জলদস্যু ও একজন জলদাস
সুন্দরবনের দুবলারচর। সেই চরে এখন চলছে জেলেদের ছাপরা তোলার কাজ। আশ্বিন মাসের শুরুতে প্রতিবছরই চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-সাতক্ষীরা-খুলনা ও বাগেরহাটের এই সাগরদ্বীপে এসে অস্থায়ী জেলেপল্লি গড়ে জেলেরা। সারি সারি ছাপরা-কুঁড়েঘর। আশ্বিনের মাঝামাঝি সময়ে সাগর একটু শান্ত হলেই জেলেরা জাল-ফিশিং ট্রলার ও বড় বড় জেলেনৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গভীর সমুদ্রের বুকে। মাছে নৌকা-ট্রলার ভরে গেলে ফিরে আসে পল্লিতে। মাছ খালাস করেই আবার ছোটে সাগরের বুকে। পল্লিতে থাকা জেলেরা মাছ কেটে শুঁটকি করে শুকাতে দেয় রোদে। রাতে পালা করে গরানের ডালের মশাল জ্বালিয়ে আর লাঠিসোঁটা হাতে ঢোল-করতাল বাজিয়ে পল্লির কিনারা দিয়ে টহল দিতে হয়।
দুবলারচরের এক পাশ জোড়া জঙ্গল তো তিন পাশ জোড়া সাগর। সুন্দরবন থেকে মানুষখেকো বাঘ এসে জেলেপল্লিতে হামলা করতে চায় প্রতিটি রাতে। এক হাতে জীবন এখানে, অন্য হাতে মরণ। এক হাতে হাড় খাটুনি, অন্য হাতে আনন্দ-খুশি। সমুদ্রে সলিলসমাধি হতে পারে। তুলে নিতে পারে মানুষখেকো বাঘে। চুপিসারে অজগর এসে গিলে ফেলতে পারে। ছোবল দিতে পারে ভয়ংকর রাজগোখরা বা গোখরা সাপ। তারপর আছে জলদস্যু-বনদস্যুদের হামলার ভয়। অবশ্য দুবলারচরে হামলা করলে দুঃসাহসী লক্ষাধিক জেলে প্রবল সাহসে রুখে দাঁড়াতে জানে। গুলির ভয় পায় না এরা। দেশীয় অস্ত্র তো আছেই! এসব কিছুকে উপেক্ষা করার জন্যই এখানকার গরিব জেলেরা রাতে বাউলগানের আসর বসায়, সুন্দরবনের রানি বা দেবী বনবিবির গানের আসর জমায়। গাজীর গীতের পালাও চলে মাঝেমধ্যে। প্রায় তিন লাখ জেলে এই চরে কাজ আর আনন্দে কাটায় চৈত্র মাস পর্যন্ত। সাগর গরম হতে শুরু করলেই জেলেরা আবার বুকভরা আনন্দ নিয়ে নৌকা-ট্রলার ভাসায় ডাঙার দিকে। সাত মাসের কামাইয়ে বছর চলে যায় ভালোভাবে। জাল, নৌকা ও ট্রলার তো আর গরিব জেলেদের নয়! দাদনের টাকাসহ মহাজন-আড়তদার বা বহরদারদের কাছ থেকে সাজসরঞ্জাম নিয়েই জীবনের সন্ধানে আসে তারা এই দুবলারচরে। ফিশিং ট্রলারও বহরদারদের। যারা আসে, তাদের সবাই ফিরতে পারে না। কেউ যায় হাঙরের পেটে, কেউ মরে সমুদ্রে ডুবে, কাউকে তুলে নেয় বাঘে, কেউ মরে সাপের কামড়ে। সাগরদস্যুরা মাছসহ ট্রলার ছিনতাই করে জেলেদের ফেলে দেয় সাগরে। কেউ বাঁচে, কেউ মরে। অপহরণ করে মুক্তিপণও আদায় করে জলদস্যু-বনদস্যুরা।
