তৃতীয়জন

অলংকরণ: এআই আর্ট

পাঁচ দিনের ট্রেক!

পাঁচ দিন ধরে বান্দরবানের বন-পাহাড়ের রাস্তা ঠেঙানোর এই কঠিন কাজ শেষ পর্যন্ত পারব কি না, রওনা দেওয়ার আগমুহূর্তেও সেই সন্দেহ যায়নি আমার। না, একটু ভুল বললাম, ট্রেক শুরু করার পর আড়াই দিন পেরোলেও আসলে ভাবছি, এই যাত্রা ঠিকঠাক শেষ করতে পারব তো?

আমার স্বাস্থ্য মোটামুটি। একটু পাতলার দিকে গড়ন। ভার্সিটির মাঠে মাঝেমধ্যে বিকেলবেলা ফুটবলের পেছনে দৌড়ানো ছাড়া খেলাধুলা বা শরীরচর্চার সঙ্গে খুব একটা সম্পর্ক রাখি না। এদিকে আমার বন্ধু এবং একমাত্র ট্রেকিং-সঙ্গী কায়সারের দিনের অর্ধেকটা কাটে জিমে। বেশ দশাসই গড়ন ওর—তিন গোয়েন্দার মুসা আমানের মতো। এমনিতে আমার আরামপ্রিয় স্বভাব নিয়ে হাসিঠাট্টা করলেও বান্দরবানের বাসে ওঠার আগপর্যন্ত আমাকে সাহস দিয়েছে কায়সার: ‘ভয় কিসের, অভিজিৎ? হালকা–পাতলা লোকজনই তো ভালো ট্রেকিং করে। এই পাথর-ওই পাথরে পা দিয়ে দিয়ে চলে যাবি। একলাফে পার হয়ে যাবি সরু ঝিরি।’

খুব একটা ভরসা পাইনি তখন ওর কথায়। আমতা-আমতা করছিলাম। সকালবেলা উঠে ১০ কিলোমিটার দৌড়ানো কায়সারের কাছে যেটা সহজ, সেটা আমার কাছে দুস্তর পারাবার মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তবে বরাবরের মতো মুশকিল আসানে এগিয়ে এসেছিল আমাদের আরেক বন্ধু রূপু। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তুড়ি মেরে বলে উঠেছিল, ‘একদম ঠিক বলেছে কায়সার। দেখ না, বডিতে এত মাসল থাকলে কী হবে, পাহাড়ের উঁচু–নিচু পথে অত বড় শরীর নিয়ে ব্যালান্স রাখাই কঠিন হবে ওর জন্য। এদিকে হ্যাংলা–পাতলা তুই আর আমি পাহাড়ি ছাগলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাব।’

একমুহূর্ত বিরতি দিয়ে যোগ করেছিল রূপু, ‘তা ছাড়া আমি পুরো ট্যুরের প্ল্যান করে রাখব। একদম ঢাকায় আমাদের হোস্টেল থেকে রওনা দেওয়া থেকে শুরু করে বান্দরবানের কোথায় গিয়ে নামব, গাইড কোথা থেকে নেব, ট্রেকিংটা ঠিক কোন কোন পথে হবে, কোন পাহাড়ি পাড়ায় রাতে থাকব, ঢাকায় কীভাবে ফিরব—সব আগে থেকে সাজিয়ে রাখব আমি। কীভাবে স্বপ্নের মতো পেরিয়ে যাবে পাঁচটা দিন, টেরও পাবি না।’

আমি আর না করতে পারিনি। দেশসেরা মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আমরা, ভর্তি হওয়ার পর থেকেই পড়াশোনার রাজ্যে ডুবে আছি কয়েকটা মাস ধরে। একটা টার্ম পরীক্ষা শেষ করে নিরবচ্ছিন্ন ছুটি পেয়েছি কয়েকটা দিন। পাহাড়ের রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার এই তো সময়। একগাল হেসে বলে দিয়েছিলাম ওদের, যাচ্ছি আমি বান্দরবানে ট্রেকিং করতে।

রূপু ফাঁকা বুলি দেওয়ার ছেলে নয়, দেয়ওনি। সত্যিই পুরো ট্যুরের প্ল্যান সাজিয়ে ফেলেছিল ও। আমার রুমে বইয়ের গাদার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে গুগল ম্যাপ জুম করে করে আমাকে আর কায়সারকে বুঝিয়েছিল: ‘এই যে থানচি বাজার। এখানে সাঙ্গু নদীতে নৌকায় উঠব। এই যে দেখ, রাজা পাথর। এখানে ছবি-টবি তোলে মানুষ। এই যে এর পরে দেখ...’ দেখিও বটে আমরা মুগ্ধ হয়ে। নাফাখুম রেমাক্রি আমিয়াখুম যাব, দেবতা পাহাড়ে উঠব, তারপর একটু ঘুরপথে রওনা দেব তাজিংডংয়ের দিকে। আর শুধু কী প্ল্যান? আমাদের সবার থানচি পর্যন্ত বাসের টিকিট, আবার ফিরতি টিকিট সব করল রূপুই।

