গুড্ডুবুড়া খায় না, দায় না। গুড্ডুবুড়ার শরীরটা তাই শুকনো পাটকাঠি। সেই পাটকাঠির ওপরে বসানো গোল মাথাটা। দেখতে লাগে একটা চাবির মতো। একটা লোহার দণ্ড, ওপরে একটা গোল। কিংবা বাচ্চারা মানুষের ছবি আঁকলে যে রকম আকার দেয়, একটা খাড়া রেখা, তার ওপরে একটা গোল্লা, গুড্ডুবুড়া দেখতে সেই রকমই। তবে যেহেতু সে শার্ট পরে, প্যান্ট পরে, তাকে দেখায় কাকতাড়ুয়ার মতো। মানে একটা বাঁশের কঞ্চি খাড়া করে পোঁতা, তার বুক বরাবর আরেকটা কঞ্চি আড়াআড়ি বাঁধা, তার ওপরে একটা হাঁড়ি। আর ওই কঞ্চির গায়ে জামাকাপড় পরানো।
গুড্ডুবুড়া কিছুই খেতে চায় না।
মা বলেন, বাবা, একটু ভাত খাও।
মা, আমার খিদে নেই মা। আমি কিছুই খাব না।
মা বলেন, বাবা, সকালবেলা স্কুলে যাবি, একটু নাশতা খেয়ে যা।
গুড্ডুবুড়া বলে, মা, আমার নাশতা খেতে ইচ্ছা করছে না।
মা তাকে টিফিন দিয়ে দেন। ক্লাস থ্রিতে পড়ে গুড্ডুবুড়া। ছোটবেলায় তবু কিছুটা খাওয়াদাওয়া করেছে। গত দুই বছর খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে বললেই চলে। ক্লাস টু থেকে থ্রিতে ওঠার সময় রেজাল্ট ছিল ভয়াবহ।
থ্রি থেকে সে ফোরে উঠতে পারবে, কেউ তা আশা করে না। কারণ, তার বোকামো। এই রকম বোকা ছেলে এই পৃথিবীতে থাকতে পারে!
তাকে যখন কেউ জিগ্যেস করে, ও গুড্ডুবুড়া, তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন?
সে বলে, ওমা, আমি বুঝি সারাক্ষণ ভেজা থাকব?
সেদিন ও শুয়েছিল বিছানায়। মাকে সে বলল, মা, একটু ফ্যানটা অন করো না। গরম লাগছে।
মা বললেন, দাঁড়াও একটুখানি। হাতে আটা। ধুয়ে আসি।
মা এলেন খানিক পরে। দেখলেন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বিছানার ওপরে। মশারির নিচে।
মা বললেন, গুড্ডুবুড়া, তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন?
গুড্ডুবুড়া বলল, তুমি না বললে, দাঁড়াও একটুখানি। তাই দাঁড়িয়ে আছি।
ওরে, এই দাঁড়ানো মানে কি সেই দাঁড়ানো? এই দাঁড়ানো মানে একটু সবুর করো। একটু ওয়েট করো। একটু অপেক্ষা করো।
গুড্ডুবুড়াদের ক্লাসে স্যার বললেন, অ্যাই, তোমরা একটা রচনা লিখবে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে। রচনার বিষয়: আমরা তোমাদের ভুলব না। কাগজের এক পৃষ্ঠায় লিখবে।
গুড্ডুবুড়া ইয়া বড় একটা কাগজ নিয়ে বসল রচনা লিখতে।
মা বললেন, গুড্ডুবুড়া কী করো?
মা, রচনা লিখি, আমরা তোমাদের ভুলব না বিষয়ে রচনা।
মা বললেন, খুব ভালো। কিন্তু এত বড় কাগজ নিয়ে বসেছ কেন?
কারণ স্যার বলেছেন, কাগজের এক পৃষ্ঠায় লিখতে।
মা বললেন, ওরে গুড্ডু। কাগজের এক পৃষ্ঠায় মানে হলো... একটা কাগজের দুটো পিঠ থাকে। ওই পিঠ আর ওই পিঠ। স্যার একটা পিঠে লিখতে বলেছেন। অপর পৃষ্ঠায় লিখতে নিষেধ করেছেন।
গুড্ডুবুড়া মায়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মা কী বলছেন, সে কিছুই বুঝছে না।
ক্লাসে স্যার জিগ্যেস করলেন, গুড্ডুবুড়া, তুমি কি কক্সবাজার গিয়েছ কখনো?
গুড্ডুবুড়া একবার মগবাজার গিয়েছিল। সে বলল, হ্যাঁ গিয়েছি।
ওখানে গিয়ে কি সমুদ্র দেখেছ?
সমুদ্র, না তো স্যার। গুড্ডুবুড়া মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল।
কক্সবাজারে গিয়েছ, কিন্তু সমুদ্র দেখোনি? কেন?
গুড্ডুবুড়া বলল, রোববারে গিয়েছিলাম তো স্যার। রোববারে সমুদ্র বন্ধ ছিল।
রোববারে সমুদ্র বন্ধ থাকে?
জি স্যার। ওরা সোমবারে সমুদ্র খোলে। আমরা তো স্যার সোমবার পর্যন্ত থাকিনি।
ক্লাসের সবাই হাসতে লাগল।
সবাই কেন হাসছে গুড্ডুবুড়া কিছুই বুঝছে না। কক্সবাজার নিশ্চয়ই একটা বাজার। সেখানে সমুদ্র বলে একটা দোকান-টোকান কিছু আছে। সেটা রোববারে বন্ধ থাকবে, এটাই তো নিয়ম। গুলশান এলাকায় তো রোববারেই মার্কেট বন্ধ থাকে।
গুড্ডুবুড়ার খুব মন খারাপ। সে বাসায় এসে মন খারাপ করেই রইল।
মা বললেন, গুড্ডুবুড়া, আজকে স্কুলে কী কী হলো?
গুড্ডুবুড়া বলল, স্কুলটা পচা মা। আমার বন্ধুরা পচা। টিচার পচা।
কেন রে?
মা, আমি বললাম, রোববারে সমুদ্র বন্ধ থাকে, তাই আমি সমুদ্র দেখতে পাইনি, শুনে সবার কী হাসি। মা, আমি আর স্কুলে যাবই না।
শুনে মা খুব মন খারাপ করলেন। বললেন, আচ্ছা তোকে আগে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাব।
সন্ধ্যার পর বাবা এলেন অফিস থেকে।
আসার সময় তিনি কিনে এনেছেন কতগুলো চিকেন শাশলিক। সিপির দোকান থেকে।
গুড্ডুবুড়া এমনিতেই কোনো কিছু খেতে চায় না। তার কী মনে হলো, সে প্যাকেট খুলে চিকেন শাশলিকে কামড় দিল। ভেতরে ছিল কাঠি। সেটা তো সে খেয়ালই করেনি। কাঠিসমেত কামড় দিয়ে জিব কেটে ফেলল। ঠোঁট কেটে ফেলল।
মা বললেন, গুড্ডুর বাবা, চলো আমরা কক্সবাজার বেড়াতে যাই।
কেন, হঠাৎ কক্সবাজার কেন?
কারণ, গুড্ডুবুড়া কোনো দিন সমুদ্র দেখেনি। সে ক্লাসে বলেছে, রোববার সমুদ্র বন্ধ থাকে। তাই সে সমুদ্র দেখতে পারেনি।
বাবা বললেন, তাহলে তো ওকে সমুদ্র দেখতে নিয়ে যেতেই হয়।
গুড্ডুবুড়ার উত্তেজনার সীমা নেই। তারা কক্সবাজারে যাচ্ছে। সমুদ্র দেখতে।
বাবা কক্সবাজারে আমরা কিসে যাব? রিকশায়?
বাবা বলেন, না।
তাহলে কিসে যাব? বেবিট্যাক্সিতে?
না?
তাহলে?
সোহাগেও যেতে পারি। তূর্ণা নিশীথা দিয়েও চট্টগ্রাম পর্যন্ত যেতে পারি।
আচ্ছা।
গুড্ডুবুড়া কী বুঝল সে-ই জানে।
একটু পরে সে তার বন্ধুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে নিজের উত্তেজনা ভাগ করে নিচ্ছে।
দোস্ত, জানিস, আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি।
তাই নাকি।
সমুদ্র দেখতে যাব। বৃহস্পতিবার রাতে যাব। শুক্রবার সকালে পৌঁছাব।
বন্ধুটি রসিকতা করে, ও তাহলে তো রোববারে যাচ্ছিস না। সমুদ্র খোলা থাকবে।
হুঁ।
তাহলে তো মজা করবি অনেক।
হুঁ। কক্সবাজারে অনেক মোরগ পাওয়া যায়। আমি মোরগ কিনে আনব।
কক্সবাজারে মোরগ পাওয়া যায়?
কেন তুই কবিতা পড়িস নাই। ককস ক্রো ইন দ্য মর্ন। সকালে অনেক মোরগ ডাকে। সেই জন্যই তো জায়গাটার নাম কক’স বাজার।
আচ্ছা যাচ্ছিস কিসে?
