তার মানে সেই বিশ্বকাপ ট্রফি এখন আপনার কাছে?’ চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করলাম আমি।
বুড়ো লোকটার নাম ব্রায়ান হিডিংস। একসময় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড় কর্তা ছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ সংস্থার হয়ে বিশ্বের নানা প্রান্ত ঘুরে ঘাঘু অপরাধী ধরেছেন। তাঁর দাড়ি-গোঁফে ঢাকা মুচকি হাসি দেখে ঠিক বুঝতে পারলাম না, তিনি রসিকতা করছেন কি না।
ব্রায়ানের সঙ্গে আমার পরিচয় পর্বটা বেশ মজার। তখন আমি সদ্যই লন্ডনে এসেছি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চ সে সময় একটু একটু করে ফিকে হতে শুরু করেছে। তার বদলে আমার ওপর জেঁকে বসেছিল তীব্র হোমসিকনেস। ক্লাসে বসে ফিলোসফির কঠিন কঠিন থিওরি শুনতাম, আর মনে হতো মায়ের হাতের এক বাটি ঘন ডালের বিনিময়ে আমি এই সবকিছু ছেড়ে যেতে রাজি আছি।
মাঝেমধ্যে খুব কান্না পেত। কিন্তু উপায় নেই। দেশ থেকে কেউ ফোন করলে হাসিমুখে কথা বলতে হতো। হি হি হা হা শেষ করে ডর্মে আমার ঘরে যখন একা হয়ে যেতাম, মনে হতো এই বিশাল শহরে আমাকে নিয়ে ভাবার কেউ নেই। জ্বর হলে কেউ কপালে হাত দিয়ে দেখবে না। কেউ বলবে না, ‘বাহ্, লাল সোয়েটারে তো তোমাকে দারুণ লাগছে!’
আমাদের ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়েই টেমস নদী বয়ে গেছে। নদীটা আমার কাছে কেন যেন বড্ড প্রাণহীন লাগে। তাই নাম দিয়েছি ‘রোবট নদী’। মন খারাপ হলে রোবট নদীর তীরে একা একা বসে থাকতাম। সে সময়ই ব্রায়ানের সঙ্গে পরিচয়।
ব্রায়ান প্রতিদিন তাঁর পোষা কুকুর শার্লককে (কুকুরের নাম কেন শার্লক, সে-ও এক লম্বা গল্প) নিয়ে নদীর ধারে হাঁটতে আসতেন। আর প্রায় প্রতিদিনই আমাকে বসে থাকতে দেখতেন। একদিন বলেই ফেললেন, ‘আর ইউ ওকে সান?’ এটুকু শুনেই কেন যেন আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সেই থেকে সখ্য।
বিশাল বাড়িটাতে ব্রায়ান একা একা থাকেন। সুযোগ পেলেই আমি তাঁর বাড়িতে চলে আসি। নানা গল্প শুনি। এসবের মধ্যেই ব্রায়ান হঠাৎ একদিন বলে বসলেন, ‘তুমি কি জানো, ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জেতার পর ম্যারাডোনার হাতে যে ট্রফিটা দেওয়া হয়েছিল, সেটা নকল?’
অবাক হয়ে বলেছিলাম, ‘না তো!’
তখন ব্রায়ান একটা অদ্ভুত গল্প শোনালেন।
‘ফাইনালের আগের দিন রাতেই কাপটা চুরি হয়ে গিয়েছিল। আয়োজকদের মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়েছে। যেহেতু বেশ কয়েকটা রেপ্লিকা বানানোই থাকে, পরদিন আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না। কিন্তু এত কঠোর নিরাপত্তা ভেদ করে চুরিটা হলো কীভাবে, সেটাই কেউ ধরতে পারছিল না।’
‘জীবনে প্রথম শুনলাম! এত বড় ঘটনা পত্রিকায় এল না? এই ঘটনা নিয়ে কোনো ভ্লগ হলো না, সিনেমা হলো না?’
‘না। কারণ টপ অথরিটির সবাই মিলে ঘটনাটা চেপে গিয়েছিল।’
‘তারপর?’
