দ্রিঘাংচু

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

এক ছিল রাজা।

রাজা একদিন সভায় বসেছেন। চারদিকে তাঁর পাত্র-মিত্র, আমির-ওমরা, সেপাই-সান্ত্রি গিজগিজ করছে। এমন সময় কোথা থেকে একটা দাঁড়কাক উড়ে এসে সিংহাসনের ডান দিকে উঁচু থামের ওপর বসে ঘাড় নিচু করে চারদিকে তাকিয়ে, অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলল, ‘ক’।

কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ এ রকম গম্ভীর শব্দ—সভাসুদ্ধ সবার চোখ একসঙ্গে গোল হয়ে উঠল। সবাই একেবারে একসঙ্গে হাঁ করে রইল। মন্ত্রী একতাড়া কাগজ নিয়ে কী যেন বোঝাতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ বক্তৃতার খেই হারিয়ে তিনি বোকার মতো তাকিয়ে রইলেন। দরজার কাছে একটা ছেলে বসে ছিল, সে হঠাৎ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল, যে লোকটা চামর দোলাচ্ছিল, চামরটা তার হাত থেকে ঠাঁই করে রাজার মাথার ওপর পড়ে গেল। রাজামশাইয়ের চোখ ঘুমে ঢুলে এসেছিল, তিনি হঠাৎ জেগে উঠেই বললেন, জল্লাদ ডাকো।

বলতেই জল্লাদ এসে হাজির। রাজামশাই বললেন, মাথা কেটে ফেলো। সর্বনাশ! কার মাথা কাটতে বলে; সবাই ভয়ে ভয়ে নিজের মাথায় হাত বোলাতে লাগল। রাজামশাই খানিকক্ষণ ঝিমিয়ে আবার তাকিয়ে বললেন, কই, মাথা কই? জল্লাদ বেচারা হাতজোড় করে বলল, আজ্ঞে মহারাজ, কার মাথা? রাজা বললেন, বেটা গোমুখ্যু কোথাকার, কার মাথা কিরে! যে ওই রকম বিটকেল শব্দ করেছিল, তার মাথা। শুনে সভাসুদ্ধ সবাই হাঁফ ছেড়ে এমন ভয়ানক নিশ্বাস ফেলল যে কাকটা হঠাৎ ধড়ফড় করে সেখান থেকে উড়ে পালাল।

তখন মন্ত্রিমশাই রাজাকে বুঝিয়ে বললেন যে ওই কাকটাই ও রকম আওয়াজ করেছিল!

তখন রাজামশাই বললেন, ডাকো পণ্ডিতসভার যত পণ্ডিত সবাইকে। হুকুম হওয়ামাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে রাজ্যের যত পণ্ডিত সব সভায় এসে হাজির। তখন রাজামশাই পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে একটা কাক এসে আমার সভার মধ্যে আওয়াজ করে এমন গোল বাধিয়ে গেল, এর কারণ কিছু বলতে পারো?

কাকে আওয়াজ করল, তার আবার কারণ কী? পণ্ডিতেরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। একজন ছোকরামতো পণ্ডিত খানিকক্ষণ কাঁচুমাচু করে জবাব দিল, আজ্ঞে, বোধ হয় তার খিদে পেয়েছিল। রাজামশাই বললেন, তোমার যেমন বুদ্ধি! খিদে পেয়েছিল, তা সভার মধ্যে আসতে যাবে কেন? এখানে কি মুড়ি-মুড়কি বিক্রি হয়! মন্ত্রী, ওকে বিদেয় করে দাও। সবাই মহা তম্বী করে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ঠিক, ওকে বিদায় করুন।

আরেকজন পণ্ডিত বলল, মহারাজ, কার্য থাকলেই তার কারণ আছে—বৃষ্টি হলেই বুঝবে মেঘ আছে, আলো দেখলেই বুঝবে প্রদীপ আছে, সুতরাং বায়স পক্ষীর কণ্ঠনির্গত এই অপরূপ ধ্বনিরূপ কার্যের নিশ্চয়ই কোনো কারণ থাকবে, এতে আশ্চর্য কী?

রাজা বললেন, আশ্চর্য এই যে তোমার মতো মোটা বুদ্ধির লোকও এ রকম আবোলতাবোল বকে মোটা মোটা মাইনে পাও। মন্ত্রী, আজ থেকে এর মাইনে বন্ধ করো। অমনি সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠল, মাইনে বন্ধ করো।

দুই পণ্ডিতের এ রকম দুর্দশা দেখে সবাই কেমন ঘাবড়ে গেল। মিনিটের পর মিনিট যায়, কেউ আর কথা কয় না। তখন রাজামশাই দস্তুরমতো খেপে গেলেন। তিনি হুকুম দিলেন, এর জবাব না পাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন সভা ছেড়ে না ওঠে। রাজার হুকুম—সবাই আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল। ভাবতে ভাবতে কেউ কেউ ঘেমে ঝোল হয়ে উঠল, চুলকাতে চুলকাতে কারও কারও মাথায় প্রকাণ্ড টাক পড়ে গেল। বসে বসে সবার খিদে বাড়তে লাগল। রাজামশাইয়ের খিদেও নেই, বিশ্রামও নেই, তিনি বসে বসে ঝিমুতে লাগলেন।

সবাই যখন হতাশ হয়ে এসেছে, আর মনে মনে পণ্ডিতদের ‘মূর্খ অপদার্থ নিষ্কর্মা’ বলে গাল দিচ্ছে, এমন সময় রোগা শুঁটকিমতো এক লোক হঠাৎ বিকট চিৎকার করে সভার মাঝখানে পড়ে গেল। রাজা, মন্ত্রী, পাত্র-মিত্র, উজির-নাজির সবাই ব্যস্ত হয়ে বলল, কী হলো, কী হলো? তখন অনেক জলের ছিটে, পাখার বাতাস আর বলা-কওয়ার পর লোকটা কাঁপতে কাঁপতে উঠে বলল, মহারাজ, সেটা কি দাঁড়কাক ছিল? সবাই বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন বলো দেখি? লোকটা আবার বলল, মহারাজ, সে কি ওই মাথার ওপর দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসে ছিল, আর মাথা নিচু করে ছিল, আর চোখ পাকিয়ে ছিল, আর ‘ক’ করে শব্দ করেছিল? সবাই ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ওই রকম হয়েছিল। তাই শুনে লোকটা আবার ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল, হায় হায়, সেই সময়ে কেউ আমায় খবর দিলে না কেন?

রাজা বললেন, তাই তো, একে তোমরা তখন খবর দাওনি কেন? লোকটাকে কেউই চেনে না, তবু সে কথা বলতে সাহস পেল না। সবাই বলল, হ্যাঁ, ওকে একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল—যদিও কেন তাকে খবর দেবে, আর কী খবর দেবে, এ কথা কেউ বুঝতে পারল না। লোকটা তখন খানিকটা কেঁদে তারপর মুখ বিকৃত করে বলল, দ্রিঘাংচু! সে আবার কী! সবাই ভাবল, লোকটা খেপে গেছে।

মন্ত্রী বললেন, দ্রিঘাঞ্চু কী হে? লোকটা বলল, দ্রিঘাঞ্চু নয়, দ্রিঘাংচু। কেউ কিছু বুঝতে পারল না। তবু সবাই মাথা নেড়ে বলল, ও! তখন রাজামশাই জিজ্ঞাসা করলেন, সে কী রকম হে? লোকটা বলল, আজ্ঞে আমি মূর্খ মানুষ, আমি কি অত খবর রাখি, ছেলেবেলা থেকে দ্রিঘাংচু শুনে আসছি, তাই জানি দ্রিঘাংচু যখন রাজার সামনে আসে, তখন তাকে দেখতে দেখায় দাঁড়কাকের মতো। সে যখন সভায় ঢোকে, তখন সিংহাসনের ডান দিকের থামের ওপর বসে মাথা নিচু করে দক্ষিণ দিকে মুখ করে চোখ পাকিয়ে ‘ক’ বলে শব্দ করে। আমি তো আর কিছুই জানি না। তবে পণ্ডিতেরা যদি জানেন। পণ্ডিতেরা তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়ে বলল, না না, ওর সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায়নি।

রাজা বললেন, তোমায় খবর দেয়নি বলে কাঁদছিলে, তুমি থাকলে করতে কী? লোকটা বলল, মহারাজ, সে কথা বললে যদি লোকে বিশ্বাস না করে, তাই বলতে সাহস হয় না।

রাজা বললেন, যে বিশ্বাস করবে না, তার মাথা কাটা যাবে। তুমি নির্ভয়ে বলে ফেলো। সভাসুদ্ধ লোক তাতে হ্যাঁ হ্যাঁ করে সায় দিয়ে উঠল।

লোকটা তখন বলল, মহারাজ, আমি একটা মন্ত্র জানি, আমি যুগজন্ম ধরে বসে আছি, দ্রিঘাংচুর দেখা পেলে সেই মন্ত্র তাকে যদি বলতে পারতাম, তাহলে কী যে আশ্চর্য কাণ্ড হতো, তা কেউ জানে না। কারণ, তার কথা কোনো বইয়ে লেখেনি। হায় রে হায়, এমন সুযোগ আর কি পাব? রাজা বললেন, মন্ত্রটা আমায় বলো তো। লোকটা বলল, সর্বনাশ! সে মন্ত্র দ্রিঘাংচুর সামনে ছাড়া কারোর কাছে উচ্চারণ করতে নেই। আমি একটা কাগজে লিখে দিচ্ছি, আপনি দুদিন উপোস করে তিন দিনের দিন সকালে উঠে সেটা পড়ে দেখবেন। আপনার সামনে দাঁড়কাক দেখলে তাকে আপনি মন্ত্র শোনাতে পারেন, কিন্তু খবরদার, আর কেউ যেন তা না শোনে। কারণ, দাঁড়কাক যদি দ্রিঘাংচু না হয়, আর তাকে মন্ত্র বলতে গিয়ে অন্য লোকে শুনে ফেলে, তা হলেই সর্বনাশ!

তখন সভা ভঙ্গ হলো। সভার সবাই এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিল, তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল; সবাই দ্রিঘাংচুর কথা, মন্ত্রের কথা আর আশ্চর্য ফল পাওয়ার কথা বলাবলি করতে করতে বাড়ি চলে গেল।

তারপর রাজামশাই দুদিন উপোস করে তিন দিনের দিন সকালবেলা, সেই লোকটার লেখা কাগজখানা খুলে পড়লেন। তাতে লেখা আছে—

হল‌‌দে সবুজ ওরাং ওটাং
ইটপাট‌‌কেল চিতপটাং
মুশকিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি।

রাজামশাই গম্ভীরভাবে এটা মুখস্থ করে নিলেন। তারপর থেকে তিনি দাঁড়কাক দেখলেই লোকজন সব তাড়িয়ে তাকে মন্ত্র শোনাতেন, আর চেয়ে দেখতেন কোনো রকম আশ্চর্য কিছু হয় কি না! কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি দ্রিঘাংচুর কোনো সন্ধান পাননি।

সুকুমার রায়: প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক এবং বাংলা সাহিত্যে ননসেন্স রাইমের প্রবর্তক সুকুমার রায় ১৮৮৭ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে একজন লেখক, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। তাঁর বাবা জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং সন্তান খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। সুকুমার রায়ের লেখাকে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা ‘ননসেন্স’ ঘরানার শিশুসাহিত্য বলে মনে করা হয়। ১৯২৩ সালে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।