ভবিষ্যৎ
‘আপনে হাসান সাহেব?’
সরু গলিটার মুখে অবস্থিত লাইটপোস্টটার নিচে দাঁড়িয়ে মফিজের জন্য অপেক্ষা করছিল হাসান। চারদিকে রীতিমতো পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ হঠাৎ সামনে দিয়ে একটা ছুঁচোর তরতর করে দৌড়ে যাওয়া কিংবা দূরে কোথাও একটা কুকুরের একবার-দুবার ডেকে ওঠার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই নেই আশপাশে।
সেই নীরবতা ফুঁড়ে আচমকা একটা অপরিচিত এবং বাজখাঁই কণ্ঠ ভেসে আসতেই চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকাল সে। দেখল, কালো রঙের শার্ট পরা শীর্ণকায় এক লোক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। লাইটপোস্টের টিমটিমে হলদেটে আলোয় লোকটার চেহারা দেখল হাসান। না, এ মফিজ নয়। তার পরিচিত কেউ-ও নয়।
‘কে এই লোক? আর আমার নামই-বা কীভাবে জানে?’ মনে মনে ভাবল হাসান। মুখে বলল, ‘জ্-জি। আপনি?’
‘আমারে মফিজ ভাই পাঠাইছে। হ্যায় অন্য জায়গায় আটকায়ে গেছে।’
হাসান লক্ষ করল, লোকটার এক হাতে বাজারের ব্যাগে মোড়ানো কিছু একটা আছে। সেটা একনজর দেখে নিয়ে তারপর আবার লোকটার দিকে তাকাল সে। এরপর পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে সেখান থেকে এক হাজার টাকার তিনটা নোট বের করে এগিয়ে দিল লোকটার দিকে।
হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল লোকটা। খসখস করে ঘষে পরীক্ষা করে দেখল নোটগুলো, তারপর হাসানের দিকে তাকিয়ে খনখনে গলায় বলল, ‘বকশিশ দিবেন না?’
‘বকশিশ?’ অবাক হলো হাসান। ‘মফিজ ভাই তো কখনো বকশিশ নেন না!’
‘ওইডা মফিজ ভাইয়ের লগে আপনের হিসাব। আমার হিসাব আলাদা।’
‘কিন্তু...’
বিরক্তির ছাপ প্রকট হয়ে উঠল লোকটার চোখে-মুখে। হাজার টাকার নোট তিনটি আবার হাসানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ধমকের সুরে সে বলল, ‘রাখেন মিয়া আপনের ট্যাকা! যত্তসব!’
‘ঠিক আছে ভাই, ঠিক আছে! দিচ্ছি দাঁড়ান!’ হাসান দ্রুত নিজের মানিব্যাগটা বের করে আনল আবার। সেখান থেকে ২০০ টাকার একটা নোট বের এগিয়ে দিল লোকটার দিকে।
‘আর ১০০ দেন!’ লোকটা বলল কাঠ কাঠ গলায়।
নিরুপায় হাসান আরও ১০০ টাকার নোট বের করে মোট ৩০০ টাকা এগিয়ে দিল লোকটার দিকে। লোকটা হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে আগের তিন হাজার টাকাসহ নিজের পকেটে গুঁজে রাখল। তারপর ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে অন্য হাতে ধরা বাজারের ব্যাগে মোড়ানো জিনিসটা এগিয়ে দিল হাসানের দিকে।
হাসান দুহাত বাড়িয়ে ধরল জিনিসটা। তারপর বাজারের ব্যাগটার ভেতর থেকে খানিকটা অংশ বের করে দেখল সে। অসন্তোষের কালো মেঘ জমল তার চেহারায়। মফিজ ভাইয়ের পাঠানো লোকটার দিকে তাকিয়ে একই সঙ্গে অসন্তুষ্ট এবং অসহায় কণ্ঠে সে বলল, ‘ভাই, পরিমাণে একটু কম আছে বলে মনে হচ্ছে।’
‘নিলে নেন, না নিলে নিয়েন না!’ আবারও বিরক্তির ছাপ প্রকট হয়ে উঠল লোকটার মুখমণ্ডলে। কঠিন গলায় সে বলল, ‘এত কথা বলেন ক্যান?’