‘আমি যখন ব্যাপারটা জেনেছি, তখন প্রায় চার বছর পেরিয়ে গেছে। নানা হাত ঘুরে কাপটা তখন লন্ডনে। খোঁজ পেয়েছিলাম, ডালউইচের এক চোরাকারবারির কাছে কাপটা আছে। প্রথমে আমাদের ইউনিটের কেউই ব্যাপারটা বিশ্বাস করেনি। তারপরও টিম ভাবল, একবার পরখ করেই দেখা যাক।’
কথা বলতে বলতে ব্রায়ান হাঁটছিলেন। বাড়িটা বিশাল বড়। তাঁর পিছু পিছু পৌঁছে গেলাম লাইব্রেরি ঘরে। ব্রায়ান বলতে থাকেন, ‘লোকটা একা ছিল। অতএব পুরো বাড়িটা দখলে নিতে আমাদের ৩ মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু মুশকিল হলো, আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়েই চোরটা নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করে। এরপর পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমরা বিশ্বকাপ তো দূরের কথা, একটা চায়ের কাপও পাইনি। অন্তত ইউনিটের সবাই তা-ই জানে।’
মুচকি হাসলেন ব্রায়ান। আমার আর তর সইছিল না। বললাম, ‘আসলে পেয়েছিলেন?’
হেসে মাথা দোলালেন বুড়ো। বললেন, ‘তখন আমার বয়স প্রায় ৬০। চাকরির সময় শেষ হয়ে এসেছে। সারা জীবন এই চাকরির নেশায় বিয়ে থা করিনি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সবার সঙ্গে দূরত্ব হয়ে গেছে। ভাবছিলাম, এত বছর এত ত্যাগের বিনিময়ে আমি কী পেলাম? স্রেফ কিছু টাকা? অথচ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কত মিশনে গিয়েছি। গুলি খেয়েছি। রাতের পর রাত জেগে থেকেছি। দিনের পর দিন বাড়ি ফিরিনি। এত কিছুর বিনিময়ে একটা বিশ্বকাপ তো আমি পেতেই পারি। জিনিসটা লুকিয়ে ফেলেছিলাম।’
আমি মনে মনে হিসাব করার চেষ্টা করছিলাম, বুড়োর বয়স এখন তাহলে কত? বিশ্বকাপের চার বছর পর বয়স যদি ৬০ হয়…
‘৯২,’ ব্রায়ান বললেন। আমার মনের কথা তিনি কী করে পড়ে ফেললেন!
‘আমি জানি, তুমি মনে মনে ভাবছ, কাজটা আমি ঠিক করিনি। হ্যাঁ, সে কথা ঠিক। কিন্তু বিশ্বকাপটা নিজের কাছে রেখে একটা অসুস্থ আনন্দ পেয়েছি। ভেবে দেখো, তোমাদের ভিনগ্রহের খেলোয়াড় মেসিও বিশ্বকাপের ট্রফি বুকে নিয়ে ঘুমায়, আমিও। আমাদের মধ্যে কত মিল। হা হা হা হা!’
ব্রায়ানের হাসিটা উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাল। আমার কেন যেন খুব মন খারাপ হলো। লোকটার প্রতি একটা অন্য রকম শ্রদ্ধা ছিল। দূরের দেশে আমার একমাত্র কাছের মানুষটাও এ রকম একটা অন্যায় করেছে, ব্যাপারটা মানতে পারছিলাম না। ইচ্ছা হচ্ছিল তখনই তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। কিন্তু বিশ্বকাপটা একনজর দেখার লোভও সামলাতে পারছিলাম না।
ব্রায়ান এবারও আমার মনের কথা পড়ে ফেললেন। বললেন, ‘কী? একবার দেখতে চাও, তাই তো?’
এরপর ব্রায়ান যা বললেন, আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ‘শুধু দেখাতে নয়, আমি জিনিসটা তোমাকে দিয়ে দিতে চাই। ইনফ্যাক্ট, সে জন্যই আজকে তোমাকে ডেকেছি।’
‘আপনি রসিকতা করছেন, তাই না?’