আমরা সোহাগ ভাইয়ার সঙ্গেও যেতে পারি। আবার তূর্ণা নিশীথা আপার সঙ্গেও যেতে পারি।
মানে কী?
বাবা তো তা-ই বলল। সোহাগেও যেতে পারি আবার তূর্ণা নিশীথাতেও যেতে পারি।
সোহাগ কে?
আমার মামাতো ভাই।
তূর্ণা নিশীথা কে?
তূর্ণা তো আমার খালাতো বোন। নিশীথা আপাকে চিনি না।
গুড্ডুর বন্ধু আদনান বড় পাকা। সে তার বন্ধুদের ফোন করে বলে দিল, গুড্ডুবুড়া মানুষের পিঠে চড়ে কক্সবাজার যাচ্ছে।
রাতের বেলা তাদের বাস ছাড়বে মালিবাগ থেকে। এসি বাস। বাসের নাম সোহাগ পরিবহন। এই বাস তাদের সরাসরি নিয়ে যাবে কক্সবাজারে।
প্রথমে বাবা একটা সিএনজিচালিত থ্রি হুইলার ডেকে আনলেন। সেইটাতে তারা চড়ল। তিনজন যাত্রী। মা, বাবা আর গুড্ডুবুড়া।
বাবা বললেন, চলেন মালিবাগ। সোহাগের কাউন্টারে।
গুড্ডুবুড়া বলল, বাবা, সোহাগ ভাই মালিবাগে থাকেন?
বাবা বললেন, সোহাগ ভাই কে?
কেন! ছোট মামার ছেলে? গুড্ডুবুড়া বলল।
ছোট মামার ছেলের কথা আসছে কোথা থেকে?
তুমি না বললে, সোহাগে যাবে।
ও গুড্ডুবুড়া। সোহাগ একটা বাসের নাম।
মালিবাগে সেই বাস থাকে?
মালিবাগ থেকে সেই বাস ছাড়ে।
সোহাগের কাউন্টারে গেল তারা। গুড্ডুবুড়া সাইনবোর্ড পড়ল। সোহাগ পরিবহন।
সিএনজির তিন চাকা ট্যাক্সি ছেড়ে তারা সোহাগ পরিবহনের ওয়েটিং রুমে বসল।
গুড্ডুবুড়া বলল, বাবা, এইটাই কি সোহাগের বাস?
বাবা বললেন, তুমি বাস চেনো না?
চিনি বাবা।
তাহলে বলছ কেন?
তাহলে আমরা এখানে বসে আছি কেন?
বাস এখানে থাকে না। এখানে আসে। তখন সবাই সেটায় চড়ে।
আচ্ছা। বুঝেছি।
খানিক পরে তাদের বাস এসে গেল। বাস কাউন্টারের লোকেরা বলতে লাগল, কক্সবাজারের যাত্রীরা বাসে ওঠেন।
গুড্ডুবুড়া আর মা পাশাপাশি সিটে বসলেন। বাবা বসলেন আলাদা সিটে।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস।
একটু পরেই বাস ছেড়ে দিল।
গুড্ডুবুড়া জানালা দিয়ে রাতের ঢাকা দেখতে লাগল।
রাস্তায় কত আলো। আর কত ভিড়। রাত বাজে সাড়ে দশ। তবু রাস্তার ভিড় কমে না।
আস্তে আস্তে বাস ঢাকার বাইরে চলে গেল। জোরে জোরে ছুটছে। গুড্ডুবুড়ার মনে হচ্ছে, কাছের গাছগুলো সব দৌড়ে পেছনে যাচ্ছে। আবার দূরের আলোগুলো যেন সামনে যাচ্ছে।
একটু পরেই সে পড়ল ঘুমিয়ে।
ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে। বাবা গুড্ডু, ওঠো।
গুড্ডু চোখ মেলল। বাইরে ভোর হচ্ছে। একটু একটু করে আলো ফুটছে। বাস দাঁড়িয়ে আছে।
মা নামলেন। বাবা নামলেন।
একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন তাঁরা।
গুড্ডুবুড়া বলল, বাবা, এটা কি কক্সবাজার?
বাবা বললেন, না। আমরা এখনো পৌঁছাইনি। এখানে রেস্টুরেন্টে বাথরুম সেরে নাও। নাশতা করে নাও। কক্সবাজার পৌঁছাতে পৌঁছাতে দশটা-এগারোটা বেজে যাবে।
বাবা বললেন, একটা মুরগি দাও, একটা গরু। আর পরোটা আর সবজি।
গুড্ডু বলল, বাবা, একটা মুরগি নাহয় সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যাবে। একটা গরু কী করবে?
বাবা বললেন, গরু মানে হলো গরুর মাংস।
গুড্ডু বলল, গোটা গরুর মাংস তুমি কী করবে?
বাবা বললেন, গোটা গরু না বাবা। এক প্লেট গরুর মাংস।
গুড্ডু তো কিছুই খেতে চায় না। নাশতা সে কিছুই মুখে তুলল না।
আবারও বাসে উঠে তারা রওনা হলো।
কক্সবাজারের শহরের ভেতরে বাসস্ট্যান্ড। তবে গুড্ডুবুড়ার বাবা বলে রেখেছিল, হোটেলের কাছে যেন নামিয়ে দেওয়া হয়।
তাদের রাস্তার ওপরে হোটেলের কাছেই নামিয়ে দেওয়া হলো। তারা ব্যাটারিচালিত বেবিট্যাক্সিতে উঠে হোটেলের দিকে চলতে শুরু করল।
বাবা, এটা কি কক্সবাজার?
হ্যাঁ।
রাস্তার ধারের একটা নালা দেখিয়ে গুড্ডু বলল, বাবা, এটা কি সমুদ্র?
না। এটা একটা ডোবা।
তারা একটা সুন্দর হোটেলে উঠল। তিনতলায় তাদের রুম।
তারা প্রথমে উঠল একটা লিফটে।
লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
গুড্ডুবুড়া বলল, মা, এটা কি আমাদের রুম?
মা বললেন, না, এইটা লিফট।
গুড্ডুবুড়া বলল, ও হ্যাঁ লিফট। লিফটে চড়ে আমরা কয় তলায় যাব?
মা বললেন, তিনতলায় যাব।
বাবা বললেন, আগে গোসল করে নিই। সারা রাত জার্নি করতে হয়েছে।
মা বললেন, সেই ভালো।
বাথরুমে বাথটাব ছিল। মা সেটায় পানি ভরে গুড্ডুকে ডাকলেন। গুড্ডু আয়, গোসল কর।
বাথটাব দেখে গুড্ডু বলল, মা, এটা কি সমুদ্র?
মা বললেন, তুই শুধু সমুদ্র সমুদ্র করছিস কেন?
