[বিখ্যাত প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর আর্দশির শাপুর শিপলুর এই কেস স্টাডিটাও বরাবরের মতো প্রকাশিত হয়েছিল হালচাল পত্রিকার ’৯২ সালের একটা সংখ্যায়। মূল লেখার সঙ্গে যেসব ভূমিকা, ছবি আর অলৌকিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা ছিল, সেগুলো বাদ দিয়ে কেবল ঘটনাটা তুলে দেওয়া হলো]
একদম শুরু থেকে টের পাচ্ছিলাম, এই কেস স্টাডিটা সাধারণ নয়। অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা তো আর কম দেখলাম না জীবনে, দেশের আনাচকানাচে চষে বেড়াতে কসুর করিনি। খুব সাধারণ ভুতুড়ে বাড়িই বলুন বা মানুষের ভেক ধরা পিশাচ বা একজনের মরা বউ বারবার ফিরে আসা কিংবা জিনপোষা গ্রাম্য মৌলভি—সবই দেখেছি। হালচালের পাঠকদের তা অজানা নয়। তবু চিঠিটা যখন পেলাম, একবার চোখ বুলিয়েই শিরদাঁড়া খাড়া করে বসে ছিলাম। বহুদিনের অভিজ্ঞতা আমাকে বলছিল, এবারের কেসটা একমেবাদ্বিতীয়ম।
আর দশটা চিঠিতে যেমন আমন্ত্রণ থাকে, এটাতেও তা–ই ছিল। কিসের আমন্ত্রণ? পুরো জিনিসটা চাক্ষুষ দেখার আগে নাকি বিস্তারিত লেখা যাবে না। তবে জিনিসটা কী রকম, তার একটু আভাস দেওয়া আছে। চিঠি পড়া শেষ করে ভাঁজ করতে যতক্ষণ, আমি ব্যাগ গোছাতে লেগে পড়েছি। সরেজমিন তদন্ত করব। পল্টনে আমাদের হালচালের অফিসেই বসা ছিলাম যেহেতু, সম্পাদক হিফজুর রহমানের কাছ থেকে অনুমতি নিতে সময় লাগেনি।
গন্তব্য উত্তরবঙ্গের একটা জেলা শহর। ট্রেনে চড়ে বসলাম কমলাপুর থেকে, তারপর বাহাদুরাবাদ-তিস্তামুখ ফেরিতে যমুনা পারাপার। তারপর আবার রেলগাড়ি ঝমাঝম। গন্তব্যের শহরের ছোটখাটো ছিমছাম স্টেশনটায় যখন পা রাখলাম, সকালের ঝলমলে রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। প্ল্যাটফর্মের উল্টো দিকের গাছপালাগুলোর মাথা ছাড়িয়ে এক টুকরো কালো মেঘের উপস্থিতি অবশ্য আমার নজর এড়ায়নি। বর্ষাকাল যে চলছে, তার প্রমাণ ওটা।
চশমাটা নাকের ওপরে ঠেলে ব্যাকপ্যাকটা সামলে স্টেশন থেকে বেরোনোর রাস্তা খুঁজছি, মনে ঘুরছে চিঠিতে লেখা ঠিকানাটা, এমন সময় নিজের নামটা শুনতে পেলাম। ‘জনাব শিপলু! জনাব শিপলু!’ বলে চেঁচাচ্ছে কেউ।
দেখি, প্ল্যাটফর্মের ও মাথা থেকে ছুটে আসছে একটা লোক। মাথায় লম্বা নন, স্বাস্থ্যটা ভারীর দিকে, বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন, স্থূল নাকের ডগায় একটা চশমা ঝুলছে। চাঁদির ওপরে চুল খুব বেশি নেই।
আমার কাছাকাছি এসে থামলেন লোকটা, হাঁপাচ্ছেন। গায়ের ফতুয়াটা ইতিমধ্যেই ঘামে ভিজতে শুরু করেছে। দম ফিরে পাওয়ার জন্য ভদ্রলোককে হাসিমুখে সময় দিলাম খানিকটা, তারপর বললাম, ‘রউফ সাহেব? বামী এস্টেটের ম্যানেজার?’
