গরমের ছুটি

অলংকরণ: সাইফ মাহ্‌মুদ

নিজেদের বাগানের ছায়াময় এক অংশে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে দুই ভাই ঘাসের ওপর। মেঘহীন নীল আকাশে আগুন ঝরাচ্ছে সূর্যটা। বাতাস নেই একরত্তি।

ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল আয়ান। ‘এত্ত গরম লাগছে যে মনে হচ্ছে গলে যাব আইসক্রিমের মতো।’

‘ইশ্‌!’ আফসোস করল আয়মান, ‘যদি যেতে পারতাম সাগরপারে! একবার শুধু চিন্তা করে দেখো, ভাইয়া...ছোট ছোট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সৈকতে...সোনালি বালু, ইচ্ছেমতো গোসল, ছোট্ট এক ডিঙি নিয়ে ভেসে পড়া!’

‘থাক, থাক, বলিস না আর!’ কষ্ট আর বাড়াতে চায় না আয়ান ওসব শুনে।

‘হুফ!’ বাদামি এক স্প্যানিয়েল ছুটে এল দ্রুতপায়ে, এসেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপর।

‘অ্যাই, দুষ্টু! নাম! নাম বলছি গায়ের ওপর থেকে!’

আয়মানের বকা খেয়ে অপরজনের কান চাটায় প্রবৃত্ত হলো কুকুরটা।

‘উফ! থামলি, ডুগ্গু!’ ধমক দিল আয়ানও, ‘পেয়েছিসটা কী কানে—মধু? পাজি একটা!’

দমল না ডুগ্গু। কানের বদলে নাক নিয়ে পড়ল এবার।

‘ব্যাপার কী, বলো তো!’ অবাক হলো আয়মান। ‘এত খুশি কেন ব্যাটা?’

‘কিছু একটা ভুটভুট করছে মনে হয় পেটের মধ্যে।’ বলতে বলতে উঠে বসল আয়ান, ‘ওই দেখ, আম্মি আসছে।’

দৌড় দিল কুকুরটা মিসেস ইকরামুল্লাহর দিকে।

‘বাচ্চারা!’ হাসছেন আম্মু, ‘দারুণ এক খবর আছে তোদের জন্য। বল তো, কী!’

‘কী, আম্মি?’ একই সঙ্গে বলে উঠল দুই সহোদর।

‘সমুদ্রের ধারে কাটাতে যাচ্ছি আমরা এবারের ছুটিটা!’

শুনে বিকট চিত্কার ছাড়ল ছেলেরা। ‘হুফ! হুফ! হুফ! হুফ!’ ডাকতে লাগল ডুগ্গু।

‘জানো আম্মি, মাত্রই ভাইয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল সমুদ্র নিয়ে!’ হড়বড় করে বলল আয়মান।

‘কবে যাচ্ছি, আম্মি?’ আয়ানের জিজ্ঞাসা।

‘আগামীকাল। জায়গাটার নাম অ্যালবাট্রস কোভ। তোদের এক দূরসম্পর্কের চাচা-চাচি থাকেন ওখানে। নিমন্ত্রণ করেছেন কটা দিন ওদের ওখান থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য।’

‘হুররে!’

‘তো, চলে আয় এখন। ব্যাগট্যাগ গোছাতে সাহায্য করবি আমাকে।’

সন্ধ্যার মধ্যেই সারা হয়ে গেল সব গোছগাছ। ট্রেনের টিকিট নিয়ে বাড়ি ফিরলেন আব্বু। এমনকি কুকুরটার জন্যও কেনা হয়েছে টিকিট। গর্বে তিড়িং-বিড়িং করতে লাগল ডুগ্গু।

আর নামবে না খাবার গলা দিয়ে, আধাআধি খাওয়ার পর পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে ঘোষণা করল আয়মান। উসখুস করছে উত্তেজনায়। সানন্দে ওর ভাগের বিস্কুটগুলোর সদ্ব্যবহার করল ডুগ্গু, অবশ্যই মিস্টার আর মিসেস ইকরামুল্লাহর অগোচরে। শেষ বিস্কুটটা কপাত করে গিলে নিতেই প্রশান্তি ভর করল কুকুরটার চেহারায়।

‘ট্যাক্সি এসে গেছে!’ জানালা দিয়ে দেখে আচমকা জানান দিল আয়ান, ‘চলো, চলো, তাড়াতাড়ি করো!’

নেমে এল ড্রাইভার লাগেজ তুলতে সাহায্য করার জন্য। গোটা বাড়ি চক্কর দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক রয়েছে কি না, নিশ্চিত হয়ে নিলেন মিস্টার ইকরামুল্লাহ। সদর দরজায় তালা লাগিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে যোগ দিলেন ট্যাক্সিতে।

‘চললাম তাহলে!’ ভদ্রলোকের কণ্ঠেও আনন্দের পরশ।

‘আশা করছি, সময়মতোই ধরতে পারব ট্রেনটা। যদি না পারি...।’ আশঙ্কায় চুপ হয়ে গেল আয়মান।

‘আরে বুদ্ধু, তাতে কী হয়েছে! চলে যাব পরের ট্রেনে।’ বলল আয়ান বিজ্ঞের মতো।

দেখতে দেখতে পৌঁছে গেল ওরা রেলস্টেশনে। এরই মধ্যে চলে এসেছে গাড়ি। দেখে, প্রজাপতির ওড়াউড়ি শুরু হলো আয়ান-আয়মানের পাকস্থলীতে।

তড়িঘড়ি করে নামল ওরা ট্যাক্সি থেকে। তখনই শুঁয়োপোকার মতো মন্থরগতিতে চলতে আরম্ভ করল ট্রেনটা।

‘চিন্তার কারণ নেই।’ বললেন বাবা ছেলেদের উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে, ‘আমাদের ট্রেন নয় ওটা...যাচ্ছে উল্টো দিকে।’

ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে অপেক্ষায় রইল ওরা প্ল্যাটফর্মে এসে। জমজমাট জায়গা। একটা মালগাড়ি দেখে বগিগুলো গুনতে লাগল আয়মান।

‘বাপরে, পঁয়তিরিশটা!’ চোখ কপালে উঠল গোনার পর।

‘দেখ, দেখ, আরেকটা ট্রেন আসছে!’ আঙুল তাক করল আয়ান, ‘এটা বোধ হয় আমাদেরটা!’

ঝড়ের গতিতে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করল ট্রেনটা। এমনই ভয় পেল বেচারা ডুগ্গু যে আত্মগোপন করল মালপত্রের ফাঁকে।

ফিক করে হেসে ফেলল আয়মান। ‘ব্যাটা বোধ হয় ভাবছে, খেয়ে ফেলবে ওকে ট্রেনটা।’

খালি এক কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়ল ইকরামুল্লাহ পরিবার। হুমড়ি খেয়ে পড়ল ছেলেরা দুদিকের জানালায়। ওদিকে সিটের তলায় গিয়ে লুকিয়েছে ডুগ্গু। এখনো কাবু হয়ে রয়েছে আতঙ্কে।

একটু পর ধীরেসুস্থে চলতে শুরু করল আবার রেলগাড়ি। ছেলেদের উল্লাসধ্বনি কানে যেতেই সিটের নিচ থেকে বেরিয়ে জানালায় উঁকি দিল ডুগ্গু। ভৌঁ দিল বাইরে একটা বিড়াল দেখে।

দারুণ মজা ট্রেন জার্নিতে। সাঁই সাঁই পেছনে ছুটছে সবকিছু। মাঠে মাঠে চরে বেড়ানো গরু-ভেড়া, নদীনালা, বনজঙ্গল ইত্যাদি আসছে আর যাচ্ছে। সময়ে সময়ে অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ছে ট্রেনটা, উঁচু উঁচু ব্রিজ পেরোচ্ছে, যাত্রাবিরতি করছে বিভিন্ন স্টেশনে। ভেবেই পাচ্ছে না আয়মান-আয়ান, এত সব চমত্কার দৃশ্য থাকতে বসে বসে ম্যাগাজিন পড়ছেন কীভাবে আম্মু-আব্বু!