আমার বন্ধু আরীব বলেছে, তারা সমুদ্রের পানিতে গোসল করেছে। তাই ভাবছি, এটা সমুদ্র কি না।
বাবা বললেন, এখন এখানেই গোসল সেরে নাও। দুুপুরে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে তারপর বিকেলে যাব সমুদ্র দেখতে। এখন যা রোদ।
মার্চ মাস। বেশ গরম বাইরে।
দুপুরের খাওয়া তাঁরা সেরে নিলেন হোটেলের রেস্টুরেন্টেই। গুড্ডুবুড়া তো কিছুই খেতে চায় না। কাজেই হোটেলের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে সে কোনো উৎসাহ দেখাল না। মা-বাবা রুপচাঁদা মাছ ভাজা খেলেন মজা করে।
খাওয়ার পরে রুমে ফিরে গিয়ে তাঁরা একটু বিশ্রাম করলেন। বিকেল সাড়ে চারটায় তাঁরা বের হলেন সমুদ্র দেখতে।
হোটেল থেকে বেরিয়ে আবার তাঁরা একটা ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান ভাড়া করলেন। গুড্ডুবুড়ার উৎসাহ ব্যাপক। সে এখন যাচ্ছে সমুদ্র দেখতে।
তারা নামল ট্যাক্সি থেকে। বাবা ভাড়া দিলেন। তারপর তারা হাঁটতে লাগল বালুর ওপর দিয়ে।
সুন্দর আবহাওয়া। রোদ এখনো আছে, তবে তাপটা অসহ্য লাগছে না। বাতাস বইছে।
গুড্ডুবুড়া সামনে তাকিয়ে আছে। হায় হায়, এত বড়! সমুদ্র এত বড়! যত দূর চোখ যায় পানি আর পানি। তারপর আকাশ। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে। আছড়ে পড়ছে তীরে। সাদা ফেনা। মাথার ওপরে উড়ছে গাংচিল।
আর কত মানুষ। অনেকেই বড় বড় ছাতার নিচে বসে আছে।
মা বললেন, এইটা হলো সমুদ্র।
বাবা বললেন, দেখেছ সমুদ্র? চলো, আমরা সমুদ্রের জলে পা ভেজাব।
গুড্ডুবুড়া বলল, চলো। আমি ভিজব। তাহলে লোকে আর আমাকে শুকনা বলবে না।
তাঁরা একটা ছাতা ভাড়া করলেন। ছাতার নিচে একটা বড় চেয়ারের মতো। কিংবা জলচকির মতো। সেটাতে মা বসলেন। বাবা তাঁর হাতের মোবাইল, ঘড়ি, মানিব্যাগ রাখলেন মায়ের কাছে। তাঁরা স্যান্ডেল খুলে রাখলেন। বাবা তাঁর প্যান্টের পা গুটিয়ে নিলেন। গুড্ডুবুড়া হাফপ্যান্ট পরাই ছিল। তাই তাকে আর প্যান্টের পা গোটাতে হলো না।
বাবার হাত ধরে গুড্ডুবুড়া চলল সমুদ্রের দিকে। ভেজা মাটিতে পা রাখল। এই জায়গাটা খুব আরাম। বালুমাটি হলেও সমান। হাঁটতে কষ্ট হয় না। পা দেবেও যায় না।
একটা ছোট ঢেউ চলে এল তাদের পায়ের কাছে। গুড্ডুবুড়া বাবাকে জড়িয়ে ধরল। ঢেউ তাদের পায়ের নিচ দিয়ে চলে গেল।
ভয়ের কিছু নেই। আনন্দই লাগছে।
তারা একটু একটু করে সমুদ্রের আরেকটু কাছে চলে গেল।
অনেক মানুষ সমুদ্রের অনেক গভীরে চলে গেছে। দুটো বাচ্চা ছেলেও বেশ গভীর জলে গিয়ে কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে আছে। গুড্ডুবুড়া যেখানে আছে, সেখানে তার গোড়ালি পর্যন্ত পানি।
একটা বড় ঢেউ আসছে। গুড্ডুবুড়া বাবাকে জড়িয়ে ধরল। বাবাও তাকে ধরে রাখলেন শক্ত হাতে। এবার ঢেউ এসে তার হাঁটু পর্যন্ত ভিজিয়ে দিল।
ঢেউটা চলে যেতেই গুড্ডুবুড়া হেসে উঠল খিলখিল করে।
সে বলল, বাবা, থ্যাংক ইউ। সমুদ্র আমার খুব ভালো লেগেছে। আমাকে সমুদ্রে নিয়ে আসার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
এরপর বাবা গিয়ে বসলেন ছাতার নিচে। মাকে বললেন, যাও তুমি যাও। সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে আসো।
মা উঠলেন। বললেন, গুড্ডু তুইও চল আমার সঙ্গে।
গুড্ডু বলল, চলো।
মা বললেন, এই বোতলে এখনো একটু পানি আছে। পানিটুকুন খেয়ে নে।
গুড্ডু পানি খেলো। বোতলটা খালি হয়ে গেল। সে বলল, মা, সমুদ্র থেকে যদি এক বোতল পানি নিই, সেটার কি দাম দিতে হবে?
মা বললেন, না, দিতে হবে না।
কেউ কি কিছু বলবে? বকা দেবে?
না। দেবে না।
গুড্ডুবুড়া বোতলটা সঙ্গে নিয়ে চলল মায়ের আঙুল ধরে। মাকে সে সমুদ্র দেখাবে।
মা, দেখো পায়ের নিচ থেকে বালু কী রকম সরে সরে যায়। পানিতে গোড়ালি ভেজাতে ভেজাতে বলল গুড্ডুবুড়া।
মা বললেন, তাই তো, তাই তো। পায়ের তলাটা কেমন শিরশির করে।
গুড্ডুবুড়া বলল, মা, আমার বোতলে পানি ভরে দাও।
মা গুড্ডুর হাত থেকে বোতলটা নিয়ে সমুদ্রের পানি ভরলেন।
তারা আবার এসে বসে রইল ছাতার নিচের গদি বিছানো বেঞ্চে।
আস্তে আস্তে সূর্য লাল হয়ে আসছে। আকাশে কত রঙের খেলা।
বাবা বললেন, আমরা সমুদ্রের জলে সূর্যের ডোবা দেখব। মোবাইল ফোনে ছবি তুলব।
গুড্ডুবুড়া বলল, বাবা, সূর্য কি রোজ সমুদ্রের পানিতেই ডুবে যায়?
বাবা বললেন, সমুদ্রের পাশে থাকলে তুমি সমুদ্রে সূর্য ডোবা দেখতে পাবে। আবার ধরো তুমি ঢাকায়, তখন সূর্য বিল্ডিংয়ের আড়ালে চলে যাবে।
গুড্ডুবুড়া বলল, বাবা, আমরা তো সব সময় বলি, সূর্য ডুবে যায়। পানি ছাড়া সূর্য ডুববে কোথায়? মনে হয়, সূর্য সমুদ্রের পানিতেই রোজ ডোবে। ঢাকা থেকে সেটা আমরা দেখতে পাই না।
বাবা আর তর্ক করলেন না। আরেকটু বড় হলে গুড্ডুবুড়া নিজেই বুঝবে। সূর্য আসলে ডোবে না। পৃথিবী রোজ একবার নিজের চারদিকে একবার ঘুরে আসে। সূর্য তার জায়গাতেই থাকে। ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবী একবার ঘোরে বলেই দিন হয়, রাত হয়।
সূর্য ডুবছে। পরিষ্কার আকাশে কী সুন্দর দেখা যাচ্ছে। ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা পানিতে অর্ধেক ডুবল। তারপর পুরোটাই ডুবে গেল।
বাবা মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে লাগলেন।
চলো, এখন উঠে পড়ি। একবারে খেয়েদেয়ে হোটেলে যাব। ঝাউবন নামের একটা রেস্টুরেন্টের কথা খুব শুনেছি। চলো, ঝাউবন রেস্টুরেন্টে খেতে যাই।
পরের দিন ভোরবেলা তারা ঘুম থেকে উঠল।
বাবা বললেন, গুড্ডু, রেডি হয়ে নাও। আমরা সূর্য ওঠার আগেই সমুদ্রের ধারে যাব। সমুদ্রে সূর্যোদয় দেখব।
গুড্ডু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিল।
তারপর তারা তিনজন চলল সমুদ্রের দিকে। তাদের হোটেল থেকে সমুদ্র বেশি দূরে নয়। তারা ঠিক করল হেঁটেই যাবে সমুদ্রের ধারে।
এবার সমুদ্রের ধারে গিয়ে গুড্ডু তো অবাক। পানি অনেক নিচে নেমে গেছে।
গুড্ডু বলল, বাবা, আমি এক বোতল পানি এনেছি। এই রকমভাবে অনেকেই কি সমুদ্র থেকে পানি নিয়ে গেছে?
কেন বাবা?
দেখো না সমুদ্রের পানি কত কমে গেছে। কাল সমুদ্র এই দোকানটার কত কাছে ছিল, আজকে সমুদ্র কত দূরে চলে গেছে। তার মানে সবাই নিশ্চয়ই রাতে বোতলে করে পানি নিয়ে গেছে।
বাবা বললেন, বাবা, বোতলে করে পানি নিয়ে কি আর সমুদ্রের পানি কমানো যায়? এটাকে বলে জোয়ার-ভাটা। সমুদ্রে একবার জোয়ার আসে। তখন পানি বাড়ে। তারপর ভাটা আসে। তখন পানি কমে। আবার জোয়ার আসে। তখন পানি বাড়ে। তারপর আবার ভাটা আসে, তখন পানি কমে।
বাবা জোয়ার-ভাটা কেন হয়? গুড্ডু বলল।
বাবা বললেন, চাঁদের টানে হয় বাবা।
চাঁদ কি একবার টান দেয় আরেকবার ঢিলা দেয়?
কঠিন প্রশ্ন। বাবা তো এই প্রশ্নের উত্তর জানেন না। তিনি বললেন, বাবা, আমি নিজে জেনে তারপর তোমাকে জানাব।
বাবা তাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন রাতে। তার মোবাইল ফোনে তিনি ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখালেন। কেন জোয়ার-ভাটা হয়। সেটা ব্যাখ্যা করা হলো ওই ভিডিওতে। চাঁদ সবকিছুকে টানে। সূর্য সবকিছুকে টানে। আবার পৃথিবীও আমাদের তার দিকে টানে। চাঁদ যখন পৃথিবীর কাছে আসে, তখন সমুদ্রের পানিকে টানে। সমুদ্রের পানি ফুলে ওঠে। সূর্যও টানে। যখন সূর্য আর চাঁদ পৃথিবী এক সমকোণ তৈরি করে, তখন চাঁদের টান আর সূর্যের টান মিলে ছোট জোয়ার হয়।
কঠিন জিনিস। গুড্ডুবুড়া কিছু বুঝল। কিছু বুঝল না। পৃথিবী গোল, এটা মানাই কঠিন। আবার পৃথিবী সারাক্ষণ ঘুরছে, আবার সূর্যের চারদিকে বছরে একবার ঘুরে আসে, সেটাও মানা কঠিন। পৃথিবী যদি ঘোরে, তাহলে মানুষ টের পায় না কেন। আকাশের মেঘ কেমন করে পৃথিবীর সঙ্গে যায়। কিংবা উড়োজাহাজ?
