ভূতেদের ছোঁয়া যায় না

অলংকরণ: এস এম রাকিব

আমার বন্ধু রাতুল ছোটবেলা থেকেই ভূত হতে চাইত। দ্বিতীয় শ্রেণিতে থাকতে একবার নাজিমা ম্যাম বাংলা ক্লাসে এসে সবাইকে বললেন,

‘সবাই একটা পাতায় বড় বড় করে লেখো, তোমরা বড় হয়ে কী হতে চাও।’

আমি লিখলাম, বিজ্ঞানী। আমার পাশের বেঞ্চে জিসান লিখল, পাইলট। প্রতিদিন ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে ক্লাসে আসা তানজিল লিখল, চিকিৎসক। আর রাতুল লিখল, ‘ভূত’।

নাজিমা ম্যাম অবাক হয়ে বললেন, ‘রোল ১৭। রাতুল। দাঁড়াও।’

কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়াল ক্লাসের সবচেয়ে লম্বা ছেলে রাতুল।

‘তুমি ভূত হতে চাও?’

মিষ্টি চেহারাটা কাঁদো কাঁদো করে রাতুল মাথা নাড়ল।

‘কেন?’

রাতুল কথা বলল না। কারণ, কিছু বলতে গেলেই ও কেঁদে ফেলবে। ছেলেটা সব সময় কাঁদে। একবার স্কুলে দুষ্টু ছেলেরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। হাঁটু ছিলে গেল আমার। রাতুল ছুটে গেল তানজিলকে ডেকে আনতে। তানজিল ফার্স্ট এইড বক্স থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে হাঁটু ব্যান্ডেজ করে দিতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। দেখি রাতুল কাঁদছে। সামান্য এই কারণে কেউ কাঁদে?

ম্যাডাম বোধ হয় ভেবেছিলেন, রাতুলকে আরও কিছু প্রশ্ন করবেন। কিন্তু তখনই ঘণ্টা পড়ে গেল। সব ছেলে হইহই করে রওনা দিল মাঠের দিকে। আমি রাতুলের কাছে গিয়ে বললাম, ‘তুই ভূত হতে চাস কেন?’

রাতুল ফিক করে হেসে বলল, ‘তাহলে আম্মু-আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে পারব।’

আমরা সবাই জানি, রাতুলের আম্মু-আব্বু মারা গেছেন। কিন্তু এটা নিয়ে ক্লাসে কেউ কথা বলে না। ক্লাস টিচার হিয়া মিস মানা করেছেন। কারণ, রাতুলের মন খারাপ হবে। তাই আমি আর কোনো কথা বললাম না।

তবে বড় হওয়ার আগেই রাতুলের ইচ্ছা পূরণ হলো। চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষে দাদাবাড়িতে যাওয়ার সময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল ও।

সবাই এমনভাবে কান্না করল যেন রাতুল আর কখনো ক্লাসে ফিরে আসবে না। সব সময়ের জন্য হারিয়ে গেছে। লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড রুমে না পাওয়া যাওয়া ইরেজারগুলোর মতো। কিন্তু আমি জানি, রাতুল ঠিকই ক্লাসে আসবে। তাই আজ আমার পাশের সিটে কাউকে বসতে দিলাম না। কেউ জিজ্ঞেস করতেই বললাম, ‘রাতুল এলে বসবে।’ ব্যাপারটা জানতে পেরে আমাকে স্কুল কাউন্সিলরের রুমে নিয়ে গেলেন নওরীন মিস। স্কুল কাউন্সিলর মোতাহার স্যার। উনি ভালো মানুষ। রুমে গেলেই কিটক্যাট দেন। নাক ধরে বলেন, ‘লিটল ফেইরি, ফ্লাই অ্যাওয়ে।’ ছেলেমানুষি কাজ। কিন্তু আমার ভালো লাগে। তবে আজ মোতাহার স্যার কেমন যেন গম্ভীর। আমাকে বললেন, ‘তুমি রাতুলের জন্য সিট রেখেছ?’