তিনজন মিলে আসার কথা ছিল এই অ্যাডভেঞ্চারে। এখন এই যে উঁচু–নিচু ঝিরিপথ বেয়ে এগোচ্ছি আমিয়াখুমের দিকে, আমাদের ছোট্ট দলে আছে ঠিক তিনজনই—কিন্তু সেটা গাইডসহ। আসল অভিযাত্রী আমরা দুজন। বন–পাহাড় ঠেঙিয়ে চলেছি, পিঠে ব্যাকপ্যাক, হাতে ব্যালান্স রাখার বাঁশের লাঠি, পায়ে ট্রেকিংয়ের জুতা। রূপুর থাকার কথা ছিল এই বেশভূষায়, আমাদের দলটার সবার সামনে থাকার কথা ছিল ওর, গাইডের সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে বলতে তরতরিয়ে এগিয়ে যেত ও-ই। কিন্তু এখন সামনে তাকালে কেবল আমাদের গাইড ক্লেমেন্ট ত্রিপুরার পিঠটা দেখতে পাচ্ছি। রূপু নেই আমাদের সঙ্গে। এই ট্রেকিংয়েই আসা হয়নি ওর।

কায়সার এমনিতে আড্ডা-মাতানো ছেলে হলেও বান্দরবানের বুনো সৌন্দর্যের কাছে এসে কথা বলতে ভুলে গেছে যেন। চুপচাপ হাঁটে আর মাঝেমধ্যে মাথা ঘুরিয়ে চারপাশের পাহাড় দেখে। চাউনিতে স্পষ্ট বিস্ময় আর প্রশংসা। আবার এদিকে আমি এমনিতে মুখচোরা ছেলে হলেও জীবনে প্রথমবারের মতো পাহাড়ে এসে মুখের বাঁধন খুলে গেছে। বকবক করছি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এর একটা কারণ হয়তো উৎসাহের আতিশয্য, তবে আরেকটা বড় কারণ আছে। হাঁটতে হাঁটতে গল্প করলে পথের কষ্ট মাথায় থাকে না।

আরও পড়ুন

‘ভঙ্গিল পর্বত, বুঝলি!’ দম নিতে নিতে বলছি আমি। পাথর ডিঙিয়ে ওঠা, নামা, পিচ্ছিল জায়গায় সাবধানে পা ফেলা—এসব করতে গিয়ে দম ফুরিয়ে যায়, একটানা একটা বাক্য বলাই মুশকিল। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো হচ্ছে ভঙ্গিল পর্বত। ভারতীয় উপমহাদেশের ভূখণ্ডটি ছিল আলাদা একটা দ্বীপের মতো, অ্যান্টার্কটিকা আর অস্ট্রেলিয়ার কাছাকাছি। সেখান থেকে উত্তর দিকে উঠতে উঠতে এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে টক্কর লেগে যে পর্বতমালা তৈরি হলো, তার মধ্যে যেমন গিরিরাজ হিমালয় আছে, ঠিক তেমনি আছে আসাম মিয়ানমার আর পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্বতমালা। আসলে উত্তরে যেটা হিমালয়, সেটাই মিয়ানমার আর ভারতের সাত পার্বত্য রাজ্যের ভেতর দিয়ে নেমে এসেছে বাংলাদেশে। বলতে গেলে, এগুলো পাহাড় হিমালয়ের চাচাতো ভাই।’

কায়সার কাঁধে ঝোলানো গামছায় মুখ মুছে হাসল। ‘চমৎকার তথ্য। জানতাম না। এখানে রূপু থাকলে কী করত জানিস? তুই যেমন বই থেকে একটা দারুণ ফ্যাক্ট বললি, ও তেমন একটা জুতসই সাহিত্যের লাইন তুলে আনত টুক করে।’

‘ঠিক। ঝাউ–রহস্য বইয়ে দার্জিলিং গিয়ে টেনিদার বলা একটা লাইন হতো হয়তো সেটা।’ মুচকি হাসলাম আমি।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। বেশ গরম। বোতল থেকে পানি খাচ্ছি আর ঝিরিপথ বেয়ে চলছি। খিদে লেগেছে। গাইডকে জিজ্ঞেস করতে যাব যে খাবারের ব্যবস্থা কী, তার আগেই পাশের পাহাড়টার ঢাল বেয়ে উঠে মোটামুটি সমতল জায়গায় একটা ছোট্ট পাহাড়ি ‘পাড়া’য় নিয়ে এল আমাদের সে। আমাদের গাইড ক্লেমেন্ট ত্রিপুরা কথা বলে কম, আঙুল তুলে একটা মাচা-বাড়ির বারান্দাটা দেখিয়ে আমাদের কেবল বলল, ‘বসেন। খাবার নিয়ে আসি।’

