শীতকাল, তাই বরকাদের বাড়ির রাস্তাটার দুপাশে ঢিপ হয়ে জমল বরফ। সকালে ঘুম ভেঙেই ও শুনত, ফুটপাথের ওপর জমাদারের বরফটানা কোদালের শব্দ।
বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে পোড়ো জমিটা এখন পরিণত হয়েছে স্কেট খেলার ময়দানে, আর যেখানে একদিন দুই সাহসীবীর রকেট ছেড়েছিল ঠিক সেই মাঝখানটায় ম্যানেজার বসিয়ে দিয়েছে ফার গাছ। বরকা একদিন স্বচক্ষে দেখল সে ফার গাছের চারপাশে হাত ধরাধরি করে ল্যবকা আর গেনা স্কেট করছে। গেনা পেখমের মতো এক পা তুলে আর এক পায়ে '৪'এর মতো রেখায় ভেসে যাচ্ছিল বরফের ওপরে। ল্যবকাও একটা লাল সোয়েটার আর লাল টুপি মাথায় একই রেখায় স্কেট করছিল। তারপর ওরা থেমে কী সব কথাবার্তা বললে। লু্যবকার টুপিতে সোনার মতো ঝক ঝক করছিল বরফ। গেনার দিকে চেয়ে লুল্যবকা এমনভাবে হাসল
যেন ল্যবকা নয়, পরী। সবাই ভারি হাসিখুশি, এমন কি গৃহম্যানেজার পর্যন্ত। বিস্ফোরণের কাহিনীটা সে একেবারে ভুলে গেছে। কিন্তু এই অশুভ ঘটনাটার একটা নীরব সাক্ষী রয়ে গিয়েছিল বাড়িতে, সেটা বকুনির চেয়েও বেশি অস্থির করে তুলেছিল বরকাকে। সোফার পাশে কোণের দিকে চোখে পড়ত ফুটকিদার সেই ছোট্ট তোশকটা যেটাতে শুয়ে থাকত তিয়াপা, চোখে পড়ত রান্নাঘরের গামলাটা, যাতে গিন্নি তার জন্যে সযত্নে জমিয়ে রাখত হাড়। সবচেয়ে অসহ্য লাগত যখন কথা উঠত, আহা, হারিয়ে যাওয়া কুকুরটা কী আদুরে বুদ্ধিমানই না ছিল। বরকা তখন আর সইতে পারত না, টুপিটা টেনে নিয়ে একটা কথাও না বলে ছুটে বেরিয়ে যেত ঘর ছেড়ে। তিয়াপাকে উদ্ধার করার শত শত পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে সে ঘুরত রাস্তায় রাস্তায়। সাধারণত এমন তন্ময় হয়ে থাকত সে যে খেয়ালই হত না কখন আঁধার হয়ে এসেছে, দশতলা প্রকাণ্ড বাড়িটার জানলায় জানলায় রীতিমতো আলো ফুটে উঠলেই তবে বাড়ি ফিরত সে।
আলোকিত জানলাগুলোর দিকে চেয়ে নিঃশ্বাস ফেলত সে, 'বাড়ি বটে, হয়ত হাজার দুয়েক লোক থাকে ওতে, হয়ত আরো বেশি। অথচ তিয়াপা হয়ত কোথায় ঠান্ডায় জমে মরছে তা নিয়ে কারো এতটুকু মাথা ব্যথা নেই। গেনা? তার কথা না ভাবাই ভালো। নিশ্চয় বসে বসে রকেট আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। নয়ত বাপের সঙ্গে বসে পত্রিকা দেখছে। কারাতভদের 'বাড়িতে পিয়ন কত সব পত্রিকা নিয়ে আসে, নামই মনে রাখা কঠিন।'
কিছু দিন আগেও গেনাকে হিংসে করত বরকা - ওর বাপ সাংবাদিক, আর তার বাপ মামুলী একজন লেদমিস্ত্রি। কিন্তু তাদের ৬ নং 'ক' ক্লাস একবার গিয়েছিল 'বলে' (বাপের বন্ধুরা তাদের বলবেয়ারিং কারখানাটাকে ওই বলে ডাকত), বরকা সেখানে দেখেছিল গোটা কারখানাঘর জুড়ে প্ল্যাকার্ড লেখা: 'স্মেলভের পাল্লা ধরো!' তা দেখে ওর চোখ যেন খুলে গিয়েছিল।
সন্ধ্যায় বাপ যখন ফুল তোলা মস্ত মগটা থেকে বরাবরের মতো চা খাচ্ছিলেন তখন বরকা সামনে বসে তাঁর নাক ভুরু চোখের দিকে এমন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল যে বাপের ভয় হল।
বিব্রতভাবে বললেন, 'কী ব্যাপার, অমন তাকিয়ে দেখছিস কী? কী পেয়েছিস আমাকে- বেলভেদিয়েরের অ্যাপলো নাকি আমি? যা তো, শুতে যা।'
শুতে গেল বরকা, কিন্তু এই ভেবে তার বুকের ভেতরটা ফুলে উঠেছিল যে এমন একটা লোকের সঙ্গে সে একই ঘরে বাস করে যার পাল্লা ধরতে চায় সবাই...
