নিশার প্রথম বাজার
নিশার হাতে একটি মুরগির ডিম। ডিমটির সাইজ নিয়ে ভীষণ বিড়ম্বনায় আছে নিশা। ডিমটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে সে। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছে না; ডিমটিকে কি বড় ডিম বলা যায়, নাকি ছোট? মা বলে দিয়েছে, ‘ডিমের সাইজ যেন ছোট না হয়।’ কিন্তু নিশার মনে হচ্ছে, ডিমগুলো বোধ হয় সাইজে কিছুটা ছোট। শেষ পর্যন্ত দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল নিশা। বলল, ‘আনিস চাচা, এই ডিমগুলো এত ছোট কেন?’
নিশার প্রশ্ন শুনে হাসতে শুরু করল দোকানদার আনিসুর রহমান। হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি শুনেছি, এই ডিমগুলো পাড়ার সময় মুরগির মন নাকি খারাপ ছিল। এ জন্য ডিমের সাইজ ছোট। কী রে সাব্বির, ঠিক না?’
সাব্বির আনিস চাচার অ্যাসিস্ট্যান্ট; এই দোকানের সাহায্যকারী। সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল আনিসুর রহমান। সাব্বিরও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
নিশা বলল, ‘মুরগি মন খারাপ করে ডিম পেড়েছে? এই ডিম খেলে তো আমাদেরও মন খারাপ হবে। সাব্বির ভাইয়া, প্লিজ ডিমগুলো বদলে বড় সাইজের ডিম দাও। তাহলে আমরা সবাই মিলে আনন্দ করে ডিম খাব আর আনন্দে থাকব।’
আনিস চাচা সাব্বিরকে ডিমগুলো বদলে দিতে বলল।
‘যাক বাঁচা গেছে। আরেকটু হলেই আনিস চাচা ছোট সাইজের ডিমগুলো হাতে ধরিয়ে দিত। একটুর জন্য বেঁচে গেছি,’ মনে মনে ভাবল নিশা।
নিশা ব্যাগ হাতে দোকান থেকে বের হয়ে আসবে, ঠিক সেই মুহূর্তে একজন ভিক্ষুক দোকানে ঢুকছিল। ভিক্ষুকটি অন্ধ। সঙ্গে আছে একটি কুকুর। কুকুরটিই তাকে পথ দেখাচ্ছে। নিশার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তার হাতে ৩০ টাকা আছে। সে আনিস চাচাকে বলল, ‘চাচা, এই টাকাতে একটা চকলেট আর বানরুটি হবে না?’
আজই প্রথম পাড়ার এই মুদিদোকানে একা বাজার করতে এসেছে নিশা। ওর অনেক দিনের ইচ্ছা, আনিস চাচার দোকানে একা বাজার করবে; যেমনটি শাফি ভাইয়া করে। কিন্তু দোকানে আসার কথা বললেই মা বলে, ‘আরেকটু বড় হও। এরপর একা বাজারে যেয়ো।’ নিশা বলে, ‘শাফি ভাইয়াকে তো তুমি আমার চেয়ে কম বয়সে একা বাজার করতে পাঠিয়েছ। তাহলে আমাকে একা পাঠাতে সমস্যা কোথায়?’ কিন্তু নিশার মা কোনোভাবেই রাজি নয়।
নিশাকে প্রায়ই রাফির উল্টাপাল্টা কথা শুনতে হয়। রাফি বলে, ‘বাজার করতে বুদ্ধি লাগে, বুঝলি? অঙ্কও জানতে হয়। অঙ্কে যেন কত পেয়েছিস বার্ষিক পরীক্ষায়? তোর বুদ্ধির যা অবস্থা, তাতে দোকানের বাজার দোকানেই পড়ে থাকবে। মাঝখান থেকে মায়ের টাকাগুলো হাওয়া হয়ে যাবে। তোর আইকিউ লেভেল একেবারে জিরোর কোঠায়, বুঝলি? আগে বড় হ। একটু বুদ্ধিশুদ্ধি হোক। এরপর বাজার করতে যাস।’
নিশার বয়স ৯ বছর, ক্লাস ফোরে পড়ে। শাফি নিশার চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড়। অথচ নিশার সঙ্গে এমন ভাব করে, না জানি সে কত বড়! রান্না করতে গিয়ে হঠাৎ কোনো কিছু ফুরিয়ে গেলে বা কোনো কিছুর খুব প্রয়োজন হলে শাফিকে আনিস চাচার দোকানে পাঠায় মা। ওদের বাসা থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে আনিস চাচার দোকান। আজ অনেক বলার পর মা রাজি হয়েছে নিশাকে একা আনিস চাচার মুদিদোকানে বাজার করতে পাঠাতে। মা নিশার হাতে বাজারের ছোট্ট একটি লিস্ট দিল। কিন্তু লিস্ট নিয়ে বাজারে যেতে রাজি হলো না নিশা। কারণ, সে কখনো শাফিকে লিস্ট নিয়ে দোকানে যেতে দেখেনি। নিশা সাহস করেই মাকে বলল, ‘লিস্ট লাগবে না, মা। আমার এমনিতেই মনে থাকবে।’