আমি আর কায়সার শুয়েই পড়লাম পরিষ্কার চাটাইয়ের ওপর। ঘুমই চলে আসছিল ক্লান্তিতে, কিন্তু এখন ঘুমালে খাবে কে? ব্যাকপ্যাক থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে সেগুলোয় মন দিলাম দুজন। গুগল ম্যাপ থেকে ছাপিয়েছি নাফাখুম-সাতভাইখুম-তাজিংডংয়ের এদিককার এলাকাটা। এমনিতে ফোন খুললে নিখরচায় দেখা যায় এসব, জিপিএস লোকেশনসহ। কিন্তু সামান্য ফোনকলের নেটওয়ার্ক পাওয়াটাই কঠিন এই পাহাড়ি এলাকায়, ইন্টারনেট তো দূরের কথা।

‘এই যে, আরেকটু সামনে গিয়ে চেনা পথ ছেড়ে যাব আমরা।’ কাগজের একটা জায়গায় আঙুল রাখল কায়সার। ‘সাধারণত এদিক দিয়ে কেউ তাজিংডংয়ের দিকে যায় না, অনেকটা পথ ঘুরতে হয় বলে। কিন্তু রূপু কয়েকজন অভিজ্ঞ পর্বতারোহীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছে, এই পথের সৌন্দর্য অসাধারণ। কয়েকটা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে যাব, প্রকৃতির এমন নিখাদ সৌন্দর্যের দেখা পাব, যেটা খুব কম ট্রেকারেরই ভাগ্যে থাকে। দুটি সুবিধা আছে এই পথে। এক, কঠিন কোনো পাহাড় বাইতে হবে না, আমাদের মতো আনাড়ি ট্রেকারও পারবে। দুই, উটকো কোনো পর্যটকের দেখা পাব না। পুরো রাস্তায় হইচই দেখে কম বিরক্ত তো হইনি, এবার শুধু পাখির ডাক আর বাতাসের গান শুনে এগোনোর পালা।’

আমাদের বিমূঢ় চেহারা দেখে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল সে। পাহাড়ে ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার, বিশেষ করে এদিকটায়। হাতে গোনা দু–একটা জায়গাতেই কোনোমতে কল দেওয়া যায়। বাঁশের গায়ে ফোন বেঁধে রাখা সে জন্যই, ওখান থেকে নড়ানো হলে নেটওয়ার্ক কেটে যাবে কুট করে। পাশের মাচাটায় যে বুড়ো পাহাড়ি বসে আছেন, ফোনটা তাঁরই। তাকে খরচ মিটিয়েই ফোন করতে হয়।

মুচকি হাসলাম আমি। মাত্র দুজনের দল নিয়ে আমরা বান্দরবান এসেছি। ওদিকে ২০-২২ জনের দলের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রায়ই, তাদের চেঁচামেচি শুনলে মনে হয় পাহাড়ের নির্জনতায় নেই আমরা, বরং গুলিস্তানের মোড়ে বাস ধরতে এসেছি। সবুজ পাহাড়ের মধ্যে আনমনে চলেছি আমরা—ভাবলেই মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, খাসা প্ল্যান করেছে বটে রূপু। খালি যদি ও থাকত আমাদের সঙ্গে!

ক্লেমেন্ট ত্রিপুরা ভাত নিয়ে এসেছে। সামান্য আয়োজন, কিন্তু খিদের জ্বালায় সেটাই অমৃতের মতো লাগল। মুহূর্তের মধ্যে খালি করে দিলাম প্লেট। হাত ধুতে ধুতে দেখি, করিতকর্মা গাইড তিনজনের জন্য তিন কাপ চা-ও হাজির করে ফেলেছে! তৃপ্তির চুমুক দিতে দিতে চাঙা হয়ে আমাদের কাঙ্ক্ষিত যাত্রাপথ দেখালাম ক্লেমেন্টকে। আগেই বলে রেখেছিলাম যে আমরা কম-মাড়ানো পথ দিয়ে যেতে চাই, সেভাবেই চুক্তি হয়েছে তার সঙ্গে।

মন দিয়ে ম্যাপটার খুঁটিনাটি দেখল ক্লেমেন্ট। বেশি শব্দ খরচ না করে কেবল বলল, ‘নো চিন্তা, রাস্তা সুন্দর আছে। ম্যাপের একটা জায়গা দেখিয়ে বলল, ‘এখানে একটা পাড়ায় রাতে থাকব।’

বটে। বিকেল হয়ে গেছে। আর খুব বেশি হলে ঘণ্টা দুয়েক পথ চলতে পারব। ক্যাম্পিংয়ের সরঞ্জাম মানে তাঁবু-টাবু তো আনিনি আমরা, পাহাড়ি কোনো পাড়াতেই থাকতে হবে। তার মানে পাড়াটা খুব দূরে নয়।

তবু দিনের আলো থাকতে থাকতে সেখানে পৌঁছাতে চাইলে বেশিক্ষণ আলসেমি করা যাবে না। তার মানে বেশিক্ষণ জিরোনো কপালে নেই আমাদের। হলোও তা–ই, মিনিট পনেরো পরেই ক্লেমেন্টের ডাক, ‘চলুন ভাই, পাহাড়ের সত্যিকারের রূপ দেখবেন এবার।’