ব্রায়ান হাসলেন। কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, ‘৪০ বছরের ক্যারিয়ারে আমি কোন স্কিলটা সবচেয়ে ভালো রপ্ত করেছি, জানো? মাইন্ড রিডিং। যেকোনো মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি তার মনের গভীরে ডুব দিতে পারি। তোমার মনের ভেতর উঁকি দিয়ে খুব অবাক হয়েছি। তুমি একটা দারুণ ছেলে। মেধাবী। কনফিডেন্ট। অথচ ভেতরটা পুরোটাই আবেগ। এত আবেগপ্রবণ মানুষ আমি আগে দেখিনি। হয়তো তোমরা বাঙালিরা সবাই এমন। আমি জানি না। কিন্তু তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। বেশ পছন্দ হয়েছে।’
আমি কী বলব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এমনকি ব্রায়ানের কথা খুব একটা মন দিয়ে শুনছিলামও না। আমার মাথায় যা ঘুরছিল, সেটা খুব হাস্যকর। ভাবছিলাম, ব্রায়ান যদি সত্যিই আমার হাতে এখন একটা বিশ্বকাপ ট্রফি ধরিয়ে দেন, জিনিসটা নেব কী করে? ব্যাগ আনিনি। ব্রায়ানের কাছ থেকে একটা বাজারের ব্যাগ চেয়ে নেব? বাজারের ব্যাগে করে একটা বিশ্বকাপ বয়ে নেওয়া কি ঠিক হবে?
‘জিনিসটা তোমাকে সত্যিই দিয়ে দেব। আমার শুধু দুইটা শর্ত আছে।’ ব্রায়ান বললেন, ‘দ্বিতীয় শর্তটা সহজ। আমার মৃত্যুর আগপর্যন্ত এটার কথা কাউকে বলা যাবে না। জানি, এটা তুমি নিজের কাছে রাখবে না। যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। যা ইচ্ছা কোরো। শুধু আমার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা কোরো। কথা দিচ্ছি, তোমার অপেক্ষা খুব বেশি দীর্ঘ করব না।’
এই পর্যায়ে এসে বুড়োর জন্য আমার একটু মায়া হলো। বললাম, ‘আর প্রথম শর্ত?’
ব্রায়ান এবার নাটকীয় ভঙ্গিতে হাসলেন। লাইব্রেরির তাকে সাজানো সারি সারি বইয়ের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট তিনটা বই ধরে অল্প টান দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের এক পাশে একটা গোপন কুঠুরির দরজা খুলে গেল। বিস্ময় নিয়ে দেখলাম, ভেতরে একটা কাচের টেবিলের ওপর সাজানো বিশ্বকাপ ট্রফি।
কিন্তু একটা নয়। সাতটা!
হা হয়ে গেলাম! আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে বুড়ো বোধ হয় খুব মজা পাচ্ছিলেন। কোনোমতে বললাম, ‘কিন্তু আপনি তো…’
‘ইয়াংম্যান, মেসি বিশ্বকাপ পেয়েছে জান–প্রাণ দিয়ে ফুটবল খেলে। আমি গুলি খেয়েছি। অপরাধী ধরতে গিয়ে জীবন বাজি রেখেছি। তুমি কী করেছ? তোমাকে কেন আমি ট্রফিটা দেব? আমার সঙ্গে গল্প করেছ বলে? উহু, অত সহজ নয়।’
কথা বলতে বলতে ট্রফিগুলোর কাছে এগিয়ে গেলেন ব্রায়ান। ‘এখানে যে সাতটা ট্রফি দেখতে পাচ্ছ, তার মধ্যে একটা আসল। বাকি ছয়টা নকল। যদি বলতে পারো আসল ট্রফি কোনটা, জিনিসটা তোমার। আর বলতে না পারলে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে তোমাকে একটা আপেল দিতে পারি। খেতে খেতে ডর্মে ফিরে যেয়ো। হা হা…’
লোকটা পাগল নাকি? ভেবে একটু ভয় হলো আমার।
‘উহু, আমি পাগল নই।’ আবারও চমকে দিলেন ব্রায়ান। বললেন, ‘আমার ট্রফি আমি যাকে খুশি তাকে দেব। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে দেব। ইচ্ছা হলে টেমস নদীতে ফেলে দেব। পুড়িয়ে ফেলব। কার কী?’
