মায়ের জন্য অপেক্ষা

ঘড়ি দেখল তাসমিয়া। বিকেল ৪টা ৫০ বাজে। আর ১০ মিনিট পর ৫টা বাজবে। সারা দিন এই ৫টা বাজার জন্যই অপেক্ষা করে তাসমিয়া। কারণ, ৫টার সময় ওর আম্মু বাসায় আসেন। আম্মু আসার আগমুহূর্তের সময়টা যেন কাটতেই চায় না। আসলে তাসমিয়ার আম্মু সরকারি চাকরি করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেই সকাল আটটার সময় চলে যান। দুই শিফটের স্কুল ছুটি দিয়ে আসতে আসতে বিকেল পাঁচটা বেজে যায়। তাসমিয়া ক্লাস সেভেনে পড়ে। কোনো ভাইবোন নেই। তাই নিজের স্কুল থেকে এসে একা একাই সময় কাটাতে হয় তাকে। স্কুলের হোমওয়ার্ক, কোচিংয়ের পড়া সব শেষ করে ফেলে। কিন্তু সময় আর কাটে না। সময় কাটাতে গল্পের বই পড়ার অভ্যাস করেছিল। কিন্তু বই পড়ে কতক্ষণ আর কাটানো যায়? আব্বুও ব্যস্ত মানুষ, সময় দিতে পারেন না। তাই সারা দিন আম্মুর আসার প্রতীক্ষায় বসে থাকে সে। আম্মু স্কুল থেকে বাসায় এসে তার সঙ্গে অনেক মজা করেন, মোটেই অন্য অনেক মায়ের মতো শুধু পড়ার কথা বলেন না; বরং প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই আদর করেন তাসমিয়াকে। সারা দিন সময় দিতে পারেন না বলেই বোধ হয়।

তাসমিয়া আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটা বেজে এক মিনিট। আম্মুর আসার সময় হয়ে গেছে। তাসমিয়া গিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। এই বারান্দা থেকে বাসার সামনের রাস্তার খানিকটা দেখা যায়। এদিক দিয়েই আসবেন ওর আম্মু। তাসমিয়া গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইল। আশপাশের বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খেলা করছে। কা কা করে একঝাঁক কাক উড়ে গেল। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আরেকটু পরই সন্ধ্যা নামবে। শীতকাল এসে যাওয়ায় এখন বেশ তাড়াতাড়িই সন্ধ্যা হয়ে যায়। শীতকাল তাসমিয়ার খারাপ লাগে না। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হয়। কাজিনদের সঙ্গে মিলে ব্যাডমিন্টন খেলে, সকাল সকাল দাদির বানানো ভাপা পিঠা খেয়ে বেশ মজার একটা সময়ই কাটানো হয়।

আরও পড়ুন

এবার শীতে ওরা যাবে ওদের নানুবাড়ি। সেখানেও মজা কম নয়। ওর নানুর বানানো পাটিসাপটা পিঠার সুখ্যাতি গ্রামজুড়ে। এ ছাড়া আছে কনকনে শীতের রাতে লেপ মুড়ি দিয়ে বসে নানার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা। ওর নানা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। তাসমিয়া আবারও ঘড়ি দেখল। ৫টা ২০ বাজে। আজ আম্মু একটু বেশিই দেরি করছেন। এত দেরি তো কখনো করেন না। ড্রয়িংরুম থেকে ফোনের রিংটোন শোনা গেল। বাসার ফোনটা বাজছে। তাসমিয়া গিয়ে দেখে আম্মুর নম্বর। আম্মু এখন ফোন কেন দিলেন? তাসমিয়া গিয়ে ফোন ধরল।

‘হ্যালো।’

ফোন থেকে আম্মুর বদলে একজন লোকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

‘হ্যালো, এটা কি আফরোজা ম্যাডামের বাসার নম্বর?’

‘জি,আমি ওনার মেয়ে। আপনি কে বলছেন?’

‘আমি নাজমুল হাসান, চরপাড়া থেকে বলছি। এখানে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আফরোজা ম্যাডাম যে রিকশাতে করে আসছিলেন, সেই রিকশার সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষ হয়। আফরোজা ম্যাডাম স্পট ডেড। হ্যালো...আপনি কি শুনছেন?...’

তাসমিয়ার হাত থেকে ফোনটা ফ্লোরে পড়ে গেল। মুহূর্তে পেছনের কভার খুলে গিয়ে ফোনটা অফ হয়ে গেল। তাসমিয়ার চোখ অশ্রুতে ভরে যাচ্ছে। ও আবার বারান্দায় গেল।

এখনো আসছে না কেন আম্মু? আর কত প্রতীক্ষা করবে ও?

লেখক: শিক্ষার্থী, সপ্তম শ্রেণি, আফরোজ খান মডেল স্কুল, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন