ওই ঘটনার পরদিন স্কুল বন্ধ ছিল। পরদিন স্কুলে গেল রাফিন।
সে খেয়াল করল, আড়চোখে সবাই তাকাচ্ছে তার দিকে। তবে ওই দিনের দলনেতাকে ছুড়ে ফেলার ঘটনাটা সবাই জেনে গেছে। রাফিন খেয়াল করল ওই মারদাঙ্গা চারজনের দুজন আজ আসেনি। ছুড়ে ফেলা ছেলেটা আর ওদের দলনেতা। ছুড়ে ফেলার পর রাফিন আরও কিছু করেছিল কি না, ঠিক মনে করতে পারছে না রাফিন। ঘটনার শেষটা তার মনে নেই। এটা তার একটা রোগবিশেষ, কিছু কিছু বিষয় সে ভুলে যায়। বাবাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল।
‘বাবা, আমার এমন হয় কেন?’
‘কেমন হয়?’
‘ওই যে কিছু কিছু জিনিস মনে করতে পারি না।’
‘শর্ট টাইম মেমোরি লস, এটা কেন হয় জানিস?’
‘কেন হয়?’
‘এটা তুই আমার থেকে পেয়েছিস। জিন টু জিন ট্রান্সফার। পরে তো মনে পড়ে?’
‘হ্যাঁ, পরে মনে পড়ে।’
‘যেমন ধর, তুই স্কুলে গেলি। ক্লাসে বসলি। তোর স্যার তখনো আসেনি। হঠাৎ সময় উল্টে গেল।’
‘মানে?’
‘আহা ধর যে সময় হঠাৎ করে উল্টো দিকে চলতে শুরু করল। থার্মোডায়নামিকসের সেকেন্ড ল...’
এই এক সমস্যা। বাবাকে কিছু বললে সে তার ক্লাসের বক্তৃতা শুরু করে দেয়। শুনতে খারাপ লাগে না। আবার অত ভালোও লাগে না। অনেক কিছু রাফিন বুঝতেও পারে না, মাথার ওপর দিয়ে যায়, সহজ ব্যাখ্যায় বাবা যান না কখনোই।
‘...মাইক্রোলেভেলে সময় উল্টে যাওয়া কোনো ব্যাপার না। আরও সহজ করি বলি...ধর তোর সময় উল্টে গেল। তুই পেছাতে শুরু করলি। পিছিয়ে পিছিয়ে আবার বাসায় চলে এলি। এখন যেটা হলো, তোর দুটি স্মৃতি। ভবিষ্যতের স্মৃতি আর অতীতের স্মৃতি—মাঝখানে তুই...।’
‘কিন্তু আমি তো ভবিষ্যতে যাইনি।’
‘তু্ই হয়তো যাসনি, কিন্তু তোর অবচেতন মন ভবিষ্যতে যায়নি, সেটা কী করে বলবি? তখনি কিছু স্মৃতি সাময়িকভাবে স্মৃতিভ্রংশ হয়। এ যেন বস্তু ও প্রতিবস্তুর সংঘর্ষ...অতীত স্মৃতি আর ভবিষ্যৎ স্মৃতির সংঘর্ষ, এটা অবশ্য আমার নিজস্ব ধারণা। ভুলও হতে পারে...।’
‘রোল নম্বর ১৮?’ স্যারের চিত্কারে সংবিৎ ফিরে পায় রাফিন।
‘স্যার, ও আসেনি। ১৮, ১৯ দুজনই আসেনি। ওরা হাসপাতালে।’ ক্লাস ক্যাপ্টেন রাশনা দাঁড়িয়ে বলল। তবে আড়চোখে রাফিনের দিকে তাকাতে ভুলল না।
‘হাসপাতালে কেন?’
‘স্যার, একজনের কোমরে ফ্র্যাকচার, আরেকজন কাগজ খেয়ে ফুড পয়জনিং।’ কাগজ খাওয়ার কথা শুনে ক্লাসের সবাই হেসে উঠল। রাফিন খেয়াল করল, সবাই ঘুরে ঘুরে তার দিকে তাকাচ্ছে। তার মানে কি ওই ১৯ রোলের লিডারটাকে ও উল্টো কাগজ খাইয়েছিল?
সেদিন আর ক্লাসে তেমন কিছু ঘটল না। টিফিন পিরিয়ডে যখন তার জায়গায় বসে রাফিন টিফিন খাচ্ছিল। ক্লাস মোটামুটি ফাঁকা। তখন ক্লাস ক্যাপ্টেন রাশনা তার সামনে এসে দাঁড়াল।
‘ক্লাসে বসে টিফিন খাওয়া যাবে না।’
‘মানে?’