লোকটা সত্যিই মানসিকভাবে স্থির নন। আমি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘দেখুন, আমি তো কোনো বিশেষজ্ঞ নই। কোনটা আসল, সেটা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে দেওয়া লাগবে না। আপনি বরং জিনিসটা পুলিশের হাতে…’
‘খবরদার! আমাকে জ্ঞান দিতে আসবে না। একদম না। তোমার হাতে আর ১০ মিনিট সময় আছে। হয় আসল ট্রফিটা নিয়ে যাও। নয়তো খালি হাতে বিদায় হও। জলদি।’
ধমক খেয়ে আমি মিইয়ে গেলাম। ট্রফিগুলো কাছ থেকে দেখলাম। সব কটি ট্রফির গায়ে আলতো করে হাত বোলালাম। নাহ্। অসম্ভব! আমার কাছে সব কটিই আসল মনে হচ্ছে।
পাগলা বুড়ো নিশ্চয় এবারও আমার মনের কথা পড়ে ফেললেন। বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাকে শেষ একটা সুযোগ দিচ্ছি। আসল বিশ্বকাপ ট্রফির ওজন কত, জানো?’
সংখ্যাটা আমি সত্যিই জানতাম। কিন্তু ভয়ে সব কেন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। ব্রায়ান বললেন, ‘গাধা! ৬ কেজি ১৭৫ গ্রাম। রেপ্লিকাগুলোর ওজনে একটু গড়বড় হয়ে গেছে। ৬ কেজি ১০০ গ্রাম আছে। এবার দেখি, বের করতে পারো কি না।’
আমি সব কটি ট্রফিই একে একে হাতে নিয়ে দেখলাম। বেশ ভারী। কিন্তু নাহ্! কোনোটার ওজন এক-দেড় শ গ্রাম বেশি হলেও স্রেফ হাতে তুলে সেটা বোঝা অসম্ভব।
‘আর ৮ মিনিট আছে।’ বুড়ো আমাকে আরও ঘাবড়ে দিলেন। কী ঝামেলা। হাল ছেড়ে দেব নাকি?
বললাম, ‘খালি হাতে তো ওজন বোঝা সম্ভব না। একটা ওজন মাপার মেশিন থাকলে হতো। অন্তত একটা দাঁড়িপাল্লা…’
‘কী বললে? দাঁড়িপাল্লা?’
‘জি…’
গটগট করে বেরিয়ে গেলেন ব্রায়ান। ফিরলেন বড় সাইজের একটা ডিজিটাল দাঁড়িপাল্লা নিয়ে। দাঁড়িপাল্লাটা একটা ট্রলির ওপর রাখা। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নাও।’
আমি হাত দিয়ে ধরতে নেব, অমনি বুড়ো ট্রলিটা নিজের দিকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘নিউ রুল। জিনিসটা তুমি মাত্র দুবার ব্যবহার করতে পারবে।’
‘মানে?’
‘মানে পাল্লা দিয়ে তুমি মাত্র দুবার মাপতে পারবে।’
‘এটা কী ধরনের নিয়ম! সাতটা ট্রফি। দুবার মেপে আমি কীভাবে…’
‘আর ৫ মিনিট। কথা বাড়াবে, না কাজ শুরু করবে?’
কী বিপদ! আমি ভালো করে যন্ত্রটা দেখলাম। দুই পাশে দুটো পাল্লা আছে। এই জিনিস মাত্র দুবার ব্যবহার করে কেমন করে বুঝব, কোনটা আসল?
উত্তর
প্রথমে পাল্লার দুই দিকে তিনটি তিনটি করে ট্রফি রাখতে হবে। যদি দেখা যায় দুই পাশে সমান। তার মানে অবশিষ্ট, অর্থাৎ পাল্লার বাইরে রাখা ট্রফিটাই আসল। আর যদি দেখা যায়, কোনো এক দিকের পাল্লা ভারী হয়ে আছে, বুঝতে হবে সেই পাল্লায় রাখা তিন ট্রফির মধ্যে কোনো একটা আসল। অতএব, দ্বিতীয় ধাপে ওই তিনটি ট্রফি রেখে বাকি ট্রফিগুলো সরিয়ে রাখতে হবে। এবার এই তিন ট্রফির মধ্যে দুটিকে দুই পাল্লায় তুলে দিতে হবে। যদি দেখা যায় দুই পাশ সমান, তাহলে অবশিষ্ট ট্রফিটা আসল বলে ধরে নিতে হবে। আর যদি কোনো পাশে ভারী হয়, তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে, সেই ট্রফিটার ওজন বেশি। অতএব সেটা আসল।