হাজার বছর আগের পৃথিবী

২৯৭০ সালের ঢাকা শহর। ১৫০ তলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ৯৮ তলায় ফ্ল্যাট সিতে থাকে অরিনরা।

একটু পরেই ক্লাস শুরু হবে। এখন অবশ্য কোনো ছেলেমেয়েকে স্কুলে যেতে হয় না। বাসায় বসেই ক্লাস করা যায় ‘ভার্চুয়াল’ স্কুলগুলোতে। শুধু পরীক্ষাগুলো হয় এক্সাম সেন্টারে। কারণ, ঢাকা শহরের বাতাস এখন প্রচণ্ড বিষাক্ত। সেটা আর মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের উপযোগী নেই। মানুষ এখন বিশাল সব অ্যাপার্টমেন্টে বাস করে। সেখানে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা আছে। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টে স্কুল, মার্কেট, সুপারশপ সবকিছুই আছে।

অরিন তাদের ড্রয়িংরুমের দেয়ালজুড়ে থাকা জায়ান্ট স্ক্রিনটা অন করে। এরপর স্মার্ট কিবোর্ডে ‘স্কুল’ লিখতেই স্ক্রিনে ক্লাস থ্রির ম্যাথ টিচারের (ফারহানা ম্যাডামের) হাসি হাসি মুখ দেখা যায়।

‘গুড মর্নিং অরিন।’

‘গুড মর্নিং ম্যাম।’ মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ম্যাডামের দিকে তাকায় অরিন। গতকালের হোমওয়ার্ক করা হয়নি। নতুন যে চ্যাপ্টারটা ম্যাডাম গতকাল বুঝিয়েছিলেন তার কিছুই সে বুঝতে পারেনি। আজ ম্যাডাম আবার নতুন চ্যাপ্টার শুরু করেছেন। কিন্তু সেদিকে মন নেই অরিনের। তার হঠাৎ করে আকাশ দেখতে ইচ্ছে করছে। সেদিন ন্যাচার চ্যানেলে ‘স্কাই’ নামে একটি ডকুমেন্টারি দেখছিল সে। এর পর থেকে তার শুধু আকাশ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। অরিন কাচ দিয়ে ঢাকা ছোট্ট ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। গাঢ় কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে আছে আকাশ। সেটা ভেদ করে খুব অল্পই সূর্যের আলো আসছে। কেমন যেন গুমোট দমবন্ধ পরিবেশ।

‘অরিন, ক্লাস বাদ দিয়ে বারান্দায় কী করছ?’ হোম স্পিকারে মায়ের কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

বাসায় ছোট বাচ্চা থাকলে মা-বাবারা প্রত্যেক রুমে চাইল্ড অবজারভার নামে একটি ডিভাইস লাগান। ফলে অফিসে বসেও সবসময় তাঁরা বাচ্চার কর্মকাণ্ড দেখতে পারেন।

অরিন অভিমানী স্বরে বলল, ‘মা, আমার আকাশ দেখতে ইচ্ছে করছে।’

‘তোমার টিচারের সঙ্গে এক্ষুনি কথা হলো। তুমি নাকি পড়ালেখায় মনোযোগ দিচ্ছো না।’ একটু থেমে মা বললেন, ‘আর তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে। স্কুল থেকে স্টাডি টুর অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে। থিম পার্কে।’

অরিন বুঝতে পারল স্কুল থেকে যে পার্কটিতে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটির নাম ‘ওয়ার্ল্ড অব থাউজেন্ড ইয়ারস অ্যাগো’। বাংলায় যার মানে দাঁড়ায় হাজার বছর আগের পৃথিবী। এই থিম পার্কটিকে নিয়ে চারদিকে এখন তুমুল আলোচনা। ওখানে গেলে নাকি আসতেই ইচ্ছে করে না।

শুক্রবারের খুব সকালে অরিন তার মাকে নিয়ে পার্কের উদ্দেশে রওনা হলো। ঢাকা শহরে এখন রাস্তা বলে কিছু নেই, আছে স্কাইওয়ে। শহরের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর ছাদের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে এগুলো। আর এই পথগুলো দিয়ে বিশেষ যে যানগুলা চলে, তার নাম স্কাইবাস।

স্কাইবাস থেকে নেমে অরিন দেখল তার বন্ধুরা সবাই চলে এসেছে। খুব উত্তেজিত সবাই। পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যেকে তাদের মা কিংবা বাবাকে নিয়ে। অবশ্য পার্কের ভেতর অভিভাবকেরা কেউ যাবেন না। শুধু ছেলেমেয়েরা যাবে।

সবাই ভেতরে ঢুকতেই পার্কের একজন স্টাফ বললেন, ছোট্ট বন্ধুরা, তোমাদের কমিউনিকেশন ফোন ও গেমিং ডিভাইসগুলো অফিসে জমা দিয়ে দাও। তোমরা এখন হাজার বছর আগের পৃথিবীতে আছো। সে সময়ের শিশুরা এগুলো ব্যবহার করত না।’