‘পৌঁছে গেছি প্রায়।’ জানালেন ইকরামুল্লাহ সাহেব ঘণ্টাখানেক পর, ‘পরের স্টেশনেই নামব আমরা।’ হাত লাগালেন তিনি ওপরের তাকে তুলে রাখা ব্যাগগুলো নামানোর জন্য।

শর্টস আর চপ্পল পরে বাগানের দিকে ছুটছে দুই ভাই, সঙ্গী হয়েছে কুকুরটা। নীল ফটক পেরিয়ে পড়ল গিয়ে হলদে বেলাভূমিতে। আনন্দে আত্মহারা।

পরেরটাই শেষ স্টেশন। এরপর আর এগোবে না ট্রেনটা। সেখানেই রেললাইন শেষ হয়ে গেছে কিনা!

বিশাল বাহনটা থেমে দাঁড়াতেই হুড়োহুড়ি করে দরজার দিকে পা বাড়াল উত্তেজিত ভাইয়েরা।

‘ওই যে...তোদের চাচা।’ বললেন আমান ইকরামুল্লাহ, ‘আরি, চাচিও এসেছেন দেখি!’

আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরলেন চাচা-চাচি দূরসম্পর্কের ভাতিজাদের। যেন কতকালের চেনা। কুকুরটাও ভাগ পেল আদরের। মহা উত্সাহে এর-ওর পায়ে পায়ে ঘুরছে ওটা।

‘অ্যালবাট্রস কোভে স্বাগত!’ বললেন সাঈদ চাচা, ‘খুব ভালো লাগছে তোমাদের দেখে।’

‘আমাদেরও।’ বললেন ইকরামুল্লাহ দম্পতি।

‘পোর্টারের হাতে ছেড়ে দাও লাগেজগুলো।’ পরামর্শ দিলেন ওদের মেজবান, ‘হেঁটেই ফিরতে পারি আমরা। এই তো...কাছেই বাড়ি আমাদের।’

সহনীয় রোদ বিলাচ্ছে সূর্যটা। নীল আকাশে মেঘের ভেলা। প্রচুর বাতাস খেলছে। সমুদ্র কাছে বলেই। প্রথম মোড়টা ঘুরতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল ছেলেরা।

‘সাগর! সাগর!’ ধেই ধেই নাচতে লাগল আয়মান, ‘কী রকম ঝলমল করছে, দেখো!’

‘এখন কি জোয়ার, নাকি ভাটা চলছে, চাচা?’ চালিয়াতের ভঙ্গিতে জানতে চাইল আয়ান।

‘ভাটা।’ হেসে বললেন চাচা।

‘এক্ষুনি একবার যেতে পারি ওদিকটায়?’ বলল আয়মান অনুরোধের সুরে, ‘যা লোভ লাগছে না!’

‘লাঞ্চের পর হবে ওসব।’ মৃদু হাসি জেনি চাচির ঠোঁটে, ‘সারাটা বিকেলই সাগরতীরে খেলতে পারবে তোমরা।’

আহামরি কিছু না হলেও মনোরম দেখতে সাঈদ-জেনিফার দম্পতির কটেজটা। পেছনের বাগানটা সৈকতের দিকে মুখ করা, ছোট এক নীল রং করা গেট পেরিয়ে যাওয়া যায় ওদিকে। ভাই-ভাবিদের আগেই মার্কিন মুলুকে স্থায়ী নিবাস গেড়েছেন নিঃসন্তান স্বামী-স্ত্রী।

‘জোয়ারের পানি কি বাগান পর্যন্ত আসে?’ জিজ্ঞেস করলেন ছেলেদের বাবা।

‘আসে বৈকি।’ মাথা নাড়েন আবু সাঈদ, ‘তবে শীতের সময়।’

শিগগিরই খেতে বসল ওরা। সকালে ঠিকমতো নাশতা করেনি আয়মান। এখন মনে হচ্ছে, খেয়ে ফেলতে পারবে আস্ত হাতি।

আধা ঘণ্টা বাদেই দেখা গেল, শর্টস আর চপ্পল পরে বাগানের দিকে ছুটছে দুই ভাই, সঙ্গী হয়েছে কুকুরটা। নীল ফটক পেরিয়ে পড়ল গিয়ে হলদে বেলাভূমিতে। আনন্দে আত্মহারা।

কিন্তু সাগরসৈকতে পৌঁছাতেই আদিগন্তবিস্তৃত জলরাশি দেখে সিঁটিয়ে গেল ডুগ্গু। একটা ঢেউ এসে ওর থাবা স্পর্শ করতেই চেঁচামেচি জুড়ল তারস্বরে।

অল্পক্ষণেই অবশ্য ভয় কাটিয়ে উঠল কুকুরটা। সহজাত প্রবৃত্তির বশে ভাসতে লাগল খুদে মনিবদের আশপাশে। সারমেয়দের শেখাতে হয় না সাঁতার। ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা বলা যায় একে।

অসাধারণ লাগছে ওদের উষ্ণ নোনাপানি আর পায়ের তলায় নরম বালুর ছোঁয়া। হাঁটু অবধি নেমেছে সমুদ্রে। সাঁতার জানা নেই বলে এগোতে ভরসা পাচ্ছে না আর।

‘তোমরাও শিখে ফেলবে সাঁতার।’ তীর থেকে বললেন সাঈদ চাচা, ‘তারপর বেড়াব আমরা স্টিমারে।’

যারপরনাই উপভোগ করল ওরা প্রথম দিনটা। বালুর এক দুর্গ বানাল সাঈদ চাচার সাহায্যে, দুর্গ ঘিরে তৈরি করল পরিখা—ঢেউ এলে ভরে যাবে ওটা পানিতে। সামুদ্রিক আগাছা আর ঝিনুকের খোলা দিয়ে সুন্দর করা হলো দুর্গটা। সবশেষে ছোট্ট এক পতাকা পুঁতে দেওয়া হলো দুর্গের মাথায়।

সৈকতের আরেক আকর্ষণ লাল কাঁকড়া। দাঁড়িয়ে থাকে চুপটি করে, যেন বোঝাতে চায়—জীবন্ত কিছু নয় ওরা, পাথর। কাছে গেলেই ঝট করে বেরিয়ে আসে দাঁড়া। বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ে বালির গর্তে।

মিষ্টি অনুভূতি নিয়ে ঘুম ভাঙল ওদের পরদিন সকালে। শুয়ে থেকেই শুনতে পাচ্ছে সাগরের গর্জন, গাংচিলের অবিশ্রান্ত চিত্কার।

‘মনে হচ্ছে না, হাসছে ওরা?’ বড় ভাইকে সাক্ষী মানল আয়মান। খাট থেকে নেমেই চলে গেল জানালায়, ‘উঠে পড়ো, ভাইয়া। দেখে যাও, কী রকম ময়ূরের মতো নীল দেখাচ্ছে সাগর!’

এদিন সাঁতারের পাঠ দিলেন ওদের সাঈদ সাহেব। ওস্তাদ সাঁতারু তিনি, শিক্ষক হিসেবে ধৈর্য অপরিসীম।

গোসলের আগে সিনিয়র ইকরামুল্লাহও যোগ দিলেন পুত্রদ্বয়ের সঙ্গে, ফুটবল খেললেন চারজন মিলে। বাদ যায়নি ডুগ্গুও। পুরোটা সময় ছুটল সে বলের পেছনে।

আবহাওয়া এত চনমনে যে বাইরেই সেরে নেওয়া হলো দুপুরের খাওয়াটা। সাগরের ধারে এলে বোধ হয় বেড়ে যায় খিদে। ইকরামুল্লাহ ভাইদের তো মনে হচ্ছে—তিন বেলা নয়, অন্তত পাঁচবার খেতে পারবে ওরা। দুদিনেই বাদামি হয়ে উঠেছে ওরা রোদে পুড়ে।