আমি মাথা নাড়লাম।

স্যার বললেন, ‘তুমি তো জানো, ও আর নেই, তাই না?’

রাতুল যে ভূত হয়ে ওর আম্মু-আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে গেছে আর দেখা করেই ফিরে আসবে, এই জটিল ব্যাপারটা বড়দের বোঝানো প্রায় অসম্ভব। তাই আমি চুপ করে রইলাম।

স্যার একটা নিশ্বাস ফেলে ড্রয়ার থেকে কিটক্যাট বের করে দিয়ে বললেন, ‘ক্লাসে যাও। রাতুলের সিটটা খালি থাকুক।’

আমি কিটক্যাট হাতে ক্লাসে চলে এলাম। এর পর থেকে সবাই আমাকে বোঝাতে থাকল যে রাতুল কখনো ফিরে আসবে না। রাতুল নেই। রাতুল ফিরে এলে সবাই কেমন চমকে উঠবে, সেটা কল্পনা করেই আমি চুপচাপ সব শুনে গেলাম। কিন্তু এক সপ্তাহ পরও ও এল না।

শুরুতে আমার বেশ অভিমান হলো। মা–বাবাকে পেয়ে রাতুল আমাদের সবাইকে ভুলে যাবে? এমন তো করার কথা নয়। ঠিক করলাম, কাল থেকে ওর জন্য ক্লাসে সিট রাখব না। ওর মতো আমিও ওর কথা আলবত ভুলে যাব।

কিন্তু এমনও তো হতে পারে, ওর মা–বাবা ওর স্কুল বদলে দিয়েছেন। রাতুল এখন ভূতেদের স্কুলে পড়ে। ভূতেদের কোনো স্কুল আছে কি না, সেটাও জানা দরকার। জিজ্ঞেস করলাম রহিমা খালাকে, ‘ভূতেরা কি আমাদের মতো ওদের স্কুলে যায়?’

ঘর ঝাঁট দেওয়া থামিয়ে রহিমা খালা আমাকে বললেন, ‘মৃত্যুর পরে তো পড়াশোনার কাম নাই। ওদের ইস্কুল থাকবে কোন দুঃখে?’

বড় হলেও রহিমা খালা যুক্তি দিয়ে কথা বলে। আমি মাথা নাড়লাম। তাহলে রাতুল আসছে না কেন?

আরও একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল। মানুষেরা কি ভূতেদের দেখতে পায়? হতে পারে রাতুল আমার আশপাশেই আছে। আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি না। ক্লাসে ও ঠিকই পাশের সিটে বসে থাকে। কিন্তু আমি টের পাই না।

রাতে ঘুমানোর আগে রহিমা খালা দুধের গ্লাস নিয়ে রুমে এল। জিজ্ঞেস করলাম,

‘মানুষ কি ভূতেদের দেখতে পায়?’

ভূত নিয়ে আমার এত আগ্রহ দেখে খুব খুশি হলো রহিমা খালা। সে নিয়মিতই দাবি করে, এই বাড়িতে ভূত তার চুল ধরে টানে। কিন্তু কেউই সে কথা পাত্তা দেয় না। অন্তত একজন ভূত-প্রেত নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করায় রহিমা খালার ভালো লাগছে।

‘জে। অবশ্যই দেখতে পাই। আমি এখনো টিয়ার বাপেরে সবখানে দেখি।’

আমি চিন্তায় পড়ে বিছানায় উঠলাম। ঠিক তখনই মাথায় এল, রাতুল আসলে কোথায়।

আমার ধারণা কয়েক দিন ধরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেই ও বসে আছে।