বেশি প্রশ্ন করাও যাবে না। প্রশ্ন করলেই বাবা বলবেন, গুড্ডুবুড়া তুমি খাও না। তাই তোমার বুদ্ধি কম। আজ থেকে বেশি করে খাবে। তাহলে তোমার বুদ্ধি বাড়বে।
সমুদ্রসৈকতে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ঝিনুকের মালা বিক্রি করছে।
বাবা বললেন, চলো, আমরা ঝিনুক কুড়াই।
গুড্ডুবুড়া বাবার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের কিনার ধরে হেঁটে হেঁটে ঝিনুক কুড়াতে লাগল।
সূর্য উঠল। আস্তে আস্তে সৈকতে মানুষের ভিড় বেড়ে যেতে লাগল।
বাবা বললেন, চলো, আমরা হোটেলে ফিরে যাই। হোটেলের ব্রেকফাস্ট খাই। এরপর যখন জোয়ার শুরু হবে, আমরা এসে সমুদ্রের পানিতে গোসল করব।
হোটেলের রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা ফ্রি। তারা ফিরে গেল হোটেলে। নিচের ডাইনিং রুম থেকে নাশতা করেই একবারে ওপরে উঠবে।
নাশতার আয়োজন বেশ ভালো। দুধ আছে, কর্নফ্লেক্স, পাউরুটি, মাখন, ডিম, পরোটা, সবজি, মাংস।
চা কফি।
ফলের রস।
গুড্ডুবুড়া কিছুই খাবে না।
বাবা বলেন, একটুখানি জুস নাও।
না বাবা। আমি জুস খাব না।
একটুখানি দুধ খাও। কর্নফ্লেক্স দিয়ে।
না বাবা। দুধে আমার বমি পায়।
কী খাবে তাহলে?
কিছু খাব না। তোমরা খাও।
এই ছেলেকে নিয়ে বাবা-মা কী করবেন? সে তো কিছুই খেতে চায় না। মা তাকে জোর করে একটুখানি পাউরুটি খাওয়ালেন।
সকাল দশটার দিকে তাঁরা আবার গেলেন সমুদ্রে। বাবা সমুদ্রে গোসল করার জন্য কাপড়চোপড় নিলেন। মা-ও নিলেন। গুড্ডুর জন্যও গোসলের পরে পরার কাপড়চোপড় নেওয়া হলো।
মা বসে রইলেন ছাতার নিজে, জিনিসপাতি পাহারা দিতে।
বাবা আর গুড্ডু নামল পানিতে।
বাবা তাকে ধরে কোলে নিয়ে বেশ খানিকটা গভীরে নিয়ে গেলেন। সেখানে তাকে নামিয়ে দিলেন পায়ের ওপরে। তার কোমর পর্যন্ত পানি। তার ভয়ভয় করছে। আবার আনন্দও হচ্ছে। একটা বড় ঢেউ এল।
বাবা তাড়াতাড়ি তাকে কোলে তুলে নিলেন। তবু ঢেউয়ের ঝাপটা লাগল তার গায়ে। চোখেমুখে পানি লাগল। গুড্ডুবুড়ার জিবে পানি লাগল।
গুড্ডুবুড়া স্বাদ নিয়ে বুঝল, সমুদ্রের পানি নোনা।
সে বলল, বাবা পানিতে তো লবণ বেশি। পানি নোনা।
বাবা বললেন, হ্যাঁ। সমুদ্রের পানি নোনা হয়।
গুড্ডুবুড়া বলল, কেন বাবা, সমুদ্রের পানি নোনা হয় কেন? জাহাজে করে লবণ নিয়ে যাচ্ছিল। সব জাহাজ ডুবে গেছে তাই?
বাবা বললেন, না না। তা নয়। তবে সমুদ্রের পানি নোনা কেন হয়, এটা তো আমার জানা নাই।
বাবা তুমি না বলো, সব নদী সমুদ্রে মেশে। নদীর পানি তো নোনা নয়। তাই না?
হ্যাঁ।
তাহলে কেন সমুদ্রের পানি নোনা হয়?
বাবা, এটাও আমি তোমাকে একটু পরে বলছি। ইন্টারনেট দেখে উত্তরটা জেনে নেব। তারপর বলব।
এবার মা পানিতে নামবেন।
বাবা বললেন, গুড্ডু, তুমি বসে বসে আমাদের জামাকাপড় পাহারা দাও। আমি তোমার মাকে পানিতে নামিয়ে আবার আসছি।
গুড্ডুবুড়া বলল, আচ্ছা।
বাবা আর মা সমুদ্রের পানিতে নামছেন। গুড্ডুবুড়া ওই ওদিকে তাকিয়ে আছে।
একটা ঘোড়ার পিঠে চড়েছে একটা বাচ্চা ছেলে। ভারি মজা।
ওই ওদিকে একদল ছেলেমেয়ে লাল রঙের একটা বল নিয়ে খেলছে।
বলটা তার কাছে চলে এসেছে।
সে উঠে বলে মারল এক লাথি।
ওইখানে একটা কাঁকড়া।
সে কাঁকড়াটা ধরবে নাকি।
যেই না ধরতে গেছে অমনি কাঁকড়া ধরল দৌড়।
গুড্ডুবুড়াও কাঁকড়ার পেছনে পেছনে দৌড়াতে শুরু করে দিল।
আজ শুক্রবার। সমুদ্রসৈকতে খুব ভিড়।
ভিড়ের ফাঁকে ফাঁকে কাঁকড়াটা দৌড়ায়। পেছনে পেছনে গুড্ডুও দৌড়ায়।
তারপর কাঁকড়া চলে গেল পানিতে।
ঘোড়াটা ওই ওদিকে।
তাহলে ওই দিকেই তো তাদের ছাতাটা ছিল।
সে ঘোড়ার দিকে যাচ্ছে। ঘোড়াও এগোচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দেখল, সে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেছে।
বাবা-মাকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
ওই ঘোড়াটার কাছেই ছিলেন বাবা-মা।
তাহলে আমাকেও ওই ঘোড়ার কাছেই যেতে হবে। গুড্ডুবুড়া ঘোড়ার দিকে হাঁটতে লাগল।
তারপর সে ছাতার নিচে গেল। কই, তার জিনিসপত্র তো দেখা যায় না। বাবা-মাকেও দেখা যায় না। হায় হায় এখন কী হবে। সে হারিয়ে গেছে। সে হারিয়ে গেছে।
সে কাঁদতে আরম্ভ করল।
তাকে মানুষজন জিগ্যেস করল, এই বাবু তুমি কাঁদো কেন?
আমি হারিয়ে গেছি।
তোমার বাবা-মা কই?
খুঁজে পাচ্ছি না।
তোমার নাম কী?
গুড্ডু।
তোমার বাবার নাম কী।
গুড্ডু বাবার নাম বলল।
তোমার মায়ের নাম কী।
গুড্ডু মায়ের নাম বলল।
তোমাদের বাড়ি কোথায়?
ঢাকা।
তোমরা এখানে কোথায় উঠেছ?
মানে কী?
তোমরা রাতে কোথায় ছিলে?
হোটেলে।
তোমাদের হোটেলের নাম কী।
জানি না।
ভারি মুশকিল। এই ছেলেকে এখন কে উদ্ধার করবে। কোথায়ই-বা নিয়ে যাবে।
ওদিকে বাবা-মা তো গুড্ডুকে দেখতে না পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেলেন। বাবা বললেন, গুড্ডুর মা, তুমি এখানে বসে থাকো। আমি একটু এই দিকটায় খুঁজে আসি।
মা কাঁদছেন। আর দোয়া পড়ছেন। হে আল্লাহ, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও।
বাবা খানিকক্ষণ পরে এসে বললেন, না পাওয়া গেল না। তুমি কোনো খোঁজ পেয়েছ?
মা বললেন, না।
বাবা বললেন, এবার আমি ওই দিকটায় যাব। তুমি এখান থেকে নড়বে না। ছেলে যদি ফিরে আসে...
বাবা আরেক দিকে গেলেন। এখানে ওখানে খুঁজলেন। ছেলেকে পেলেন না।
আবার এলেন। গুড্ডু এসেছিল?
না তো।
বাবা কাঁদতে লাগলেন, বললেন, হায় হায়, তখন যে বড় ঢেউটা এসেছিল, তাতেই কি ছেলে আমার ভেসে গেছে?
সেই কথা শুনে মা সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
বাবা কী করবেন। তিনি গুড্ডুর মায়ের মাথায় পানি ঢালতে লাগলেন।
খানিক পরে মায়ের জ্ঞান ফিরে এল।
চোখ মেলেই তিনি বললেন, গুড্ডু কই? আমার গুড্ডু কই?
গুড্ডুকে একটা দম্পতি নিয়ে গেছে সৈকতের পাশে। ওখানে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে গুড্ডুকে দিয়ে তাঁরা বললেন, এই ছেলে হারিয়ে গেছে। তার বাবা-মা কেউ এসেছে কি না আমরা জানি না। আপনারা কি বাচ্চাটাকে তার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন?
পুলিশ বলল, খবরদার, একজনের ছেলে রেখে আপনারা যেতে পারবেন না। আপনাদেরও আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে।
তাঁরা বললেন, বাবারে, মানুষের উপকার করতে এসে কী ঝামেলাতেই না পড়লাম। চলুন থানায়।
পুলিশের ভ্যান এল। গুড্ডুকে সেই ভ্যানে তোলা হলো। পুলিশের কাঁধে বড় বড় বন্দুক দেখে গুড্ডু গাড়িতেই পেশাব করে দিল।
একটু পরে সৈকতে ডিউটিরত পুলিশের কাছে গেল গুড্ডুর বাবা-মা।
তাঁরা বললেন, আমাদের ছেলে হারিয়ে গেছে। ছেলের নাম গুড্ডু।
পুলিশ বলল, কত বড় ছেলে।
এই বয়স আটের একটু বেশি।
খুব হালকা-পাতলা?
হ্যাঁ।
একটা ছেলে পাওয়া গেছে। তাকে নিয়ে আমাদের সহকর্মীরা থানায় গেছে। আচ্ছা আমি মোবাইলে ফোন করে দিচ্ছি। দেখেন ছেলে আপনার কি না। হ্যালো স্যার। একজন বাবা একজন মা এসেছেন। তাঁরা বলছেন তাঁদের ছেলে হারিয়ে গেছে।
ছেলের নাম কী?
গুড্ডু।
হ্যাঁ হ্যাঁ। এই ছেলের নামও গুড্ডু। ওদের থানায় আসতে বলেন।
বাবা বললেন, ছেলেকে একটু ফোনে দিন না। আমি একটু কথা বলি।
হ্যালো, বাবা বললেন।
গুড্ডুবুড়া ওদিক থেকে বলল, হ্যালো।
বাবা, তুমি গুড্ডুবুড়া।
জি বাবা। বাবা আমি হারিয়ে গেছি। পুলিশ আমাকে থানায় এনেছে। আমাকে নিয়ে যাও।
এই তোর মায়ের সঙ্গে কথা বল।
হ্যালো। মা ফোন কানে দিলেন।
মা। আমি হারিয়ে গেছি—গুড্ডু কাঁদছে।
মা বললেন, এই যে বাবা আমরা আসছি।
মা আর বাবা তাড়াতাড়ি একটা বেবিট্যাক্সি ভাড়া করে ছুটলেন থানার দিকে।
গুড্ডুবুড়া বাবা-মাকে পেয়ে বেজায় খুশি।
তাঁরা ওই দম্পতিকে অনেক ধন্যবাদও দিলেন।
দম্পতি বলল, আপনার ছেলেকে আপনাদের মোবাইল নম্বর কেন মুখস্থ করিয়ে রাখেন না?
গুড্ডুবুড়া বলল, আমি মোবাইল নম্বর মুখস্থ রাখতে পারি না।
কেন পারো না?
গুড্ডুবুড়া বলল, আমার ব্রেইন খুব খারাপ। কারণ, আমি খাই না।
তখন আন্টিটা বললেন, বাবা তোমার চোখ দুটো কত ব্রাইট। তুমি কেন খাও না? খেলে তো তোমার অনেক বুদ্ধি হবে।
পুলিশ অফিসার বললেন, তুমি আজ থেকে ঠিকভাবে খাবে। তুমি যদি ঠিকঠাক না খাও তাহলে তোমাকে ছাড়ব না। এই থানায় আটকে রাখব। ওই দেখো, ওইখানে বন্দীদের আটকে রাখা হয়। ওই তালার ভেতরে। তুমি কি ওখানে থাকতে চাও, নাকি বাবা-মায়ের সঙ্গে যেতে চাও?
বাবা-মায়ের সঙ্গে যেতে চাই।
তাহলে বলো, আজ থেকে তুমি ঠিকমতো খাবে।
জি খাব।
কী কী খাবে বলো।
ভাত খাব।
আর?
মাছ খাব।
আর?
ডিম খাব।
আর?
দুধ খাব।
আর?
মাংস খাব।
আর?
শাকসবজি খাব।
আর?
ফল খাব।
গুড। কথা যেন ঠিক থাকে।
কাগজে সাইন করে মা-বাবা গুড্ডুবুড়াকে নিয়ে এলেন হোটেলে।
গুড্ডুবুড়া বলল, বাবা-মা, চলো, আমরা খেতে যাই। আজ থেকে আমি বেশি বেশি করে খাব।
সেদিন থেকে গুড্ডুবুড়া ঠিকমতো খাওয়া শুরু করল।
সে ভাত খায়।
সে মাছ খায়।
সে ডিম খায়।
সে দুধ খায়।
সে ডাল খায়। সে শাকসবজি, ফলমূল খায়।
ঠিকমতো পানি খায়।
তার শরীরে বল হতে লাগল। ফলে এখন আর সে সারা দিন ঝিমোয় না। দৌড়ায়। খেলে। ছটফট করে।
আর বই পড়ে।
আস্তে আস্তে তার মাথায় বুদ্ধি হতে লাগল।
একদিন সে বাবাকে বলল, বাবা, বাবা, তোমার মনে আছে, কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকতে তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সমুদ্রের পানি কেন নোনা হয়?
হ্যাঁ, করেছিলে। আমার মনে আছে।
আমি সেই প্রশ্নের উত্তর বের করেছি। পৃথিবীর মাটি থেকে নদীনালা ঝরনার পানি বৃষ্টির পানি সমুদ্রে যায়। যাওয়ার সময় মাটিতে মিশে থাকা খনিজ পদার্থ সেই পানি নিয়ে যায় সমুদ্রে। কিন্তু সমুদ্রের পানি সূর্যের তাপে বাষ্প হয়ে আকাশে যায়। তখন আর সমুদ্রের খনিজ পদার্থ নিয়ে যেতে পারে না। তুমি ভাবো, প্রতিবার একটা হাঁড়িতে তুমি লবণ-পানি মেশাচ্ছ। আর হাঁড়িটা তুমি চুলায় জ্বাল দিচ্ছ। এক বছর ধরে। তাহলে তোমার ওই হাঁড়ির কী দশা হবে। শুধু লবণ আর লবণ মিশে থাকবে পানিতে। সমুদ্রেরও সেই দশা হয়েছে। পানি যখন আসে, তখন লবণ নিয়ে আসে। যখন যায়, তখন বাষ্প হয়ে যায়। ফলে লবণটা আর বের হতে পারে না। তাই সমুদ্রের পানি লোনা।
বাবা বললেন, বাহ্। এটা তুমি কীভাবে জানলে?
বই পড়ে বাবা।
সাংঘাতিক ঘটনা তো।
বাবা, আমি তো এখন ঠিকভাবে খাই। এখন তো আমি আর আগের মতো বোকা নই।
এক বছর পরের কথা। গুড্ডুবুড়া আর তার বাবা-মা আবারও যাচ্ছে কক্সবাজারে। এবার তাঁরা যাচ্ছেন ফেব্রুয়ারি মাসে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। গুড্ডুবুড়া মা-বাবার সঙ্গে এরই মধ্যে বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে ঘুরে এসেছে। অনেকগুলো বই কিনেছে গুড্ডুবুড়া। নানা ধরনের বই। গল্পের বই, ছড়ার বই, বিজ্ঞানের বই। আর কিনেছে কিশোর আলোর সবগুলো পুরোনো সংখ্যা। কিশোর আলোতে নাকি মেলা কিছু থাকে। এটা পড়লে নাকি বুদ্ধির দুয়ার খুলে যায়।
কক্সবাজারে যাওয়ার সময় গুড্ডুবুড়া কয়েকটা বই আর দুটো কিশোর আলোও তার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়। কক্সবাজারে রাত্রিবেলা কোনো কাজ থাকে না। বসে বসে সে বই পড়তে পারবে।
বাসায় ছোট খালা এলেন বিকেলে। বললেন, কী রে। তোরা নাকি কক্সবাজারে যাচ্ছিস?
জি খালা।
কিসে যাচ্ছিস?
আদরে।
আদরে মানে?
সোহাগে।
সোহাগে মানে?
সোহাগে মানে বুঝলে না! সোহাগ বাসে। বাসের নাম সোহাগ।
ও তাই বুঝি। তো গিয়ে তোরা উঠবি কোথায়?
হোটেলে।
কোন হোটেল?
মহাসাগর।
মানে?
হোটেলের নাম।
হোটেলের নাম মহাসাগর?
না। একটা হিন্ট দিলাম। তুমি বলো হোটেলের নাম কী হতে পারে?
পারলাম না।
মহাসাগরের ইংরেজি কী?
