লাল পাহাড় (দ্বিতীয় পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

-গুলি করো! গুলি করো!

রাব্বির বুকটা ধক ধক করছে। সে কখনো গুলি করেনি, এই বয়সে করার কথাও না। পিস্তলটা একটু আগেও অত ভারী লাগেনি। এখন অসম্ভব ভারী লাগছে। ঢোক গেলা দরকার, কিন্তু কী আশ্চর্য, ঢোক গিলতে পারছে না রাব্বি। পেছনের সেই বৃদ্ধা হুইল চেয়ার নিজে নিজেই ঠেলে ঠিক তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

ওই লোক দুটোকে দেখা যায়?

না।

না দেখা গেলে নাই, তুমি আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি করো। রাব্বির কেমন দম আটকে আসে। যতই সময় যাচ্ছে, পিস্তলটা তার হাতে ভারী হয়ে উঠছে যেন। 

বৃদ্ধা এবার হুকুমের স্বরে বললেন, ‘গুলি করো!’

পরপর দুবার ট্রিগারে টান দিল রাব্বি। ঠাস ঠাস করে দুটো আওয়াজ হলো। 

গুলির শব্দ না? 

হু! বন্দুকের গুলি। লাল দালানটার ঠিক পেছনে একটা ছাপরামতো টংয়ের দোকান। সেখানে তিনজন বৃদ্ধ বসে চা খাচ্ছিলেন। তৃতীয় জন একটু বেশি বৃদ্ধ। তিনি অনুচ্চ স্বরে বললেন, ‘বন্দুকের গুলি না।’ 

তাইলে কিসের শব্দ?

পিস্তলের গুলি, কোল্ট থার্টি টু। জার্মানির তৈরি পিস্তল।  

তুমি জানলা ক্যামনে? আরেক বৃদ্ধ জানতে চান। তিনি তখন একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। 

যুদ্ধ করছি না, সেই ১৯৭১–এ। সব কি ভুলছি মনে করো?

যুদ্ধ তো করছ থ্রি নট থ্রি দিয়া!

আমার একটা পিস্তল ছিল। মনে নাই, কামালপুর যুদ্ধে হাসির গ্রামের এক পলাতক পাঞ্জাবিরে তাড়া কইরা ধরছিলাম। সে ছিল মেজর। তার কাছে একটা পিস্তল ছিল। ঠিক এই রকম কোল্ট থার্টি এইট। পরে আমাদের কমান্ডার আমারে ওইটা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারের অনুমতি দিছিল। আমার বীরত্বের পুরস্কার বলতে পারো। বৃদ্ধ হাসেন। 

কিন্তু এখানে পিস্তলের গুলি করব কে?

আছে ব্যাপার আছে।

কী ব্যাপার?

এই যে লাল দালানটা দেখছ? 

হু...সে তো অনেকদিন ধইরাই দেখতাছি। 

এই লাল দালানে ঝামেলা আছে।   

কী ঝামেলা?

সময় হইলে জানতে পারবা।

মুরব্বিরা এইখানে রাজনীতির আলাপ করবেন না—টংয়ের দোকানি তরুণ মজিদ মিয়া গম্ভীর হয়ে বলার চেষ্টা করেন। এটা মোটেই রাজনীতির আলাপ নয়, তার পরও তিন বৃদ্ধ প্রতিবাদ করেন না। তাঁরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসেন। এবার তিনজনই সিগারেট ধরিয়েছেন। একজন খুক খুক করে কাশেন।  

রাব্বি ছুটছে। তার সামনে ক্লান্টু ছুটছে। সে আসলে ক্লান্টুকে ফলো করেই ছুটছে। তার চেনা পথ, তার পরও মনে হচ্ছে অচেনা। যেন বাঘা, মানে রাব্বির ক্লান্টু তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাসায় যখন ঢুকল, তখন বাসার দেয়ালঘড়িতে ৭টা ৪৫।

কিরে, এত দেরি, কোথায় ছিলি? মা ভ্রু কুঁচকে জানতে চান।

এই তো কাছেই রনিদের বাসায়। বলেই বুঝল মিথ্যে বলেছে। রনিরা গেছে থাইল্যান্ড বেড়াতে। সেটা মা–ও জানেন, কিন্তু মা বিষয়টা খেয়াল করলেন না। বললেন, নুডলস খাবি? 

খাব। মা- 

বল।

ক্লান্টুকে পেয়েছি।

তা–ই, কোথায় পেলি?

ওই যে লাল দালানটা, ওইখানে।

ভালো। কদিন পর এল সে?

চার দিন।

তারপর রাব্বি মিয়া, কেমন চলছে?

রাব্বি চমকে উঠল। কী আশ্চর্য সে খেয়ালই করেনি। বিছানার ওপর বসে আছে ছোট চাচা। আসলে রাব্বির মাথা থেকে পিস্তল দিয়ে গুলি করার বিষয়টা যাচ্ছেই না। এটা এখনো একটা জটিল বিষয় হয়ে আছে তার মাথায়। এখনো স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে না যেন। স্মৃতি হয়ে গেলে কি সে একটু স্বস্তি বোধ করত? 

জি চাচা ভালো। তুমি কখন এলে?

এই তো সন্ধ্যার পর।

এই চাচাকে রাব্বির মোটেই পছন্দ না। তার মনে হয়, সব সময় সে একটা ধান্দা করছে। আজকেও তার বসার ভঙ্গিটা কেমন যেন। সে বিছানায় বসবে কেন? চেয়ার–টেবিল আছে, সেখানে বসলেই হয়।

রাব্বি নুডলস খেতে লাগল। সে টেরই পায়নি তার এত খিদে পেয়েছে। মনে হচ্ছে নুডলসের বাটিটাও চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারবে। 

ভাবি, রাব্বিকে আমার কাছে দিয়ে দিন। ও আমার সঙ্গে থাকবে, ওখানেই পড়াশোনা করবে। আমাদের চট্টগ্রামে ভালো ভালো স্কুল আছে। এক স্কুলের হেডমাস্টার আমার বন্ধুমানুষ।

রাব্বি চলে গেলে কি আমি একা থাকব এখানে?

ছোট চাচা মায়ের কথাই শোনেন যেন।

ওই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব আর আমার দোকানে বসবে মাঝেমধ্যে।

মানে? ও তোমার দোকানে দোকানদারি করবে?

আহা, ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। দোকানে আমার কর্মচারী তো আছেই । আমার ব্যবসাটা এখন থেকেই একটু দেখভাল করল। বাপ–দাদার ব্যবসা...একসময় তো ওকেই ব্যবসা বুঝে নিতে হবে নাকি? আমরা আর কদিন। আর আমার মেয়েরা কি মনে করো এসব ব্যবসা বুঝবে?

আর আমার রাব্বি খুব বুঝবে না?র

না বুঝুক, সে তো পুরুষ মানুষ...

রাব্বিকে নিয়ে যাবে আর আমি এখানে একা থাকব? কী রাব্বি, যাবি চট্টগ্রামে?

রাব্বি সজোরে মাথা নাড়ে। তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তার সামনেই ছোট চাচা তাকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করছেন। রাব্বি আদৌ যেতে চায় কি না, সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই!  

একা থাকবে কেন? ছোট চাচা বিশ্রীভাবে গলা খাঁকারি দিয়ে ফের শুরু করেন। আপনি চলে যাবেন কোনো কর্মজীবী হোস্টেলে। ঢাকায় তো শুনেছি আজকাল ভালো ভালো অনেক কর্মজীবী হোস্টেল হয়েছে মেয়েদের জন্য। ওখানে থাকবেন। বাসাভাড়াটা বেঁচে যাবে। ছুটিছাটায়...মাসে মাসে আমার ওখানে বেড়াতে যাবেন।   

দেখো ছটু, এ ধরনের হাস্যকর প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে আর কখনো এই বাসায় আসবে না । রাব্বি আমার কাছেই থাকবে। 

মা বেশ কড়া গলায় বললেন। ছোট চাচা একটু থতমত খেয়ে গেলেন।  

ছোট চাচা তোমাদের চট্টগ্রামে নাকি প্রজাপতি পার্ক আছে? পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য বলে রাব্বি।

অ্যাঁ? আছে নাকি? খেয়াল করিনি তো। ছোট চাচা উঠে দাঁড়ান। ভাবি, যাই তাহলে আজকে। 

যাও, খোদা হাফেজ।

অন্যদিন হলে মা বলতেন ভাত খেয়ে যাও, আজ বললেন না।  

সে রাতটা ক্লান্টু রাব্বিদের বাসার বারান্দায় ঘুমাল। পরদিন সকাল থেকে আবার উধাও। আবার কি সেই বৃদ্ধার বাড়ি গেল? ব্যাপারটা কী? তখনই রাব্বির মনে পড়ল কাল সে ফিরেছে সেই বৃদ্ধার বাড়ির পেছন দিয়ে একটা অদ্ভুত পথে। সামনের দরজা খোলে না। পুরো বিষয়টা মনে করার চেষ্টা করল রাব্বি। সেদিন পিস্তলে দুই রাউন্ড গুলি করার পর। বৃদ্ধা বললেন, পিস্তলটা যেখানে ছিল ওখানে রেখে দাও। তা–ই করল রাব্বি। 

আমি বাড়ি যাব। কোনোমতে বলে রাব্বি।

তোমাকে বাঘা নিয়ে যাবে। বলে মহিলা হাতে তুড়ি মারার মতো একটা শব্দ করে বলে উঠলেন, বাঘা..। সঙ্গে সঙ্গে বাঘা, মানে রাব্বির ক্লান্টু লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাব্বির চারদিকে একটা চক্কর দিয়ে গলায় কেমন একটা শব্দ করল। যেন বলছে, আমাকে অনুসরণ করো! ক্লান্টু ছুটতে শুরু করল। তার পেছনে পেছনে ছুটতে শুরু করল রাব্বি। রাব্বি ঠিক ছুটছিল না, সে যেন উড়ছিল। কেমন একটা ঘোরের মতো সে ক্লান্টুর পেছনে পেছনে ছুটছিল। স্যাঁতসেঁতে একটা বধ্য গলির ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ একটা খোলা প্রান্তরের মধ্যে এসে পড়ল। জায়গাটা অচেনা আবার চেনা…চেনা–অচেনা পথে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ রাব্বি নিজেকে আবিষ্কার করল তাদের বাসার পরিচিত গলিটায়।   

পুরো ঘটনাটাই কেমন যেন অস্বস্তিকর। সেই লোক দুটো, পিস্তলে গুলি করা, বৃদ্ধা...। যা হোক, পরদিন মাথা থেকে সব ঝেড়ে বের করে পাড়া ঘুরতে বেরোল রাব্বি। তবে লাল দালানের দিকে গেল না। আজ থাইল্যান্ড থেকে রনিদের ফেরার কথা। রনিদের বাসার সামনে গেল। হ্যাঁ ওদের মেইন গেট খোলা। তার মানে ওরা ফিরেছে। রাব্বি মুখের কাছে হাত মুঠো করে চেঁচালো—

রনি্ইইইইই!

সঙ্গে সঙ্গে রনি বের হয়ে এল। যেন দরজার কাছেই ঘাপটি মেরে ছিল সে। 

কিরে কেমন বেড়ালি?

ভালো।

কবে এসেছিস?

গতকাল রাতে।

অনেক মজা করেছিস নিশ্চয়ই? 

তা একটু হয়েছে মজা। আয় না ভেতরে আয়, তোর জন্য একটা গিফট এনেছি।

সত্যি?

রাব্বি ঢুকল ওদের বাসায়। রনিদের ড্রয়িং রুমে ঢুকেই জমে গেল রাব্বি। সেই লোক দুটো বসে আছে। সেই একই পোশাক। একজনের গায়ে চক্করবক্কর শার্ট, এই লোকের কোমরেই পিস্তল ছিল। লোক দুটো রাব্বির দিকে ঠান্ডা চোখে তাকাল। কিছু বলল না। তবে রাব্বির দিকে তাকিয়েই রইল। 

রাব্বি ভেতরে এসে রনিকে জিজ্ঞেস করল, লোক দুটো কে রে?

কী জানি কে? বাবার কাছে এসেছে।

আঙ্কেলের পরিচিত?

কী জানি। এই দ্যাখ।

রাব্বির হাতে একটা চ্যাপ্টা অদ্ভুত পাথর ধরিয়ে দিল রনি। রাব্বির গিফট। রাব্বির মনে হলো বিষয়টা কি রনিকে বলবে? এই লোক দুটো যে খারাপ, কোমরে পিস্তল নিয়ে ঘোরে, তাকে জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল? ওরা রনির বাবার কাছে কী চায়? কেন এসেছে? 

কিরে তোর পছন্দ হয়নি?

অ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ, পছন্দ হয়েছে।

এই পাথরের একটা দারুণ ইতিহাস আছে।

ইতিহাসটা পরে শুনব। বাসায় মায়ের একটা দরকারি কাজ ফেলে এসেছি রে। এখন যাই।

বলে একরকম তড়িঘড়ি করে বের হয়ে গেল রাব্বি। অবশ্য ওর গিফটটা নিতে ভুলল না। ড্রয়িংরুমে তখনো লোক দুটো বসে আছে। তারা একসঙ্গেই তাকাল রাব্বির দিকে। ঠান্ডা চোখের দৃষ্টি।

রাব্বি এক ছুটে বের হয়ে বাসায় চলে এল। তার কেমন যেন ভয় করছে। লোক দুটো রনিদের বাসায় কেন? বাসায় ঢুকতেই মা ধরলেন, কিরে কাল রাতে কোথায় গিয়েছিলি বল তো? দ্যাখ তোর জুতা জোড়ার কী অবস্থা? শক্ত লাল মাটি লেগে আছে। উঠছেও না। শোন, জুতা নিয়ে মোড়ের মুচির কাছে যা, পালিশ করিয়ে নিয়ে আয়। কাল স্কুল আছে না? এই জুতা পরে স্কুলে যেতে পারবি? যা, এখনই যা।

জুতা টাকা নিয়ে বের হলো রাব্বি। মোড়ের মুচি একটা স্যান্ডেল সেলাই করছিল। তার জুতাজোড়া দেখে বিস্ময় প্রকাশ করল। 

এই লাল মাটি কই থাইকা লাগাইছ? 

কী জানি কোত্থেকে লাগল, জানি না।

তোমার জুতা তুমি জানো না?

তা–ই তো! তার জুতা সে জানবে না কেন? খুব সম্ভব সেদিন ওই লাল বাড়িটা থেকে ক্লান্টুর পেছন পেছন একটা বধ্য স্যাঁতসেঁতে গলির ভেতর দিয়ে আসার সময় মাটিটা কেমন যেন ভেজা ভেজা লাগছিল। খুব সম্ভব ওই মাটিতেই সমস্যা ছিল...ওখান থেকেই তার জুতা জোড়ার বারোটা বেজেছে। তারপর ওই গলি থেকে বের হয়ে আসার পর একটা খোলা প্রান্তরের মাটিটাও ভেজা ভেজা ছিল...ওখানে কি লাল মাটি ছিল? 

তোমার জুতার মাটি এই এলাকার মাটি না। মুচি গম্ভীর গলায় বলে। ‘কুমিল্লা গেছিলা? লালমাই পাহাড়ে বেড়াইতে? ওইখানে মাটি লাল, পুরাই লাল...কী, ঠিক ধরছি না?’ মুচি আগ্রহের সঙ্গে তাকায় রাব্বির দিকে। 

হ্যাঁ, ঠিক ধরছেন।

দেখতে দেখতে রাব্বির জুতা জোড়া একসময় নতুনের মতো হয়ে গেল। টাকা দিয়ে জুতা জোড়া হাতে নিয়ে হাঁটা দিল। বেশি দূর যেতে পারল না। দুটো দীর্ঘ ছায়া তার পথ আটকাল। ছায়ার মালিক দুজন আর কেউ না। সেই লোক দুটো। 

মি. রাব্বি কেমন আছো?

ঢোক গিলল রাব্বি। এখন কী করবে সে, দৌড় দেবে? কেন দৌড় দেবে? সে কি কোনো অপরাধ করেছে? লোক দুটো হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। চক্করবক্কর শার্ট পরা লোকটার কোমরে সেই পিস্তলটা আগের মতোই উঁকি দিচ্ছে। 

বাহ, তোমার জুতা জোড়া দেখছি একদম নতুনের মতো হয়ে গেছে।

লাল মাটির চিহ্ন আর নেই!

লাল মাটির ব্যাপারটা ওরা জানল কী করে? রাব্বি আশপাশে তাকাল। এই মুহূর্তে এই গলির ভেতরে কোনো মানুষ নেই। সে আর তার সামনে পাহাড়ের মতো লোক দুটি দাঁড়িয়ে। রাব্বির বুকের ভেতরে ড্রাম পেটানোর মতো শব্দ হচ্ছে। রাব্বি এখন কী করবে?

(চলবে...)

আরও পড়ুন