রাতুল কখনো একা একা রাস্তা পার হতে পারে না। ও বলে, জোরে গাড়ি চলতে দেখলে ওর ভয় করে। শুনে আমি অবাক হইনি। রাতুল সবকিছুতেই ভয় পায়। ভূতের গল্প শুনলে ভয় পায়, ভূতের মুভি দেখলে ভয় পায়। কেউ বাসার ডোরবেল বাজালেও ও চমকে ওঠে। ক্লাস শেষে প্রতিদিন আমিই ওকে রাস্তা পার করাই। ও কীভাবে মেইন রোড থেকে অ্যাক্সিডেন্টের পর ফিরে আসবে? আমার ধারণা, রাতুল এখনো রাস্তার ধারে বসে আছে।

বিছানায় উঠে বসলাম আমি। ঘুম আসার আর প্রশ্নই নেই। রাত বাজে একটা। গত সাত দিন রাতুল একা একা রাস্তার ধারে কাটিয়েছে, এটা চিন্তা করেই আমার কান্না পেয়ে গেল। ঠিক করলাম, আমিই ওকে নিয়ে আসব।

তবে কাজটা জটিল। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। সমস্যা আসবে। সমাধান বের করতে হবে। আমি স্কুলব্যাগ খুলে পেনসিল আর রাফ খাতা নিয়ে বসলাম। মুন্নী ম্যাম বলেন, যেকোনো কাজে নামার আগে প্রবলেম লিস্ট করতে। এতে কাজটা সহজ হয়। আমি শুরু করলাম।

সমস্যা ১: দিনের বেলায়ই আমাকে একলা বের হতে দেয় না। রাতে তো অসম্ভব। কী কারণে বের হব, সেটা কাউকে বোঝানো যাবে না। বোঝালেও কেউ বিশ্বাস করবে না।

সমস্যা বড় হলেও সমাধান সোজা। সবাই ঘুমাচ্ছে। কেউ দেখবে না আমি বের হচ্ছি কি না।

সমস্যা ২: আমি জানি, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের কোথাও রাতুল আছে। কিন্তু কীভাবে যেতে হয় জানি না।

সমাধান গুগল ম্যাপ। আপুর ফোনের লক প্যাটার্ন আমি জানি। উল্টো এল। মাথার কাছ থেকে ওর ফোন নিয়ে রওনা দিলেই হবে।

সমস্যা ৩: খেয়াল করলাম আর কোনো সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে না। আনন্দের ব্যাপার। সব গুছিয়ে ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে যখন আমি ঘরের ছিটকিনি খুললাম, তখন বাজে রাত দুইটা। সিঁড়ি বেয়ে অর্ধেক নেমে আমি আবার ঘরে ঢুকলাম। ব্যাগে নিলাম এক প্যাকেট বিস্কুট। সাত দিন একলা থেকে রাতুলের ক্ষুধা লাগতে পারে। বিস্কুট নিয়ে যাওয়া উচিত।

রাতের বাসগুলোর কেউই আমাকে নিতে চাইল না। যে বাসেই উঠতে চাই, কন্ডাক্টর অবাক হয়ে বলে, ‘তোমার আম্মু-আব্বু কই?’

আমি চুপ করে থাকি। পরের বাস আসার অপেক্ষা করি। হঠাৎ দেখি একটা বাসের কন্ডাক্টর বাচ্চা ছেলে। আমার চেয়ে একটু বড়। আমাকে দেখে অবাক না হয়ে বলল, ‘কই যাইবা?’

‘ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক।’

ছেলেটা ঘাবড়ে গেল শুনে।

‘মাঝরাইস্তায় নামবা?’

আমি মাথা নাড়লাম। ভাবলাম এই বাসও হয়তো রেখে চলে যাবে।

কিন্তু ছেলেটা কিছু না বলে আমাকে বাসে টেনে ওঠাল। বাস প্রায় খালি। শুধু শেষের দিকে কয়েকটা সিটে মাঝবয়সী কিছু লোক ঘুমাচ্ছে। আমি ফাঁকা সিটে বসতেই কন্ডাক্টর আমার পাশে এসে বসল।

‘তুমি একলা রাস্তায় নামবা ক্যান?’