জলধর জলদাস। বয়স ১৩ বছর। সিড়িঙ্গে শরীর। শরীরের রং সুন্দর। বড় বড় সাহসী-বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ। মাথাভরা ঝাঁকড়া-কোঁকড়া চুল। তার বাবাও ছিল সমুদ্রের জেলে। সিডরের রাতে সে ভেসে গিয়েছিল—সাগরের বুকেই ছিল সে সেই রাতে, জেলেবহরে। ঠাকুরদা ছিলেন সুন্দরবনের মৌয়াল। মৌচাকে ধোঁয়া বেশি পরিমাণে দিতে গিয়ে মৌমাছির কামড়েই মারা যান তিনি। সিডরের সময় জলধর ছিল শিশু। সংসার অচল। সংসারের হাল এখন তাই জলধরের হাতে। দুই বছরের ছোট একটি ভাই, মা আর বৃদ্ধা ঠাক্মাকে নিয়ে ছাপরায় সংসার তার। এক কাকা ছিলেন বাওয়ালি। সুন্দরবনের বাঘের কবলে পড়ে পঙ্গু এখন। আছেন কাকিমা। এই দুজনকেও টানতে হয় জলধরের। গেল তিন মৌসুমেও গ্রামের জেলেদের সঙ্গে এসেছিল সে। এ বছরও এসেছে দুবলারচরে। তার বহরের জেলেদের সঙ্গে সে-ও এখন মহাব্যস্ত ছাপরা তুলতে। দুবলারচরে জেলেপল্লি গড়ে ওঠে খুব সহজে। লাগোয়া বন থেকে গোলপাতা আর গরানের ডালপালা আনলেই হলো। গরানের খুঁটি-চালা। গোলপাতার ছাউনি ও বেড়া। মাটিতে বিছানো হোগলাপাতার পাটি। রান্নাবান্না হয় বাইরে। লাকড়ির কোনো অভাব তো আর নেই।
এক ভোরবেলায় একখানা ট্রলার এসে ভিড়ল চরের কিনারে। পোশাক দেখেই জেলেরা বুঝল, কোস্টগার্ড বাহিনীর সদস্য এরা। হাতে রাইফেল। ওরা এগিয়ে এসেই চারদিকে তাকাচ্ছে মানুষখেকো বাঘের মতো। অন্য জেলেদের মতো বালক জলধরও কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম ঠুকল। অফিসারমতো একজন এসে খপ করে জলধরের চুলের মুঠি ধরে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘অ্যাই! তোর বহরের সর্দার কে?’
জলধর ভয়ে ভয়ে আঙুল তুলে সর্দারকে দেখাল—বৃদ্ধ ভজহরি জলদাস। তিনি জোড়হাতে এগিয়ে এসে বললেন, ‘স্যার, জলধর কি কোনো কেসের আসামি নাকি?’
‘চুপ!’ ধমক দিয়ে বলল অফিসার, ‘আসামি তুমি! এইটুকু দুধের শিশুকে মাছ শুঁটকি দিতে কেন নিয়ে এসেছ এই চরে?’
‘ও তো দুধির শিশু না স্যার। ওর বয়েস তো তেরো বৎসর। গেল তিন বছর ধইরে আসতিছে। সিজনে ৭০-৮০ হাজার টাকা কামাই করে। ও তো স্যার সংসার চালানোর জন্যিই দুবলারচরে আইছে।’
‘চুপ বুড়ো, একদম চুপ!’ প্রচণ্ড ধমক দিয়ে আবারও বলল অফিসার, ‘তুমি জানো না, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাই শিশু?’
বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন অসহায়ের মতো—জানেন না তিনি এ বিষয়টা।
‘খবরের কাগজ-টাগজ পড়ো না? টিভি-টিবি দেখো না? জানো না, শিশুশ্রম দণ্ডনীয় অপরাধ?’
আবারও মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ—বিষয়টা জানেন না তিনি।
ইতিমধ্যে জেলেদের ভিড় জমে গেছে চারপাশে।
বৃদ্ধ জেলে সর্দার জমিরউদ্দিন সামনে এসে বললেন, ‘স্যার, আইনটা আমি জানি।’
‘তুমি কে?’
‘আমি স্যার আরেক বহরের সর্দার। ৪০ বছর ধইরে এই চরে আসি। মাছ ধরি। শুঁটকি করি। রোদে শুকাই।’
‘তো আইন যখন জানো, তখন শিশুদের আনো কেন এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে? বাঘে খেতে পারে। সাপে কাটতে পারে। সমুদ্রে ডুবে মরতে পারে! জলদস্যুরা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতে পারে। মুক্তিপণের টাকা না পেলে গলা কেটে সাগরে ভাসিয়ে দিতে পারে লাশ!’
