৫৩ বছর পর মা ফিরে পেলেন হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে
প্রিয় মরিয়ম, তুমি কি এই ফেসবুক পোস্ট দেখছ? বোন আমার। তুমি কি এই ফেসবুক পোস্টটা দেখছ? আপনারা কি কেউ মরিয়ম নামের কোনো ভদ্রমহিলাকে চেনেন? যাঁর বয়স ৫৮ বছর। যাঁর চেহারার সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই, শুধু আমাদের দুজনের চোখের রং বিড়ালের মতো। কারণ, আমার মায়ের চোখের রং ছিল বিড়ালের মতো। আমার মা মৃত্যুশয্যায়। নানা রকমের স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগছেন। পেটের ভেতরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন, ‘উনি যা চান, করতে দিন। তাঁর শেষ ইচ্ছাগুলো পূরণ করুন।’
আমার মায়ের একটা শেষ ইচ্ছা আছে। তিনি তাঁর হারিয়ে যাওয়া মেয়ে মরিয়মকে একটাবারের জন্য হলেও দেখতে চান।
আমার মা সারাটা জীবন মরিয়ম মরিয়ম বলে কেঁদেছেন! অথচ আমরা পাঁচ ভাইবোন ছিলাম। আমি ছাড়াও আমার ছোট আরও তিন ভাই আছে। আমি আর মরিয়ম ছিলাম যমজ। আইডেন্টিক্যাল যমজ না। দুজনের চেহারার কোনো মিল ছিল না। কিন্তু আমাদের দুজনের চোখ চারটা ছিল একই রকম দেখতে।
আজ থেকে ৫৩ বছর আগের একটা ছবি আমাদের আছে। আমরা পুরানা পল্টনের ছায়াছবি স্টুডিওতে গিয়ে একটা ছবি তুলেছিলাম। দুই ভাই–বোন গলা ধরে ছবি তুলেছিলাম। পেছনে হাতে আঁকা একটা নদীর দৃশ্য ছিল। সাদা–কালো ছবিতে বোঝা যাচ্ছে না যে পেছনের ছবিটা কি রঙিন ছিল, নাকি সাদা–কালো ছিল। তখন আমাদের বয়স ছিল বছর চারেক। স্মৃতির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
শুধু ছবিটা রয়ে গেছে। আমাদের আরেকটা ছবি আছে ওই দিন তোলা। বাবা, মা, আমি আর মরিয়ম আর আমাদের দুই বছরের ভাই মন্টু। আমার নাম মিথুন।
তো মিথুন আর মরিয়ম—আমরা দুই যমজ ভাই–বোন ছিলাম হরিহর আত্মা।
মাঝেমধ্যে ওর মনের কথা আমি পড়তে পারতাম।
একদিন রাতে ওকে পিঁপড়ায় ধরেছিল। ও গুড়মাখা মুড়ি খেয়েছিল। সেই গুড়মাখা মুড়ি মরিয়ম তার জামার কোছায় রেখেছিল। রাতের বেলা পিঁপড়া উঠে ওর সারা গা ভরে ফেলেছিল। ওকে কামড়াচ্ছিল। ও ঘুমের ঘোরে টের পাচ্ছিল না। আর আমার পেশাব পাওয়ায় আমি ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলাম। মাকে বললাম, ‘মা, হিসু করব।’ মা ঘুম থেকে উঠে বাতি জ্বালালেন।
আমি বললাম, ‘মা আমার পেটে পিঁপড়া কামড়াচ্ছে।’ মা আমার গেঞ্জি তুলে দেখলেন, ‘কই, না তো!’