"নাকি বাড়ি ফিরে যাব, দাবা খেলা যাবে বাবার সঙ্গে?" নিজের ঘরের জানলাটার দিকে তাকিয়ে বরকা এ ভাবনা বাতিল করে দিলে, 'না, আর একটু ঘুরে বেড়ানো যাক। সবুজ আলোটা যখন জ্বলছে তখন বোঝাই যাচ্ছে বাবা তার ট্র্যাফটিং নিয়ে বসেছে...'
লোকে যখন একলা, মন খারাপ, তখন অনবরত ভাবনা খেলে যায় মাথায়। মনে হয় যেন ঘরবাড়ি, রেলিং, রাস্তার বাতিগুলো মন দিয়ে তার কথা শুনছে। শ্রোতা হিসেবে তারা খুব চমৎকার কখনো কথায় বাধা দেয় না। আর কান থাকলে তাদের কাছ থেকেও কম জিনিস শোনা যায় না।
জানলার আলোগুলো থেকে আনন্দিত নিরানন্দ অনেক কাহিনীই টের পায় বরকা। দোতলায় লাল শেড দেওয়া আলো দেখে বলে দেওয়া যেতে পারে ট্রেনার সোফিয়া লেপ কাজ থেকে ফিরেছে নাকি বুড়ি ধাই আনফিসা এখনো সংসারের কাজে ব্যস্ত। কর্ত্রী বাড়ি না থাকলে মিতব্যয়ী আনফিসা জোরালো আলো জ্বালায় না। আর সোফিয়া লেপ ভালোবাসে চোখ ধাঁধানো ঝকঝকে আলো। সোফিয়া লেপের বাড়িতে আছে ট্রেইনড্ সব কুকুর। লোকে বলে তাদের একটা কুকুর নাকি 'ছিঃ' আর 'ননসেন্স' বলতে পারে। ওর কাছে তিয়াপার কথা বললে হয়। কিন্তু তার আশ্চর্য আশ্চর্য সব কুকুরের কোনো একটা নিয়ে সোফিয়া লেপকে যতবার গেটে দেখেছে বরকা, ততবারই তার এ সংকল্প উবে গেছে, আর মিনিট খানেকের পরে মোড়ের পাশে উধাও হয়ে গেছে স্বয়ং সোফিয়া লেপ।
তিন তলার ঝুল বারান্দাওয়ালা ফ্ল্যাটদুটোয় থাকে এক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আর এক নামজাদা শিল্পী। যদি জেনারেলের ঘরে আলো জ্বলে আর শিল্পীর ঘরের জানলাটা অন্ধকার, তাহলে বুঝতে হবে শিল্পী গেছে জেনারেলের বাড়িতে, আর যেই জেনারেলের ঘরের ল্যাম্প নেভে, অমনি শিল্পীর ফ্ল্যাটে জ্বলে ওঠে কমলা রঙের আলো।
শিল্পী কনস্তান্তিন পাভলভিচ রোগভ এক অদ্ভুত ধরনের লোক। রঙ আর পেন্সিল দিয়ে সে দুনিয়ায় ছেড়ে দিত শত শত মজাদার লোককে, বাচ্চাদের খুশি করত। গল্পে আছে, কার্লো বুড়ো নাকি কাঠ থেকে এক লম্বা নাক পুতুল বানাতে গিয়ে বানিয়ে তোলে এক জীবন্ত বুরাতিনোকে। এ ব্যাপারে রোগভ তাকেও ছাড়িয়ে যায়। কার্লো
বুড়োর মতো রোগভও তার সৃষ্ট জীবদের প্রতি ভারি সদয়, তাদের মধ্যেকার সবচেয়ে বিদঘুটেগুলোকে পর্যন্ত দেখেও ভালো লাগে বাচ্চাদের।
আবহাওয়া যেমনই হোক, দেখা যাবে গরম জুতো, ওভারকোট পরে মাফ্লার জড়িয়ে রোগভ এসে দাঁড়িয়েছে ঝুল বারান্দায়, হাতে একটি ফিল্ড বাইনোকুলার। অদ্ভুত এ মূর্তি দেখে কেউ কেউ তাকে কাগতাড়ুয়ার সঙ্গে তুলনা করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু বাড়ির ছেলেপিলেরা কেউ শিল্পীকে নিয়ে ঠাট্টা সহ্য করার পাত্র ছিল না।