মাথা ওপর-নিচ করলেন লোকটা। ‘আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। গতকাল তো টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছিলেন, আসবেন। চলুন, গাড়ি রেডি।’
স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে হেঁটে বাইরে পার্ক করে রাখা এখানে-ওখানে তোবড়ানো পুরোনো মডেলের ফোর্ড গাড়িটা পর্যন্ত যেতে যতটুকু সময়, তার মধ্যে পুরোটাই রউফ সাহেব ব্যয় করলেন নিজের চাকরিদাতা পরিবারের গুণকীর্তনে। বামী বংশ যে এদিককার বড্ড খানদানি, বিরাট জমিদার পরিবার, আশপাশের কয়েক জেলায় যে তাদের সম্পত্তি ছিল—সেটা জানা গেল। পাকিস্তান আমলে জমিদারি বিলুপ্ত হয়ে অনেক জমিজমা হাতছাড়া হয়েছে, তা ঠিক। কিন্তু মানুষের সম্মান তো কেউ কেড়ে নিতে পারে না, তাই না? ছবার চেষ্টায় গাড়িটা স্টার্ট দিতে দিতে স্বগতোক্তি করলেন রউফ সাহেব। আমি সায় দিলাম।
মফস্বল শহরের চিকন রাস্তায় রিকশা-ঠেলাগাড়িকে এঁকেবেঁকে কাটিয়ে শহরতলির দিকে ছুটে চললাম আমরা। পুরোনো নোনাধরা বট-পাকুড় গজানো দালানে ঠাসা শহরের এদিকটা। আমার জানা ছিল যে এ রকমই কোনো একটা জমিদারবাড়ি আমাদের গন্তব্য, তবু যখন একটা মোড় ঘুরে বিরাট প্রাসাদটা চোখে পড়ল, ভুরু কপালে না তুলে পারলাম না। বামী বংশের জমিদারবাড়ি এখানে ভাঙা-ওখানে পলেস্তারা ওঠা, শেষবার রং করা হয়েছে বছর পঞ্চাশেক আগে, তবু রাজকীয়। গথিক কলামে সাজানো সামনের দিকটা। চারপাশে বেশ বড় জায়গা রয়েছে, আম–কাঁঠালের শ-দেড় শ বছরের পুরোনো গাছে ছাওয়া। এই চনমনে সকালেও পুরো জায়গাটা কেমন বিষণ্ন, নিঝুম। প্রথম দেখায় খুব একটা ভালো ঠেকল না আমার কাছে।
বাগানের ধ্বংসাবশেষের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একটা নুড়ি বিছানো রাস্তা, তাই ধরে এগিয়ে জমিদারবাড়ির সিঁড়ির গোড়ায় গাড়িটা পার্ক করলেন ম্যানেজার রউফ সাহেব। কোনো চাকরবাকরকে এগিয়ে আসতে দেখলাম না। রউফ সাহেব যখন আমার ব্যাকপ্যাকটা নিজে বয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন, তখন না-না করে প্রায় জোর করেই ওনার হাত থেকে কেড়ে নিলাম সেটা। ‘এটা দেখতেই ভারী, ভাই। ভেতরে তেমন কিছু নেই।’ জমিদারবাড়ির ম্যানেজারকে দিয়ে ব্যাগ টানানোর কাজ নেহাত পাষণ্ড ছাড়া কে করতে পারে?
তরে ঢুকতেই বুঝলাম, বাইরে থেকে যা আঁচ করেছি, তা ভুল নয়। কিছু একটা বিদঘুটে ব্যাপার চলছে এ বাড়িতে, মোটামুটি নিশ্চিত। এত বড় বড় জানালা খোলা অথচ আবছায়া হয়ে আছে প্রবেশকক্ষটা। বাতাস ঠান্ডা, গুমোট। দেয়ালে ঝোলানো শিকার করা হরিণ আর মোষের মাথাগুলো পরিবেশটার কোনো উন্নতি করতে পারেনি, বরং উল্টো।
প্রবেশকক্ষ থেকে রাজকীয় স্টাইলের দুটো বাঁকানো সিঁড়ি উঠে গেছে দুদিকে। তার একটা ধরে আমাকে ওপরতলায় একটা মাঝারি সাইজের ঘরে নিয়ে এলেন রউফ সাহেব। আসবাবগুলো পুরোনো বেশ, মেহগনি কাঠ বলেই এখনো আস্ত আছে। বালিশটায় দুই ঘা লাগিয়ে আরেকটু নরম করে রউফ সাহেব বললেন, ‘নিন, আরাম করুন শিপলু সাহেব।’
‘ট্রেনে তো কম আরাম করিনি।’ বললাম আমি, ‘যিনি আমাকে চিঠি লিখেছেন, সোলায়মান বামী সাহেব কি এখন ব্যস্ত? ওনার কোনো সমস্যা না হলে...’