আমি বললাম, ‘তার মানে মরিয়মের পেটে পিঁপড়া উঠেছে।’
মা মশারি তুলে মরিয়মের জামা তুললেন। পেটে অনেক লাল পিঁপড়া।
এই রকমের আশ্চর্য সব ঘটনা ঘটত।
আমরা খুব রান্নাবাটি খেলতাম। আমি বাজারে যেতাম। ইটের টুকরা আনতাম। সেগুলো হলো মাংস। ঘাসপাতা আনতাম। শাক হিসেবে। ছোট একধরনের পাতা ছিল, টিপ দিলে তেল বের হতো। সেটাকে আমরা বলতাম, পরাটার গাছ। সেটা এনে পাটখড়ির বেলনা দিয়ে বেলে মরিয়ম পরাটা বানাত। আর মনে আছে, আমরা টিলো এক্সপ্রেস খেলতাম। সেটা ছিল একধরনের লুকোচুরি খেলা।
১৯৭১ সালের আর কোনো স্মৃতি আমার নাই। হাতের লেখা খাতায় অ আ লেখার চেষ্টা করতাম। সেই খাতার ওপরে ৬ দফা লেখা ছিল। আর ছিল বঙ্গবন্ধুর একটা ছবি। সেই খাতায় আমরা লিখতাম। আমার চেয়ে মরিয়মের ব্রেন ভালো ছিল। সে তিনের ঘরের নামতা মুখস্থ বলতে পারত। আর নামাজের জন্য ওর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল চারটা সুরা। আমার শুধু সূরা ফাতিহা মুখস্থ ছিল। কিন্তু আমি ভালো ছবি আঁকতে পারতাম। আমি খাতার মলাট দেখে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকতে পারতাম। তবে আরেকটা বুদ্ধি ছিল। সাদা কাগজে তেল লাগালে কাগজটা স্বচ্ছ হয়ে যেত। ইংরেজিতে বলা যায়, ট্রান্সপারেন্ট। ট্রেসিং পেপারের মতো। সেই কাগজটা খাতার মলাটে ধরে নিচের বঙ্গবন্ধুর ছবির ওপর রেখে পেনসিল দিয়ে আমি ছবিটা কপি করতে পারতাম। এই নিয়ে মরিয়মের সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতা হতো।
আমিও ছবি আঁকতাম।
মরিয়মও ছবি আঁকত।
আমরা বাবাকে দেখাতাম। আমাদের বাবা ছিলেন গানের শিক্ষক। তিনি বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে গান শেখাতেন। তাঁর চুল ছিল লম্বা। আর মাথায় মাখতেন গন্ধরাজ তেল। (আমি সেই তেল কাগজে মেখে কাগজটাকে পাতলা বানাতাম।)
আমাদের মা তাঁর ছাত্রী ছিলেন। তিনি ছাত্রীকে বিয়ে করেন। আমার মা রান্নাবান্না করতেন। মাঝেমধ্যে বাবার সঙ্গে গান নিয়ে বসতেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরতেন। বাবা তখন তবলা বাজাতেন।
মায়ের প্রিয় গান ছিল, ‘কাবেরী নদী–জলে কে গো বালিকা’।
তো আমরা দুই যমজ ভাই–বোন। এরপর আরেকটা ভাই হলো। এরপর আরেকটা পেটে। মা গান করবেন কখন? রান্নাবান্না করতেও হতো। কাজের একটা ছোট্ট মেয়ে ছিল। রংপুর থেকে এসেছিল। তার নাম ছিল জোলেখা। সে রংপুরকে বলত অংপুর। আর রাজাকে বলত আজা।
যুদ্ধের আগে ঢাকায় খুব মিছিল হতো। মিছিলে গুলি হতো। সব যে আমার স্মৃতিতে আছে, তা নয়। আমাদের দুজনের, আমার আর মরিয়মের বয়স—৫ বছর। হয়তো মনে আছে, হয়তো অন্যরা বলেন, আমরা শুনি, সেই থেকে আমার মধ্যে কল্পনাগুলো স্মৃতি হয়ে আছে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই জোলেখার বাবা এসে জোলেখাকে নিয়ে গেলেন।
মা বললেন, ‘জোলেখার বাবা, আপনি জোলেখাকে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?’