ওশান।
তাহলে আমাদের হোটেলের নামও ওশান।
গতবারও ওই হোটেলে ছিলি?
হ্যাঁ, ছিলাম।
ভালো?
হ্যাঁ। ভালো।
তারা কক্সবাজারে পৌঁছাল সকাল দশটায়।
গুড্ডু বলল, বাবা, চলো, বিচে যাই। একবারে কাপড়চোপড় নিয়ে যাই। সমুদ্রে গেলে পানিতে না নেমে পারা যাবে না।
বাবা বললেন, তা না হয় যাব, কিন্তু তুই আবার হারিয়ে যাবি না তো?
গুড্ডু বলল, বাবা, তোমার মোবাইল নম্বর আমার মুখস্থ। মায়ের মোবাইল নম্বরও আমার মুখস্থ। এমনকি আমি বুদ্ধি করে কক্সবাজার থানার নম্বরও নিয়ে নিয়েছি। যদি কোনো কাজে লাগে।
কক্সবাজারের ওশিন হোটেলে তারা উঠল ৩২৩ নম্বর রুমে। এই রুমটাও তেতলায়। তারা রুমে ঢুকে পেছনের ব্যালকনিতে ঢুকল। পাশের ব্যালকনিতে একটা বাচ্চা মেয়ে। গুড্ডুর সমানই হবে।
মেয়েটা বলল, হাই।
গুড্ডুও বলল, হাই।
মেয়েটা বলল, তোমরা বুঝি আজকেই এলে?
গুড্ডু বলল, আজকে মানে এখনই। তোমরা কবে এসেছ?
মেয়েটা বলল, আমরা এসেছি গতকাল।
গুড্ডু বলল, আমার নাম গুড্ডু। তোমার নাম কী?
মেয়েটা বলল, আমার নাম ফাইজা।
গুড্ডু বলল, আমি পড়ি ক্লাস ফোরে। তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
আমিও পড়ি ক্লাস ফোরে।
বাহ্। ভালো তো। ফাইজা, তোমরা কি এখন বিচে যাবে?
যাব, একটু পরে যাব।
আমরা এখনই যাব। তাহলে দেখা হবে।
গুড্ডুবুড়ারা সৈকতে চলে গেল।
সমুদ্র দেখেই গুড্ডুবুড়া খিলখিল করে হাসছে। কী সুন্দর এই সমুদ্র। শুধু তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছা করে। যতই তাকাও, মন ভরে না। একটুও একঘেয়ে লাগে না। তারা আগের মতোই একটা চেয়ার ভাড়া করল। ছাতা ভাড়া করল।
আর গুড্ডুবুড়া একটা হাফপ্যান্ট পরে নিয়ে ছুটতে লাগল সমুদ্রের জলের দিকে।
একবার পেছনে তাকিয়ে সে বলল, বাবা, ওই দেখো, সবুজ পতাকা। তার মানে এখন জোয়ার। জোয়ারের সময় পানিতে নামা নিরাপদ।
বাবা বললেন, সাবধান। বেশি গভীরে যেয়ো না। কক্সবাজারের সৈকতে অনেক চোরাবালি থাকে আজকাল। অনেকেরই পায়ের তলার বালু সরে যায়। তখন তারা পানিতে ডুবে যায়। আর উঠতে পারে না।
গুড্ডুবুড়া পানিতে নামল। প্রথমে গোড়ালি-পানি। তারপর হাঁটুপানি। এর চেয়ে গভীরে সে যাবে না। কারণ কোমরপানি পর্যন্ত সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে বটে, কিন্তু অনেক সময় অনেক বড় ঢেউ আসে। অনেক সময় পায়ের নিচের বালু সরে যায়। তখন সে আর উঠতে পারবে না। সে এরই মধ্যে সাঁতারও শিখে নিয়েছে। তাদের বাড়ির কাছে একটা জিম আছে। সেখানে সুইমিংপুল আছে। বাবার কাছে বায়না ধরে সে সাঁতার শিখতে গেছে সেই সুইমিংপুলে। এখন সে ব্যাঙের মতো ভেসে থাকতে পারে।
একটু পরে ফাইজারা চলে এল এই সৈকতে। দূর থেকে দেখেই গুড্ডুবুড়া চিনতে পারল ফাইজাকে।
গুড্ডুবুড়া বলল, ফাইজা, চলে এসো পানিতে।
ফাইজা তাকিয়ে দেখল, ওই যে গুড্ডু। সে বলল, না বাবা, আমি সাঁতার জানি না। আমি পানি ভয় পাই।
গুড্ডু বলল, পানি ভয় পাওয়া অনেকেরই বাতিক আছে। আচ্ছা তাহলে তুমি দাঁড়িয়ে থাকো ওখানে। আমি আসছি।
গুড্ডু চলে এল সৈকতে। ফাইজাদের কাছে।
ফাইজা বলল, আমি অনেক খেলনা এনেছি। বালু দিয়ে ঘরবাড়ি বানানোর জিনিস। এসো আমরা বালুতে খেলি। ঘর বানাই।
গুড্ডু বলল, তুমি কোন স্কুলে পড়ো, ফাইজা?
ফাইজা বলল, আমি পড়ি ভিকারুন্নিসা স্কুলে।
গুড্ডু বলল, ধানমন্ডি ব্রাঞ্চে? ঠিক কি না?
হ্যাঁ। কী করে বুঝলে?
তোমার হাতের ওই ব্যাগটা দেখে। ওটাতে যে দোকানের নাম লেখা, সেটা ধানমন্ডিতে। ওটাতে তেল, নুন, সাবান, শ্যাম্পু সব পাওয়া যায়। তার মানে তোমার মা ওখানে বাজার করেন। তার মানে হলো আশপাশেই তোমাদের বাসা। তার মানে হলো, তোমার বাসার কাছে স্কুল। কাজেই তোমার স্কুলটা ধানমন্ডি ব্রাঞ্চে।
বাহবা। তোমার এত বুদ্ধি।
তেমন না। কিছু কিছু।
তারা দুজনে খেলছে। বালু দিয়ে সুন্দর একটা বাড়ি বানিয়েছে ফাইজা।
গুড্ডু বালু দিয়ে একটা সাঁকো বানিয়েছে। নিচ দিয়ে নদী। গর্ত খুঁড়ে সৈকতে সে জলও বের করেছে। তার সাঁকোর নিচ দিয়ে জলও গড়াচ্ছে।
বিকেলবেলা তারা আবারও গেল সৈকতে। দুই পরিবার একসঙ্গেই গেল।
বিকেলটা খুবই সুন্দর। ফেব্রুয়ারি মাস। ঠান্ডা আবহাওয়া। তবে কক্সবাজারে সমুদ্রের ধারে ঠান্ডা কম।
ফাইজা বলল, আমি ওই গাড়িতে চড়ব।
সমুদ্রের বালুর ওপর দিয়ে চার চাকার কতগুলো গাড়ি চলছে। সেগুলোর চাকা খুব মোটা।
গুড্ডু বলল, আমিও চড়ব।
গুড্ডুর বাবা আর ফাইজার বাবা মিলে দরদাম করলেন ওই ব্যাটারিচালিত বিচ কারের লোকদের সঙ্গে। ৫০ টাকায় ১০ মিনিট। দুজনে দিতে হবে ১০০ টাকা।
ফাইজার বাবা বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। বাচ্চা দুটোকে ১০ মিনিট ঘুরিয়ে নিয়ে আসুন।
তারা দুজনে গিয়ে গাড়ির সিটে বসল। লাল রঙের গাড়ি। চারটা মোটা মোটা চাকা। খোলা গাড়ি। কোনো ছাদ নেই।
গুড্ডু বলল, বাবা, আমাদের একটা ছবি তোলো। ড্রাইভার আংকেলকেসহ তোলো। ড্রাইভার আংকেল। আসেন। আসেন। একটা ছবি তুলি।
গুড্ডুবুড়ার বাবা গুড্ডুবুড়া আর ফাইজার ছবি তুললেন তাঁর মোবাইল ফোনে। ফাইজার বাবাও তুললেন।
তারপর তাদের নিয়ে ওই গাড়ি স্টার্ট করল।
ছুটে যেতে লাগল পূর্ব দিকে।
গুড্ডুবুড়া হিহি করে হাসছে।
ফাইজা ভয় পেয়ে গুড্ডুবুড়ার হাত চেপে ধরছে।
দশ মিনিট সোজা গিয়ে গাড়িটা একটা জঙ্গলের আড়ালে চলে গেল।
সেখানে গিয়ে গাড়িটা থামল।
গুড্ডুবুড়া বলল, আংকেল কী হয়েছে?
