সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বসে বসে ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়? সিলেট থেকে দাওয়াত এসেছে গ্রীষ্মটা ওখানেই কাটাতে হবে। কিন্তু ‘দুত্তোর ছাই,’ কমলালেবু যে গ্রীষ্মকালে পাকে না। সিলেট যেতে হলে যাওয়া চাই শীতকালে।
বড় মামা চিঠি লিখেছেন, ‘কোত্থাও যাওয়া-যাওয়ির দরকার নেই, মীরন। তুমি সোজা চলে এসো এখানে। টুটুল, হীরন, জেরিনা তোমার সঙ্গে খেলবে বলে বসে আছে। আম-কাঁঠালও পেকেছে। এবার বড্ড মজা হবে কিন্তু!
আম-কাঁঠালের গন্ধ যখন পেয়েছি, আর কি থাকা যায়? সোজা চলে এলুম মামাবাড়ি। শনিবার বিকেল চারটেয় টিকিট কেটে চাপলুম গাড়ি; আর ভোর না হতেই মামাবাড়ির স্টেশন। স্টেশন থেকে মাইল সাতেক পায়ে হাঁটা পথ। তারপরেই মামাবাড়ির বিরাট ফটক। আমাকে দেখে টুটুল, পুতুল তারা দৌড়ে এল। আমার কিন্তু এই প্রথম পাড়াগাঁয়ে পদার্পণ। তাই কামরান ভাই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে মামাবাড়ির প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি দেখাল।
মামাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন প্রতিপত্তিশালী জমিদার। বিরাট বাড়ি। সাবেক প্যাটার্নে গড়া। সামনে একটা পুকুর, পেছনে একটা পুকুর। আর সারাটা বাড়িভরা আম-কাঁঠালের গাছ। দেখে তো আমার আনন্দ আর ধরে না।
কাজেই, বুঝতে পারো, সেবার আমাদের গ্রীষ্মের ছুটিটা কাটল কেমন? পাশের বাড়ির নান্টু-পিন্টুরা আর আমার মামাতো ভাইবোনেরা মিলে প্রায় জনা দশেক। একখানা পল্টন বললেও অত্যুক্তি হয় না। আর এই পল্টনখানির অগ্রে কামরান ভাইকে অধিনায়ক রেখে, আমরা বের হতুম আম-কাঁঠালের অভিযানে। সারা দিন গাছে গাছে বাদুড়ঝোলা ঝুলে সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরতুম, বড় মামা একটুও আপত্তি করতেন না। বলতেন, ‘এই তো চাই। খাবি-দাবি ফুর্তি করবি,—এই তো জীবন!’
কিন্তু বাবা ছিলেন মামার উল্টো। প্রথমত বাবা তো আমাকে মামাবাড়ি যেতে দিতেই নারাজ। শেষে যখন কথা দিলুম যে কামরান ভাই থেকে জ্যামিতিটা শিখে নেব, তখন অনেক অনিচ্ছায় রাজি হলেন। কামরান ভাই যে খেলাধুলাতেই কেবল আমাদের ক্যাপ্টেন তা নয়; লেখাপড়াতেও ছিল তুখোড়।
সে যাক গে। হইহুল্লোড় করে সারাটা গ্রীষ্ম প্রায় শেষ হয়ে এল। লেখাপড়ার কথা বেমালুম ভুলেই গেছলুম। এদিকে আমার যাওয়ার সময়ও ঘনিয়ে এল। আমি যাব যাব করছি। এমন সময়, একদিন বড় মামা আমায় ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘এই নাও, তোমার বাবার চিঠি।’
বাবার চিঠিটা পেয়ে বুকটা দুরু দুরু করে উঠল। হায় রে! বাবাকে মুখ দেখাব কেমন করে। সারাটা ছুটি যে বই-পত্তরের সঙ্গে একদম ‘নন-কোঅপারেশন।’ আর জিওমেট্রিটাকে সত্যি আমার ভয় করে। ওটা দুরস্ত করতে না পারলে, বাবা লিখেছেন, বাড়ি-ফেরা নাকি আমার উচিত হবে না। মরিয়া হয়ে কামরান ভাইকে ধরে বসলুম, ‘ভাই, যেমন করেই হোক, এর একটা উপায় করো।’ কামরান বললে, ‘বেশ তো। আর কটা দিন থেকে যাও। জিওমেট্রি শিখে নিয়ো।’ তা-ই সাব্যস্ত হলো। আমি থেকে গেলাম। বড় মামা বললেন, ‘ভালোই হলো। লিচু পাকাটাও দেখে যেতে পারবি।’