জোলেখার বাবা বললেন, ‘শেখ সাহেব বলে দিচে, যার যা কিছু আছে, তাই নিয়া লড়াই করা নাগপে। যুদ্ধ বাজি যাবে। তোমরা ঢাকাত থাকেন। ঢাকাত তো বেশি বোমা মারিবে। হামরা অমপুর গেরামত চলি যামো। অটে কোনো যুদ্ধ না হইবে। হইলে মুই জোলেখাক অর মায়ের কাছে থুয়া যুদ্ধ করিবার লাগি চলি যামো। মুই জোলেখাক নিয়া যাই।’
জোলেখা চলে গেল।
আমাদের খেলা বন্ধ হলো না। আমি আর মরিয়ম আর আমাদের নয়াপল্টন এলাকার ছোট ছেলেমেয়েরাও মিছিল করতাম।
‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।
বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতটা ছিল ভয়ংকর। এত গোলাগুলির শব্দ হলো। আমরা আমাদের পল্টনের ভাড়া বাসার নিচতলায় থাকতাম। আমরা সবাই খাটের নিচে শুয়ে থাকলাম।
এখন বুঝতে পারি, আমাদের বাড়ি থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস বেশি দূরে ছিল না। কাজেই আমরা গুলির শব্দ আর আগুনের গনগনে আলোর দমক বেশি করে পেয়েছিলাম।
ভয়ে আমি আর মরিয়ম কাঁদছিলাম।
মা আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন। পাশেই মন্টু।
তার পাশে বাবা। বাবা কী করবেন, বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে আজান দিতে শুরু করলেন। আল্লাহ আকবর।
অমনি একটা গুলি এসে আমাদের কাচের জানালা দিয়ে ঢুকে আলনার শাড়ি ভেদ করে দেয়ালে বিঁধল।
মা দৌড়ে বাবাকে জাপটে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিলেন।
২৫ মার্চ রাতটা কীভাবে কেটেছিল, আল্লাহ জানেন। ৫৩ বছর পর আমি, সেদিনের ৫ বছরের শিশু কী আর বলব।
২৬ মার্চ কারফিউ ছিল।
২৭ মার্চ কারফিউ কিছুক্ষণের জন্য তুলে নেওয়া হলো। আমরা, বাবার কথামতো, কিছু জিনিসপত্র ব্যাগে পুরে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে নদীর ওই পারে গেলাম। জিনজিরা না কী যেন জায়গা। বাবার এক ছাত্রের বাড়ি ছিল। আমাদের ওরা ডিম সেদ্ধ দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছিল। আর বাড়িতে কামরাঙাগাছ ছিল।
আমি আর মরিয়ম কামরাঙাগাছের নিচে গেলাম। গাছের নিচে কামরাঙার হলুদ পাতা পড়ে ছিল। আর একটা অন্ধকার ঠান্ডা জায়গায় ছিল টিউবওয়েল। ওদের পায়খানাটা ছিল উঠানের এক কোণে।
আরেকটা কথা মনে আছে। ওই বাড়িতে ওরা চালতার আচার শুকাতে দিয়েছিল কুলায় করে।
মরিয়ম সেই আচার মুখে দিয়েছিল। আর নোনা টক স্বাদে আমার জিব ভরে গিয়েছিল। যমজ ভাই–বোনদের অনেক কিছু হয়।
তারপর একদিন আমাদের এই এলাকাতেও পাকিস্তানি সৈন্য আক্রমণ করতে এল।
আমার আর কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে, আমরা পালাচ্ছি। গুলি হচ্ছে। গুলিতে লোক পড়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে। আমরা পালাচ্ছি। আমি বাবার হাত ধরে আছি। মরিয়ম আমার হাত ধরে আছে। আমার প্রেগন্যান্ট মা মন্টুকে কোলে নিয়েছেন। আমরা পালাচ্ছি। এরই মধ্যে বাবার হাতে একটা ব্যাগে জিনিসপাতি।
আমরা দৌড়ে একটা নদীর ধারে গেলাম। তীর থেকে নামলাম। নিচে নদীর বালুচরে। সামনে নৌকা।
নদীর চরে নামার পর সবাই বলল, এইখানে গুলি লাগবে না। কারণ, গুলি আকাশ দিয়ে চলে যাবে।
সামনে একটা নৌকা। সামনে আরও নৌকা। সবাই নৌকায় উঠে নদী পার হয়ে ওই পাড়ে যাবে।
মানুষ পিঁপড়ার মতো পিলপিল করে আসছে। একজনের গায়ে আরেকজন উঠছে।
আমরা নৌকায় উঠলাম। আমি মরিয়মের হাত ছাড়িনি।
বড়ই ছিল নৌকাটা। কিন্তু লোক উঠে পড়ল বেশি। ভারে বুঝি ডুবেই যাবে। নৌকা ছাড়ল। মাঝিরা লগি ঠেলছে। সবাই মিলে বইঠা বাইছে। সাধারণ মানুষেরাও হাত দিয়ে পানি ঠেলছে। যাতে নৌকা এগোতে পারে।
নদীর ওই পাড়ের কাছে যাওয়ার সময় নৌকা গেল ডুবে। আমরা পানিতে পড়ে গেলাম। বেশি পানি ছিল না। বাবার কোমরপানি হতে পারে।
ততক্ষণে পাকিস্তানি সৈন্যরা ওই পারে এসে গেছে। তারা গুলি ছুড়ছে পানিতে।
বাবা আমাকে কোলে তুলে ছুটছেন। মা মন্টুকে কোলে নিয়ে ছুটছেন। আমার হাত থেকে মরিয়মের আঙুল খসে গেল।
আমরা ওই পারে গিয়ে চরের মধ্যে শুয়ে পড়লাম। হোগলার গাছের মধ্যে লুকালাম। তারপর ছুটে নদীর তীরে উঠে একটা বটগাছের আড়ালে গেলাম।
তারপর গুলি থামল।
তখন আমার মনে হলো, মরিয়ম নেই।
মরিয়ম মরিয়ম বলে কাঁদতে কাঁদতে মা আবার নদীতে গেলেন। এপাশ–ওপাশ ছুটতে লাগলেন। আমিও মরিয়ম মরিয়ম বলে ডাকতে লাগলাম। আমরা আর মরিয়মকে খুঁজে পেলাম না।
তবে নদীতে দেখলাম, কত বিচিত্র পোশাক পরা মানুষের লাশ ভেসে যাচ্ছে। এত মানুষ মেরেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। মরিয়মকেও কি ওরা মেরে ফেলেছে।
না। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, মরিয়ম বেঁচে আছে।
কারণ, আমার মনে আছে, মরিয়ম নদীর পানি খাচ্ছিল, সেই স্বাদ আমি পাচ্ছিলাম। তারপর ওর পেট থেকে কেউ পানি বের করে নিল, সেটাও আমি টের পাচ্ছিলাম। আমি বলতে লাগলাম, ‘মা, মরিয়ম বেঁচে আছে। মা, মরিয়ম এখন খুব ঝাল মরিচ পান্তা খাচ্ছে মা, আমি টের পাচ্ছি।’
আমরা গ্রামের বাড়ি চলে গেলাম। আমাদের গ্রামের বাড়ি শিবচরে। সেখানে কাঁচা ঘরে আমরা ১৯৭১ সালের বাকি ৯টা মাস থাকলাম। বাবা রাতের বেলা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতেন।
এরপর আমার আরও দুই ভাই জন্মাল। আমি বড় হলাম। এখন আমি মতিঝিল স্কুলের আর্টের শিক্ষক। ঢাকা চারুকলা থেকে পাস করে স্কুলে জয়েন করেছি। আমার নিজের দুই ছেলেমেয়ে। একজন আমেরিকায় থাকে। পাভেল, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। মেয়েটাও বায়োকেমিস্ট্রি পড়েছে, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে থাকে, ওর হাজব্যান্ড একটা ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করে। মেয়েটাও ওখানে একটা স্কুলে পড়ায়।
আমার স্ত্রী শামসুন নাহার। আমি ডাকি নাহার। ও মতিঝিল এজিবি অফিসে চাকরি করে। আমাদের দিন ভালোই যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে যেমন যায়।
কিন্তু আমার মা আমাকে বলেছেন, ‘বাবা, আমার যাওয়ার সময় হলো, মরিয়মকে কি আমি খুঁজে পাব না?’
মরিয়মকে আমি খুঁজে পেয়েছি বলেই আমার মনে হয়।
মেট্রোরেলে ফার্মগেটের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। যাব মতিঝিলে। আর উল্টো প্ল্যাটফর্মে উত্তরাগামী সাইডে একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পরনে সালোয়ার–কামিজ। নীল রঙের। ওড়নাটা সাদা। তাঁর চোখ একেবারে আমার মায়ের চোখের মতো। কটা রং, বিড়ালের চোখের মতো। এই চোখ আমি চিনি। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, ‘মরিয়ম।’ ও চমকে উঠল।
আমি আমার ডান কানে চিমটি দিলাম। গায়ের জোরে। ও ওর ডান কানে হাত দিল। ও মরিয়ম ছাড়া আর কেউ নয়। মরিয়ম, মরিয়ম...এমন সময় আমার ট্রেন এসে গেল। আমাকে আড়াল করল। আমি ট্রেনে চড়লাম না। আমি দৌড়ে অন্য পাশের প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে লাগলাম। নিচের তলায় নামতে হবে। আমি দৌড়াচ্ছি। সিঁড়ি বাইছি।
আমি যখন উত্তরাগামী প্ল্যাটফর্মে গেলাম, তখন দেখলাম, একটা ট্রেন উত্তরার দিকে চলে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হয়ে গেল। আমার সবকিছু হরণ করে নিয়ে একটা ট্রেন উত্তরা গেল।
মরিয়ম, তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস। মরিয়ম...
মরিয়ম। মরিয়ম। আমার ফোন নম্বর এখানে দিচ্ছি...০১৭১২৩...
মরিয়ম। মা তোকে দেখতে চায়। মরিয়ম, তুই কি জানিস, তুই একাত্তরে আমার হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলি।
অনেকগুলো ফোন এল। অনেকেই বলছেন, ‘আমি মরিয়ম নই। কিন্তু আমি তো আপনার বোন হতে পারি।’
তারপর এল সেই ফোনটা। বলল, ‘মিথুন বলছেন?’
‘জি।’
‘আমি মরিয়ম।’
‘মরিয়ম। আমি তোর গলা শুনেই টের পাচ্ছি, মরিয়ম। তুই আমার হারিয়ে যাওয়া বোন। এটা তোর নম্বর। আমি সেভ করছি। মা তো গ্রিন হসপিটালে আছে। তুই আয়। কখন আসবি। মায়ের তো আর বেশি সময় নাই।’
‘দেখি, গগনের বাবাকে বলি। কখন সময় দিতে পারবে।’
‘গগনের বাবাকে বল, তোর নিজের মা। নিজের ভাই। মরিয়ম, তুই যে কাঁদছিস, আমি কিন্তু টের পাচ্ছি। তোর চোখের নিচের পানি আমার গালে এসে স্পর্শের অনুভূতি দিচ্ছে। আয়...’
আমরা গ্রিন হসপিটালের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। আমি, মন্টু। ছোট ভাই দুটো আসেনি। কারণ, তারা কোনো দিনও মরিয়মকে দেখেনি। বাবা আছেন মায়ের বেডের পাশে।
আমি টের পাচ্ছি, মরিয়ম আসছে। ও আসছে রিকশায়। বসন্তের বাতাস এসে ওর চুল উড়িয়ে দিচ্ছে। একটা চুল ওর চোখে পড়ল, আমি সেটাও টের পাচ্ছি।
মরিয়ম এলে আমি ওকে মায়ের কাছে নিয়ে যাব। মা যাওয়ার আগে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে একবার বুকে টেনে নেবেন।