চালক বললেন, ব্যাটারি ডাউন।
তিনি নামলেন।
গুড্ডুবুড়াদের দিকেই এগিয়ে এলেন। তার হাতে একটা রুমাল। সেই রুমালটা তিনি এগিয়ে ধরলেন দুজনের নাকের কাছে।
এরপর গুড্ডুবুড়া আর ফাইজা জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
গুড্ডুবুড়ার বাবা-মা আর ফাইজার বাবা-মা অপেক্ষা করছেন। ছেলেমেয়ে দুটো ফিরে আসবে। কিন্তু তারা আর ফিরছে না।
কী ব্যাপার। ওরা আর ফিরছে না কেন?
গুড্ডুবুড়ার বাবা এগিয়ে গেলেন। ওইখানে আরেকটা বিচ কার দেখা যাচ্ছে।
ফাইজার বাবাও সঙ্গী হলেন তাঁর। রোদ দ্রুত মরে আসছে। শীতকালের সন্ধ্যা। বড় তাড়াতাড়ি নামছে।
এগিয়ে গিয়ে ধরলেন ওই বিচ কারের চালককে।
বললেন, ভাই, আমাদের ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে লাল রঙের গাড়িটা যে ওই দিকে চলে গেল, আর যে আসছে না।
ড্রাইভার বলল, কোন গাড়িতে গেছে?
গুড্ডুবুড়ার বাবা তার মোবাইল ফোন থেকে ফোন বের করে বললেন, এই লোকের এই গাড়িতে।
ড্রাইভার বলল, সর্বনাশ। এই ব্যাটা গাড়ি পাইল কোত্থেইকা?
মানে কী?
এ তো লোক সুবিধার না।
বললেই হলো। তোমরা সবাই একই কোম্পানির না?
না। ওই হারামজাদা আমাগো কোম্পানির না।
মানে কী। এক বিচে কখনো দুই কোম্পানির গাড়ি থাকতে পারে না।
সেই জন্যই তো আমি টাস্কি খাইলাম। ওই হারামজাদা কোন ফাঁকে আইসা গাড়ি নামাইল। আর কোন ফাঁকে আপনাগো ছেলেমেয়েরা তুইলা চম্পট দিল।
চম্পট দিয়েছে নাকি?
বুঝতাছেন না? অহনও বেশি দূর যাইতে পারে নাই। তাড়াতাড়ি পুলিশে খবর দেন।
গুড্ডুবুড়ার বাবা আর ফাইজার বাবা কাঁদতে কাঁদতে ছুটতে লাগলেন থানার দিকে। গুড্ডুবুড়ার বাবা কক্সবাজার থানা ভালো করেই চেনেন। গতবারও তাঁকে থানায় যেতে হয়েছিল।
থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ওই চালকের ছবি দেখেই আঁতকে উঠলেন।
সর্বনাশ!
সর্বনাশ মানে।
এ তো শিশু পাচারকারী দলের সদস্য। এর নাম কালাম ওরফে শাহিন ওরফে মিলন ওরফে চেংগিস। ও বিচে আসতে পারল কীভাবে? তাও এই গাড়ি নিয়ে?
সেটা আমরা জানব কী করে? রেগেমেগে বললেন গুড্ডুর বাবা।
আচ্ছা, আমি দেখছি।
পুলিশ কর্তা ওয়্যারলেসে কথা বলতে লাগলেন। হ্যালো, হ্যালো, চেকপোস্ট, মোবাইল টিম, একটা বাচ্চা ছেলে একটা বাচ্চা মেয়ে বয়স আনুমানিক...
নয় বছর, বলল গুড্ডুর বাবা।
বয়স আনুমানিক নয় বছর, তাদের নিয়ে কালাম ওরফে শাহিন ওরফে মিলন ওরফে চেংগিস বিচ থেকে চম্পট দিয়েছে। সব গাড়ি, বাস, সিএনজি, বেবি, ট্রাক চেক করো। কোনো পিঁপড়াও যেন কক্সবাজারের বাইরে যেতে না পারে। মেরিন পুলিশ। হ্যালো হ্যালো। দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে কিডন্যাপড হয়েছে। কোনো নৌকা, স্পিডবোট, জাহাজ যেন এই এলাকা থেকে ছাড়তে না পারে। সব সার্চ করতে হবে।
একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে জেগে উঠল গুড্ডুবুড়া। আমি এখন কোথায়? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল সে।
কিছুক্ষণ সে কিছুই বুঝতে পারছিল না।
একটু পরে তার চোখ সয়ে গেল। সে বুঝতে পারল যে তার মুখ বাঁধা। আর হাতও বাঁধা পেছন থেকে। সে বসে আছে একটা কাঠের মেঝের ওপর।
তারপর সে এও বুঝল, তার ঘরে আরেকজন কেউ আছে। তার নাক দিয়ে ঘরঘর শব্দ হচ্ছে।
ক্ষীণ আলোয় সে বুঝল, তার পাশে আছে সেই মেয়েটা, যার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল হোটেলের ব্যালকনিতে। যার সঙ্গে সে উঠেছিল বিচ কারে।
ড্রাইভার লোকটা তার নাকে ক্লোরোফর্ম বা একটা কিছু ধরেছিল। তাতেই সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল নির্ঘাত। এখন পাজি লোকটা তাদের এইখানে এনে রেখেছে।
কেন এনেছে, তারা জানে না।
কতক্ষণ এইভাবে থাকতে হবে বোঝা মুশকিল।
একটু পরে দরজা খোলার শব্দ। ঘরের ভেতরে দুটো লোক এসেছে। তারা একটা কেরোসিনের বাতিও এনেছে সঙ্গে করে। লোক দুটোর মধ্যে কথা হচ্ছে:
এই দুটোকে মিয়ানমার দিয়া থাইল্যান্ড পাঠায় দিতে হইব।
দিমু নে।
যাও নিয়া যাও। যাওয়ার আগে আমার টাকা দিয়া যাও।
তোমার টাকা তো তুমি অ্যাডভান্স নিছ। সেইখান থাইকা কাইটা রাখো।
অ্যাডভান্স? মাত্র কুড়ি হাজার টাকা লইছি। এই দুইটার দাম কম কইরাও দুই লাখ আছে।
হাসাইলা মিয়া। এগো কিডনি বেচলেও বিশ হাজার টাকা হইব না। রক্ত বেচলে পামু দুই শ টাকা।
আচ্ছা আপনে আর বিশ হাজার দিয়েন।
দিমু নে।
তাইলে আজকা রাইতেই পার করেন। আমি ঝামেলা বেশিক্ষণ রাখতে পারুম না।
মাত্র বিশ হাজার টাকা তার দাম। লোকটা করছেটা কী। বাবাকে বললে এক লাখ দিয়ে হলেও বাবা আমাকে ছাড়িয়ে নেবেন। মনে মনে বলল গুড্ডুবুড়া। কিন্তু তার মুখ বাধা। সে তো কথা বলতে পারছে না।
একটু পরে লোকটা এল আবার। তার হাতে একটা পাউরুটি, দুইটা কলা আর এক জগ পানি।
লোকটা প্রথমে ফাইজার মুখের বাঁধন খুলল। তারপর খুলল গুড্ডুবুড়ার মুখের বাঁধন।
গুড্ডুবুড়া বুঝল, যা করার এখনই করতে হবে। এই লোকটা তাদের পাচার করতে চাইছে মাত্র কুড়ি হাজার টাকার লোভে। এর চেয়ে বেশি টাকার আশ্বাস দিলেই তাকে তার পরিকল্পনা থেকে সরানো যাবে।
গুড্ডুবুড়া বলল, আঙ্কেল, আমার বাবার কাছে কিন্তু এখনই এক লাখ টাকার বেশি আছে। আপনি বললে বাবা এখনই আপনাকে এক লাখ টাকার বেশি পাঠিয়ে দেবেন।
ফাইজা ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আম্মুর কাছে যাব।
লোকটা বলল, কী কইলা? তোমার বাবার কাছে এক লাখ টাকা আছে?
হ্যাঁ। বাবা দুই লাখ টাকা নিয়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এসেছেন। এখনো এক লাখ টাকার বেশি আছে। আপনি বললেই বাবা টাকাটা পাঠিয়ে দেবেন।
আচ্ছা। তাহলে একবার এই জিনিসটা তো চেষ্টা করন যায়। তোমার বাবার নম্বর কত?
আমাকে দিন আমি ডায়াল করে দিচ্ছি। বলল গুড্ডুবুড়া।
না, তুমি নম্বর কও।
গুড্ডুবুড়া নম্বর বলল। লোকটার মুখে কাটা দাগ, হারিকেনের আলোয় তার মুখটাকে খুবই ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
লোকটা ডায়াল করল তার মোবাইল ফোন থেকে। রিং হতেই গুড্ডুর বাবা ধরে ফেলল ফোন।
হ্যালো।
হুনেন, আপনার পোলারে আর মাইয়ারে আমি ধইরা আনছি। হেরা ভালা আছে। তয় আজকা রাইতের মইদ্যে এক লাখ টাকা না পাইলে দুইটারেই মাইরা গাঙের জলে ভাসায়া দিমু।
আচ্ছা টাকা নিয়ে কোথায় আসব বলুন।
টাকা নিয়া হিমছড়ি ঝরনার ওপরের পাহাড়ের কাছে আইসা এই নম্বরে ফোন দিলেই হইব।
আচ্ছা আমরা আসছি।
কতক্ষণ পরে আইবেন?
