ইঁদুর

মিশুর সামনের দাঁতটা অনেক কায়দা করে শেষ পর্যন্ত তোলা হয়েছে। দাঁতটা অনেক দিন থেকেই নড়ছিল। কিন্তু কিছুতেই সে তুলতে দেবে না। শেষ পর্যন্ত ছোট মামা এসে অনেক গল্প শুনিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সুতো দিয়ে দাঁত বেঁধেছেন। তারপর আচমকা টান দিয়ে তুলেছেন দাঁতটা। না, মিশু কাঁদেনি। তাকে সবাই মিলে বাহবা দিচ্ছে। ‘বাঘের বাচ্চা বটে, একটা টুঁ শব্দটা করল না...’। সবার প্রশংসায় মিশুর বেশ গর্বই হলো। এখন সে সুতা বাঁধা দাঁতটা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সকাল থেকে। মিশুর মা বললেন,

মিশু?

উঁ

যাও দাঁতটা ইঁদুরের গর্তে ফেলে দিয়ে আসো।

ইঁদুরের গর্তে দাঁত ফেলব কেন?

তাহলে সুন্দর নতুন দাঁত উঠবে, ইঁদুরের দাঁতের মতো ধারালো ধবধবে সাদা।

সত্যি? মিশু বেশ উত্তেজনা বোধ করে!

হ্যাঁ, যাও পেছনের ভাড়ার ঘরে দরজার কাছে দেখবে একটা গর্ত আছে, ওখানে ফেলে দিয়ে আসো।

ওটা ইঁদুরের গর্ত?

হ্যাঁ, যাও।

মিশু হূষ্টচিত্তে সুতা বাঁধা দাঁত নিয়ে ভাড়ার ঘরে উপস্থিত হলো। ভাড়ার ঘরটায় কেমন একটা গুমোট গন্ধ। ছোট্ট মিশু নাক কুঁচকে গন্ধটা বোঝার চেষ্টা করে। এ ঘরে সে খুব একটা ঢোকে না। মা মাঝেমধ্যে চাল নিতে ঢোকে। কোনার একটা

বড় ড্রামের ভেতর চাল থাকে। টুকিটাকি আরও অনেক কিছুই থাকে এখানে।

দরজার কোনায় গর্তটার সামনে এসে দাঁড়াল মিশু। তারপর সুতাসুদ্ধ দাঁতটা ছুড়ে দিল গর্তটায়। টুপ করে একটা শব্দ হলো। আর কী আশ্চর্য! একটু পরেই দাঁতটা গর্ত থেকে ছিটকে বাইরে এসে মিশুর পায়ের কাছে পড়ল। তবে সুতাটা নেই, শুধু দাঁতটা। ভারি অবাক লাগল মিশুর। সে দাঁতটা তুলে আবার ফেলল গর্তে...আশ্চর্য! একটু পর আবার দাঁতটা ছিটকে বেরিয়ে এল আগের মতোই। নিশ্চয়ই ইঁদুরটা দুষ্টুমি করছে। বেশ মজা লাগল মিশুর। ফের সে দাঁতটা ছুড়ে দিল। এবং আবার একইভাবে দাঁতটা ছিটকে এসে পড়ল মিশুর পায়ের কাছে।

মা রান্না করছিলেন। মিশু এসে দাঁড়াল।

মা।

বলো, দাঁতটা ফেলেছ ইঁদুরের গর্তে?

ইঁদুরটা সুতা রেখে দিয়েছে।

মানে?