রাতে কামরান ভাই-এর কাছে জিওমেট্রি পড়ি, আর দিনে মামাদের পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে লিচু পাকা দেখি। আম-কাঁঠাল শেষ হয়েছে। গ্রীষ্মের শেষভাগে মামাদের লিচুগাছে লিচু পাকল। লাল-লাল থোবা-থোবা ইয়া বড় বড় লিচু। রসে টসটস করা! দেখলে সত্যি লোভ হয়। সুগন্ধে মাছি ভনভন করে বেড়ায় গাছের চারদিকে। কিন্তু দুঃখ কি জানো? মামাদের লিচুগাছে লিচু ধরে, পাকে, ঝরে পড়ে, পচে যায় বছরের পর বছর। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো জনমনুষ্যি সেই লিচু খেতে পারেনি। এইটেই মামাবাড়ি-জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
একটা কথা বলিনি বুঝি? মামাদের পেছনের পুকুরের কথা শোননি? আমাদের যত দাপাদাপি ঝাঁপাঝাঁপি মামাদের সামনের পুকুরেই ছিল সীমাবদ্ধ। পেছনের পুকুরের কথা শুনলেই ভয়ে আমাদের গা কাঁটা দিয়ে উঠত। হাজার হাজার জোঁক ওতে কিলবিল করছে।
মামাদের পূর্বপুরুষেরা নাকি (শোনা যায়) অত্যাচারী জমিদার ছিল। যে প্রজা খাজনা দিত না, তাকে ধরে এনে জোঁক-পুকুরের মধ্যিখানে যে একটা দ্বীপ ছিল, তাতে ছেড়ে দেওয়া হতো। বেচারীর সাধ্য ছিল না, জোঁকের ভেতর দিয়ে সাঁতার কেটে পাড়ে আসে। এভাবে দ্বীপে বন্দী হয়ে বেচারী অনশনে কষ্ট পেত, যে পর্যন্ত না আত্মীয়স্বজনেরা খাজনার টাকা নিয়ে উপস্থিত হতো। খাজনা উশুল হলে পর, দুখানা লম্বা মজবুত তক্তা ছিল সমান দৈর্ঘ্যের, তাদেরই একখানাকে (বা উভয়কেই পাশাপাশি) পুলের মতো করেপুকুরপাড়ে ও দ্বীপের পাড়ে যোগাযোগ করে দেওয়া হতো। একমাত্র এ উপায়েই দ্বীপের বন্দী পাড়ে আসতে পারত ও মুক্তি পেত। (বিশ্বাস না হয়, যদুনাথ সরকার কৃত বার ভূঞার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসখানা একবার পড়ে দেখ।)
যাক—এ তো গেল ইতিহাসের কথা। হাল জামানায় সেসব অত্যাচারের কাহিনি অবশ্য প্রত্নতত্ত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দুঃখের কথা কি জানো? মামাবাড়ির এত ভালো ভালো জায়গা থাকতে, মামাবাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে ব্যাপারটি অর্থাৎ লিচুগাছটি—কিনা শেষটা ওই হতচ্ছাড়া দ্বীপে গিয়ে জন্মাল। কবে থেকে যে লিচুগাছটি এ দ্বীপে জন্মেছে কেউ বলতে পারে না।
তারপর, দুঃখের ওপর দুঃখ হলো এই যে, সেকালে তক্তায় দ্বীপ নাগাল পেলেও আজকাল তক্তা দুটোর একটাতেও সামান্যের জন্য দ্বীপটা নাগাল পাওয়া যায় না। কারণ দ্বীপ বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে ছোট হয়ে গেছে। তাই কেউ সে দ্বীপে যেতেও পারে না, লিচুও খেতে পারে না। বছর বছর লিচু পেকে ঝরে পড়ে পুকুরের জলে পচে।
রাতে জিওমেট্রির একটা দুরূহ প্রবলেম সলভ করতে গিয়ে একদিন বললুম, ‘কামরান ভাই, ছাই তোমার জ্যামিতি। অকেজো বিদ্যা। লিচুটা পর্যন্ত পেড়ে খাওয়াতে পারলে না এত দিন।’ বলেই বই বন্ধ করে শুতে চলে গেলুম।
আমার ধিক্কার হঠাৎ কামরানের চিন্তায় কী যেন ভাবান্তর এল। অনেক রাত পর্যন্ত কামরান আমার ফেলে-দেওয়া প্রবলেম নিয়ে আঁক কষাকষি করল। তারপর শুতে যাওয়ার সময় আমায় জাগিয়ে বললে, ‘মীরন, ভারি একটা মজার কথা শুনবি? তুই আমার বড্ড উপকার করেছিস। এত দিন ভাবিনি। এখন দেখছি যে জ্যামিতির সাহায্যেই তো অনায়াসে লিচুটা খাওয়া যেত এত দিন। কাল সকালে দেখবিখন।’ শুনে আমার হাসি পেল: কোথায় জ্যামিতি আর কোথায় লিচু খাওয়া!