‘বিকেলে মাছ ধরতে যাব আমরা।’ খাওয়াদাওয়ার পর পরিকল্পনা পেশ করলেন চাচা।

সোল্লাসে বাতাসে হাত ছুড়ল দুই ভাতিজা।

ফিশিং বোট ভাড়া নিয়ে তিনজনের দলটা রওনা হলো সাগরের অগভীর এক অংশে। সঙ্গে ছিপ নিয়েছে।

বাড়ি ফেরার আগে দেখা গেল, চারটি মাছ আটকেছে আয়মানের বড়শিতে, আর আয়ানেরটায় বিঁধেছে সাতটি। ওদিকে মাত্র তিনটি মাছ জুটল মিস্টার সাঈদের ভাগ্যে। মিছেমিছি মন খারাপ করলেন তিনি এটা নিয়ে।

ওদের আনা মাছগুলো দিয়েই ডিনার তৈরি করলেন জেনিফার চাচি। তৃপ্তি করে খেল সবাই। নিজের হাতে ধরা মাছের স্বাদই আলাদা।

‘প্রবালের পুলে নামতে চাই আজকে।’ তৃতীয় দিন আবদার ধরল আয়মান, ‘যাই, চাচি?’

‘তা যাও।’ পারমিশন দিলেন মিসেস সাঈদ, ‘তবে এখন নয়, ভাটার সময় যেয়ো। জোয়ারের সময় পানি অনেক গভীর থাকে পুলগুলোয়।’

সেইমতো, চলল ওরা প্রবাল-প্রাচীরঘেরা পুলের উদ্দেশে। যথারীতি ডুগ্গুও রয়েছে।

চমত্কার কাটল সময়টা পুলের পানিতে দাপাদাপি করে।

চতুর্থ দিন গুহায় ঘোরার অনুমতি চাইল ছেলেরা। পেয়েও গেল। শর্ত ওই একটাই: যেতে হবে ভাটার সময়, আর জোয়ারের আগেই বেরিয়ে আসতে হবে গুহা থেকে।

অসংখ্য গুহা রয়েছে সৈকতের একদিকে সার দিয়ে দাঁড়ানো পাহাড়গুলোর গায়ে। মাছ ধরার জন্য বোট ভাড়া নিয়েছিল যার কাছ থেকে, সেই ডেনভার বুড়ো বলেছে, এক শ বছর আগে নাকি জলদস্যুর ঘাঁটি ছিল ওগুলো।

অনেকক্ষণ লাগল পাহাড়ের ওদিকটায় পৌঁছাতে। প্রথম যে গুহাটিতে ঢুকল ওরা, ছোট আর নিচু ওটা। পরেরটা তুলনামূলকভাবে বড় বটে, তবে খানিকটা এগিয়েই শেষ হয়ে গেছে। সন্তুষ্ট হলো তৃতীয় আরেক গুহায় প্রবেশ করে। মানুষ ঢোকার মতো এক গহ্বর দেখা যাচ্ছে গুহার দেয়ালে। সম্ভবত সুড়ঙ্গ কিংবা শাখাগুহা এটি।

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফেনায়িত তরঙ্গের দিকে। কী করা উচিত, বুঝতে পারছে না। ফুটন্ত পানির মতো যে রকম অশান্ত হয়ে আছে সাগর, সম্ভব নয় সাঁতরে বেরোনো।

সঙ্গে করে আনা মিনিটর্চটা জ্বালল আয়ান। ‘চল, ঢুকি।’ পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান সিনেমার ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো মনে হচ্ছে নিজেকে।

সামুদ্রিক শেওলায় ছাওয়া শাখাগুহাটি। বিটকেল গন্ধ বাতাসে। জলদস্যুর গুপ্তধন আবিষ্কারের আশায় এদিক-ওদিক টর্চের আলো ফেলতে লাগল আয়ান। কিন্তু হতাশ হতে হলো ওকে। গুপ্তধন দূরে থাক, ফুটো একটা পয়সাও মিলল না কোনোখানে।

হঠাৎই টনক নড়ল ওদের। অনেক বড় গুহাটা। খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিল সময়ের হিসাব। আশপাশে দেখতে পাচ্ছে না এখন কুকুরটাকে। সটকে পড়েছে কোন ফাঁকে যেন। তবে শোনা যাচ্ছে ওটার চাপা ঘেউ ঘেউ। কী কারণে অমন করছে ডুগ্গু?