‘স্যার, জীবনে ম্যালা লাশ দেহিছি। জলদস্যুগে লাঠি-বৈঠা-রামদা দিয়ে মাইরে-কাইটে সাগরে ফেলাইছি। অপহরণ তো স্যার পেত্যেক বছরই হয়। ডাকাতগে চাঁদা দিয়ে টোকেন দিয়েই তো সাগরে নৌকো-ট্রলার ভাসাতি হয় আমাগের। তা-ও তো ঘটনা ঘটে। স্যার, ভয় পালি কি জীবন চলে? আর ওই যে আইনের কথা কোতিছেন আপনি, তা তো আপনারা গভীর সাগরে যাইয়ে চালাতি পারেন না। সাগর ডাকাতরা গহিন সাগরের বুকি আমাগে মাইরে-কাইটে জাল-মাছ আর ট্রলার কাইড়ে নিয়ে যে সাগরে ফেলাইয়ে দে, আমরা তেলের ড্রাম ধইরে সাত-আট দিন লোনা দরিয়ায় ভাসি, লোনাজলে শরীরের চামড়া খইসে পড়ে, সগলে তো আর বাঁচতি পারিনে, তয় বাঁচার চেষ্টা করে যাই—তহন স্যার আপনারা কোহানে থাহেন? আইন কি তহন মইরে লাশ হইয়ে যায়, স্যার?’
‘সাবধানে কথা বলো, বুড়ো! জানো, সরকারবিরোধী কথা এগুলো? তোমার বিরুদ্ধে আমরা রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করতে পারি এখন?’
‘তা তো পারেনই স্যার। যুগ যুগ ধইরে সাগরের জাইলেরা সাগরে নৌকা ভাসাতিছে, আগে আসত স্যার মগাইয়া জলদস্যুরা। এখনো আসে তারা আমাগের সীমানায়। “ফেয়ার ওয়ে বয়া” পেরিয়ে আইসে আমাগের মাইরে-কাইটে সাফ কইরে দেয়। আসে থাই জলদস্যুরাও। মগাইয়ারা (মগ জলদস্যু) ভয়ংকর স্যার! দয়া-মায়া নাই। ওই বার্মার মগাইয়ারাই তো স্যার রোহিঙ্গাগের মাইরে-কাইটে আর ঘরবাড়ি জ্বালাইয়ে দিছে। দশ লাখ রোহিঙ্গা এহন বাংলাদেশে। আমরা তো স্যার মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি গেইলাম ভারতে। মগাইয়ারা (মগ জলদস্যু) স্যার রাজাকার-মিলিটারির চেয়েও দুর্ধর্ষ-ভয়ংকর। সেই মগাইয়ারা গেল বছরও আমাগের তিনখেন ট্রলার কাইড়ে নিয়ে গেল। কই, আইন তো গভীর দরিয়ায় গেল না! আপনি আইন ফলাতি আইছেন এই দুবলারচরে? কেন স্যার?’
‘অ্যাই বুড়ো, চুপ! দুবলারচরে না থেকে বাড়ি ফিরে রাজনৈতিক দল গঠন করো। উন্নতি হবে। আমরা আইনের লোক। কাজ করতে দেও আমাদের।’
বৃদ্ধ ভয় পেলেন, ঘাবড়ে গেলেন, তবু চেষ্টা করছেন সাহস বজায় রাখতে। হাজার হোক, কোস্টগার্ড বাহিনী এরা। বৃদ্ধ আবারও বললেন, ‘স্যার, প্যাটের চেয়ে আইন বড় না। খিদের সামনে স্যার দুনিয়ার কোনো আইন টেকে না। আইন জীবনের জন্যি, মরনের জন্যি নয়।’
অফিসার এবার যেন হাঁক দিল বাঘের মতো, বলল, ‘অ্যাই বুড়ো! আমাকে জ্ঞান দিতে আসিস না, বুঝলি! এখন বল, এই চরে আজ পর্যন্ত কতজন শিশু জেলে এসেছে।’
‘স্যার, যে ছেলে গভীর সাগরে যাইয়ে বেহেন্দী জাল ফেলাতি পারে, জাল টাইনে তুলতি পারে, সাগরের বড় বড় ঢেউরে যে ভয় পায় না একটুও; সে কি শিশু হোতি পারে? ছয়জনের সংসারের বোঝা ঘাড়ে লইয়ে এই জলধর চরে আইছে—সেই জলধর কি শিশু? আপনারা তো স্যার গহিন সাগরে টহল দিয়ে বেড়ান। আপনাগের যেমন ভয় করে না, তেমনি জলধরও ভয় পায় না।’
এবার চার কদম এগিয়ে গিয়ে অফিসার চেপে ধরল জমিরউদ্দীন বুড়োর ঘাড়। বুড়ো বললেন, ‘আইন এহন আমার ঘাড় চাইপে ধরিছে, কিন্তু আইন আমার প্যাটে ভাত দিতে পারে না। আইনের হাত এহন জলধরের ঘাড়েও, কিন্তু আইন তার ছয়জনের সংসার চালাতি পারে না। গলা ছাড়েন স্যার। কী করতি চান তাই বলেন!’
ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে অফিসার বলল, ‘শিশু জেলেদের এনে জড়ো করো এখানে, আমরা বাগেরহাট থানায় নিয়ে যাব।’
কথা শুনে বহু শিশু ঝেড়ে দৌড় দিল। কোস্টগার্ডের কজন সদস্য ধাওয়া করে ধরল মোট সাতজনকে। জলধর দাঁড়িয়ে ছিল নির্ভীক। মোট আটজনকে নিয়ে বাহিনী যখন যাচ্ছে তাদের ট্রলারের দিকে, তখন পেছনে পেছনে চললেন অনেক সর্দার—সবাই কাকুতি-মিনতি করে চলেছেন।
ট্রলার ছাড়ার আগে আবার সেই বৃদ্ধ, ভজহরি জলদাস জোড়হাতে বললেন, ‘এইগে সগলের সংসার অচল হইয়ে যাবে, না খাইয়ে মরবে এইগে পরিবার-পরিজনেরা।’
সেই অফিসার বলল, ‘তাহলে কী করতে চাও তোমরা?’
‘এইগে ছাইড়ে দেন স্যার। এইগে আমরা বাড়ি পাঠাইয়ে দেব।’
‘তা হবে না। আড়তদারদের কাছে খবর পাঠা। আমরা আজ রাতেও জঙ্গলের ভেতরের খালে টহল দেব। এদিকে জলদস্যু-বনদস্যুদের উ্ততপা বেড়েছে। এদের পরশু কিংবা তার পরের দিন সকালে কিন্তু চালান করে দেব বাগেরহাটে। এদের দুবলারচরে আনার অপরাধে শিশু অধিকার আইনে র্যাব-পুলিশ এসে সর্দারদেরও পাকড়াও করবে। বুঝবি তখন ঠ্যালা!’
‘আড়তদাররা এখন করবে কী স্যার?’
‘২ লাখ টাকা করে মোট ১৬ লাখ টাকা এনে আগামীকাল বিকেলের মধ্যে আমাদের হাতে দিলে ছেড়ে দেব এদের।’
বলেই ট্রলারকে চলার হুকুম দিল অফিসার। ট্রলার দূরে—সাগর ছেড়ে সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে পড়ল বড় একটি খাল ধরে।
দুবলারচরে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। তাই সবাই মিলে তখনই দুজন জেলেকে ট্রলারে পাঠিয়ে দিল পিরোজপুরের পাড়েরহাট বন্দরে—ওখানেই মাছের আড়ত, বহরদারদের গদিঘর।
রাত নামল সুন্দরবনে। কোস্টগার্ডরা পোশাক খুলে ফেলল। পরল লুঙ্গি-গেঞ্জি। ৮ বালকই বুঝে ফেলল, এরা বনদস্যু-জলদস্যু। জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে এরা। সাগরে এখন কোস্টগার্ড বাহিনীর কড়া প্রহরা, র্যাবের চিরুনি অভিযান, ধরা পড়েছে এবং আত্মসমর্পণ করেছে বহু জলদস্যু-বনদস্যু। র্যাব আর কোস্টগার্ডের ভয়ে যখন সবকিছু বন্ধ হওয়ার দশা, তখন এরা বেছে নিয়েছে ভিন্ন পথ। কোস্টগার্ডের পোশাক পরে এই আটজনকে তুলে এনে জিম্মি করেছে সুকৌশলে। জলধর জলদাস দিনের বেলায় দেখে ফেলেছে ২০ ফুট উঁচুতে বানানো গাছঘর। চারটি সুন্দরীগাছকে খুঁটি করে, গরানগাছ আড়াআড়ি বেঁধে, তার ওপরে টুকরো গরানের ডাল বিছিয়ে মাচান বানানো হয়েছে। তারপর চালা দেওয়া হয়েছে গোলপাতা দিয়ে। মাচান ঘরে ওঠার জন্য টুকরো টুকরো কাঠ বেঁধে বেঁধে খাপ বা সিঁড়ির মতো বানানো হয়েছে। এটা দস্যুদের অস্থায়ী ডেরা।
আট বালককেই আটটি ভিন্ন ভিন্ন গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে—পায়ে মোটা রশি, হাতও পেছনে কষে বাঁধা। সারা দিনে এদের খেতে দেওয়া হয়েছে একথালা করে ভাত ও ডাল। ভয়ে সবাই পাথর হয়ে আছে। ওরে বাব্বা! কত বন্দুক! চায়নিজ রাইফেল!