তা গাড়ি জোগাড় করে আসতে ঘণ্টা দুয়েক তো লাগবেই। টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। টাকা আমার কাছেই আছে।
দুই ঘণ্টা। আইচ্ছা। দুই ঘণ্টা পরে আমি পোলা-মাইয়া দুইটারে লইয়া জায়গামতো আইতাছি।
লোকটা এবার দুজনের মুখে পাউরুটি আর কলা তুলে দিতে লাগল।
ফাইজা বলল, আমি কলা খাই না।
গুড্ডুবুড়া বলল, খাও ফাইজা। এখন না খেলে জোর পাবে না।
ফাইজা একটু পাউরুটি খেল। গুড্ডুবুড়া কলা খেল। পাউরুটি খেল। লোকটাই তুলে তুলে খাওয়াল তাদের।
তারপর লোকটা কাঠের দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে রইল। একটু পরে তার নাক ডাকার শব্দ শোনা যেতে লাগল।
হাত পেছনে বাঁধা।
গুড্ডুবুড়া পা দুটো ভাঁজ করে সাপের মতো ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলে গেল ফাইজার সামনে। তার কানে মুখ রেখে বলল, তুমি আমার হাতের বাঁধন মুখ দিয়ে খুলে দেওয়ার চেষ্টা করো।
তারপর উবু হলো গুড্ডু। ওর হাত দুটো গেল ফাইজার মুখ বরাবর।
ফাইজা মুখ দিয়ে হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে। গামছা দিয়ে হাত বাঁধা। কিছুক্ষণের মধ্যেই গুড্ডুর হাতের বাঁধন আলগা হতেই হাত কচলে বের করে নিয়ে এল গুড্ডু।
এবার সে খুলে ফেলল ফাইজার হাতের বাঁধন।
এবার গুড্ডু তর্জনী মুখে তুলে চুপ করে থাকতে বলল ফাইজাকে।
আস্তে আস্তে সে চলে গেল ঘুমন্ত ড্রাইভার কাম কিডন্যাপারের কাছে।
গুড্ডু মনে মনে বলল, লোকটা তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে আমাদের নাকে ধরেছিল। তার মানে ক্লোরোফর্ম বা এই জাতীয় জিনিসটা তার পাঞ্জাবির ডান পকেটে আছে। এটা দরকার সবার আগে।
লোকটা নাক ডাকছে। তার মুখ দিয়ে লালা ঝরছে।
আল্লাহকে স্মরণ করে গুড্ডু হাত দিল তার পাঞ্জাবির পকেটে। একটা রুমাল পেল সে। আরেকটা ছোট্ট শিশি।
তার বুক ঢিপঢিপ করে কাঁপছে। কিন্তু এরপরের কাজটা যত দ্রুত করা যায় ততই মঙ্গল। সে শিশিটার ছিপি সরাসরি খুলে লোকটার নাক বরাবর ধরল। লোকটা একবার নাকের কাছে হাত এনেই স্থির হয়ে গেল। তারপর শুয়ে পড়ল মেঝেতে।
এই লোকটা অজ্ঞান হয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি শিশিটার মুখ বন্ধ করল। এই জিনিস কিছুতেই নাকের কাছে আনা যাবে না।
তার হাতের মোবাইলটা বের করে সে ডায়াল করল বাবার নম্বরে।
হ্যালো, বাবার গলা শুনতে পেল গুড্ডু।
বাবা আমি গুড্ডু। লোকটাকে অজ্ঞান করেছি। আমরা দুজন একটা কাঠের ঘরে আছি। এখনই বের হয়ে যাব। তুমি মোবাইল ট্র্যাকার দিয়ে আমাদের লোকেশন বের করে পুলিশ নিয়ে চলে আসো। এই ফোনটা আমি সাথে নিয়ে বেরুব।
বাবা বললেন, আচ্ছা। দেখি।
গুড্ডু বলল, চলো আমরা পালানোর চেষ্টা করি। হাতে তো ক্লোরোফর্ম আছেই। রুমালে ক্লোরোফর্ম ভরে নিই। সামনে যাকে পাব, তার নাকে ধরব।
তারা আস্তে করে দরজার খিল খুলল। তারপর দরজার পাল্লা খুলতেই ক্যাঁ ক্যাঁ করে শব্দ হতে লাগল।
তারা বাইরে এল। দেখল, একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে ঘুমুচ্ছে। লোকটার নাকে ক্লোরোফর্মের রুমাল ধরল গুড্ডু। এই পাহারাদার লোকটাও অজ্ঞান হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
দুজনে বাইরে এল।
ঘন অন্ধকার রাত। যদিও আকাশে এক টুকরা চাঁদও আছে।
বাইরে এসে তারা দৌড়াতে লাগল একটা পায়ে চলা পথ বেয়ে। দুধারে অনেক জঙ্গল।
সামনে ওই যে সমুদ্র দেখা যায়। চলো, আমরা সমুদ্রসৈকতে যাই। তাহলে আমাদের খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। বলল গুড্ডু।
ফাইজা বলল, চলো। বলেই সে কাঁদতে লাগল আবারও।
গুড্ডু ফোন করল বাবাকে।
বাবা, বাবা, আমরা সমুদ্রের সৈকতে চলে এসেছি। তোমরা যদি সমুদ্র বরাবর আসো। আমাদের পাবে।
বাবা বললেন, কত দূর আসব?
আচ্ছা আমি সেটাও বলে দিচ্ছি।
গুড্ডু দেখল ফোনটা একটা সস্তা চায়নিজ ফোন। তবে এটা স্মার্টফোন। সে প্রথমে চেষ্টা করল মোবিডাটা অন করতে। দেখল, এই মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটের কানেকশন নেই।
সে তখন ফোন করল সার্ভিস সেন্টারে।
উফ। সার্ভিস সেন্টারে ফোন করা মানে এক যন্ত্রণা। আপনি যদি বাংলায় শুনতে চান, তাহলে এক চাপুন। আপনি যদি অমুক করতে চান তাহলে দুই চাপুন। অনেকক্ষণ পরে গুড্ডু পেল একজন মানুষের সাহায্য। তাকে সে বলল, আপনি এই নম্বরে ইন্টারনেট অন করে দিন। এখনই।
লোকটা বলল, আপনার তো টাকা নাই।
আচ্ছা আমি টাকা ভরছি। আপনি মোবিডাটা অন করে দিন। এখনই। কত টাকা ভরব বলুন।
৩৭ টাকা ভরলেই এটা আপনিই ইন্টারনেট অন করে দেবে।
সে বাবাকে ফোন করল, বাবা, এই নম্বরে এখনই ৩৭ টাকা ভরো তো। বেশিও না, কমও না।
একটু পরে ৩৭ টাকা যাওয়ার এসএমএস এল। এইবার গুড্ডুবুড়া ইন্টারনেট অন করল। গুগল ম্যাপে গিয়ে সে সার্চ দিল, প্রেজেন্ট লোকেশন।
সঙ্গে সঙ্গে তার অবস্থান আর কক্সবাজারের ম্যাপ দেখাতে শুরু করল গুগল ম্যাপ। জায়গাটার নাম নিমডাঙ্গা। হিমছড়ির পশ্চিমে এটা। সে বাবাকে ফোন করে বলল, বাবা, আমরা নিমডাঙ্গায়। হিমছড়ি থেকে জায়গাটা উত্তরে। আমরা কিন্তু বাবা সমুদ্রসৈকতে।
আধা ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা।
তারপর দেখা গেল সৈকত ধরে দুটো হেডলাইটের আলো এদিকেই এগিয়ে আসছে।
গুড্ডু তার হাতের মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বালাল।
জিপ এসে থামল তাদের সামনে।
গুড্ডুর বাবা আর ফাইজার বাবা নামলেন। নামলেন দুজন পুলিশ।
যার যার বাবা তাকে তাকে জড়িয়ে ধরলেন।
গুড্ডু বলল, পুলিশ আঙ্কেল, আপনারা কি কালপ্রিট দুটোকে ধরতে চান? তাহলে আমি আপনাদের দেখিয়ে দিতে পারি তাদের ঘরটা।
পুলিশ বলল, আচ্ছা, তোমরা গাড়িতে ওঠো। ওই যে পেছনে আমার ব্যাকআপ টিম আসছে।
আরও একটা জিপ এসে দাঁড়াল তাদের পেছনে পেছনে। দুটো গাড়িই সৈকত ছেড়ে পাকা রাস্তায় উঠে পড়লে গুড্ডুবুড়া দেখিয়ে দিল, ওই যে, এই রাস্তার ভেতরে একটা কাঠের ঘর। সেইটাই কালপ্রিটদের আস্তানা।
পুলিশ বলল, আমরা চিনেছি। আমরা পারব।
আপনারা যান। আমরা দেখছি।