কামান নাকি রকেট?

কত অদ্ভুত যোগাযোগই না ঘটে জীবনে। আলোর শেডের নিচে ঘরের মধ্যে বসে আছে নানান ধরনের লোক। হঠাৎ কেমন একঘেয়ে লাগতে লাগল একজনের। মিনিট খানেকের মধ্যেই দেখা যাবে দ্বিতীয়, তৃতীয় লোকটাও জুটেছে আড্ডা দিতে। হাই তোলার মতো একঘেয়েমিও যেন এক জনের কাছ থেকে আর এক জনের মধ্যে ছড়ায়। বড়দের একঘেয়েমি লাগলে তারা একলা থাকতে চায়। আর যাদের বয়স তেরো, তাদের যদি পড়া সাঙ্গ হয়ে গিয়ে থাকে, শার্লক হোম্স সম্বন্ধে বইটা যদি জুল ভার্নের 'রহস্যদ্বীপ' আর ডাক টিকিটের অ্যালবামের সঙ্গে বিস্মৃত হয়ে পড়ে থাকে শেলফে, আর বয়স্কদের কেউ যদি আর 'সামুদ্রিক লড়াই' খেলতে না চায়, আর গতকালের তুষার ঝড়ের পরে যদি স্কেটিং মাঠে বরফ যেন ইচ্ছে করেই এমন উলচুল হয়ে ওঠে যে আত্মসম্মানী কোনো স্পোর্টসম্যানই স্কেট নিয়ে হাজির হতে রাজী নয় - তখন তেরো বছরীরা সব জোটে বাড়ির সদর দরজার কাছে, আলাপ চলে দূর তারা থেকে আসা রহস্যময় সব সঙ্কেত, অদৃশ্য মহাবীর, অমর হবার গুপ্ত কথা, আর সেই সব ভাগ্যমন্তদের নিয়ে যারা হাজার বছর পরেও একই ভাবে সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার

নীলাভ আবছায়ায় তর্কাতর্কি করবে। অশেষ এই আলাপ চলতেই থাকবে যতক্ষণ না ওপর তলার কোনো একটা জানলা খুলে গিয়ে ঝঙ্কার উঠবে "এগারোটা বেজেছে আড্ডাবাজ কোথাকার, ঘরে আয় শিগগির!"

এই ভাবেই সেদিন পথচারীদের অসংখ্য পায়ে পায়ে গড়ে ওঠা পথের ধারে বিনা যোগসাজশেই দেখা হয়ে গেল আমাদের তিন নায়কের। অপ্রত্যাশিতভাবে এমন পাশাপাশি দেখা হয়ে গেলে বলতেই হয় "কেমন আছিস!" তবে সেই সঙ্গেই প্রত্যেকেই একটু সরে দাঁড়াবার জন্যে পা বাড়ায়। তাহলেও আলাপ করার ইচ্ছেটা কিন্তু দড়ির মতো বেধে রাখে তাদের, ওইখানে দাঁড়িয়েই উশখুশ করে, আশা করে কেউ হয়ত সেই যাদুকর কথাটা শেষ পর্যন্ত বলে দেবে, যার পর হালকা হয়ে যাবে বুক, লজ্জা করবে না, চোখাচোখি হলে অস্বস্তি হবে না। সে কথাটা ল্যবকাই বললে প্রথম।

'এ্যই, ওই দ্যাখ,' মাথা তুলে সে বললে, 'ধ্রুব তারাটা আমাদের বাড়ির ঠিক মাথায়!'

তার কথা মেনে মাথা তুললে ছেলেরা।

'এখন আর দেখা যাচ্ছে না, মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে, নইলে তোদের জ্বলজ্বলে তারাগুলো দেখিয়ে দিতাম,' গেনা বললে।

বরকা লক্ষ্য করলে তার ভূতপূর্ব সাথী 'তোকে' না বলে বলল 'তোদের'। বাড়ির মাথার ওপরে বড়ো মতো নিশ্চল তারাটা কেমন ঠান্ডা কনকনে, আর গেনা যে নামগুলো বলে যাচ্ছিল সেগুলোও ঠিক তেমনি ঠান্ডা: "আলুগল, আলদেবারান্, আলুটেইর, আলুৎসিয়ন, আন্টারেস্, আঙ্গুর..." কিন্তু বরকার

মনে হল বাতাস যেন একটু উষ্ণ হয়ে উঠেছে।

'ঠান্ডা নেই, বরং গরম,' বললে ও খাপছাড়াভাবে।

'আর চাঁদে ঠান্ডা পড়ে শুন্যের নিচে ২৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এই হচ্ছে একেবারে শেষ তথ্য,' জবাব দিলে ভূতপূর্ব সাথী।

ইতিমধ্যে ল্যবকা তার ফেল্টের হাই বুট পরে চলে গেছে সেই বরফ-ঢাকা চালা ঘরটাতে, যেখানে শরৎকালে আপেল বিক্রি হত। লাফিয়ে উঠে সে বসে পড়ল শূন্য কাউন্টারটার ওপর।

'এই - সব চলে আয় এখানে। কী মজা! বাতাসের কোনো ঝাপটা নেই!'

Kishor Alo 02

বরফের মসৃণ আস্তরের ওপর সর্বশক্তিতে পা ঠুকে ঠুকে ছুটে গেল বরকা আর গেনা। চালাটায় যখন পৌঁছল তখন ওদের হাই বুট বরফে ভরা। এক পায়ে চালা ধরে দাঁড়িয়ে ওরা বুটের বরফ ঝাড়তে লাগল আর ভয় দেখাল ল্যবকাকে বরফের স্তূপের মধ্যে ফেলে দেবে। কিন্তু যে কোনো পরীক্ষাতেই ল্যবকা রাজী, সোল্লাসে ও লক্ষ্য করলে যে বরফ গলছে।

'দাঁড়া, এখুনি আমরা তোর মজা দেখাচ্ছি!' চে'চাল বরকা, বোঝা গেল 'আমরা' বলতে পেরে বেশ তৃপ্তিই সে পাচ্ছে। তারপর সর্বশক্তিতে বরফের গোলা ছুড়ে মারল দেয়ালে। গেনাও তুলতে লাগল বরফ।

'এই নে তোর এক নম্বর স্পুৎনিক,' এক একবার ছুড়ে মারে সে আর মন্তব্য জুড়ে দেয়, 'এই বার দু নম্বর স্পুৎনিক, এবার তিন নম্বর! আর এইটে- এ হল রকেট "স্বপ্ন”।'

দোকান ঘরের মধ্যে জমতে লাগল এক বরফের পাহাড়। ল্যবকা চ্যাঁচায় আর লুকায়।

'এই! খুব হয়েছে, থাম!' অন্ধকারের মধ্যে কোথা থেকে চেচিয়ে বললে সে, 'আয় তার চেয়ে বরং প্রশ্নোত্তর খেলি। সবাই ভেবে রাখো, জীবনের সবচেয়ে জরুরী প্রশ্ন কী। পরে আলোচনা করব। নাও, ভাবো সবাই ভাবো ঠিক করে।'

'যত সব,' মুখ ঝামটা দিল বরকা, কিন্তু পরের মুহূর্তেই চুপ করে গেল সে কারণ গেনা হাসছিল না।

দোকান ঘরটায় ঠেস দিয়ে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ল্যাম্পপোস্টের নিচে ঝলক দিয়ে ওঠা ক্ষুদে ক্ষুদে প্যারাশুটগুলোর দিকে। ঘুরছে প্যারাশুটগুলো, গায়ে গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে, উড়ে চলে যাচ্ছে একপাকে আর মাটিতে নেমে মিশে যাচ্ছে তার সহোদরদের শাদা একটানা আস্তরে, গড়ে তুলছে পৃথিবী ঢেকে দেওয়া একটি একক প্যারাশুট। হঠাৎ কেমন সব প্রশ্ন নাড়া দিয়ে উঠল তার মাথায় অবিলম্বে যার উত্তর প্রয়োজন। এ প্রশ্নের সবকটিকেই মনে হল প্রধান, যার সমাধান না করে বাঁচাই চলে না পৃথিবীতে।

'নমস্কার টুনটুনিরা!' হঠাৎ একটা অপরিচিত গলা কাছেই কোথায় গমগম করে উঠল। দোকান ঘরটার পেছন থেকে বেরিয়ে এল বাদামী একটা ফার ওভারকোট আর মাথার পেছন দিকে ঠেলে দেওয়া টুপি পরা একটা লোক। পকেটে হাত ঢুকিয়ে আগন্তুক হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে দেখল গোটা দলটার দিকে। 'বটে, বটে... তা কী করা হচ্ছে এখানে? গতবছরের আপেল খোঁজা হচ্ছে নাকি? আহা, আহা রাগ করতে হবে না!' বল্লকার ভুরু কু'চকে উঠতে দেখে আপোষের সুরে সে বললে, 'ঠাট্টা করছিলাম। বলতে কি, খুশি হয়েই তোদের সঙ্গে আড্ডা মারতে রাজী। ম্যাজিক দেখাতে পারি। দেখবি, বলব কে কী ভাবছে? সত্যি, লোকের ভেতরটা আমি দেখতে পাই। যেমন এই তুই,' আঙুল দিয়ে সে খোঁচা দিল লুল্যবকার হাতায়, 'তুই পা দোলাতে দোলাতে ভাবছিস, আচ্ছা দুনিয়ায় ঠিক হুবহু আমার মতোই আর একটা লোক আছে কী না, যে ঠিক এই সময়েই দোকানের কাউন্টারে বসে পা দোলাতে দোলাতে ভাবছে, টিকটিকির লেজ যদি কেটে এমন জায়গায় ফেলে দেওয়া যায় যে কিছুতেই তা আর সে খুঁজে পাবে না, তাহলেও তার লেজ গজাবে কি?'

মুখ হাঁ হয়ে গেল ল্যবকার।

'আপনি কাকু, যাদুকর?' গুরুত্ব দিয়েই সে জিজ্ঞেস করলে।

'নারে, বোকা, এ সবই বোঝা যাচ্ছে তোর উটকো নাকটা থেকে। আর তুই,' বরকার কাঁধে হাত রেখে আগন্তুক বললে, 'তোর সাধ অদৃশ্য মানুষ হবার... আর তুই,' গেনার কাছেই এল সে, 'আর তুই ভাবিস এমন একটা ওষুধ বার করা যায় না, যাতে গায়ে হবে সিংহের মতো জোর আর হরিণের মতো গতি? এ সব প্রশ্নই একেবারে বাজে প্রশ্ন। তোরা বরং ভেবে ভেবে বল ত দেখি মানুষ কিভাবে চাঁদে গিয়ে পৌঁছবে, কামান থেকে ছুড়ে দেওয়া হবে, নাকি রকেটে করে যাবে?'

আরও পড়ুন

প্রশ্ন করেই অপরিচিত সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে জবাবের অপেক্ষা না করেই চলে গেল।

'এই হল আসল জিনিস!' উল্লাসে নিঃশ্বাস ফেলল বরকা, 'ঐ মনের কথা বলে দিতে পারার বিদ্যে যদি শিখতে পারতাম!'

'সব কিন্তু ঠিক ঠাক বলেনি ও হরিণের কথা আমি ভাবিনি,' গেনা বললে।

'কিন্তু টিকটিকি, টিকটিকির কথা ও বললে কেমন করে?' ল্যবকার মুখ থেকে বিস্ময় তখনো কাটেনি।

'ইস, এত তাড়াতাড়ি যদি না চলে যেত, তাহলে ওকে আমি জবাব দিতাম, কামান থেকে নাকি রকেটে চেপে!' উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে বললে বরকা।

'কী বলতিস তুই?' জিজ্ঞেস করলে বন্ধু।

'বলতাম, কামান ক্লাবের সভাপতি বারবিকেনের সেই ক্ষেপণকের উদ্দেশে বিখ্যাত স্তবসঙ্গীতটা মনে আছে ত?' বলে বরকা পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে লাগল: 'হে আশ্চর্য গোলক, হে অপূর্ব ক্ষেপণক! স্বপ্ন দেখি একদিন ঐ ঊর্ধে তোমায় বরণ করে নেওয়া হবে পৃথিবীর দূতের মর্যাদায়!'

'এ আবার কী কবিতা? বারবিকেন আবার কে?'

কৌতূহলী হয়ে উঠল ল্যবকা। এমন কি কাউন্টার থেকেও নেমে এল সে।

'খে'দী কোথাকার!' অবজ্ঞায় কাঁধ ঝাঁকাল গেনা,

'কী তুই একটা! জুল ভার্নের "পৃথিবী থেকে চাঁদে",

"চন্দ্র প্রদক্ষিণ” বই পড়িসনি?'

'কথায় বাধা দিস নে!' ওকে থামাল বরকা, 'আমি নিজেই বলব। মোট কথায় ওতে আছে কামান ক্লাবের সভাপতি বারবিকেনের গল্প। মানে, চাঁদে কী করে সে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে মিলে একটা গোলা পাঠাতে চেয়েছিল সেই কথা। মস্ত এক কামান বানালে তারা "কলম্বিয়াদা"। কামান ছোড়ার দিন ঠিক হল। লোকজন জড়ো হল সব মেঘ করেছিল। সবাই অপেক্ষা করে আছে কখন চাঁদ উঠবে। শেষ পর্যন্ত চাঁদ উঠল। তারপর জেমিনি তারকা মণ্ডলীর কাছে আসতেই কামান দাগা হল। ছুটে গেল গোলা...'

'কিন্তু চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছল না!' হো হো করে হেসে উঠল গেনা।

'কিন্তু পৌঁছল না কেন, কেন পৌঁছল না?' হতাশ হয়ে উঠল লুল্যবকা, 'কী চমৎকার হত তাহলে...'

'বাজে কথা বলিস না!' পা ঠুকল বরকা, 'গোলা উড়ে পৌঁছল চাঁদে। জুল ভার্নের বইয়ে স্পষ্ট লেখা আছে: উড়ে পৌঁছল।'

'জুল ভার্নে যাই থাক, আসলে...'

'কী আসলে? তোর মতে তাহলে কী হল আসলে?' কান খাড়া করল বরকা।

'আসলে,' বুঝিয়ে বলতে শুরু করল গেনা, 'চাঁদে গোলা দাগা কোনো কামানের কম নয়। তার জন্যে দরকার প্রচন্ড স্পীড - সেকেন্ডে এগারো কিলোমিটার। আর তুই জানিস কামানের

গোলা কতখানি ছোটে সেকেন্ডে? জানিস তুই?' আক্রমণ শুরু করল সে। 'হ্যাঁ জানি। সেকেন্ডে তিন কিলোমিটার। দাদার কাছে শুনেছি।'

'হ্যাঁ, ঐ তিন কিলোমিটার। তবেই বুঝে দ্যাখ- চাঁদে পৌঁছবে তা? ডোবায় গিয়ে পড়বে!'

'সাবধান বলছি,' হুঁশিয়ার করে দিলে বরকা।

'রাগ করছিস কেন? এত হল আমাদের আলোচনা, গ্রীকরা যা বলে বিশুদ্ধ তর্ক'।'

'আলোচনাই তো,' খুশি হয়ে বললে ল্যবকা।

'বিশুদ্ধ তর্ক'ই যদি হয়,' জুল ভার্নের সমর্থক বললে চটে উঠে, 'তাহলে এটা কেন ধরছিস না যে "কলম্বিয়াদা" একটা সাধারণ কামান নয়, বিশেষ রকমের কামান, তিনশ মিটার লম্বা।'

'সে তো আরো খারাপ,' শান্তভাবে আপত্তি করল গেনা, 'ও থেকে দাগলে তোর বারবিকেন আর তার বন্ধু বান্ধবরা সব চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যেত। বলবি, না? ফরাসী বৈজ্ঞানিক রবের এনো- পেলত্রি'র কথাও মানবি না বল? ইনিও জুল ভার্নের বই পড়েছেন, সব কিছু হিসাব করে দেখেছেন... উনি বলেছেন, কামানের নল অত লম্বা হলে ত্বরণ হবে প্রচণ্ড, আর গোলকের মধ্যে বসা লোকেদের ওজন দাঁড়াত তাদের স্বাভাবিক ওজনের কয়েক হাজার গুণ। বুঝতে পারিস? তোর ঐ সভাপতির মাথার টুপিটারই ওজন দাঁড়াত কয়েক টন, তাতেই পিষে যেত সে!'

'তাই কখনো হয়!' আধা বিশ্বাসে আধা অবিশ্বাসে বলে উঠল ল্যবকা।

'তার মানে, তোর ধারণা, আমি মিছে কথা বলছি? নাকি বিজ্ঞানীরা সব মিছে কথা বলেছেন? এহ, খুকী কোথাকার!' এর চেয়ে ধিক্কারজনক কথা আর গেনা খুজে পেল না। খুকী ঠোঁট ফোলালে।

ফরাসী বৈজ্ঞানিক রবের এনো-পেলত্রি'র নামটা অবশ্য খুবই ভারিক্কি গোছের। তাহলেও জুল ভার্নের পক্ষ সমর্থন করে গেল বরকা। চন্দ্র যাত্রার সমস্ত পরিস্থিতিগুলো ও মনে মনে

যাচাই করে দেখল, গেনার সিদ্ধান্ত টেকে কিনা। শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেল সে: 'জল! জল!' এমনভাবে ও চেচিয়ে উঠল যেন একেবারে এক তপ্ত মরুভূমিতে রয়েছে

সে।

'বরকা,' চিন্তিতভাবে বললে ল্যবকা, 'অসুখ করেছে তোর?'

কিন্তু হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলে বরকা।

উত্তেজিতভাবে বললে, 'বুঝেছিস? জলের কথাটা আমি একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। গোলার ভেতরে মেঝের ওপর শুয়ে ছিল ওরা, আর মেঝের নিচে জল। জলের জন্যে বে'চে যায় ওরা, বুঝেছিস?'

'জলের বালিশ? তা মন্দ নয়!' অপ্রত্যাশিতভাবে সায় দিল তার্কিক, 'তবে খুব খুশি হবার কারণ নেই। তাহলেও চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। তবে আইডিয়াটা ঠিক। তসিওলকভস্কিও ভেবেছিলেন, ধাক্কা থেকে বাঁচাতে পারে জল। মহাকাশযাত্রী যদি জলের টবের মধ্যে থেকে থাকে, তাহলে বেচে যাবে। মোটের ওপর তসিওলকভস্কি সবই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।'

ল্যবকা ঠাট্টা করে জিগ্যেস করলে, 'সেই জন্যেই তুই স্কুলে তসিওলকভস্কির মতো কানে না শোনার ভান করিস বুঝি?'

গেনা ভাব করলে যেন কথাটা ওর কানে যায়নি।

"আন্দ্রোমেদার কুয়াশা" বইতে ইয়েফ্রেমভ...' ওদের একজন শুরু করেছিল কিন্তু ল্যবকার আর সহ্য হল না, বললে:

'ইয়েফ্রেমভ, তসিওলকভস্কি খুব হয়েছে বাবা, পা একেবারে জমে গেল।'

'কিন্তু আমরা এখন ভারহীনতার একটা পরীক্ষা করব, গাও গরম করে নেব,' ঘোষণা করলে গেনা। কাউন্টারের ওপর চেপে সে উঠে গেল চালাটার ছাদে।

বরকাও গেল তার পিছু পিছু। তারপর ওরা দুজনে টেনে তুললে ল্যবকাকে।

আরও পড়ুন

'আমি প্রথম,' এই বলে ভয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে লাফ দিলে ল্যবকা।

'কী রকম লাগছিল তোর? ভারহীনতা টের পেয়েছিলি?' ছাদের ওপর থেকে জিজ্ঞেস করল গেনা।

নিচে বরফের স্তূপের মধ্যে কী একটা নড়ে চড়ে উঠল, হাঁচল।

'টের পাচ্ছি...' ল্যবকার নাকী কণ্ঠস্বর ভেসে এল ওদের কাছে, 'টের পাচ্ছি যে হাঁটুতে কালশিটে পড়বে।'

'দাঁড়া আসছি এক্ষুনি!' দুই তার্কিক লাফ দিলে। এমনভাবেই ওরা পড়ল যে ভারহীনতা বোধ করার অবকাশ মিলল না।

'তেমন উচু নয় তো,' তসিওলকভস্কির শিষ্য বললে বুঝিয়ে।

'তেমন নয়,'ন নিয়ে বললে জুল ভার্নের 'সমর্থক।

ল্যবকা ততক্ষণে বরফের মধ্যে থেকে উঠে যাত্রা শুরু করেছে বাড়ির দিকে।

সিড়ির চত্বরটায় এসে মহাকাশযাত্রীরা একটু সুস্থ বোধ করলে।

'জুল ভার্নও ভারহীনতার কথা লিখেছেন,' বরকা বলে চলল এমনভাবে যেন কিছুই হয়নি,

'কল্পনা কর ক্ষেপণকের মধ্যে ওরা ভাসছে যেন জলের মধ্যে মাছ, দিয়ানা নামে ওদের একটা কুকুরও আছে সঙ্গে। তারপর মদ খেতে লাগল। গেলাস টেলাস সব রাখল স্রেফ শূন্যে, তারপর বোতল থেকে মদ ঢেলে খাওয়া হল।'

'কিন্তু কিছুই খেতে পারল না,' যেন নিজের মনে মনেই যোগ করল গেনা।

'ফের, ফের তুই খত ধরতে শুরু করেছিস!' মুখিয়ে এল ল্যবকা।

'খেতে পারল না,' গোঁয়ারের মতো পুনরাবৃত্তি করল গেনা, 'গেলাস থেকে মদ লাফিয়ে উঠত, বিন্দু বিন্দু হয়ে ছড়িয়ে যেত, গিয়ে পড়ত চোখে কানে নাকে সর্বত্র, সবারই শুরু হয়ে যেত হাঁচি কাশি, এমন কি নিউমোনিয়াও বাদ যেত না। তোর বারবিকেন জানত না যে ভারহীনতার অবস্থায় তরল পদার্থ পাত্রে রাখা যায় না। আমি যদি মাস্টার হতাম, তাহলে ফেল করিয়ে দিতাম তাকে।'

'আর তুই ভুলে গেছিস যে বারবিকেন একশ বছর আগেকার লোক?' মনে পড়িয়ে দিল কামান গোলার ভক্ত।

গেনা কী একটা ভাবলে, টুপিটা টেনে নিলে কপালের ওপর, তারপর গণিতজ্ঞের সুরে বললে:

'পত্রিকায় লিখব: সঙ্গত কারণেই তরল পদার্থের ওপর ভারহীনতার ক্রিয়া কী তা শিক্ষার্থী বারবিকেনের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। বাস। ফেল করার কথা বাদ দিচ্ছি।'

'আমিও হার মানছি,' বললে বরকা,

'কামান আজকাল অচল হয়ে যাচ্ছে। তাহলেও জুল ভার্নকে কিন্তু আমার খুব ভালো লাগে।' 'উড়তে হলে রকেট, কোনো ভুল নেই,' প্রস্তাব করল গেনা, 'দেখলি তো রকেট "স্বপ্ন” কীভাবে উড়ে গেল সূর্যের দিকে। সারা দুনিয়া বাহবা দিচ্ছে, আর এ সবই তো ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন তসিওলকভস্কি।

তাঁর সমস্ত সূত্র খেটে গেছে। আমার বাবা বলে, তসিওলকভস্কি হলেন জেট টেকনিকের গুরু।

তাই নির্ভয়ে ওড়া যাবে।' 'খুব তো বলছিস ওড়া যাবে। আর খাবে কী সেখানে?' ব্যস্ত হয়ে উঠল ল্যবকা।

'কী আবার খাবি কলা খাবি। মিষ্টি শাঁসালো সুগন্ধি কলা। কলা ফলবে হটহাউসে। হিহি করে হাসবার কিছু নেই। স্বয়ং তসিওলকভস্কি বলে গেছেন, ব্যোমযানের ভেতরে হটহাউস করার কথা। কলার কথাও লিখে গেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি অবশ্য ক্লরেলা খেয়ে থাকাই পছন্দ করি। নাম শুনেছিস কখনো ক্লরেলার? এ হল এককোষী এক ধরনের সামুদ্রিক উদ্ভিদ। সব রকমের ভিটামিন ওর মধ্যে আছে পুরো মাত্রায়। আর জানিস কী রকম বাড়ে। এক দিনের মধ্যেই বেড়ে যাবে হাজার গুণ। আমিও বাড়িতেই ক্লরেলার চাষ করছি।'

'তুই চাষ করছিস? কোথায়?' একবাক্যে প্রশ্ন করে উঠল শ্রোতারা।

'অ্যাকোয়ারিয়মে। দেখবি? আয় আমার সঙ্গে।' গেনার পড়ার টেবলটা যেন একটা ছোট্ট ল্যাবরেটরি। ফ্লাস্ক, টিউব, বকযন্ত্র ও এমন সব

নানাবিধ জিনিস যা প্রথম দৃষ্টিতে দেখে মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাবে না তা সংখ্যায় এত যে কেবল ল্যাবরেটরিতেই দেখা যায়। একটা অদ্ভুত বিশৃঙ্খলায় ছড়িয়ে আছে ফ্লাস্কগুলো। আর ক্লাসের স্বাস্থ্য পরিদর্শনের ভারপ্রাপ্তা হিসাবে অবিলম্বেই লু্যবকার মন গেল সেদিকে। কিন্তু গেনা তাকে ভয়ানক একটা ঘোষণা করে থামিয়ে দিলে। বললে, এমন কি তসিওলকভস্কির কাজের ঘরও ছিল ভারি অগোছালো। টেবলের উপর কাউকেও হাত দিতে দিতেন না তিনি।

'এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই আছে এক বিশেষ শৃঙ্খলা,' সগর্বে বললে গেনা, 'যা দরকার সব হাতের কাছে আছে আমার।'

ক্লরেলা জিনিসটা দেখা গেল খানিকটা সবজেটে ন্যালসানির মতো, আকর্ষণীয় কিছু নয়। ভাসছে অ্যাকোয়ারিয়মের মধ্যে, স্বচ্ছ প্ল্যাস্টিকের ঢাকনা দেওয়া তাতে। ঢাকনার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা কাচের বাঁকা নল, সেটা গেছে জল ভরা একটা বয়ামের মধ্যে। সেই জলের মধ্যে একটা ফ্লাস্কের মুখের সঙ্গে তা লাগানো। এই অদ্ভুত সরঞ্জামটাকে অতিথিরা যখন দেখছিল, ততক্ষণে গেনা রান্নাঘর থেকে নিয়ে এল একটা ধুমায়িত কাঠের টুকরো। 'এক্ষুনি দেখাচ্ছি, ক্লরেলার কত গুণ,' এই বলে গেনা ফ্লাস্কটা নিয়ে তার মধ্যে ধুমায়িত

কাঠটা ফেলে দিলে। ফ্লাস্কের মধ্যে স্থির অকম্প শিখায় জ্বলতে লাগল কাঠটা। 'দেখলি তো? অক্সিজেন! O2। এ অক্সিজেন ছাড়ছে ক্লরেলা। মহাকাশযাত্রীর পক্ষে এ উদ্ভিদ হল রত্ন। খাওয়াও চলবে। আমি খেয়ে দেখেছি - মন্দ নয়... বোস না, অমন ঠায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমি তোদের দেখাব জলভরা কামরার মধ্যে মহাকাশযাত্রীর ওড়া। মা,' খোলা দরজা দিয়ে চ্যাঁচাল গেনা, 'একটা ডিম দাও তো আমায়!'

এ প্রার্থনার জবাব এল না।

'একটু দাঁড়া, আমি এক্ষুনি আসছি,' বলে চলে গেল গেনা।

আরও পড়ুন

অতিথিরা যদি রান্নাঘরে তখন উকি দিত, তাহলে তারা দেখতে পেত, বলা ভালো, শুনতে পেত নিচের কান্ডটা:

'মা, ডিম দাও একটা!'

'বললাম যে ডিম নেই।'

'আমি জানি, আছে।'

'আর আমি বলছি, নেই।'

'বেশ!' গেনা চেয়ারের ওপর চেপে উঠল দুয়োরের মাথায়। তারপর দরজার ওপর পেট দিয়ে এদিকে মাথা ওদিকে পা রেখে ঝুলতে থাকল। চরমপত্র দানের মতো করে ও ঘোষণা করলে, 'না দিলে রাত পর্যন্ত এইভাবেই ঝুলে থাকব।'

মচমচ করছিল দুয়োর। মা নীরবে ক্রীম ফেটাতে লাগল। আর বীরের মতো মাথা নিচু করে ঝুলতে থাকল গেনা।

'অকাল-কুষ্মাণ্ড কোথাকার!' সক্রোধে বলে উঠল মা, 'নে, ভাগ!'

লাফিয়ে নামল গেনা, ডিম, মগ আর নুনদানি নিয়ে আলুথালু চেহারায় ফিরে এল। ধৈর্য ধরে তার জন্যে সেখানে অপেক্ষা করছিল বন্ধুরা, বিজয় গর্বে ডিমটা সে দেখালে তাদের।

'তোদের চোখের সামনেই জলের মধ্যে নুন

গলাচ্ছি। জল ভরা মগটা হল জলভর্তি' কেবিন,'

ব্যাখ্যা করে বোঝালে পরীক্ষক, 'ডিমটা হল গে মহাকাশযাত্রী। মহাকাশযাত্রীকে কেবিনে রাখা হল... এবার ... ' সশক্তিতে গেনা মগটা ঠুকল জানলার বাজুতে।

ল্যবকা বলে উঠল, 'মা গো!'

মেঝের ওপর ছিটকে পড়ল খানিকটা জল।

'দ্যাখ এবার, মহাকাশযাত্রীর কোনো ক্ষতি হয়নি। হাত দিয়ে দেখতে পারিস,' অনুমতি দিলে গেনা। মগের মধ্যে তাকাল ওরা।

ডিমটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বরকা সমর্থন করলে, 'সত্যি, একটা ফাটলও নেই। তুই গেনা একজন প্রফেসর রে!'

'আমি নই,' সাধুর মতো স্বীকার করল গেনা, 'এটা তসিওলকভস্কির আবিষ্কার। তিনিই পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। তোরা যদি আমার কাছে ঘন ঘন আসিস, তাহলে আরো অনেক কিছু দেখাতে পারি তোদের...' তারপর হঠাৎ করেই বলে বসল, 'আয়, আমরা একসঙ্গে দল বাঁধি, কী বলিস?'

উত্তেজনায় গালে রঙ ধরল ল্যবকার: হল তাহলে! একের পর এক, দুই বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল সে: দুজনেই বিব্রত এবং খুশি।

গেনা বললে, 'সাধারণত কক্ষনো ছাড়াছাড়ি হব না আমরা, বেশ?'

'বেশ,' রাজীল বরকা।

'বেশ,' সমর্থন করে গেনার হাতে তালি দিলে ল্যবকা।

ঝুম! সদর দরজার কাছে এক চাঙ বরফ পড়ল ছাদ থেকে। জানলায় জানলায় আলো নিভছে। সবুজ ঐ আলোটাও মিটমিট করে নিভে গেল, সবাইকে জানিয়ে দিলে বরকা স্মেলভ ঘুমচ্ছে।

আরও পড়ুন

ঝুম!.. ফের সব চুপচাপ। কী হল? বরফ খসে পড়ল ছাদ থেকে নাকি টেবলের ওপর ঝন ঝন করে উঠল ফ্লাস্ক? বিছানায় উশখুশ করে গেনা

কারাতভ। তারপর মাথা তুলতেই দেখে: সিল্কের আলখাল্লা পরে চীনা মান্দারিন বাং হ

চেয়ারে বসে বসে দুলছে। মস্ত দুটো ড্রাগন শান্তভাবে শুয়ে আছে তার পায়ের কাছে। "কামান নাকি রকেট, কামান নাকি রকেট?” দুলতে দুলতে জিজ্ঞেস করে মান্দারিন, গলার স্বরটা তার সেই চালাঘরের আমুদে আগন্তুকটার মতো; মাথার 'সরু বেণীটা কাঁপছে।

"রকেট নয়ত কি, নিশ্চয় রকেট!” বলতে চায় গেনা, কিন্তু ওর ঠোঁট কাঁপলেও শব্দ বেরয় না।

আরো জোরে জোরে দুলাতে থাকে মান্দারিন, আরো ফুলে উঠতে থাকে ড্রাগনদুটো। চেয়ারে বসা বাং হ'কে তারা উঠিয়ে নিল মেঝে থেকে। ঝন ঝনাৎ... খুলে গেল জানলা, আকাশের দিকে উড়ে গেল ড্রাগনদুটো। সোনালী চমক দিয়ে উঠল বাং হু'র সিল্কের আলখাল্লা আর গেনা দেখতে পেলে, কোলের মধ্যে তার বরকার কুকুর তিয়াপা। "থামুন, থামুন একটু!” জোরে চিৎকার করে উঠতেই জেগে গেল গেনা।

ঘরের মধ্যে অন্ধকার। চেয়ারটা যথাস্থানেই আছে। জানলা দিয়ে দেয়ালের ওপর এসে পড়েছে রাস্তার দোলায়মান ল্যাম্পের একটু হলদেটে আলো। "স্বপ্ন দেখছিলাম,” হাঁপ ছাড়ল গেনা, "তাহলেও তিয়াপাকে কিন্তু খুঁজে বার করতে হবে।"

আরও পড়ুন