
প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে গেছে। লুসিকে বিছানায় শুইয়ে, ওর ছোট্ট দুটি হাত ধরে চুপচাপ বসে আছি আমি।এর আগে কখনো এত ছোট বাচ্চার মনের কথা বোঝার চেষ্টা করিনি। বড় কেউ হলে এতক্ষণে কাজ হয়ে যেত।
আমি মনে মনে কথা বলার চেষ্টা করলাম, ‘লুসি। লুসি বাবু! কেমন আছ তুমি? লুসিইইই...’
কোনো জবাব নেই। বাচ্চাটা আমার কথা বুঝতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু একদম চুপ করে শুয়ে আছে। আমি আবার বললাম, ‘লুসি, তুমি কেমন করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাও? তুমি কি জাদু জানো?’
ধীরে ধীরে আমার মধ্যে একটি চাপা আতঙ্ক ভর করল। মনে হলো লুসি স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো ছোট শিশুর চোখে এই দৃষ্টি আমি আগে কখনো দেখিনি। আমার কেমন যেন জেদ চেপে গেল।
আমি বারবার একই প্রশ্ন করতে থাকলাম, ‘লুসি, তুমি কি কোনো জাদুকর? কোনো ভিন গ্রহের প্রাণী? তোমার কি কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে?’
অন্য কেউ হলে আমি মাথার ভেতরে ওপাশের মানুষটার কথা শুনতে পেতাম। কিন্তু এই প্রথম, একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মাথার ভেতর, আমি বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ছবি দেখতে পেলাম।
চমকে উঠলাম। এমনটা আগে কখনো হয়নি।
বিচ্ছিন্ন কিছু ছবি। একটি কমলা, একটি হাতি...
আশ্চর্য! কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারলাম, ছবিগুলোর মধ্যে একটি প্যাটার্ন আছে। থেমে থেমে লুসি একই ছবি বারবার দেখাচ্ছে। কয়েকটা ছবি দেখায়। একটু বিরতি। এরপর আবার কয়েকটি ছবি। আবার বিরতি। আমি পরপর ছবিগুলো সাজাতে চেষ্টা করলাম।
নাক, কমলা, বাঘ
আম, হাতি
আইসক্রিম, বাঘ, ভেড়া
আম, দই
আম, কমলা, আম
একই ছবি বারবার আসতে থাকল। কী বলতে চাচ্ছে ও?
(উত্তর দেখো নিচে)
উত্তর: খাওয়ার সময় ইংরেজি বর্ণ পরিচয়ের বই দেখে লুসি। বই থেকেই সে ছবিগুলো তুলে এনেছে। নাক, কমলা, বাঘ — Nose, Orange, Tiger। আম, হাতি — Mango, Elephant... এভাবে সবগুলো শব্দের ইংরেজি করতে হবে। শব্দগুলোর অদ্যক্ষর নিলে পাওয়া যায়: Not Me, Its My Mom।