আড়মোড়া ভেঙে একটা হাই তুললাম আমি। ব্যাকপ্যাকটা পিঠে ঝুলিয়ে শরীরটা টেনেহিঁচড়ে তুলে উঠে দাঁড়ালাম। ব্যায়ামবীর কায়সার অবশ্য সটান উঠে দাঁড়িয়েছে ক্লেমেন্ট বলার সঙ্গে সঙ্গেই, ব্যাগ পিঠে তোলাই ছিল।

শরীর মুচড়ে কোমরের জড়তা কাটানোর চেষ্টা করছি আমি এখন। কায়সার করুণার হাসি হাসছে আমার দুরবস্থা দেখে। ক্লেমেন্টের দ্বিতীয় তাড়া এল এই সময়। ‘কই, ভাই, সন্ধ্যা হয়ে যাবে কিন্তু।’

‘হ্যাঁ, এই তো, রূপু তৈরি হয়ে নিলেই...’ বলতে বলতে থেমে গেলাম আমি। কী বলছি, সেটা নিজের কানে গেছে। কায়সারের চোখ বড় বড় করে দেখছে আমাকে।

‘রূপু আবার কে?’ গাইড ক্লেমেন্ট ত্রিপুরা বিস্ময়ে হাঁ।

‘আমাদের বন্ধু,’ লজ্জিত কণ্ঠে বললাম আমি। ‘এই ট্যুরটা ওরই প্ল্যান করা। ওকে বেশি মিস করছি বোধ হয় আমরা। যাকগে, চলুন।’

পাড়াটা ছেড়ে বেরিয়ে আসছি, আজব এক জিনিস দেখে থমকে দাঁড়ালাম। অনেক ওপরে, পাহাড়ের খোলা দিকে একটা ছোট মাচা ঘর, তার পাশে একটা বুকসমান উচ্চতার বাঁশের খুঁটি। একটা বাটন ফোন সেই খুঁটির মাথায় দড়ি দিয়ে বাঁধা—সেটার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আমাদেরই মতো এক পর্যটক। পাশে দাঁড়িয়ে আরও তিন-চারজন, বোঝাই যাচ্ছে তারাও অপেক্ষা করছে কখন তাদের পালা আসবে।

হাঁ করে দেখছি এই দৃশ্য, গাইড ক্লেমেন্টের প্রশ্নে ঘোর ভাঙল। ‘আপনারাও বাসায় কথা বলবেন নাকি?’

আমাদের বিমূঢ় চেহারা দেখে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল সে। পাহাড়ে ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার, বিশেষ করে এদিকটায়। হাতে গোনা দু–একটা জায়গাতেই কোনোমতে কল দেওয়া যায়। বাঁশের গায়ে ফোন বেঁধে রাখা সে জন্যই, ওখান থেকে নড়ানো হলে নেটওয়ার্ক কেটে যাবে কুট করে। পাশের মাচাটায় যে বুড়ো পাহাড়ি বসে আছেন, ফোনটা তাঁরই। তাকে খরচ মিটিয়েই ফোন করতে হয়।

‘আপনারাও কথা বলবেন নাকি?’ ক্লেমেন্টের প্রশ্ন। না, থাকগে। বাসায় বলাই আছে, পাহাড়ে গেলে চার-পাঁচ দিন নেটওয়ার্কের বাইরে থাকব। চিন্তা করবে না মা-বাবা।

পাড়া থেকে বেরিয়ে একটা ছোট ঝরনার পাশ দিয়ে আরেকটা পাহাড়ে উঠে গেছে পায়ে চলা পথ। ক্লেমেন্টের পিছু পিছু চললাম আমরা সেদিকে। দুই পাশে গাছ আর ঝোপঝাড়। বিরাট বিরাট ফার্নের পাতা, গাছের ডালপালা আর দুলতে থাকা লতা ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের, খারাপ লাগছে না। বাংলাদেশের পাহাড়গুলো বড় সবুজ, বড় কোমল। বিশাল মহিরুহের গায়ে ফুটে রয়েছে অর্কিড ফুল। সৌরভ নেই, কিন্তু রূপে করছে মন মাতোয়ারা।

থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা সবাই। মাথা কাজ করছে না কারও। অবশেষে মুখ খুলল ক্লেমেন্ট ত্রিপুরা, ‘আমরা রাতটা কোথাও কাটানোর ব্যবস্থা করি। অন্ধকার নামবে একটু পরই, তখন আন্দাজে হাঁটাচলা করতে গিয়ে আঘাত পেলে বিপদ আরও বাড়বে।’

চুপচাপ পথ চলেছি আমরা। এমনিতে আমি আর কায়সার দুজনই হল্লাবাজ, আগডুম–বাগডুম টপিক নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারি। ট্রেকিংয়ের গত দুই দিন বলেছিও। কিন্তু এই নতুন পথে চলতে শুরু করার পর পাখির ডাক, ঝিঁঝি পোকার একটানা ঐকতান আর বাতাসের বুনো মিষ্টি গন্ধেই আমরা বিভোর। মুখ খুললেই যেন মাটি হয়ে যাবে সব, চেঁচামেচি করা তো অকল্পনীয়।

পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরের দিকে ওঠাকে বলে চড়াই, আর নিচের দিকে নামাকে বলে উতরাই। প্রথম চড়াই-উতরাইটা পেরিয়ে দ্বিতীয় চড়াইয়ে উঠতে যাবে আমাদের ছোট্ট দলটা, এমন সময় কায়সারই প্রথম খেয়াল করল ব্যাপারটা। থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা, এই অর্কিডওয়ালা বড় গাছটা না একটু আগেই পার হয়ে এলাম?’