‘না, ওনাকে পাবেন না এখন।’ রউফ সাহেবের স্থূল থুতনিতে একটা হাসির আভাস ছড়িয়ে পড়ল। ‘বিশ্রাম করুন না। দুপুরের লাঞ্চ খান। বিকেলে বা সন্ধ্যায় কাজের আলাপ করবেন না হয়।’
আর কথা বাড়ানো চলে না। ‘বেশ। ইয়ে, এক কাপ চা মিলবে কি?’
‘চা-টা সব মিলবে।’ বেরিয়ে গেলেন ম্যানেজার। লোকটার আচার-ব্যবহার, কথা বলার ভঙ্গি, শরীরী ভাষা—সবই বড় অমায়িক, বিনীত। সাবেক জমিদারবাড়ির নায়েব টাইপের কোনো নাক উঁচু ভাব নেই।
চা–নাশতা ঘরেই এল। বাড়ির আর্দালি যে ট্রেটায় করে খাবার দিয়ে গেল, তা রুপোর হতেও পারে। উর্দি পরা আর্দালির বুকে যে ধাতব নেমপ্লেট সাঁটা থাকে, তাকে বলে চাপরাশ আর তা থেকেই এসেছে চাপরাশি শব্দটা, জানেন তো?
উদর পূর্তি করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে একটা লেখায় ঠাসা নোটবুক নাড়াচাড়া করতে করতে শুনলাম, মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। গরাদ বসানো সাবেকি আমলের বিরাট খোলা জানালা দিয়ে আসছে ঠান্ডা হাওয়া, আলোও কমে এসেছে বাইরে। নোটবুক সরিয়ে রেখে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লাম। বৃষ্টি আগে নামল না আমার চোখের ঘুম, বলতে পারি না।
ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে হাতঘড়িতে চোখ বোলালাম। দেড়টা বাজে প্রায়। বাইরে ঝমঝমিয়ে একদম আষাঢ়ের বৃষ্টি পড়ছে। যেকোনো জায়গায় কোনো সময় ঘুমিয়ে পড়তে পারাটা আমার পুরোনো গুণ। কাজে লেগে যায় ব্যাপারটা; কারণ, কখন পুরো রাত জাগতে হবে কে বলতে পারে? উঠে বসলাম। বামীরা কয়টার সময় লাঞ্চ করেন কে জানে। ব্রিটিশ কায়দায় ঠিক বারোটায় যদি খেয়ে থাকেন, তাহলে তো মিস করে ফেলেছি।
নাহ্, লাঞ্চও ঘরে এল একটু পরেই। কাটারিভোগ চালের দারুণ ভাতের সঙ্গে চমৎকার খাসির মাংস, মাছ, ভাজি আর ডাল—জমিদারি খাওয়া দিলাম একদম। মিং ডাইনেস্টি ধাঁচের টি–পট থেকে ঢেলে দুকাপ চা শেষ করতে না করতেই ম্যানেজার রউফ সাহেব হাজির। সৈয়দ সোলায়মান বামী সাহেব তশরিফ দিয়েছেন। নোটবুক, টেপ রেকর্ডার বগলদাবা করে বেরোলাম ম্যানেজারের পেছন পেছন।