জলধর কিন্তু চিনে ফেলেছে সমুদ্র ও সুন্দরবনের মহাত্রাস টাইগার বাহিনীর প্রধান টাইগারকে। তার মাথার দাম দশ লাখ টাকা ঘোষণা করেছে র্যাব-পুলিশ-কোস্টগার্ড বাহিনী। সেই টাইগার বাহিনীর কবলে পড়েছে জলধরেরা।
জলধর কখনো দেখেনি টাইগারকে—আজকেই প্রথম। তবে তার বর্ণনা শুনেছে দুবলারচরের বহু জেলে ও সুন্দরবনের বহু বনজীবীর মুখে।
সেই টাইগার এখন টানটান হয়ে বাঘের চামড়ার বিছানায় ঘুমাচ্ছে—কেওড়াগাছের ছায়ায়। সম্রাট আকবরি গোঁফ। সম্রাট বাবরের মতো ঝাঁকড়া-কোঁকড়া বাবরি চুল মাথায়। লম্বায় ছয় ফুটের বেশি। আহা রে শান্তির ঘুম! জঙ্গলের হরিণ মেরে হরিণের কাবাব খেয়েছে দস্যুরা মজা করে। দলে মোট ১৭ জন। অথচ জলধরদের খেতে দিয়েছে শুধু ডাল। টাইগারের একটি কানের অর্ধেকটা নেই—প্রতিদ্বন্দ্বী জলদস্যু বাদল বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের ফল। ডান চিবুকে কাটা দাগ। দুই বাহুতে গুলির ক্ষতচিহ্ন। সুন্দরবনের বাঘের মতো চাহনি তার—যার দিকে তাকায়, পিলে চমকে যায় তার।
ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল সুন্দরবনে। চার্জার লাইট জ্বলে উঠল—মাত্র একটি। শুরু হলো রাতের খাবারের আয়োজন। জলধর জলদাসের পেটে খিদে নেই। সারা দিন সে দস্যুদের কথাবার্তা থেকে টুকটাক যা সংগ্রহ করেছে, তার ভয়ানক পরিণতি চিন্তা করে প্রবল ঝড় বইছে তার বুকের ভেতরে। আজ রাতটা হতে পারে দুঃস্বপ্নের রাত। মৃত্যুর রাত। দস্যুরা আতঙ্কিত বাদল বাহিনীর আক্রমণের ভয়ে—সেও সদলবলে কাছাকাছি কোথাও আছে। দুজন দস্যু বাইরে গিয়েছিল—ঘণ্টা চারেক পরে ফিরে এসে টাইগারকে সংবাদ দিয়েছে ভয়াবহ। যেভাবেই হোক, বাদল বাহিনী খবর জেনে গেছে এই অপহূত আট বালকের। আজ রাতেই এখানে আক্রমণ করে ছিনিয়ে নিতে চায় এই আটজনকে, জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করবে। বাদল প্রধান ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড নাকি বাগেরহাটের পীর খানজাহান আলীর মাজারের কুমিরের জন্য মানত করেছে দুই জোড়া খাসি—যদি সফল হয়, যদি মেরে ফেলতে পারে টাইগার ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড সেকেন্দার ঢালীকে।
মাঝরাতে ধুন্ধুমার গোলাগুলি শুরু হলো। হুলুস্থুল লেগে গেল টাইগার বাহিনীতে। দ্রুত অস্ত্রসজ্জিত হলো তারা। শুরু করল পাল্টা গোলাগুলি। সামনে ফরোয়ার্ড করার আগে দুজন দস্যু আট বালকের হাত-পা কষে বেঁধে মাটিতে চিত করে ফেলে মুখে সেঁটে দিল নাকে-মুখে পরা মাস্কের মতো থাই টেপ, যাতে পালাতে না পারে শিকার।
জলধর জলদাসের মনে পড়ল মা ও ঠাক্মার কথা। তার এক জেঠু পড়েছিলেন বনদস্যুদের কবলে—এই সুন্দরবনে। তাঁর মুখেও লাগানো হয়েছিল থাই টেপ। জেঠু কৌশলে মুখের টেপ খুলতে পেরেছিলেন, তারপর কৌশলে দাঁতে দড়ি কেটে মুক্ত হয়েছিলেন। দাঁত-মুখ তখন তাঁর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। এক সন্ন্যাসীর শিষ্য হয়ে যোগব্যায়াম শিখেছিলেন তিনি। সেই যোগবলেই মুক্ত হয়েছিলেন। কৌশলটা জলধরও জানে।