ভালো করে তাকালাম গাছটার দিকে। কয়েক শ বছরের পুরোনো বিরাট গাছ, গায়ে জড়ানো অর্কিডের গাছে হলুদ ফুল ফুটে আছে। ‘আরে, দেখতে একই রকম। কিন্তু একই গাছ হয় কীভাবে? ওই পাহাড়টা তো আমরা পেছনে ফেলে এলাম।’

গাইড এগিয়ে যাচ্ছে, অগত্যা আমরাও পা বাড়ালাম। দ্বিধা কাটছে না কায়সারের, বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে গাছটা দেখছে ও। গহিন বনে চলতে গেলে এমন ভুল হতেই পারে—পাত্তা দিলাম না আমি।

মত বদলাতে বাধ্য হলাম মিনিট পনেরো পরেই। এবার খালি কায়সার নয়, আমিও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি। বিরাট একটা প্রাচীন গর্জনগাছের ওপর চোখ পড়ল। চোখজুড়ানো হলুদ ফুল ফুটে আছে তাতে। ভুল হতেই পারে না—ওই যে একটা ভাঙা ডাল, ওটাও মিলে যাচ্ছে।

গলায় জোর পাচ্ছিলাম না, তবু কোনোমতে ডাকলাম গাইড ক্লেমেন্টকে। ফিরে আসছে লোকটা, কাছাকাছি আসার পর তার মুখের দিকে তাকাতেই কে যেন শীতল হাতে খামচে ধরল আমার হৃৎপিণ্ডটা।

‘আপনারাও খেয়াল করেছেন?’ নিচু কণ্ঠে বলল ক্লেমেন্ট।

‘আমরা কি পথ হারিয়ে ফেলেছি? একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি?’ কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কায়সার।

সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না ক্লেমেন্ট। আর তার উত্তরটা সরাসরিও নয়। ‘এ রকমটা কখনো হয়নি,’ আস্তে করে বলল সে। ‘এসব পাহাড় আমার কাছে হাতের তালুর মতো চেনা।’

‘আমাদের মনে হয় কোনো ভুল হচ্ছে,’ হাসি হাসি মুখে বলল কায়সার। ‘এ রকম গহিন বনে এমনটা হতেই পারে, আপনাকে দোষ দিচ্ছি না গাইড সাহেব।’ শেষ কথাটা ক্লেমেন্টের দিকে তাকিয়ে বলা। সে অবশ্য মাইন্ড করার অবস্থায় নেই, চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে গাছটার দিকে। গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ চাহনিতে।

সব সময় পজিটিভ থাকার চেষ্টা করে কায়সার। গলা খাঁকারি দিয়ে চনমনে গলায় বলল, ‘যাকগে, আমাদের তিনজনের ভুল হতেই পারে। দেখি রূপু কী বলে। কই গেল ছেলেটা...’ বলে পেছনে তাকাল ও, ছেড়ে আসা ট্রেইলের দিকে। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে তাকিয়েছি আমিও।

খাঁ খাঁ করছে ওদিকটা। একচিলতে ঢালু পাহাড়ি পথ, দুই পাশে ঘন জঙ্গল, অনেক ওপরে এক-দুই ঝলক আকাশ দেখা যায় কি যায় না।

বিহ্বল দৃষ্টিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম আমরা। কায়সারকে দেখেই বুঝতে পারছি আমাকে কেমন দেখাচ্ছে, ঝুলে পড়েছে চোয়াল, চোখ নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি।

দুবার চেষ্টা করে কোনোমতে আমাদের গাইডকে বললাম, ‘ক্লেমেন্টদা, কী আশ্চর্য, এক সেকেন্ডের জন্য মনে হচ্ছিল আমাদের সঙ্গে আরও কেউ আছে। আমাদের এক বন্ধু—ট্যুরটা ওরই প্ল্যান করা, ওরই আসার আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। রূপু নাম।’

ঢোঁক গিলতে দেখলাম তাকে। কপালের ঘাম মুছে তাড়াতাড়ি বলল, ‘বাদ দিন, ওসব কিছু না। আচ্ছা, চলুন আমরা একটু বসি। ভেবে দেখি, এরপর কী করা যায়।’

আরও পড়ুন

সবারই মনে ধরল প্রস্তাবটা। একটু সামনে এগিয়ে কয়েকটা বড় পাথরের ওপর বসলাম। কিন্তু একটা ব্যাপারে খুঁতখুঁতানি দূর করতে পারলাম না মন থেকে—ক্লেমেন্ট ত্রিপুরা শেষের দিকে ও রকম ঘাবড়ে গেল কেন? শুধুই পথ হারানোর জন্য, না আরও কোনো কারণ আছে?