বিরাট টানা বারান্দা ধরে এগোচ্ছি। বৃষ্টির ছাঁটে সিমেন্টের রেলিং ভেজা। হুট করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বছর ত্রিশেকের এক ভদ্রলোক। চুলটা এই ’৯২ সালের হাল ফ্যাশনে কাটা, আবার সুচালো দাড়ি আর পাকানো গোঁফ বেশ নবাবি আমলের। লম্বা–চওড়া দেহ। ফিনফিনে শৌখিন পাঞ্জাবির বোতাম আঁটতে আঁটতে চেঁচিয়ে ডাকছেন আর্দালিকে, জুতো খুঁজে দিতে হবে। ক্লাবে যাবার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দিকে চোখ পড়তে একটা ভুরু উঁচু করলেন স্রেফ। রউফ সাহেব থতমত খেয়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘বড় সাহেব এনাকে একটা দরকারে ডেকে পাঠিয়েছেন’ বলে। আমি কিছু বলার সুযোগ পাইনি, আবার নিজের ঘরে ঢুকে গেছেন ভদ্রলোক। হাঁটতে হাঁটতে নিচু গলায় রউফ সাহেব বললেন, ‘ছোট সাহেব সৈয়দ তানভীর বামী।’ আর কিছু না বলাতে বুঝলাম, ছোট সাহেবের গুড বুকে নেই ম্যানেজার।
তানভীর বামীর চিন্তা ভুলতে আমার লাগল ত্রিশ সেকেন্ড। সোলায়মান বামীর স্টাডিতে ঢুকে আসলে দুনিয়ারই সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম খানিকক্ষণের জন্য। একটা বেশ কারুকাজ করা সেগুন কাঠের চেয়ারে বসা প্রৌঢ় সোলায়মান বামী সাহেবকে আমি সালাম দিয়েছিলাম কি না, তা-ও মনে পড়ছে না; কারণ, মাঝারি সাইজের ঘরটা আমার চোয়াল ঝুলিয়ে দিয়েছে, প্রথমবার মেলায় যাওয়া ছোট্ট শিশুর মতো চোখ রসগোল্লা করে চারপাশে নজর বোলাতে বাধ্য করেছে। কী নেই এই খুদে জাদুঘরের মতো ঘরটায়? চামড়ায় বাঁধাই করা হাজার হাজার দুর্লভ বই, দেয়ালে ঝোলানো আদিবাসীদের মুখোশ, তাকের ওপরে সাজানো গ্রিক মৃৎপাত্র, রোমান ঢাল, অষ্টাদশ শতকের ফ্রেঞ্চ মোমবাতিদানি, মোগল তৈলচিত্র, ক্লাইভের যুগের হ্যান্ডগান...আর না বলি, শেষ করতে পারব না। সবকিছু ভালোমতো দেখতেই বুঝি দিন সাতেক লেগে যাবে।
মাঝখানে মধ্যমণি হয়ে বসে থাকা সোলায়মান বামীও কিন্তু বেশ মানিয়ে যান এসব দ্রষ্টব্যের সঙ্গে, যেন তিনিও এসবেরই অংশ। ছেলের তুলনায় বেশিই যেন বৃদ্ধ তিনি, চামড়া ঢিলে হয়ে এসেছে, ঝুঁপো গোঁফটা এই বয়সে বেমানান। মাথায় চুল প্রায় গায়েব। দেয়ালে ঝোলানো ইরানি তলোয়ারের দিকে আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জানালেন, ওটা তাঁদেরই বংশের। পারস্যের বাম নগরী থেকে এসেছেন তাঁদের আদি পুরুষ, নামে যে পরিচয় বহন করছেন। এরপরই কৌতূহলী প্রশ্ন—আমার সঙ্গে ইরানের কোনো যোগাযোগ আছে কি না? আর্দশির শাপুর শিপলু নাম আমার। আর্দশির ও শাপুর যে প্রাচীন পারস্যের দুই বিখ্যাত সম্রাট, তা তো জানেন। তাহলে?
হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে কাজের কথায় চলে এলাম আমি। কড়কড়িয়ে বাজ পড়ার শব্দ ছাপিয়ে বললাম, ‘আপনার এই বাসায় নাকি খুব অদ্ভুত কিছু চুরি হয়ে চলেছে?’