সুতা বাঁধা দাঁতটা ফেলেছিলাম কিন্তু ইঁদুরটা দাঁতটা নিচ্ছে না, সুতাটা রেখে দিয়েছে। বারবার ছুড়ে মারছে আমার কাছে।

মানে? মা ভ্রু কুঁচকে তাকান। মিশু তখন পুরো ব্যাপারটা আবার বিতং ব্যাখ্যা করল। তার দাঁত নিয়ে যে পাজি ইঁদুরটা খেলছে, পিং পং বলের মতো ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছে বারবার।

চল তো। মা মিশুর সঙ্গে ভাড়ার ঘরে এলেন। ‘ফেল তো গর্তে দাঁতটা!’ মিশু ফেলল। এবার আর দাঁতটা আগের মতো ছিটকে বাইরে এল না।

এই তো গর্তে দাঁতটা পড়েছে। নিশ্চয়ই তোর গর্তে ফেলাটা তখন  হচ্ছিল না। কোথাও বাড়ি খেয়ে দাঁতটা ছিটকে তোর কাছেই ফিরে আসছিল। মিশু কিছু বলল না, তীক্ষ দৃষ্টিতে গর্তটার দিকে তাকিয়ে রইল।

যাও বাবা এখন পড়ে ফেলো ১ ২ ৩...১০ পর্যন্ত মুখস্থ হয়েছে? মিশু উত্তর দিল না। তার দৃষ্টি তখনো গর্তের দিকে। মা চলে গেলেন আর তখনই ছিটকে এসে দাঁতটা তার পায়ের কাছে পড়ল। মিশু জানত এমনটা হবে, তার মনে হচ্ছিল। এবং হঠাত্ করে সে পরিষ্কার বুঝতে পারল, ওই গর্তের ভেতর আর যা-ই থাকুক, ইঁদুর নেই। অন্য কিছু আছে। সেটা কী?

শোনো, তোমার ছেলেকে নিয়ে তো বিপদ হয়েছে, বললেন মা।

কী বিপদ? পত্রিকা পড়তে পড়তে মিশুর বাবা বললেন।

ওর দাঁত তোলার পর বলেছিলাম, দাঁতটা ইঁদুরের গর্তে ফেলতে। সে ফেলেছে, এখন দিন নাই, রাত নাই ইঁদুরের গর্তের সামনে বসে থাকে।

কেন?

সেটাই তো...বলেছিলাম যে ইঁদুরের গর্তে ফেললে সুন্দর দাঁত উঠবে...

উফ্, এখন নিশ্চয়ই তার ধারণা হয়েছে ইঁদুরের সঙ্গে লবিং না করলে সুন্দর দাঁত উঠবে না?

ওই রকম কিছু একটা হবে। মাঝেমধ্যে বিড়বিড় করে কী সব কথা বলে।

কী দরকার ছিল তোমার ইঁদুরের গর্তে দাঁত ফেলতে বলার...বাচ্চাদের মাথায় যা একবার ঢোকে... তাই গেঁথে যায়...

দেখে আসি ও ঘুমাল কি না। বলে মিশুর মা উঠে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলেন মিশুর মা, আতঙ্কিত চেহারা!

মিশু ওর ঘরে নেই!

কী বলছ, কোথায় গেছে? লাফিয়ে উঠলেন মিশুর বাবা।

দুজনেই সারা বাড়ি খুঁজতে লাগলেন। তবে পাওয়া গেল তাকে। ভাড়ার ঘরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে সে, একা।

বাবা, তুমি এখানে কী করছ?

ওরা ডাকল তাই এসেছি।

কারা ডাকল?

ওই যে ইঁদুররা।

ইঁদুররা তোমাকে ডেকেছে কেন?

ওরা বলল দাঁতটা দিতে।

দাঁত তো তুমি আগেই দিয়েছ।

দিয়েছিলাম, কিন্তু ওরা ফিরিয়ে দিয়েছে। এই যে বলে সে হাতের মুঠি খোলে। মা-বাবা দুজনেই অবাক হয়ে দেখে, তার মুঠোয় কাগজে মোড়ানো দাঁতটা। মিশুর মা সামিয়া বেগমের বুকটা কোনো কারণ ছাড়াই ধক করে উঠল।