এবার কী করা যায়, তিনজন তিনটা পাথরের ওপর বসে উপায় বের করার চেষ্টা করলাম। আলোচনা সংক্ষিপ্ত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আধা ঘণ্টার বেশি পেরিয়ে গেল তর্কাতর্কিতে। ফোনের জিপিএস কোনোভাবেই কাজ করছে না নেটওয়ার্ক ছাড়া, এরই মধ্যে কয়েকবার চেষ্টা করে দেখা শেষ। আগেকার যুগের মতো একটা কাগজের ম্যাপ থাকলে ভালো হতো। গুগল ম্যাপ থেকে ছাপানো স্ক্রিনশট না, বিস্তারিত ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র। যেহেতু নেই, তাই ওই নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। আমরা কি এখানে বসে অপেক্ষা করব অন্য কেউ এই পথে আসে কি না, তাদের সঙ্গে জঙ্গল থেকে বের হওয়ার আশায়? ক্লেমেন্ট নিচু গলায় বলল, সে মোটামুটি নিশ্চিত যে কেউ আসবে না। এমনিতেই খুব কম লোক মাড়ায় এই পথ, তার ওপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।

আমি আর কায়সার সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম সোজা ওপরের একচিলতে আকাশের দিকে। হ্যাঁ, দিনের আলো কমে আসতে শুরু করেছে বটে। এই গহিন অচেনা বনে পথ হারানো অবস্থায় নিকষ কালো রাত নেমেছে, চারপাশে কিচ্ছু দেখতে পারছি না—কল্পনা করতেই আতঙ্কে পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চাইল আমার হাত-পা। কায়সারের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ওর অবস্থাও তথৈবচ।

তবে দ্রুতই সেই খারাপ দশা কাটিয়ে এবার রেগে উঠল কায়সার। ‘পুরোটাই আপনার দোষ,’ ক্লেমেন্টের দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে গর্জে উঠল ও। ‘পথ চেনেন না কিছু না! গাইড সাজতে এসেছেন কেন, অ্যাঁ?’

ক্লেমেন্ট অবশ্য কোনো ধরনের ঝগড়াতেই গেল না। ‘বিশ্বাস করেন, এই রাস্তায় চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলেও আমি যেতে পারব, দাদা।’ প্রায় অনুনয়ের সুরে বলল সে। কেন আমরা বারবার ঘুরে একই জায়গায় আসছি, কোনোভাবেই বুঝতে পারছি না। বিশ্বাস করেন!’

কায়সারের রাগও গলে পানি হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। ‘তাহলে কী করব এখন, বলেন, ভাই! আমাদের সঙ্গে তাঁবু-টাবু কিছু নেই, খাবারও একবার খেলেই ফুরিয়ে যাবে। সারা রাত কাটাব কী করে জঙ্গলে?’

ক্লেমেন্ট কিছু বলার আগে আমিই বলে বসলাম, ‘আচ্ছা, এক কাজ করি, উল্টো দিকে হাঁটলে হয় না? হয়তো এমনও হতে পারে, আগের পাড়াটায় ফেরত চলে গেলাম। হতেও তো পারে!’

ভেবেছিলাম আমার বোকা বোকা পরামর্শটা কানে তুলবে না কেউ। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওরা দুজনই উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে, পরখ করে দেখতে চায় আমার বুদ্ধিটা। মানুষ বিপদে পড়লে যে খড়কুটাও আঁকড়ে ধরে, মিথ্যা নয় মনে হয় কথাটা।

ফিরতি পথে এগিয়ে চললাম আমরা। বাকিদের কথা জানি না, আমার বুকের ভেতরে ধড়াস ধড়াস করছে হৃৎপিণ্ডটা। প্রাণপণে দোয়া করছি যেন পাতলা হয়ে আসতে শুরু করে জঙ্গলটা, সামনে খোলা জায়গা দেখতে পাই, আর ওই ছোট পাহাড়ি পাড়াটা।

প্রায় দম আটকে হাঁটলাম আরও মিনিট দশেক। কারও মুখে কোনো কথা নেই। কেন যেন আমার মন বলছে, আমরা এবার আর একই রাস্তায় ঘুরছি না। এখনই একটা মোড় ঘুরলেই দেখতে পাব...

আরও পড়ুন

‘ওই গাছটা!’ ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠল কায়সার। ‘আমরা আবার ফেরত এসেছি একই জায়গায়!’

‘না না, তা কী করে হয়!’ তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম আমি, ‘হলুদ অর্কিডটা আছে বটে, কিন্তু ভাঙা একটা ডাল ছিল ডান দিকে, ওটা ক...’

‘আছে, আছে!’ হাহাকার করে উঠল কায়সার, ‘ওই তো, বাঁ দিকে এখন ওটা! আমরা উল্টো দিক থেকে ফিরে আসছি গাছটার কাছে!’

থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা সবাই। মাথা কাজ করছে না কারও। অবশেষে মুখ খুলল ক্লেমেন্ট ত্রিপুরা, ‘আমরা রাতটা কোথাও কাটানোর ব্যবস্থা করি। অন্ধকার নামবে একটু পরই, তখন আন্দাজে হাঁটাচলা করতে গিয়ে আঘাত পেলে বিপদ আরও বাড়বে।’

‘পানি খাই একটু,’ ক্লান্ত গলায় বলল কায়সার। ‘পানির বোতলটা দে তো, রূপু।’

আমি রূপুকে আমার পাশে খুঁজতে গিয়ে কেবল ফাঁকা বাতাস পেলাম খানিকটা।

‘পানিভর্তি বোতলটা কোথাও নেই,’ কাঁপা গলায় বললাম আমি। ‘আশ্চর্য, আমি হলফ করে বলতে পারি, পাড়াটা থেকে বেরোনোর আগে পানি ভরে রূপুর হাতে দিয়েছিলাম বোতলটা!’

‘সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন?’ ফিসফিস করে বলল ক্লেমেন্ট, ‘আমি নিজেও যেন দেখেছি আপনার বন্ধুকে বোতলটা নিতে। অথচ আপনাদের ওই বন্ধুকে আমি কখনো দেখিইনি!’

চুপ হয়ে গেছি আমরা সবাই। রাত নামছে বান্দরবানের গভীর বনে।

কতক্ষণ কেটেছে জানি না। সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলেছি বোধ হয়। ফোনের চার্জ নেই, সাপ আর বন্য জানোয়ারের ভয়ে বারবার ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেছে।

ওই পাথরগুলোর গোড়াতেই আস্তানা গেড়েছি আমরা, যদি এটাকে আস্তানা বলা যায় আরকি। গাছের ডালপালা বিছিয়ে তার ওপরে বসেছি পাথরে হেলান দিয়ে। মাথার ওপরেও ডালপালা দিয়ে তার ওপরে পাতা বিছিয়ে ছাউনির মতো করার চেষ্টা করেছে ক্লেমেন্ট ত্রিপুরা। এই কটা কাজ তড়িঘড়ি করতে না করতেই ঘনঘোর রাত নেমেছে।

বনের ভেতরে আগে কখনো রাতের বেলা ঢুকিনি। কিন্তু দিনের বেলায় যে জায়গা নানা রকম ঝিঁঝি আর পাখির ডাকে সরব থাকে, রাতে সেটা এতটা নিস্তব্ধ নিঝুম হওয়া কি স্বাভাবিক? নিজের নিশ্বাসের শব্দও বড় বেশি হয়ে কানে বাজছে।

আর আঁধার যে এমন নিঃসীম হতে পারে, আমার কল্পনায়ও ছিল না এটা। আকাশে চাঁদ তো নেই-ই, মাথার ওপরে একটা তারাও দেখা যাচ্ছে না। চারপাশের কালিগোলা অন্ধকার যেন পাথরের মতো চেপে আসছে আমাদের ওপর। অজানা আতঙ্কে ঠান্ডা হয়ে আসছে হাত-পা।

বহুক্ষণ কোনো কথা বলিনি আমরা, ঘণ্টা দুয়েক তো হবেই। কথা বলার ইচ্ছেও নেই। একবার খালি ক্লেমেন্টকে জিজ্ঞেস করতে চাইলাম যে কালকে আমাদের প্ল্যান কী হবে, কিন্তু তার আগেই একটা ক্ষীণ শব্দ শুনলাম কোথায় যেন।

সঙ্গে সঙ্গে কান খাড়া করে ফেলেছি আমি, আমার সঙ্গীদের অবস্থাও নিশ্চয়ই তথৈবচ।

ওই যে, আবার শুনলাম শব্দটা। ভুল হতেই পারে না। নুড়ি গড়ানোর শব্দ। কারও পায়ে লেগে গড়ালে যেমন হয়।

আরও পড়ুন

কায়সার কাঁপা গলায় ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কেউ আসছে এদিকে। আমাদের উদ্ধার করতে আসছে নাকি, ক্লেমেন্টদা?’

‘কেউ জানে না আমরা এদিকে এসেছি,’ ক্লেমেন্ট বলল। ‘জানলেও এত রাতে কোনো আলো ছাড়া কে আসবে!’

কেমন যেন ঘোরের মধ্যে বললাম আমি, ‘আচ্ছা, বারবার আমাদের একই ভুল হচ্ছিল কেন?’

কায়সার অসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘এ রকমটা নাকি হয় মাঝেমধ্যে। মেরুযাত্রী শ্যাকলটন এ রকম একটা ঘটনার কথা লিখেছেন। ১৯১৪-১৫–এর দিকে তাঁদের এক যাত্রায় অ্যান্টার্কটিকার নিঃসীম তুষারের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাদের নাকি বারবার ভুল হচ্ছিল যে সঙ্গে আরও একজন অভিযাত্রী আছে। টি এস এলিয়ট তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতায় এই থেকেই লিখেছেন, হু ইজ দ্য থার্ড হু ওয়াকস অলওয়েজ বিসাইড ইউ? গাইড বাদে আমরা দুজন এসেছি ট্রেক করতে, কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে সঙ্গে আরেকজন আছে। তৃতীয়জন।’

‘পাহাড়ি বনের এমন অনেক গল্প আমিও শুনেছি,’ ক্লেমেন্ট ত্রিপুরা বলল। ‘বনে অনেক লোকজন নিয়ে চলাফেরা করতে হয়, নাহলে নাকি অপদেবতারা সঙ্গ নেয় সঙ্গে। পথ ভুলিয়ে দেয়, মায়ায় ফেলে। শেষমেশ তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এত দিন বিশ্বাস করিনি কুসংস্কার ভেবে, কিন্তু এখন...’

