বীথিরা এসেছে মামার বাড়িতে। এবার এখানেই ঈদ হবে। মামা কেউঢালা প্রজেক্টের ইঞ্জিনিয়ার। কী সুন্দর দোতলা বাড়ি। বারান্দাজুড়ে লাল-সাদা ফুলের টব। বাড়ির চারপাশে বড় বড় গাছ। দোতলার বারান্দা ঘেঁষে প্রকাণ্ড এক নিমগাছ। ঝিরঝির পাতা সারা দিন হালকা বাতাসে নড়ছে, দেখতে কী যে ভালো লাগছে বীথির।
আজ দুদিন বীথিরা এসেছে এ বাড়িতে। আসার পর থেকেই হইচই চলছে। বীথির মনে হচ্ছে, দুদিন ধরেই যেন ঈদ হচ্ছে। সন্ধ্যায় টেবিলভরা ইফতারি। সাহরিতে ঘরে পাতা দইয়ের সঙ্গে খেজুর গুড়, সবরি কলা আহা!! এমন সাহরি বীথি বহুদিন করেনি।
বাড়িতে একা একা সাহরি করতে বীথির ভালোই লাগে না। এখানে মামা, মামি, রুহী, মাহী, মাহীর নানা, নানু, আমেনা, আমেনার মা, মালি, ড্রাইভার চাচা বাড়িটা গমগম করছে। বীথি, মাহী, রুহী, আমেনা সারা দিন খেলাধুলায় ব্যস্ত। মা আর মামি ছুটলেন বাজারে। ঈদের কেনাকাটা শেষই হতে চায় না।
আমেনার মা খয়ের দিয়ে মেহেদি বেঁটেছে। কী সুন্দর টুকটুক করছে আমেনার মায়ের দুই হাত। বীথি, রুহী, আমেনাও ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেহেদির নকশা নিয়ে। ওরা সরু কাঠি দিয়ে একজন আরেকজনকে নকশা করে মেহেদি লাগায় আর গল্প করে। মাহী মেহেদি লাগাবে না, ছেলেরা নাকি মেহেদি লাগায় না। ওর কড়ি আঙুলে বীথি জোর করে লাগিয়ে দিল মেহেদি।
বিকেলের কিছু আগেই মা আর মামি ফিরলেন, সঙ্গে করে ছোট-বড় নানা সাইজের প্যাকেট, বাক্স, হালিম, জিলাপি, আম, আরও কত কী! রিকশা থেকে নামার আগেই মায়ের হাতে থাকা জিলাপির প্যাকেটটা মা এগিয়ে দিলেন মাহীর হাতে। আহ্ গরম গরম জিলাপি। প্যাকেটটা ধরতেই মাহীর হাতে জিলাপির রস লেগে গেল। রস লাগতেই মাহী জিব দিয়ে চেটে খেল রস। আর যায় কোথায়?
আমেনা চিত্কার করে বলে ওঠে, ‘মাহী ভাই জিলাপির রস খাইছে ভাইয়ার রোজা ভাইংগা গেছে’ পরক্ষণেই মাহীর মনে পড়ে আরে ও তো রোজা।
রাগে-দুঃখে মাহী আমেনার পিছু নেয়। আমেনা গিয়ে লুকায় মায়ের পাশে। মা মাহীকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘মাহী, তোমার রোজা ভাঙেনি, তুমি ভুল করে রস খেয়েছ। ভুল করে কিছু খেলে রোজা ভাঙে না।’
বীথি, রুহী, আমেনার হাসি পায়। মাহী গাল ফুলিয়ে নানার বিছানায় গিয়ে বসে। নানা বলেন, ‘রোজার দিনে রাগ করতে নেই ভাই, এ রকম জিলাপির রস আমার হাতে লাগলে আমারও ভুল হতো।’
এটা তোমার মা আর ফুপির দোষ।
মাহী এবার হেসে বলে, ‘মা আর ফুপির কী দোষ? ওরা তো আমাদের জন্যই জিলাপি নিয়ে এসেছেন। ভুল তো আমার হয়েছে নানাভাই।’
নানাভাই তো অবাক। চশমার ওপর দিয়ে তাঁর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। হাসতে হাসতে বললেন, নিজের ভুল বুঝতে পারার মতো সত্মানুষ এ পৃথিবীতে খুব কম। ভুল করে কেউ স্বীকারই করে না যে সে ভুল করেছে। তুমি অনেক লক্ষ্মী ছেলে মাহী।
মাহী আর নানাভাই যখন কথা বলছিল এমন সময় আমেনা ঘরে উঁকি দেয়। মাহী ওকে দেখেই নানার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পাশের ঘরে বীথিদের হাসির শব্দ পায় মাহী। মাহী ঘরে ঢুকতেই হাসির শব্দ থেমে যায়।
মাহী ঘরে ঢুকে একটু চুপ থেকেই বলে ওঠে, নানাভাই বলেছেন কেউ ভুল করে ভুল স্বীকার করলে আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন।
ফুপি মাহীকে জড়িয়ে ধরে বলেন এইটুকুন রসে জিব ছুঁয়ে তোর এত চিন্তা? পৃথিবীতে দুষ্টুলোকেরা কত খারাপ কাজ করে তারা যদি তোর এক ভাগও চিন্তা করত, তাহলে পৃথিবীটা যে কত সুন্দর হতো!!!
সন্ধে হয়ে এলে বলি, আজ এ বছরের শেষ রোজা। দোকান থেকে ফেরার পথে মামি রিকশাওয়ালা সফর আলী ও তার পরিবারকেও দাওয়াত করেছেন, বারান্দায় বড় চাদর পেতে বসেছে সবাই।
দারোয়ান কাকুর ঘড়ির কাঁটা সব সময়ই দুই মিনিট ফাস্ট। তার ঘড়িতে আজানের ধ্বনির অ্যালার্ম বেজে উঠতেই নানাভাই ঢক ঢক করে শরবত খেয়ে ফেললেন। আবারও হইচই পড়ে গেল। নানা বিব্রত। মাহী ছুটে যায় নানাভাইয়ের কাছে বলে, ‘নানা, কেউঢালাতে আজান না হলেও ঢাকায় আজান হয়ে গেছে, তোমার মন খারাপের কিছুই নেই।’
দারোয়ান কাকুর হাতঘড়ির অ্যালার্ম নিয়ে হাসতে হাসতেই একসময় সুমধুর আজানের ধ্বনি ভেসে এল। সবাই হাতে তুলে নিল টক-মিষ্টি লেবুর শরবত।
ইফতার করতে করতেই কানে এল ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’। সবাই চাঁদ দেখতে ছুটল চিলেকোঠায়। নিমগাছের ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁকে একসময় দেখা দিল সরু ঈদের চাঁদ।
ঈদ মোবারক ধ্বনি ভেসে আসতে থাকল চারদিক থেকে। আনন্দে মেতে উঠল মাহী, রুহী আর বীথিরা।