ধমক খেয়ে মিইয়ে গেল হাসান।
‘নিবেন আপনে? নাকি ট্যাকা ফিরত দিমু?’
‘না ভাই, ঠিক আছে।’ নতি স্বীকার করে নিল হাসান। জিনিসটা আবার বাজারের ব্যাগে মুড়িয়ে নিতে নিতে সে দুর্বল স্বরে বলল, ‘যা দিয়েছেন তা-ই সই।’
‘হুমম।’
মাথা দোলাল লোকটা। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরল গলিটার অন্য প্রান্তের দিকে। দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। তার গমনপথের দিকে কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল হাসান। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরল সে।
টাকাও নিল বেশি, পরিমাণেও দিল কম! হাঁটতে হাঁটতে হাসান ভাবল আপনমনে। এতটুকুতে আর কদিন চলবে?
ছোটখাটো একটা চাকরি করে সে। বেতন মোটে ৩৫ হাজার টাকা। মাসের শেষে তার সঞ্চয়ের খাতায় কিছুই থাকে না বলতে গেলে। থাকবে কী করে? প্রতি তিন-চার দিন পরপর এ রকম এক ধাক্কায় আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে যায় তার!
তা-ও ভালো যে সে একা মানুষ, বিয়েশাদি কিছুই করেনি। বিয়েশাদি করে একটা সংসার সে পেতে বসতেই পারত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিটি খাতের খরচ হয়ে যেত দ্বিগুণ, যেটা মাত্র ৩৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে সামলানো তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না।
‘কই যান, ভাই?’
থমকে দাঁড়াতে হলো হাসানকে। তার সামনে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে গাট্টাগোট্টা এক লোক। হাসি জিনিসটা যে সব সময় স্নিগ্ধ ও সুন্দর হয় না, কখনো কখনো ভীতিকরও হয়, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ লোকটার মুখে ফুটে থাকা ক্রূর হাসিটা।
‘ভাইজানের ব্যাগের ভিত্রে কী?’ হাসানের ডান হাতে ধরে রাখা বাজারের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে খসখসে গলায় বলল লোকটা। তার দুই চোখে হিংস্র শ্বাপদের চাহনি।
এরই মধ্যে রাস্তার দুই পাশ থেকে আরও দুজন লোক এসে দাঁড়িয়ে গেল হাসানের দুই পাশে। পেছন ফিরে না তাকিয়েও সে টের পেল, তার পেছনেও এসে দাঁড়িয়েছে আরেকজন। আতঙ্কের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল হাসানের শিরদাঁড়া বেয়ে। তার আর বুঝতে বাকি নেই এরা কারা এবং কী চায় তার কাছ থেকে।
‘ভাইজান কি বয়ড়া? কানে শোনেন না?’
‘জ্-জি শুনি।’ ভয়ে তোতলাতে লাগল হাসান। দুর্বল স্বরে সে বলল, ‘ব্যাগে বা-বা-ব্বাজার।’
‘বাজার?’ আরও চওড়া হলো লোকটার মুখের হাসি। এক পা এক পা করে হাসানের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল সে। ‘কী বাজার করলেন এত রাইতে?’ হাসানের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। ‘ব্যাগটা দেন। দেহি কী বাজার করলেন!’
ব্যাগটা তুলে হাসান নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে এল তার মুখ। অনুনয়ের সুরে সে বলল, ‘বি-বিশ্বাস করেন ভাই, ব্যাগের ম-ম-অধ্যে সত্যিই বা-আজা...!’