আসলে শিল্পীর খুব একটা কঠিন অসুখ আছে। ঘর থেকে তার বেরুনো মানা করে দিয়েছে ডাক্তাররা। অথচ ক্যাপটেনের ডেকের মতো ঝুল বারান্দাটা থেকে কিন্তু চারিপাশের অনেকখানিই চোখে পড়ত শিল্পীর। ফিল্ড বাইনোকুলার তাকে পৌঁছে দিত রাস্তাঘাটে, আর বুড়ো জোয়ান, চিন্তিত ফুর্তিবাজ অনন্য কত মুখ ভেসে উঠত তার দৃষ্টিপথে। শিল্পীর ফ্যাকাশে মুখ থেকে গালভরা হাসি কখনো মিলাত না। সারা মুখ যেন আলো হয়ে উঠত তাতে, সদানন্দ রগুড়ে চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠত আরো।
ভিড়ের মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু একটা হয়ত সে দেখল। অমনি একটা হাত চোখের কাছে বাইনোকুলার তুলে ধরত আর একটা হাত চেপে ধরত পেনসিল।
কয়েক মিনিট পরেই দেখা যেত শাদা কাগজের ওপর বড়ো কর্তার মুখের দিকে কুকুরের মতো চেয়ে তোষামোদ করছে কর্তাভজা; বস্তাকৃতি এক চওড়া ওভারকোট পরা অতি ফ্যাশনেবল মেয়ে চলেছে তড়বড় করে; ভারি পোর্টফোলিওর চাপে নুয়ে পড়েছে ব্যুরোক্রাট।
রোগভের ছবি দেখে অনেকে প্রথমে হো হো করে হেসে উঠেছে, তারপর চুপ করে গেছে হঠাৎ, নিজেকে চিনতে পেরে চোখ সরিয়ে নিয়েছে লজ্জায়।
বরকার মনে পড়ল আজ সকালে রোগভের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে যাবার সময় ধাক্কা লেগেছিল একটা লম্বা লোকের সঙ্গে, হাসতে হাসতে লোকটার দম বন্ধ হবার জোগাড়। বোঝা যায় ঘর থেকেই হাসি শুরু হয়েছিল। তখনো কিছুতেই থামাতে পারছিল না। অপরিচিত লোকটা মাথা নেড়ে উবু হয়ে চোখের জল মুছলে; তারপর দম নিয়ে ফাইলটা খুলে তাকিয়ে দেখলে ছবিটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই ফের এক হাসির দমক।
কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে বরকাও পেছন থেকে উ'কি দিয়ে দেখেছিল ছবিটার দিকে, সেও এমন হো হো করে হেসে উঠেছিল যেন পেটের মধ্যে শুড়শুড়ি দিয়েছে কে। কাকাতুয়ার আদলে একটি ফুলবাবুর ছবি সেখানে।
রোগভের এই পরিচিতটি বরকার দিকে চোখ টিপে হাত তুলে ট্যাক্সি থামাল। সম্পাদকীয় দপ্তরে ছুটছিল সে। তার ক্ষিপ্রতার ওপরেই নির্ভর করছিল ছবিটা কাল সকালের কাগজে প্রকাশিত হবে কি হবে না। ঠিক সময়ে যদি পৌঁছতে পারে তাহলে কাল হাজার হাজার,
না লাখ লাখ লোক হাসবে নির্বোধ বাবুগিরির নিদর্শন দেখে। আর সবাই জানে, হাসির ক্রিয়াটা ওষুধের মতো মোক্ষম।
"কিন্তু রোগভ যদি তিয়াপার ছবি এ'কে দেয়, তাহলে এই লোকগুলো হয়ত তাকে সন্ধান করে বের করায় সাহায্য করতে পারে!"
এই আকস্মিক ভাবনাটায় বুক ধক করে উঠল বরকার। বাড়ির জানলার আলোর দিকে তাকাল সে। রোগভের স্টুডিয়োতে আলো জ্বলছে। এক্ষুনি, এক্ষুনি যেতে হবে ওর কাছে!
'শুভ সন্ধ্যা, তরুণ বন্ধু, বলো কী করতে পারি।'
হাসিখুশি, বলি রেখাঙ্কিত দুচোখে ভরসা দেবার মতো করে তাকিয়ে রইল শিল্পী আর চৌকাটে দাঁড়িয়েই তড়বড় করে বরকা তাকে শোনাতে শুরু করল তিয়াপার 'কথা, রকেটের কথা। বাধা না দিয়ে শিল্পী ঘরে পিছিয়ে এল, অতিথিকে নিয়ে এল তার স্টুডিয়োয়, একটা ছোটো নরম সোফায় বসাল তাকে, একেবারে জীবন্তের মতো একটা লালচে মখমলের বেড়ালের কাছে। নিজে বসল রঙ পেনসিল কাগজ ছড়ানো টেবলের সামনে।
'সত্যি, দুঃখের কাহিনী,' দরদ দিয়ে বললে রোগভ, 'কিন্তু লোকে যে বেশি চট করে সাড়া দেয় মজাদার হাসির ব্যাপারে। তবে দেখা যাক, দেখাই যাক। এখুনি শুরু করছি।'
রোগভ পেনসিল তুলে নিল। আঁকতে শুরু করল বেশ মন দিয়ে, যেন আক্রমণ করলে শাদা কাগজটাকে। কিছুক্ষণ পরেই অ্যালবাম এগিয়ে দিল সে বরকার দিকে।
'এই রকম চেহারা?'
'এই চেহারা!' অবাক হয়ে সানন্দে বললে বরকা। তার সামনে তিয়াপা, তারই তিয়াপা! একশ কুকুরের মধ্যেও সে তার লম্বাটে মুখ, কালো কালো সোহাগে চোখ দেখে ঠিক চিনে নিতে পারে সে চোখ যেন জিজ্ঞেস করছে "আমি তোর বন্ধু, আর তুই?”
'আমার প্রধান সমালোচক যখন বললে চেহারা এই রকমই, তখন ছবিটার পেছনে লাগা যেতে পারে,' খুশির স্বরে বললে রোগভ।
'সে কী,' অবাক হল বরকা, 'লাগা যাবে মানে? তিয়াপার ছবি তো এ'কেই দিয়েছেন।'
'নারে খোকা, ছবি এখনো হয়নি। যেটা দেখলি সেটা শুধু স্কেচ। ধৈর্য ধরতে হবে তোকে।'
ফের চুপটি করে সোফায় বসল বরকা, আর এ'কে চলল রোগভ। এবার ও আঁকল ধীরে ধীরে, থেকে থেকে আঁকা থামিয়ে কী দেখে হেসে নিচ্ছে, সেই জানে।
বরকার যখন মনে হতে লাগল শিল্পী বোধ হয় তার কথা একেবারেই ভুলে গেছে তখন হঠাৎ ডাকল তাকে রোগভ।
'তাহলে সমালোচক, এবার দ্যাখ তো চেয়ে।'
সমালোচক এগিয়ে এসে তাকিয়ে দেখল, এমন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল যে মুখে কথা সরল না। বুঝতে পারল না খুশি হবে নাকি রাগ করবে।
ও যতক্ষণ বসে বসে ভাবছিল, ততক্ষণে সাধারণ একটা কুকুর থেকে তিয়াপা পরিণত হয়েছে মহাকাশযাত্রীতে।
রকেটে উড়ছে সে, বাতাসের ঝাপটায় উলটে গেছে তার কান পতাকার মতো। এটাও মেনে নেওয়া যেত কিন্তু টেরা চোখ খরগোস, নেকড়ে, কাঠবেরালি, পাট-করে-লেজ- আঁচড়ানো শেয়াল লাফাচ্ছে, পা নাড়ছে, ডিগবাজি খাচ্ছে- এরা সব এল কোথা থেকে? পরে বরকা নজর করে দেখলে যে এই বাছাই করা সমাবেশটা জুটেছে তিয়াপাকে সম্বর্ধনার জন্যে। ফুলের তোড়া হাতে র্যাম্পবেরি ঝোপ থেকে ছুটে এসেছে ভালুক। লেজে লেজে হাত ধরাধরি করে এসে দাঁড়িয়েছে ভীতু ভীতু ই'দুরগুলো। বোকা গম্ভীর সারস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার ডানা দোলাচ্ছে, খেয়ালই নেই জলা থেকে যে ব্যাঙটিকে সে সঙ্গে এনেছিল সে ততক্ষণে তার ন্যাড়া ঠ্যাঙ ধরে ঝুলতে শুরু করেছে।