বাধ্য হয়ে রাতুলের পুরো ঘটনা বললাম ওকে। বলে বেশ শান্তি লাগল। এত বড় ঘটনা বেশিক্ষণ পেটে চেপে রাখলে অস্বস্তি লাগে। ছেলেটা বলল, অ্যাক্সিডেন্ট কোথায় হয়েছে ও জানে, আমাকে নামিয়ে দিতে পারবে। খুশিতে কী বলব বুঝে উঠতে না পেরে আমি রাতুলের জন্য রাখা বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে দিলাম ওকে।

বাস থেকে নেমে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝেমধ্যে হুস করে বড় বড় ট্রাক-বাস বেরিয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম টের পেলাম শুধু টিকটিকি না, অন্ধকারও আমার ভয় লাগে। ব্যাকপ্যাক খুলে দেখি, টর্চ এনেছি ঠিকই, কিন্তু ব্যাটারি আনতে ভুলে গেছি। আপাতত রাতুলের নাম ধরে ডাকাডাকি করা ছাড়া কিছু করার নাই। ডাকতে ডাকতে একসময় গলা বসে গেল। তাও রাতুলের দেখা মিলল না।

এমনকি হতে পারে যে রাতুলের মা–বাবা এসে ওকে নিয়ে গেছে?

তাহলে একলা বাসায় ফিরতে হবে। এই অন্ধকারে ব্যাপারটা ভেবেই আমার হাত–পা ঠান্ডা হয়ে এল।

এমন সময় শুনতে পেলাম, দূরে কেউ কাঁদছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের চোটে এতক্ষণ শুনতেই পাইনি। একটু কান পেতেই বুঝলাম, অনেকটা রাতুলের মতোই গলা। একঝটকায় উঠে বসলাম। তারপর ছুট লাগালাম শব্দের দিকে। ডালপালায় লেগে পায়ের কোথাও কোথাও ছিলে গেল। কিন্তু ব্যথা টের পেলাম না। রাস্তার বাঁ পাশে অনেকখানি দৌড়ে গিয়ে দেখি একটা পাকুড়গাছের নিচে কেউ একজন বসে আছে। অঝোরে কাঁদছে ছেলেটা।

আমি ফিসফিস করে ডাক দিলাম, ‘রাতুল? আমি নাফিজ।’

অবয়বটা আমার দিকে তাকাল। রাতুলই কাঁদছে। আমাকে দেখে বলল, ‘আমার ভয় করে। অনেক ভয় করে।’ একবার ভাবলাম, অহেতুক কাঁদছে দেখে ওকে একটা ঝাড়ি দিই। কিন্তু আমার চোখই ঝাপসা হয়ে এল।

পরিশিষ্ট

প্রতিদিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে আমি আর রাতুল ঘর ছেড়ে বের হই। ভোরের আগপর্যন্ত রাতুলের মা–বাবাকে খুঁজি। অনেক ভূতের সঙ্গেই দেখা হয় আমাদের। রাতুলের কথা শুনে আমাদের সঙ্গে মিলে ওরা খোঁজ চালায় কোনো কোনো রাতে। মাঝেমধ্যে আমার মাথায় একটা সন্দেহ উঁকি দেয়, ‘সবাই মরে হয়তো ভূত হয় না। কেউ কেউ তারা হয়ে যায় আমার মা–বাবার মতো।’ কিন্তু রাতুলকে সে কথা বলি না। কারণ, রাতুলের আজকাল মন খারাপ থাকে। কিছু বললেই রাতুল হু হু করে কাঁদে। তখন আমরা রাস্তার ধারে গাছের নিচে বসি। আকাশ দেখি। খুব ইচ্ছা করে, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু পারি না। কারণ, ভূতেদের ছোঁয়া যায় না।