মা নিশার হাতে টাকা দিয়ে বলল, ‘প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কেনার পর যদি হাতে টাকা থেকে যায়, তাহলে তুমি তোমার ইচ্ছেমতো কিছু কিনতে পারো। এই টাকার পুরোটাই তুমি খরচ করতে পারো।’
ছোট্ট একটি বাজারের ব্যাগ হাতে সিঁড়ি দিয়ে চটপট নিচে নামল নিশা। শাফি পেছন থেকে বলল, ‘এই নিশা, টাকাগুলো দোকানে হারিয়ে আসিস না কিন্তু।’
আনিস চাচার দোকানে ডিম তো নেওয়া হলো। এরপর মা যেন কী বলেছিল! ভাবতে শুরু করল নিশা। চট করে মনে হলো, মা পেঁয়াজের কথা বলেছিল। কিন্তু পেঁয়াজের চেহারা যেন কেমন হয়? আলু আর পেঁয়াজের চেহারা গুলিয়ে ফেলেছে নিশা। এখন আনিস চাচা যদি তাকে পেঁয়াজের বদলে আলু দিয়ে দেয়, তখন কী হবে।’
নিশা যখন আলু আর পেঁয়াজের চেহারা নিয়ে মনে মনে গভীর গবেষণায় ব্যস্ত; ঠিক সেই মুহূর্তে ওর কানে এল কে যেন বলছে, ‘আনিস ভাই, দুই কেজি পেঁয়াজ দেন। দেখেশুনে পেঁয়াজ দেবেন কিন্তু। আগেরবার অর্ধেক পেঁয়াজ পচা ছিল। এইবার কিন্তু সাবধান।’
আলু-পেঁয়াজের সমস্যারও সমাধান হলো তাহলে। ভাগ্যিস, দোকানে কেউ পেঁয়াজ কিনছিল। নিশা চটপট বলল, ‘আনিস চাচা, আমাকেও এক কেজি পেঁয়াজ দিন। ভালো দেখে পেঁয়াজ দেবেন কিন্তু।’
পেঁয়াজ দেওয়া হলে সাব্বির বলল, ‘আরও কিছু নেবে আপু?’
নিশা বলল, ‘সাব্বির ভাইয়া, আমাকে একটা সাবান দাও।’
সাব্বির বলল, ‘কী সাবান? গায়ে দেওয়ার, নাকি কাপড় কাচার সাবান?’
এই রে! সাবানের কথা মনে আছে। কিন্তু কিসের সাবান, সেটা তো মনে নেই।
নিশার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ওর বাথরুমে রাখা গায়ে দেওয়ার সাবান প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মা নিশ্চয়ই গায়ে দেওয়ার সাবানের কথা বলেছে। নিশা চটপট সাব্বিরকে বলল, ‘গায়ে মাখার সাবান দাও, ভাইয়া।’
সাব্বির বলল, ‘আপু, ছোট সাইজের সাবান দেব, নাকি বড় সাইজের?’
নিশা বলল, ‘বড় সাইজ। কারণ, আগেরবার সে যে সাবানটি ব্যবহার করেছে, সেটা বেশ বড় ছিল।’
সাব্বির আবার বলল, ‘কী রঙের সাবান দেব?’
‘এ তো যন্ত্রণা হলো! এত কিছু মনে রাখা যায় নাকি!’ নিশা সাহস করে বলল, ‘সাদা রঙের সাবান দাও।’ আগেরবারের সাবানের রং গোলাপি ছিল। কিন্তু নিশার প্রিয় রং সাদা। মা নিশ্চয়ই এতে কিছু মনে করবে না।
আনিস চাচা বলল, ‘আর কী লাগবে নিশা?’
নিশা বলল, ‘সুইট চিলি সস।’
সাব্বির সুইট চিলি সস দিল। এরপর সবকিছুর হিসাব করার পালা। আনিস চাচা তার কাগজে সবকিছুর হিসাব করছে। শাফির কথা শুনে নিশা ভেবেছিল, হিসাব করার কাজটি হয়তো খুব কঠিন কিছু হবে। কিন্তু সে রকম কঠিন কিছুই নয়। সহজ একটা যোগ। আনিস চাচার কাগজের দিকে তাকিয়েই যোগটা মিলিয়ে ফেলতে পারল নিশা। এরপর যে টাকাটা মা তাকে দিয়েছে, সেই টাকা নিশা আনিস চাচাকে দিল। এরপর আনিস চাচা একটা বিয়োগ অঙ্ক করল। মায়ের দেওয়া মোট টাকা থেকে ডিম, পেঁয়াজ, সাবান আর চিলি সস কিনতে সব মিলিয়ে যা লেগেছে, সেটি বাদ দিল। আর তাতেই অবশিষ্ট টাকার পরিমাণ বের হয়ে এল।
নিশা আনিস চাচার কাছে জানতে চাইল, এই টাকা দিয়ে কী কেনা যায়?
আনিস চাচা বলল, ‘কী ধরনের জিনিস কিনতে চাও, আগে সেটা বলো। চকলেট দেব?’
নিশা বলল, ‘চকলেট তো আমার খুব পছন্দ। কিন্তু বাসার সবাই তো চকলেট খায় না। আমি এমন কিছু কিনতে চাই, যেটা বাসার সবাই মিলে খেতে পারি।’
আনিস চাচা বলল, ‘বাহ বাহ! খুব ভালো। তাহলে চানাচুরের একটা বড় প্যাকেট দিই, কী বলো? অবশ্য আইসক্রিমের একটা ছোট বক্সও কিনতে পারো।’
নিশার মনে পড়ে গেল, শাফি ভাইয়ার ঠান্ডা লেগেছে। আইসক্রিম খেলে ওর আরও বেশি ঠান্ডা লাগতে পারে। কিন্তু চানাচুর আর মুড়িমাখা সবার অনেক পছন্দ। তাই নিশা আনিস চাচাকে চানাচুর দিতে বলল।
চানাচুর কেনার পর ৩০ টাকা ফেরত এল নিশার হাতে। সাব্বির ভাইয়া সবকিছু একটা ব্যাগে তুলে দিল। সবকিছু ব্যাগে তোলার পর ডিমের প্যাকেটটা সবার ওপর রাখল।
নিশা বলল, ‘সাব্বির ভাইয়া, তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি তো। মা আমাকে বলে দিয়েছিল, ডিম যেন না ভাঙে।’
নিশা ব্যাগ হাতে দোকান থেকে বের হয়ে আসবে, ঠিক সেই মুহূর্তে একজন ভিক্ষুক দোকানে ঢুকছিল। ভিক্ষুকটি অন্ধ। সঙ্গে আছে একটি কুকুর। কুকুরটিই তাকে পথ দেখাচ্ছে। নিশার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তার হাতে ৩০ টাকা আছে। সে আনিস চাচাকে বলল, ‘চাচা, এই টাকাতে একটা চকলেট আর বানরুটি হবে না?’
আনিস চাচা বলল, ‘কী করবে চকলেট আর বানরুটি দিয়ে?’
নিশা ভিক্ষুককে দেখিয়ে বলল, ‘চকলেটটা এই দাদির জন্য আর বানরুটিটা উনার কুকুরটার জন্য।’
আনিস চাচা বলল, ‘দেখ তো নিশা, এই চকলেট আর বানরুটি চলবে?’
নিশা বলল, ‘খুব চলবে। কিন্তু ৩০ টাকায় এই দুইটা হবে তো?’
আনিস চাচা বলল, ‘কোনো চিন্তা নাই, নিশা মামণি। বাকি টাকাটা আমিই দেব। তুমি এইটুকু বয়সে সবার জন্য কত চিন্তা করো! আর আমি এইটুকু করতে পারব না?’
নিশা চকলেটটি প্যাকেট থেকে খুলে ভিক্ষুকের হাতে দিল। এমন আশ্চর্য ঘটনা ভিক্ষুকের জীবনে আগে কখনো ঘটেনি। সে যে কত যুগ চকলেট খায়নি, মনেও করতে পারল না। আনন্দে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে ভিক্ষুকের। আর সে চেটেপুটে চকলেট খাচ্ছে। ওদিকে কুকুরটিও মনে হয়ে সারা দিন কিছু খায়নি। সে বানরুটি খাচ্ছে আর কুঁই কুঁই শব্দ করছে।
দোকান থেকে বাড়ি ফিরে এল নিশা। নিশাকে ফিরে আসতে দেখে ছুটে এল শাফি, কিন্তু বাজার দেখে আর সবকিছু শুনে হাঁ হয়ে গেল একেবারে। মা-ও অবাক। মা বলল, ‘দেখেছ শাফি, আমাদের ছোট্ট নিশা কত বড় হয়ে গেছে!’ শাফি হাসতে হাসতে বলল, ‘তা-ই তো দেখছি। নিশা, তোর আইকিউ লেভেল আমি যতটা কম ভেবেছিলাম, ততটা কম কিন্তু নয়।’