পরদিনই ওই ভাড়ার ঘরের ইঁদুরের সব গর্ত মিস্ত্রি ডেকে বন্ধ করা হলো সিমেন্ট দিয়ে। তারপর ওই ঘরে তালা মারা হলো। মিশুর দাঁত তার কাছ থেকে নিয়ে অন্য কোথাও ফেলে দেওয়া হলো। মিশুর মা সামিয়ার ধারণা ছিল, মিশু হয়তো আপত্তি করবে কিংবা ভাড়ার ঘরে যেতে চাইবে। কিন্তু তেমনটা হলো না। মিশু খুব স্বাভাবিক রইল। সামিয়ার মনে হলো, যাক সমস্যা মিটেছে। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই একদিন মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। পাশের ঘরেই মিশুর বিছানা। কী মনে করে সেখানে গিয়ে দেখেন মিশু ঘরে নেই। পাগলের মতো সব ঘরে খুঁজলেন তিনি। নেই! কোথাও নেই! চেঁচিয়ে ডেকে তুললেন স্বামীকে!

ওগো, মিশু কোথাও নেই!

কী বলছ? ভাড়ার ঘরে গেছে নাকি আবার?

ওই ঘর তো তালা মারা। তারপরও কী মনে হলো, ছুটে গেলেন দুজনে। সত্যিই তালা মারা। কিন্তু কী যেন মনে হলো সামিয়ার, তালা খুলে দেখেন অন্ধকার ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মিশু। চিত্কার করে ওকে জড়িয়ে ধরলেন সামিয়া।

বাবা, তুমি এখানে ঢুকেছ কীভাবে? এ ঘর তো তালা মারা!

ওরা এনেছে!

ওরা কারা?

ইঁদুররা...ওরা অন্য রকম ইঁদুর। ওরা এখন দাঁতটা চায়। দাঁতটা কই মা? দাঁতটা ওদের দিয়ে দাও...সামিয়ার মনে হলো, কেমন ভয় পাওয়া গলায় কথাগুলো বলছে মিশু।

দাঁতটা কোথায়? পাশ থেকে বলেন মিশুর বাবা আরমান সাহেব।

আমি ময়লার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলাম।

সে রাতেই তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো দাঁতটা। যেখানে যত ময়লা আছে সব পাগলের মতো খোঁজা হলো টর্চ জ্বালিয়ে। এবং শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল ছোট্ট দাঁতটা।

মা, পেয়েছ দাঁতটা?

হ্যাঁ বাবা, পেয়েছি।

চলো এখনই দিয়ে আসি। বলে মিশু দাঁতটা একরকম ছিনিয়ে নিয়ে ছুটে গেল ভাড়ার ঘরের দিকে। পেছন পেছন বাবা-মা দুজনেই গেলেন।

না, তোমরা এসো না। দরজার কাছে গিয়ে বলল মিশু। তাহলে ওরা ভীষণ রাগ করবে! মা-বাবা দুজনেই দরজার কাছে থমকে দাঁড়ালেন, মিশু একাই ঢুকল ঘরে। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন জীবন্ত হয়ে উঠল ঘরটা। অন্ধকার ঘরে কারা সব চার পায়ে ছুটে বেড়াচ্ছে কিচকিচ শব্দ ঘরময়...বিশ্রী বোটকা গন্ধ একটা। সামিয়ার আর সহ্য হলো না। দরজা ধাক্কা দিয়ে ভাড়ার ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালালেন। সঙ্গে সঙ্গে সব চুপ, ঘরে কেউ নেই। শুধু মাঝখানে মিশু দাঁড়িয়ে আছে। ঝট করে তাকে কোলে তুলে বাইরে এলেন সামিয়া। বাবা-মা দুজনেই হতভম্ব হয়ে দেখলেন মিশুর ফোকলা দাঁতের জায়গায় ধবধবে সাদা বাঁকা তীক্ষ ইঁদুরের মতো একটা দাঁত বের হয়ে আছে।

মিশু ফিক করে হাসল। কিন্তু ছোট্ট মিশুর হাসিটা ভয়ংকর!

অলংকরণ: রাজীব