দল বেঁধে পার্কের ভেতর হাঁটছে সবাই। গোটা ব্যাপারটাই কৃত্রিম। মানুষের তৈরি। কিন্তু সবকিছু এত নিখুঁত যে বাস্তব মনে হয়।

অরিন ওপরে তাকাল। কী চমৎকার আকাশ। ছেঁড়া তুলোর মতো সাদা মেঘে ছেয়ে আছে। দেখলেই মনটা ভরে ওঠে। তারা এখন যেখানে হাঁটছে, সেটা ছোট্ট একটা বনের মতো। বিচিত্র সব গাছপালা। বিচিত্র সব শব্দে পাখিরা ডাকছে। নানা রঙের রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক।

লাল-হলুদ রঙের একটা প্রজাপতি ধরার জন্য দৌড়ে গেল অরিন। কিন্তু উড়ে গেল সেটা। তার দেখাদেখি অন্যরাও প্রজাপতি ধরার জন্য ছোটাছুটি করতে লাগল। অদ্ভুত এক আনন্দ। অরিনের মনে হলো এত আনন্দ সে জীবনে কখনো পায়নি। কেউ প্রজাপতি না ধরতে পারলেও সবার মুখ খুশিতে ঝলমল করছে।

হঠাৎ গুডুম গুডুম শব্দে মেঘ ডাকতে লাগল। বিদ্যুত্ চমকাতে থাকল। সঙ্গে সঙ্গে জোরে বাতাস। অরিন দেখল কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। পার্কের স্টাফ বললেন, ‘ভয় পেয়ো না বন্ধুরা। এখন বৃষ্টি হবে। বৃষ্টিতে ভিজব আমরা সবাই।’

ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ সত্যিই অন্য রকম। অরিনের মন জুড়িয়ে গেল। মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে সবাই।

বিকেলে সবাইকে মাঠে নিয়ে যাওয়া হলো। এখন গোল্লাছুট খেলা হবে। কেউ বুঝতে পারছিল না যে কীভাবে খেলা হবে। কারণ, সবার গেমিং ডিভাইসগুলো তো জমা নেওয়া হয়েছে। পার্কের স্টাফ বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে গোল্লাছুট খেলতে হয়। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে অরিন ও তার বন্ধুরা দুই দলে ভাগ হয়ে খেলতে শুরু করে। অরিনের এত ভালো লাগছিল যে বলার মতো নয়। গোল্লাছুট খেলার পর কম্পিউটার গেমসগুলোকে তার রীতিমতো হাস্যকর ও পানসে মনে হতে থাকে।

অবশেষে ফেরার সময় হয়ে গেল। অরিনের মনে হলো চোখের পলকে যেন দিনটা শেষ হয়ে গেল। ফেরার পথে মায়ের সঙ্গে আবার স্কাইবাসে চড়ে বসল। ঢাকা শহর এখন আর মানুষের বসবাসের উপযোগী নেই। খোলা বাতাসে কেউ বের হয় না। স্কাইবাসের পুরোটাই বিশেষ কাচ দিয়ে তৈরি। অরিন বাইরে তাকাল। কী নিকষ কালো অন্ধকার। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের প্রকৃতি নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু সে কিছুটা অন্য রকম। অরিন জানে আজ পূর্ণিমা। তার স্মার্ট ডিভাইস বারবার নোটিফিকেশন দিচ্ছে। তার ডিভাইসে ‘মুন লাইট’ নামে বিশেষ একটি সফটওয়্যার আছে, যা চাঁদসংক্রান্ত সব তথ্য দিতে পারে।

আগেকার কবি-সাহিত্যিকেরা এই পূর্ণিমা নিয়ে কত কিছু লিখেছেন। কিন্তু এই প্রজন্মের মানুষ কখনো পূর্ণিমা দেখেনি। অরিনের হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ হতে থাকে হাজার বছর আগের মানুষগুলোর ওপর। কী দরকার ছিল এত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির, এত সমৃদ্ধির? এই যে মানুষ এত এত আকাশচুম্বী সব অট্টালিকা গড়েছে, সবই তো সুখের জন্য। কিন্তু সত্যিই কি পেরেছে সুখী হতে? প্রকৃতির সর্বনাশ করে মানুষ যে সুখের স্বর্গ রচনা করতে চেয়েছে, সেই চেষ্টা কি সফল হয়েছে? যে জীবনে বৃষ্টিতে ভেজার সুখ নেই; শীতের সকালে খালি পায়ে দূর্বাঘাসের ওপর হাঁটার শিহরণ নেই, ভরা পূর্ণিমার জোছনায় ভেজার আনন্দ নেই, সে জীবনের কী মানে? এই প্রজন্মের মানুষ কখনোই জানবে না প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকার মধ্যে কী অপার্থিব সুখ!

পার্কের লাল-হলুদ রঙের প্রজাপতিটার কথা ভেবে হঠাৎ অরিনের চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।