সোলায়মান বামী জর্দা দিয়ে পান চিবাচ্ছেন, কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সুবাস পাচ্ছি। ‘হ্যাঁ। বিশেষ করে আমার এই স্টাডি থেকে। আমার দাদার শখ ছিল কিউরিও সংগ্রহ করার, আমার বাবা আর আমারও সেই বাতিক। দেখতেই পাচ্ছেন, নানান দেশের জিনিস আছে। তার মধ্যে কোনো কোনোটা অনেক দামি।’
‘কী কী জিনিস চুরি গেছে?’ আমার প্রশ্ন।
‘সুলতানি আমলের স্বর্ণমুদ্রা, রাজপুত গয়না, বক্সারের যুদ্ধের মেডেল...শিপলু সাহেব, চিঠিতে তো আমি বলেছি, জিনিস খোয়ানোর থেকেও বড় ভয়ের জিনিসটা হচ্ছে, জিনিসগুলো কীভাবে চুরি গেছে।’ শেষের কথাটা বলতে গিয়ে কণ্ঠটা কেঁপে উঠল সোলায়মান সাহেবের, কপালে ঘাম ফুটেছে এই শীত শীত আবহাওয়াতেও।
এর জন্যই আমার আসা, না হলে চুরির মামলা তো দেখবে পুলিশ। নড়েচড়ে বসলাম আমি, টেপ রেকর্ডার অন করেছি আগেই।
মাসখানেক আগের প্রথম ঘটনা। গভীর রাত পর্যন্ত স্টাডিতে বসে বই পড়ার অভ্যাস সোলায়মান সাহেবের। সেদিনও পড়ছিলেন। হুট করে আপনা থেকে খুলে গিয়েছিল ভেজানো দরজাটা, সেদিকে চোখ তুলে তাকাতেই প্রায় জ্ঞান হারানোর দশা।
‘বোঝাতে পারব না আপনাকে ব্যাপারটা। জিনিসটা একটা মানুষের মতো লম্বা, কিন্তু নিরেট কালো। যেন অন্ধকার দিয়ে তৈরি...চারপাশের সব আলো শুষে নিচ্ছিল। বিদ্যুৎ ছিল না, আমি একটা মোম জ্বালিয়ে বসে ছিলাম...ঠিক আমার সামনে এসে থামল কালো অবয়বটা। মোমটাও দপ করে নিভে গেল। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।’ সোলায়মান সাহেব কথা শেষ করামাত্রই যেন আবহ সংগীত হিসেবে আরেকটা বাজ পড়ল। বৃষ্টি আরও ঝেঁপে নেমেছে।
‘আপনাকে কিছু করেছিল ওটা?’ সামনে ঝুঁকে পড়েছি আমি।
‘সম্ভবত না। কোনো আঘাত তো টের পাইনি। জ্ঞান ফিরে পেয়ে ঘড়ি দেখে টের পেয়েছিলাম যে ঘণ্টা দুয়েক পেরিয়েছে। সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।’
‘জিনিস হারানোর ব্যাপারটা তখনই টের পান?’ প্রশ্ন করলাম।
‘না। তখন আসলে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, শরীর খারাপ করল কি না, সেই চিন্তায়। ভেবেছিলাম স্ট্রোক করেছে। সবাইকে ডেকে-টেকে আনলাম, আমার স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ, ম্যানেজার...’
‘এই বাড়িতে এই কয়জনই থাকেন?’ নোট নিতে নিতে বললাম।
‘হ্যাঁ। তো, আমার ছেলের বউ ডাক্তার, সে পরীক্ষা করে কিন্তু স্ট্রোকের কোনো লক্ষণ পায়নি বলল। আমার নিজেরও মোটেই অসুস্থ লাগছিল না, খালি ভয়টা বাদে। হাসপাতাল যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরি করলেও রাজি হলাম না। অদ্ভুত জিনিসটা দেখার কাহিনি বললাম সবাইকে। দেখি, মুখ–চাওয়াচাওয়ি করছে ওরা। বুঝলাম, কোনো গড়বড় আছে। চেপে ধরলাম। প্রথমে কেউই স্বীকার করতে চাইল না, পরে শুনি, সবাই–ই কখনো না কখনো ও রকম একটা ছায়াকে বাসার আনাচকানাচে দেখেছে। জিনিসটা হয় হুট করে ঘরে ঢোকে, নাহয় বেরিয়ে যায়, নাহয় করিডরে হাঁটাহাঁটি করে। ও হ্যাঁ, সব ঘটনাই হয়েছে রাতের বেলা।’ একটা পেতলের পানদানি থেকে আরেকটা খিলি বের করলেন সোলায়মান সাহেব।
‘তারপরই জিনিস চুরির ব্যাপারটা টের পান?’ আমার পায়ের কাছে কার্পেটের ওপরে একটা জমাট মোমের দাগ, সেটা জুতার ডগা দিয়ে ঘষতে ঘষতে বললাম।
‘একটু ধাতস্থ হওয়ার পর যখন সবাই ঘর ছেড়ে চলে গেল, তখন। আমার সামনেই খোলা ছিল কয়েনের কালেকশনটা...সেখান থেকে কয়েকটা আলাউদ্দিন হোসেন শাহর মোহর গায়েব।’
একমুহূর্ত ইতস্তত করে কঠিন প্রশ্নটা করেই ফেললাম, ‘বাসার কাউকে সন্দেহ হয়?’