পায়ের শব্দটা কাছে চলে এসেছে। আর খুব বেশি হলে ১০-১৫ হাত।

আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, তবু কীভাবে যেন বলতে পারলাম, ‘ক-কে ওখানে?’

রূপুর তাজা কণ্ঠ চনমনে করে তুলল নিকষ অন্ধকারে ডোবা পুরো বনটাকে। ‘আমি রে। তোরা আয় আমার পেছন পেছন। এই যে, দেখ।’

একটা আলো জ্বলে উঠল সামনের একটা জায়গায়, শূন্যে। ছোট জোনাকির মতো আলো—চারপাশের কোনো কিছুকেই আলোকিত করছে না।

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে দাঁড়িয়েছি, শব্দ শুনে বুঝলাম কায়সারও তাই করেছে। এগিয়ে যেতে শুরু করলাম আলোটার দিকে, আলোটাও এগোতে শুরু করল। পথ দেখাচ্ছে।

‘যাবেন না!’ ক্লেমেন্ট প্রতিবাদ করল চাপা গলায়। ‘যদি...যদি অপদেবতাদের কোনো চাল হয় এটা?’

‘অপদেবতারা আমাদের পথ ভুলিয়ে গোলকধাঁধায় ফেলেছে, ক্লেমেন্টদা।’ কায়সার জবাব দিল আমার হয়ে। ‘কিন্তু আমাদের বন্ধু এখন এসেছে আমাদের উদ্ধার করতে। কোনো ভয় নেই, চলে আসুন।’

দীর্ঘ একটা নীরবতার পর ক্লেমেন্ট উঠে এসে সঙ্গী হলো আমাদের সঙ্গে।

আলোটা এগিয়ে চলল, সেই সঙ্গে আমরাও। কতক্ষণ পথ চলেছি জানি না, মেরুর তুষারপ্রান্তরে দিনের পর দিন পথ চলা শ্যাকলটনের মতোই। আশ্চর্য, কোনো গাছ বা পাথরে হোঁচট খাচ্ছি না আমরা।

একটু পরে একটা ঢালু পেরিয়ে নিচে নামতেই দূরে দেখলাম উজ্জ্বল আলো। সোলার বাতির আলোয় দেখা যাচ্ছে ছোট একটা জুমঘর, তার সামনে বসে ঝিমাচ্ছে সেই বুড়োটা। আমরা সেই পাড়াটায় ফিরে এসেছি। আর ভয় নেই।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলারও অবস্থা নেই আমাদের। ক্লেমেন্ট ত্রিপুরা তবু বলল, জানতাম বলবেই, ‘আপনাদের তৃতীয়জন, মানে আপনাদের বন্ধু রূপু কেন আসতে পারলেন না এই ট্যুরে? ওনারই নাকি পুরোটা প্ল্যান করা।’

‘ট্যুরে আসার দুদিন আগে ভয়াবহ বাইক দুর্ঘটনা হয়েছে রূপুর। ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে কোমায় আছে ও এখন। মাথা খারাপের দশা হয়েছিল আমাদের। আমরা কোনোভাবেই আসতে চাইছিলাম না ট্যুরে, হাসপাতালেই পড়ে ছিলাম দুদিন। আমাদের মেডিকেলের স্যার যখন বললেন যে আইসিইউর পাশে বসে থেকে টেনশনে শুকিয়ে আমাদের কোনো লাভ হচ্ছে না, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যই দরকার ট্যুরটায় যাওয়া, শুনতে চাইনি তখন। শেষে রূপুর বাবা বললেন, রূপু জেগে থাকলে অবশ্যই চাইতো আমরা বান্দরবানে যেন যাই। এই কথাটা আর ফেলতে পারিনি। রূপুর জন্যই এসেছি আমরা এখানে। শুধু ওর কথা ভেবে।’

ক্লেমেন্ট হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আমি তাকালাম জুমঘরটার দিকে। ওই বুড়োই খুঁটিতে বাঁধা মোবাইল কলের ব্যবসা করে।

‘কী মনে হয়, অভিজিৎ?’ কায়সারের প্রশ্ন। ‘ঢাকায় ফোন করলে কী শুনব আমরা? রূপু সুস্থ হয়েছে, না...’

‘অবশ্যই সুস্থ হয়েছে রূপু। সুস্থ হতেই হবে ওকে।’ হাত মুঠো করে বললাম আমি, এবার এগোতে শুরু করলাম জুমঘরটার দিকে।

একটা ফোনকল, তারপর জানতে পারব কেমন আছে আমাদের তৃতীয়জন।

আরও পড়ুন