‘বাংলা বোঝো না? ক্লাসে বসে টিফিন খাওয়া যাবে না। ক্লাস নোংরা হয়।’
‘নোংরা হলে আমি পরিষ্কার করে দেব।’ বলে প্যাটিসে কামড় দিল রাফিন। ঝুরঝুর করে কিছু ভাঙা প্যাটিসের টুকরা মাটিতে পড়ল। কটমট করে তাকাল ক্লাস ক্যাপ্টেন। ফিসফিস করে ‘বেয়াদব’ বলে চলে গেল। রাফিন ক্লাসের বাইরে গিয়েই খেতে পারত; কিন্তু মেয়েটার বলার ভঙ্গিতে তার রাগ উঠেছে।
তখনই ক্লাসের চশমা পরা রোগা ছেলেটা এসে বসল সামনের বেঞ্চে। মনে হলো কিছু বলবে, বলল,
‘আমি কবীর।’
‘আমি রাফিন।’
‘তুমি কারাতে জানো?’
‘মানে?’
‘মানে ওই দিন যেভাবে সানোয়ারকে ছুড়ে ফেললে, কারাতে না জানলে...’
‘অ্যা...ইয়ে মনে হয় জানি।’ মিথ্যা বলল রাফিন।
‘আমি কারাতে জানি। সামনের মাসে ব্ল্যাক বেল্ট পাব। তবে তুমি কাজটা ঠিক করোনি।’
‘কোন কাজটা?’
‘সানোয়ারকে ওভাবে ছুড়ে ফেলাটা। ও এখন হাসপাতালে, ওর যদি সে রকম কিছু হয়, তাহলে তোমার কিন্তু খবর আছে। আর রমিজকে কাগজ খাওয়াতে গেলে কেন?’
‘ও-ই তো আমাকে কাগজ খাওয়ানোর চেষ্টা করল প্রথমে।’ রাফিনের তখন সব মনে পড়তে শুরু করেছে।
তখনই একটা বাজখাঁই গলা শোনা গেল। ‘রাফিন রিয়াজ! রোল ৩৪ কে?’
‘আমি।’ হাত তুলল রাফিন। দরজায় দপ্তরি তৌহিদ দাঁড়িয়ে।
‘হেডস্যার ডাকে, জলদি।’
রাফিন উঠে দাঁড়াল। কবীর ফিসফিস করল। ‘বলেছিলাম না? তোমার খবর আছে। মনে হয় খবর শুরু হলো তোমার...!’
রাফিনের প্রথমে মনে হয়েছিল কবীর ছেলেটা তার পক্ষেই কথা বলতে এসেছে; এখন মনে হচ্ছে উল্টো। কবীরের ঠোঁটের কোনায় মুচকি হাসি।
হেডস্যারের রুমে গিয়ে দেখে ছোট চাচা গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তাঁকে দেখে অবশ্য মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেল।
‘কিরে প্রথম দিনেই মারামারি করে দুজনকে হাসপাতালে পাঠালি?’
‘আমি মারামারি করতে যাইনি। ওরাই স্কুল ছুটির পর আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।’
‘কেন? ওরা কারা?’ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নটা করলেন হেডস্যার।
‘ওরা পাঁচ–ছয়জন ছিল, আমাদের ক্লাসেরই; ওরা বলল স্কুলে নতুন ভর্তি হলে কিছু নিয়মকানুন আছে।’
‘কী নিয়ম?’
‘কাগজ খেতে হবে।’
‘কাগজ খেতে হবে?’ হেডস্যার আর ছোট চাচা একসঙ্গে বলে উঠলেন। হো হো করে হেসে উঠলেন ছোট চাচা। হেডস্যার অবশ্য হাসলেন না।
‘তারপর?’
‘তারপর আমি বললাম, কাগজ খাব না।’
‘আহা, খাবি না বললি কেন? একটু খেতি।’ ছোট চাচার গলায় ঠাট্টার সুর।
‘তখন ওরা একজন আমাকে চেপে ধরল, আরেকজন মারতে এল।’ রাফিন তার কথা শেষ করল।
‘তখন তুমি ওদের পাল্টা মারলে?’
‘হ্যাঁ।’
চলবে সংশোধনী: এই উপন্যাসটির নাম কিশোর আলোর মার্চ সংখ্যায় 'উড়তে জানা ছেলেটা' লেখা হয়েছে। অনাকাঙ্খিত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত।