ম্যাচের কাঠিটা জ্বলে শেষ হয়ে যাবে—তখন কী হবে? আবার সবাই ছুটে আসবে ভয়ংকর চোখ আর ধারালো দাঁত নিয়ে? আমি এদিক-সেদিক তাকালাম— আগুন জ্বালানোর মতো আর কিছু নেই আশপাশে? পকেটে কয়েকটা নোট আছে—আব্বু দিয়েছিলেন দরকারের সময় ব্যবহার করতে। এর থেকে দরকার আর কখন হবে?’
আমি পকেট থেকে নোটটা ব্যবহার করে জ্বালিয়ে নিলাম, দপ দপ করে আগুনের শিখাটা বড় হয়ে উঠল আর ছোট বাচ্চাগুলো হিংস শব্দ করতে করতে আরও পিছিয়ে গেল।
ফজল আমার হাত ধরে টেনে আনে, বাড়ির বাইরে এনে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘পালা। তুই এক্ষুনি পালা?’
আমি বললাম, ‘তুই?’
‘আমার কিছু হবে না। তুই পালা—’
আমি তখন ছুটতে লাগলাম, আমার মনে হতে লাগল এই বুঝি পেছন থেকে দল বেঁধে হিংস্র শব্দ করতে করতে কিছু ছোট বাচ্চা তাদের ধারালো দাঁত নিয়ে ছুটে আসবে।
আমি কত দূর গিয়েছিলাম জানি না, একটা কুকুর হঠাৎ পেছন থেকে ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে থাকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমি একটা বয়স্ক মানুষের গলা শুনতে পেলাম, ‘কে? কে যায়?
‘আমি?’
‘এত রাতে তুমি বাচ্চা মানুষ কই যাও—’ বলতে বলতে প্রায় অন্ধকারের ভেতর থেকে একজন মানুষ বের হয়ে এল।
আমার হঠাৎ করে মনে হলো আমার শরীরে কোনো জোর নেই, আমি মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললাম, ‘আমার খুব ভয় লাগছে! আমাকে বাঁচান—’
মানুষটা আমাকে ধরে বলল, ‘তুমি কোথা থেকে আসছ?’
‘ওই যে ফজলদের বাড়ি থেকে—’
‘সর্বনাশ! ওটা তো ভূতের বাড়ি, ওখানে কেন গিয়েছিলে? জানে মেরে ফেলবে তোমাকে।’
আমার মনে হলো চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে—বিড় বিড় করে বললাম, ‘বাঁচান! আমাকে বাঁচান।’
তারপর কী ঘটেছে সবকিছু পরিষ্কার মনে নেই। বাড়ির ভেতর থেকে আরও কিছু মানুষ বের হয়ে এল। কোনো একজন মহিলা আমার শরীর মুছে দিল, লবণ-পানি খাওয়াল। একজন মাথার পাশে বসে সুরা পড়তে লাগল। কী একটা ভয়ানক বিপদ থেকে বেঁচে গেছি, ভাসা ভাসা শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম কিংবা অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
আব্বু যদিও ফজলের নানিকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন কিন্তু প্রথমে আমাকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকলেন। ফজলের নানিকে নিয়ে বিশেষ কিছু করারও ছিল না, বেচারির আর জ্ঞান ফিরে আসেনি। সেই বিছানাতেই শুয়ে মারা গেলেন। আব্বুর কাছে শুনলাম মারা যাওয়ার আগে ফজল অনেক হাউমাউ করে কেঁদেছে কিন্তু মারা যাওয়ার পর হঠাৎ আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গেল। গ্রামের লোকজন তার নানির জানাজা পড়িয়ে গ্রামের কবরস্থানে কবর দিল, ফজল বেশ শান্তভাবেই পুরো ব্যাপারটা মেনে নিল। একা মানুষ বাড়িতে কেমন করে থাকবে, সেটা নিয়ে এক-দুজন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ফজল, সেই কথাগুলোকে কোনো গুরুত্ব দিল না। ভূতের বাড়ির ছেলে—তাই কেউ কিছু বলল না।
প্রায় মাস খানেক পরে আমি আমাদের ক্লাসের কয়েকজনকে রাজি করিয়ে ফজলের বাড়ি গিয়েছিলাম। নানি মারা যাওয়ার পর সে স্কুলে আসা ছেড়ে দিয়েছে। ফজলের বাড়িতে কী ঘটেছিল সেই ঘটনাটা আমি অবশ্য আব্বু ছাড়া আর কাউকে বলিনি। আব্বু শুনেছেন কিন্তু বিশ্বাস করেছেন মনে হয় না। আব্বু ভূত-প্রেত বিশ্বাস করেন না—ধরেই নিয়েছেন কোনো একটা কারণে আমি খুব ভয় পেয়েছি। কারণটা হয়তো সত্যি নয়—ভয়টা সত্যি, আব্বু সেটা মেনে নিয়েছেন।
ফজলের বাড়ি যখন পৌঁছেছি তখন ভরদুপুর, চারদিকে কেমন জানি সুনসান নীরবতা। আমি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ফজলকে ডাকলাম, কোনো সাড়াশব্দ নেই। তখন সাবধানে ভেতরে ঢুকে আবার ডাকলাম, তখনো কোনো সাড়াশব্দ নেই। বারান্দায় সেই বিশাল মটকাটার ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দেখলাম, সেই ঝুড়িটা এখনো আছে। আমি ঘরের ভেতরে উঁকি দিলাম বাড়ির পেছনে গেলাম, কোথাও কেউ নেই। যখন ফিরে যাচ্ছি তখন হঠাৎ শুনি শুকনো পাতার খচমচ শব্দ। তাকিয়ে দেখি একটা গাছের নিচে ফজল দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা হাড়, চিবিয়ে খেতে খেতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বিড়ালের মতো চোখ দুটি কেমন জানি জ্বলজ্বল করছে। তাকে দেখে আমরা সবাই কেমন জানি চমকে উঠলাম। আমি বললাম, ‘ফজল, তুই!’
ফজল কোনো কথা বলল না। আমি বললাম, ‘তোকে ডাকছিলাম তুই কোনো উত্তর দিলি না—’
ফজল এবারও কোনো কথা বলল না। আমি বললাম, ‘তুই স্কুলে আসিস না, তাই খোঁজ নিতে আসলাম। স্কুলে যাবি না?’
ফজল একটু অদ্ভুতভাবে মাথা নাড়ল। তার উত্তর হ্যাঁ কিংবা না দুটোই হতে পারে। আমি আবার বললাম, ‘তোর শরীর ভালো আছে? নানি মারা যাওয়ার পর একা একা থাকিস—কী খাস কী করিস—’
এবার ফজল কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। আমি তখন আর কোনো কথা বলার খুঁজে পেলাম না। তাই বললাম, ‘ঠিক আছে ফজল, আমরা তাহলে যাই। ভালো থাকিস।’
আমরা যখন হেঁটে কয়েক পা গিয়েছি ফজল তখন হঠাৎ করে বলল, ‘এই, শোন।’
আমরা তখন দাঁড়িয়ে গেলাম। ফজল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই একটা কথা শুনে যা।’
অন্যদের রেখে আমি একটু এগিয়ে গেলাম। ফজল আমাকে আরও খানিকটা দূরে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘তোকে একটা কথা বলি, তুই যেন কাউকে বলিস না।’
‘আমি বললাম, ‘কী কথা?’
‘আগে বল, কাউকে বলবি না।’
‘বলব না।’
‘আমার নানি আসলে মারা যায়নি।’
আমি একেবারে ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। বললাম, ‘মারা যায়নি?’
‘না।’
‘কোথায় আছে তোর নানি?’
‘দিনের বেলায় আসে না। অন্ধকার হলে নানি আসে। নানির শরীরটাও অনেক ভালো হয়েছে।
আমার শরীরটা ঝিমঝিম করতে থাকে। ফজল বলল, ‘তোর মনে আছে পোলাপান কী রকম উৎপাত করত? তোকে ধরেছিল মনে আছে?’
আমি দুর্বলভাবে মাথা নাড়লাম। ফজল বলল, ‘এখন আর উৎপাত করে না। নানি সবাইকে দেখে-শুনে রাখে।’
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। অবাক হয়ে ফজলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফজল বলল, ‘শুধু একটাই সমস্যা, দিনের বেলায় আসতে পারে না। সেই জন্য সারা দিন আমি ঘুমাই।’
ফজল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘নানি আমারে একটা বুদ্ধি দিয়েছে। সেইটা করলে সব সময়ই নানির কাছে থাকা যায়। বুদ্ধিটা তোকে বলব? ভয় পাবি না তো?’
আমি বললাম, ‘না না, আমি শুনতে চাই না।’
ফজল চিন্তিত মুখে বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে শোনার দরকার নেই।’
আমি শুকনো মুখে বললাম, ‘আমি যাই তাহলে?’
ফজল বলল, ‘যা।’
ফজলের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। কোথায় আছে কে জানে! হয়তো চলেই গেছে তার নানির কাছে। যেখানেই আছে, ভালো থাকুক।
এই জীবনটাতে তার মনে হয় কষ্টই ছিল। অন্য জীবনটা অন্তত একটু ভালো হোক।