জানতে পারল শিগগিরই। প্রথম গুহাটায় ফিরে এসে দেখে, পানি ঢুকছে হুড়মুড় করে। বেরোনোর পথ রুদ্ধ। সর্বনাশ! জোয়ার!

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফেনায়িত তরঙ্গের দিকে। কী করা উচিত, বুঝতে পারছে না। ফুটন্ত পানির মতো যে রকম অশান্ত হয়ে আছে সাগর, সম্ভব নয় সাঁতরে বেরোনো। তা ছাড়া অতটা দক্ষও তো হয়ে ওঠেনি ওরা সাঁতারে। মনে মনে প্রার্থনা করছে আল্লাহর কাছে, এ সময় ঝাঁপ দিল ডুগ্গু উত্তাল ঢেউয়ের বুকে; পাগলের মতো চার পা ছুড়ছে।

‘হায় হায়রে!’ ডুকরে উঠল আয়মান, ‘কী করল এটা!’

‘আমার ধারণা, সাহায্য আনতে যাচ্ছে ও।’ শঙ্কার মাঝেও আশাবাদী আয়ান, ‘ভুলিস না, জন্ম-সাঁতারু কুকুররা।’

না, ভুল নয় আয়ানের অনুমান। সাঁতরে সক্ষম হলো ডুগ্গু গুহা থেকে বেরোতে। থামল না ডাঙায় উঠে আসার আগপর্যন্ত। এরপর দে ছুট কটেজ অভিমুখে। পৌঁছেই বাড়ি মাথায় তুলল চেঁচিয়ে। ঘটনা কী, দেখতে বেরোতেই টানাটানি শুরু করল ইকরামুল্লাহ সাহেবের প্যান্টের নিচের অংশ কামড়ে ধরে। বাইরে নিয়ে যেতে চাইছে ভদ্রলোককে।

‘খোদা!’ আঁতকে উঠলেন আম্মু, ‘বিপদে পড়ল না তো বাচ্চারা!’

‘কিচ্ছু হবে না, ভাবি!’ অভয় দিলেন চাচা, ‘ডেনভারের নৌকা নিয়ে যাচ্ছি আমরা ওদের খোঁজে!’ বেরিয়ে গেলেন তিনি ভাইকে নিয়ে।

বুড়োকে খুঁজে পেতে যা দেরি, তারপর আর একমুহূর্ত নষ্ট না করে ছুটলেন ওরা পাহাড়সারি লক্ষ্য করে। ওদিকেরই কোনো এক গুহায় একাকী বন্দী ছেলেরা, আতঙ্কে আধমরা।

খুঁজতে হলো না, পোষা কুকুরের সহায়তায় একবারেই পাওয়া গেল গুহাটা। তিনজনের মিলিত প্রচেষ্টায় নৌকায় তোলা হলো আয়ান আর আয়মানকে। আনন্দিত ডুগ্গু পালা করে শরীর চেটে দিতে লাগল দুজনের। পরম মমতায় কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরল দুই ভাই।

কড়া কিছু কথা শোনাতে চেয়েও বললেন না আপাতত আমান ইকরামুল্লাহ। ঠিক সময়ে উদ্ধার করা গেছে ছেলে দুটোকে, এ-ই তো অনেক।

সে রাতে বিশেষ ভোজ দিলেন চাচি কুকুরটার সম্মানে। বিপজ্জনক অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চ বুকে নিয়ে খাওয়া শেষে শুতে চলল ছেলেরা। আগামীকাল কী অপেক্ষা করছে, কে জানে!