ফিক করে হেসেই বরকার মনে হল: কিন্তু ব্যঙ্গ চিত্র কেন? ভুরু কুচকে ভারিক্কি ভাব করে সে তাকাল ব্যাঙটার দিকে। দেখলেই হাসি পায়... সংযম হারিয়ে বরকাও হেসে ফেললে।
রোগভ এতক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল তাকে, এবার হাঁপ ছেড়ে নিঃশ্বাস ফেলল... বোঝা যাচ্ছে অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে।
প্রধান কথা ছবি যেন পাঠকদের চোখ টানতে পারে। ছবিটা তারা দেখতে শুরু করবে, আর তলের লেখাটাও পড়বে নিশ্চয়। সেখানে দেওয়া থাকবে হারিয়ে যাওয়া কুকুরটার ছোট্ট একটা ইতিহাস এবং অনুরোধ, তিয়াপার মতো কোনো কুকুর কোথাও কেউ দেখে থাকলে অবিলম্বে যেন সম্পাদকীয় দপ্তরে খবর দেওয়া হয়।
এক সপ্তাহ কাটল। নতুন ছবিটা ছাপা হল সবচেয়ে মজাদার এক শিশু পত্রিকায়। জরুরী, মামুলী শত শত চিঠি পৌঁছল সম্পাদকীয় দপ্তরে। সব চিঠি টেবলে জড়ো করা হল। সম্পাদক তা থেকে একটি চিঠি তুলে নিলেন: ক্রাস্নপ্রুদনায়া থেকে এক কুকুরের মালিক বড়ো বড়ো গোল গোল অক্ষরে লিখেছে, "প্রিয় সম্পাদক, শিল্পী খুড়ো আমার টে'পীর যে ছবি এ'কেছেন তার জন্যে অনেক ধন্যবাদ জানাই। আমার টেপী তিন পর্যন্ত গুণতে পারে, আমি পারি দশ পর্যন্ত।”
খুব একটা তাৎপর্যসূচক 'হঃ' উচ্চারণ করে সম্পাদকশরের চিঠিটা ধরলেন। চিঠির সঙ্গে খাম থেকে বেরুল একটা শক্তসমর্থ বুলডগের ফোটো। ছাঁচলো মুখ তিয়াপার সঙ্গে বুলডগের কোনো মিল না থাকলেও পত্রপ্রেরকের স্থির ধারণা হয়েছে যে শিল্পী তার বুলডগটার ছবিই এ'কেছেন।
আরো কিছু চিঠি পড়ার পর সম্পাদক চোখ বাঁজে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তাঁর ধারণা হল মস্কোয় অন্তত দুশো কুকুর ঘোরাঘুরি করছে যাদের একটার সঙ্গে আর একটার তফাৎ করা মুশকিল, যেমন তফাৎ নেই দুই বিন্দু জলে। এই সব কুকুর তাদের মনিবদের সার্টিফিকেট অনুসারে জ্বলন্ত বাড়ি থেকে শিশুদের উদ্ধার করেছে, চোর ধরেছে, সহ্যগুণ, সাহস, প্রভুভক্তি তাদের অশেষ - এক কথায় সুদূরতম গ্রহে যাত্রা করার পক্ষে উপযুক্ত। কিন্তু এদের কাউকেই রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া যায়নি, সবকটিই বাচ্চা থেকে মানুষ করা। সংক্ষেপে, কেউ এরা তিয়াপা নয়।
একথা বরকা জেনেছিল খোদ রোগভের কাছ থেকে। প্রথম বারে যে সোফাটায় সে বসেছিল, সেইখানেই লালচে বেড়ালের পাশে বসেছিল সে।
'এই তো ব্যাপার ভাই। আমাদের ফন্দিটা খাটল না,' খবর জানিয়ে উপসংহার টানল রোগভ, হাসল খানিক অপরাধীর মতো, 'আমার লাইব্রেরিটা দেখবি নাকি?'
'না, আমি চলি,' বরকা বললে বিষণ্ণ সুরে। আর সময়টা ভর দুপুর হলেও বিদায় নেবার
সময় বললে, 'শুভ রাত্রি।'
অবাক হল না শিল্পী; মন খারাপ থাকলে কী না বলে লোকে...