কিন্তু পরদিন সকালে দেখি, কামরানের হাতে সত্যি সত্যিই, সদ্য গাছ-থেকে-পাড়া লিচুর থোকা। ‘কোথায় পেলে, কামরান ভাই?’ ছেলেমেয়েগুলো দৌড়ে এল।
‘কেন, দ্বীপের গাছ থেকে!’
‘দ্বীপে? গেলে কেমন করে?’
‘তক্তা দুটোর সাহায্যে।’
‘ও, তক্তা দুটোকে বুঝি পেরেক ঠুসে জোড়া লাগিয়ে লম্বা করেছ?’
‘না। অত মোটা মজবুত তক্তাতে যে পেরেক ঠাসানো যায় না।’
‘তবে কি দড়ি দিয়ে বেঁধেছ?’
‘তা-ও না। তক্তা দুটো আলাদাই রয়ে গেছে। অথচ, তাদের সাহায্যেই দ্বীপে পৌঁছানো যায় যে!’
‘কেমন করে শুনি? ভেলা বানিয়ে?’
‘দূর, ভেলা কেন বানাতে যাব? তক্তাগুলো কি আর ভাসে? আর ভাসলেই বা। যা জোঁক। ভেলাসুদ্ধ কিলবিল করে ঘিরে ফেলবে যে।’
‘তবে গেলে কেমন করে, বলো না!’
ততক্ষণে হইচই শুনে বড় মামাসহ পাশের বাড়ির আরও অনেকে দেখতে এল। সবারই মনে হলো, কামরান যেন ছোটখাটো একটা অসাধ্য সাধন করেছে। সবারই মুখে এক কথা, দ্বীপে গেলে কেমন করে তুমি? যে দ্বীপে বছরের পর বছর জনমনুষ্যি কেউ যেতে পারেনি ভয়ে!
‘শুকনোয় শুকনোয় গেলে ভয় আবার কিসের?’ কামরান ভাই বললে, ‘জোঁক তো জলে।’
‘ও, তুমি বুঝি পোল জাম্প জানো?’ বড় মামা আর ঔত্সুক্য চেপে রাখতে পারেন না।
‘হ্যাঁ, বাবা, পোলজাম্পই বটে,’ কামরান বললে হেসে, ‘তবে এটা বুদ্ধির পোলজাম্প।’ বলে কামরান আমাদের সবাইকে পুকুরপাড়ে নিয়ে গেল। বললে, ‘সামান্য একটু জ্যামিতিক বুদ্ধি খাটাতে পারলে, অনায়াসে লিচু খাওয়া যায়। তোমরা সবাই তক্তা দুটোকে পাশাপাশি স্থাপন করে ভুল করেছিলে এত দিন। (১নং চিত্র দ্রষ্টব্য)। তা না করে, যদি তক্তা দুটোর একখানাকে পুকুরের কোণে আড়াআড়ি রাখা যায়, আর একখানাকে তার ওপর লম্ব স্থাপন করা যায়, তবে অনায়াসেই দ্বীপে যাওয়া যায়।’ এই বলে কামরান কীভাবে দ্বীপে যেতে হয় দেখিয়ে দিল। (২নং চিত্র দ্রষ্টব্য)। ফের বলল, ‘কাল রাত্তিরে জ্যামিতির একটা দুরূহ কনস্ট্রাকশন সমাধা করতে গিয়ে হঠাৎ এ কথাটা আমার খেয়াল হলো। কাজেই দেখো, মীরন ভাই, জ্যামিতি জিনিসটা অতখানি নীরস নয়, যতখানি তুমি ভেবেছিলে।’
সাজেদুল করিম লিখেছেন খুব অল্প, কিন্তু যা লিখেছেন, বাংলা শিশুসাহিত্যে তা আজও প্রথম সারিতেই অবস্থান করছে। অঙ্কের মজা কিংবা কুইজ নিয়ে যেমন গল্প লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন হাস্যকৌতুক নিয়েও। সবই খুব সহজ ও সাবলীল ভাষায়। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক সাজেদুল করিমের জন্ম ১৯১৭, আর মৃত্যু ১৯৯৫ সালে। চিংড়ি ফড়িংয়ের জন্মদিনে, চেরাপুঞ্জি পলিটিক্স, এপ্রিলস্য প্রথম দিবসে, দস্যি ছেলের দশচক্র, মাসী পিসির অ্যালজেব্রা তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।