কথা শেষ করতে পারল না হাসান। তার আগেই কোমরে চোখা এবং ধারালো একটা ধাতব স্পর্শ অনুভব করল সে।
‘চুপচাপ ব্যাগটা দিয়া দেন।’ পেছনের লোকটা হিসহিস করে বলল, ‘নাইলে কইলাম ভুঁড়ি গাইল্যা দিমু!’
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল হাসান। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সামনের লোকটার দিকে।
‘কী হইল? দেন!’ ধমকে উঠল দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের মধ্য থেকে একজন। সামনের লোকটা তখনো হাত বাড়িয়েই আছে।
নিরুপায় হাসান আর কী করবে? করার মতো কীই–বা অবশিষ্ট আছে তার? অগত্যা হাতের ব্যাগটা এগিয়ে দিল সে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে। ব্যাগটা তার হাত থেকে নিয়ে ভেতরে থাকা জিনিসটা বের করে এনে লোকটা নিজে প্রথমে উল্টেপাল্টে দেখল, তারপর তুলে ধরে বাকিদেরও দেখাল। সবার চেহারায়ই ফুটে উঠল একটা সন্তুষ্টির ছাপ। হাসানের সামনে দাঁড়ানো লোকটা আবার ব্যাগের ভেতরে পুরে রাখল জিনিসটাকে।
‘ঠিক আছে ভাই, আসি আজকে।’ গাট্টাগোট্টা লোকটা হাসানের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘ভালো থাইকেন।’ নিজের সঙ্গীদের দিকে তাকাল লোকটা। ‘এই, তাড়াতাড়ি চল!’
‘চলেন ওস্তাদ!’
চারজনের দলটা হাঁটা ধরল মাত্রই হাসানের কাছ থেকে ছিনতাই করে নেওয়া বাজারের ব্যাগটা দোলাতে দোলাতে। তাদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধপাস করে রাস্তার ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল হাসান।
মাস শেষ হতে এখনো আরও চার দিন বাকি। এ মাসের বেতনের টাকা যা অবশিষ্ট ছিল, তা দিয়েই খানিকটা খাবার পানি কিনেছিল সে। সেটাও ছিনতাই হয়ে গেল! ওদিকে ঘরে তার একফোঁটাও খাবার পানি অবশিষ্ট নেই! কদিন বাঁচবে সে পানি না খেয়ে?
ফ্যালফ্যাল করে কতক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে একপর্যায়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না হাসান, ভেঙে পড়ল কান্নায়। অঝোর ধারায় কাঁদতেই থাকল সে।
আজ থেকে তিন বছর আগে পুরো পৃথিবীতে দেখা দেয় সুপেয় পানির সংকট। অবশ্য এই সংকটে যে পুরো পৃথিবীই ভুক্তভোগী, তা কিন্তু নয়। ভুক্তভোগী কেবল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো, যার মধ্যে বাংলাদেশও একটি। আর উন্নত বিশ্ব? তাদের আবার চিন্তা কিসের? তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ পানির উৎস তো তাদের দখলে!
এই সংকট শুরু হওয়ারও বেশ কিছু বছর আগে যখন উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলো এ দেশে নিজেদের শাখা খুলছিল, তখন হাসানের মতো মানুষেরাই তাদের নিয়ে হাসাহাসি করেছিল। বলেছিল, ‘বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামানো কোম্পানিগুলোর মালিকদের মনে হয় মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে! না হলে এরা কী দেখেছে আমাদের এই গরিব দেশে, যে এখানে ব্যবসা করতে এসেছে?’
হাসানের মতো মানুষেরা তখন না বুঝলেও এখন হারে হারে টের পাচ্ছে যে ওই বিদেশি ব্যবসায়ীরা এই দেশে কী দেখে এসেছিল। তারা যা দেখেছিল, তা হাসানরা কখনোই দেখেনি। কিংবা দেখতে চায়নি!
তারা দেখেছিল ভবিষ্যৎ।