সোলায়মান বামী রেগে যাওয়ার একটা সুযোগ ছিল, কিন্তু সেটা আমার অতি কল্পনামাত্র। শান্ত স্বরে জমিদারপুত্র বললেন, ‘হতো, আমি ঘরের বাইরে থাকা অবস্থায় তালা ভেঙে চুরি হলে। সত্যি বলতে কি, আমি ছাড়া আর কেউ এ ঘরে আসে না। জার্মান তালা আনিয়েছি, কম্বিনেশন লক। চাবি নকল করার উপায় নেই। শুধু আমি ঘরে থাকা অবস্থাতেই ছায়ামূর্তিটা ঢুকেছে, মোট তিনবার, আর তিনবারই কিছু না কিছু চুরি গেছে...’
‘তিনবারই আপনি জ্ঞান হারিয়েছিলেন?’
‘না। শুধু প্রথমবারই। তবু পরের দুবার এমন শকড হয়েছিলাম, নড়তেও পারিনি...জিনিসগুলো আমার সামনেই ছিল, বেশি দামি জিনিসগুলো এই সিন্দুকে রাখি, সেখান থেকে বের করেছিলাম। মূর্তিটার কালো একটা হাত তাতে লাগামাত্র ওগুলোও কালো হয়ে গেল, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ছায়াটা।’ সোলায়মান সাহেব কপালের ঘাম মুছলেন।
চুপচাপ ভাবলাম খানিক্ষণ, তারপর নরম কণ্ঠে আমার প্ল্যানটা খুলে বললাম সোলায়মান সাহেবকে। শেষ করে বললাম, ‘দেখুন, বিপদের আশঙ্কা আছে, কিন্তু সেটা আমি নিতে রাজি আছি। আর আপনাকে সামান্য স্যাক্রিফাইস করতে হবে। আমার হাতে ঘরটা ছাড়তে হবে সারা রাতের জন্য। চিন্তা নেই, কোনো কিউরিওর ক্ষতি হবে না।’
আমার কথা ফুরোনোর আগেই মাথা ওপর-নিচ করতে শুরু করেছেন সোলায়মান বামী। কম বিপদে পড়ে তো আর ডাকেননি আমাকে।
***
সোলায়মান বামীর বাহারি কারুকাজ করা চেয়ারটা কিন্তু বেশ আরামের। পায়ের ওপর পা তুলে ঘরের একমাত্র দরজাটার দিকে মুখ করে বসেছি। দরজার ঠিক ওপরে ঝোলানো একটা পেন্ডুলামওয়ালা ঘড়ির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে বারবার। রাতের খাবার খেয়েদেয়ে সেই ১০টায় বসেছি, এখন ১২টা বাজতে ১০। সব স্বাভাবিক, অবশ্য বাইরে ওই মেঘের লম্বা গুড় গুড় আর অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়াকে যদি আমলে না নেন আরকি।
আমার সামনে ডেস্কটা, তার ওপরে সাজিয়েছি নোটবুক-টেপ রেকর্ডার-ক্যামেরা। আর আছে একটা আংটি। ১৮ ক্যারেটের অতি সাধারণ আংটিটা আপনার নজর কাড়বে না, যদি আপনার জানা না থাকে যে ট্রাফালগার যুদ্ধের সেনাপতি নেলসনের সেকেন্ড ইন কমান্ডের বিয়ের আংটি এটা। ঠিক ধরেছেন, টোপ হিসেবে রাখা হয়েছে জিনিসটা। এমনিতে থাকে সিন্দুকের ভেতরে।
সময় কাটাচ্ছি লস্ট হরাইজন বইয়ের প্রথম এডিশনটা পড়ে। তিব্বত, তার দুর্গম বৌদ্ধ মঠ, সাংগ্রিলা বা সাম্ভালা—এই জিনিসগুলো নিয়ে পশ্চিমাদের ফ্যাসিনেশন শুরু হয়েছিল এই উপন্যাসের মাধ্যমে। দারুণ কালেকশন বামী পরিবারের।
একটানা পড়তে পারছি না অবশ্য, মনোযোগ ছুটে যাচ্ছে। পাহারায় তো বসলাম, কিন্তু সত্যি কিছু ঘটবে কি? হাড় হিম করা কালো অন্ধকারটা হাজির হবে আমার সামনে, না সারা রাত জেগে থাকাই কাল হবে? হয়তো শুধু এই বাসার মানুষের সামনেই আসে ওটা। কে জানে?
ভাবতে ভাবতেই কান খাড়া করলাম। কিসের যেন একটা শব্দ পাচ্ছি। পড়ার শব্দের ফাঁকে, বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ছাপিয়ে...নাহ্, কই। কিচ্ছু নেই। কানের ভুল বোধ হয়।
ছায়ামূর্তিটা নিয়ে ভাবছি। কী হতে পারে ওটা? বাসার সবাই দেখেছে, তাই হ্যালুসিনেশনের বহুল চর্চিত থিওরি বাদ। অতৃপ্ত আত্মা? জিন? অপদেবতা? কিন্তু যেটাই হোক, এত দিন কেউ দেখেনি কেন ওটাকে? ১০০ বছরের পুরোনো দালান। এত দিন কারও চোখে ভৌতিক কিছু পড়ল না?
আর জিনিসটা, কুচকুচে কালো, অন্ধকারের একটা গাঢ় টুকরার মতো...
বৃষ্টির শব্দটা হুট করে বেড়ে গেল যেন। বই থেকে ঝট করে মাথা তুললাম আমি।
দরজাটা ভেজানো ছিল, এখন খুলে গেছে ওটার একটা পাল্লা। সেদিক দিয়ে বারান্দার আলো দেখতে পাওয়ার কথা, কিন্তু আমি দেখছি আঁধার।
কুচকুচে কালো আঁধার।
আঁধারটা এগিয়ে এল, ঢুকল ঘরের ভেতর। মানুষের মতো আকার ওটার, একদম অমাবস্যার রাতের মতো কালো। শুধু তা–ই নয়, আশপাশের সব আলো শুষে নিচ্ছে যেন ওটা। ঘরের বাতির উজ্জ্বলতা যেন অর্ধেক হয়ে গেছে।
কড়কড় করে বাজ পড়ল খুব কাছে। থ হয়ে তাকিয়ে আছি আমি।
আঁধার অবয়বটা এগিয়ে এল আমার দিকে, এখন ডেস্কের ঠিক উল্টো দিকে ওটা। হাত বাড়ালেই পেয়ে যাবে অমূল্য আংটিটা...কিংবা আমার গলা।
খুব ধীর গলায় কথা বলতে শুরু করলাম আমি।
‘যে লোক ফাঁসিতে ঝুলে মারা যায়, জাদুবিদ্যার জগতে তার অসম্ভব দাম। বিশেষ করে সেই লাশের বাঁ হাতের। কী করতে হবে? ফাঁসি-খাওয়া লাশের ওই হাতটা কবজি থেকে কেটে নিতে হবে। কাফনের কাপড় দিয়ে সেটাকে শক্ত করে মোড়াতে হবে তারপর। তারপর লবণ-লবঙ্গসহ বেশ কয়েক রকম মসলায় ভরা একটা মাটির মটকায় সেই হাতটা ডুবিয়ে রাখতে হবে ঠিক ১৪ দিন-রাত। সব পানি বেরিয়ে যাবে এভাবে। তারপর হাতটা বের করে গ্রীষ্মের সবচেয়ে গরমের সময়ের রোদে ওটাকে শুকিয়ে মমি করে ফেলতে হবে।’
ছায়াটা একটা মিশমিশে কালো হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সামনে, কিন্তু আমার কথা শুনে স্থির হয়ে গেছে ওটা। আমার জিব শুকিয়ে এসেছে, কিন্তু তবু কথা থামালাম না। জানালার কাচে ঝনঝনি তুলে আরেকটা বাজ পড়ল কাছেই।
‘কোনো খুনির লাশ থেকে হাতটা কেটে নিলেও হবে, সে ক্ষেত্রে যে হাত দিয়ে খুন করেছে, সেটা লাগবে। কী হবে এই শুকনা হাত দিয়ে? একটা মোমবাতি ধরিয়ে দিতে হবে সেই হাতে। তারপর সেই মোম জ্বালিয়ে হাতটা নিয়ে ঘুরবেন, কেউ দেখতে পারবে না আপনাকে। সাধারণ মোম আলো দেয় আর এই মোম সব আলো শুষে নেয়। এই জাদুর উৎপত্তি প্রাচীন ইউরোপে। একে বলে হ্যান্ড অব গ্লোরি।’
ছায়ামূর্তিটা কি আরও কাছিয়ে এসেছে?
ঢোঁক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম আমি। ‘কী করে এত কিছু জানলাম? কারণটা...নিজেই দেখে নিন।’
পকেটে হাত বাড়িয়ে একটা জিপো লাইটার বের করে এসেছি আমি। পায়ের কাছে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিলাম আমার নিজের হ্যান্ড অব গ্লোরিটা, সব সময় আমার ব্যাগেই থাকে। চট করে আগুন ধরিয়ে নিলাম মমি হাতে ধরা মোমটায়। তারপর জিনিসটা তুলে ধরলাম মাথার ওপরে।
এক ফুঁৎকারে দূর হয়ে গেল ছায়ামূর্তিটার গায়ের সব আঁধার, দমকা হাওয়ায় একরাশ কালো ধোঁয়া উড়ে গেল যেন। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখন লোকটাকে। চেহারায় বিস্ময় আর রাগের সমসত্ত্ব মিশ্রণ, হাতে ধরা একটা মড়ার হাতে, সে হাতে জ্বলছে একটা মোম। আমার মোমের শক্তি আর ওটার শক্তিতে কাটাকাটি হয়ে গেছে, জাদুর শক্তি চলে গেছে ওটার।
ম্যানেজার রউফ সাহেব দাঁড়িয়ে আমার সামনে।
পড়তি জমিদারবাড়ির সাধু সেজে থাকা ধূর্ত ম্যানেজার ঘুরে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আমিও কম অ্যাথলেটিক নই। এক লাফে ডেস্কটা পেরিয়ে রাগবি-ট্যাকল করে ফেলে দিলাম মাটিতে।
লোকটাকে মাটিতে চেপে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে হাসছি আমি। পায়ের শব্দ পাচ্ছি, বাসার সবাই দৌড়ে আসছে এদিকে। বললাম, ‘ভালো লাগছিল না আর এই চাকরি। উন্নতির কোনো আশা নেই, চাকরি ছেড়ে দেবেন...কিন্তু তার আগে পকেটটা তো ভারী করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? দামি জিনিসগুলো বুড়োটা দামি তালা মেরে রাখে। দরজা শুধু খোলা থাকে তখনই, যখন বুড়োটা ভেতরে থাকে। এভাবেই বুদ্ধিটা পেলেন। অকাল্ট নিয়ে হয়তো পড়াশোনা ছিল, পাশের শ্মশান থেকে কাটা হাত সংগ্রহ করতে কষ্ট হয়নি। তারপর আর কী? চুরি শুরু করলেন সবার সামনেই, কেউ দেখতে পাচ্ছে না! খালি ভুল করে ফেলেছেন আমার সামনে ওই জিনিস নিয়ে হাজির হয়ে। বুঝতে হয়তো পারেননি, আমার কাজই এসব নিয়ে গবেষণা করা, চিঠি পড়েই ব্যাপারটা বুঝে নিজের সংগ্রহের হ্যান্ড অব গ্লোরিটা নিয়ে ছুটে এসেছি এখানে!’