টাইগার বাহিনী গুলি করতে বেশ দূরে সরে গেছে। নাক দিয়ে অনেক বাতাস টেনে বুক ভরে নিল জলধর, তারপরে আচমকা দমভরা বাতাস বের করতে চাইল মুখ দিয়ে—পরপর পাঁচবার চেষ্টার পরে সফল হলো সে, খুলে গেল মুখের থাই স্কচটেপ। দাঁতে দড়ি কেটে মুক্ত হলো নিজে। তার মাথায় এখন চিন্তা-দুশ্চিন্তা ও পরিকল্পনার জট। সে লাফ দিয়ে পড়ল খালের জলে। এখন সাঁতরে বা ডুব দিয়ে যাওয়ার পথে বাঘ নিছক ডাঙায় বসে হাত বাড়িয়ে নেংটি ইঁদুরের মতো তুলে নিতে পারে, কুমিরে চেপে ধরতে পারে দাঁতে, অজগরও শরীরের পাঁকে ফেলে পিষে হাড়গোড়-মাংসের তাল বানিয়ে ফেলতে পারে। না, ঝুঁকিটা নিতেই হবে। না হলে আটজনেরই জীবন যাবে জলদস্যুদের হাতে। আড়তদারেরা কিছুতেই ষোলো লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে আসবে না। তিন লাখ জেলের ভেতর থেকে আটজন তো কিছুই না আড়তদারদের কাছে।
খাল ধরে ডুব দিয়ে দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে সাগরের দেখা। সাগরে এখন পূর্ণ জোয়ার, প্রবল-প্রচণ্ড ঢেউ আর গর্জন—সাগর সাঁতরে পৌঁছানো সম্ভব নয় দুবলারচরে। লোনাজলে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে পায়ের চামড়া-মাংস খেয়ে ফেলবে লবণে। এদিকে পিপাসায় বুকের ভেতরটা দুবলার বালুচর হয়ে গেছে। কিন্তু জিবপোড়া লোনাজল তো পান করা যাবে না। জলধরের শরীরে জমেছে লবণ। মাথার চুলগুলো শজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে গেছে। পাশের একটি সুন্দরীগাছের মাথায় উঠে গেল সে। পরনের লুঙ্গি আর গায়ের হলুদ জামাটা খুলে সুন্দরীর ডাল ভেঙে লুঙ্গি-জামা বেঁধে ফেলল সে। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবৎ সে কেবল বাঘের গর্জন শুনল চারপাশে—শুনল হরিণের ‘টাই টাই’ সতর্কসংকেত ও বানরদের ঘুম জড়ানো ‘খক্ খক্’ ডাক, কোনো ট্রলারের শব্দ শুনল না, দেখল না কোনো সার্চলাইটও। না, ডান পাড় ঘেঁষে সার্চলাইট ফেলে যে যান্ত্রিক জলযানটা আসছে সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষে, সেটা যে কোস্টগার্ডের দুখানা টহল বোট, সেটা সে বুঝে ফেলল সার্চলাইটের আলোর রং দেখে এবং ভিন্ন রকম শব্দ শুনে। সে হাতের পতাকা তুলে পাগলের মতো নাড়তে শুরু করল এদিক-ওদিক। নিয়ম অনুযায়ী টহল বোটের সার্চলাইটের আলো ঘোরে ডানে-বাঁয়ে, সুন্দরবনের কিনারে কিনারে।
নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সার্চলাইট পড়ল সুন্দরীগাছের মাথায়, স্থির হলো আলো, একটু অপেক্ষা, তারপর দুখানা বোটই রওনা হয়ে এল এদিকে। আনন্দে চিৎকার দিয়ে নিচে নেমে এল জলধর জলদাস। পতাকা থেকে খুলে তাড়াতাড়ি ভেজা লুঙ্গি-জামা পরে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দুই হাত নাড়ছে। চোখ ধেঁধে যাচ্ছে তার। বুকের ভেতরে জীবনের সার্চলাইট জ্বলছে আরও জোরালোভাবে।