আমার বোহেমিয়ান গল্প
বোহেমিয়ান হওয়ার শখ আমার সেই অ আ শেখার আগে থেকেই! ছোটবেলায় রাতের আকাশের চাঁদ দেখিয়ে যখন আমাকে ঘুম পাড়ানো হতো, তখন দেখতাম, এক বুড়ি বসে আছে চাঁদে। প্রশ্ন ছুড়ে দিতাম, আচ্ছা, চাঁদে ওই বুড়ি কী করছে? আমাকে বলা হতো, শীতের জামা সেলাই করছে বুড়ি। আরেকটু বড় হওয়ার পর জানলাম, বুড়ি চরকা কাটছে। খুব ইচ্ছা করত, ওই চাঁদের দেশে যেতে। কিন্তু সেখানে কীভাবে যায়, জানা ছিল না। তাই চাঁদকে বলতাম,
চাঁদ মামা কোথায় তোমার বাড়ি?
সেথা যায় কি কোনো গাড়ি?
যদি সাধ্য থাকত, আম্মু বকা দিলেই একছুটে চলে যেতাম চাঁদের বুড়ির কাছে। হরেক মজার গল্প শোনাত বুড়ি। চাঁদের পাহাড়ে সুন্দর একটা বাড়ি বানিয়ে নিতাম। আর আসতাম না ফিরে তোমাদের নিঠুর পৃথিবীতে।
ইচ্ছা করত পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখতে। শুভ্র মেঘেদের দেশে হারিয়ে যেতে। মাঝেমধ্যে মনে হতো, বড় হয়ে ডোরেমনের পকেট চুরি করে যেকোনো জায়গায় চলে যাব। হারিয়ে যাব অচিন কোনো দেশে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম যে চাঁদের বুড়ি, পক্ষীরাজ ঘোড়া, ডোরেমন আর তার পকেট-এসব নিতান্তই কাল্পনিক চরিত্র।
আকাশের আরও ছোট্ট সদস্য যেমন গ্রহ, নক্ষত্র, তারকা ওদের কাছেও পৌঁছাতে ইচ্ছা করত। মনে করতাম যে তারা পৃথিবীর খুব কাছে একসঙ্গেই রয়েছে। মাঝেমধ্যেই দেখতে পেতাম, আমার বাড়ির ছাদের নাগালের খুব কাছে বেড়াতে এসেছে ওরা। এত কাছ থেকে ওদের দেখতে পেয়ে ভালো লাগত খুব। একদিন আমাকে ডেকে বলল, ‘দেখো আমরা তোমার কত কাছে চলে এসেছি। আমরা জানি, তুমি প্রতি রাতে আমাদের দেশে চলে আসতে চাও। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকো। এই মায়ার টান আমাদের তোমার পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে।’ তারপর আমার দিকে সুন্দর একটা সিঁড়ি সাজিয়ে দেওয়া হলো। ওরা আরও বলল, ‘এবার তুমি আমাদের দেশে ভ্রমণ করে যেতে পারো। নক্ষত্র, তারা, চন্দ্র, গ্রহ-উপগ্রহ একটি থেকে আরেকটিতে, ঠিক তোমার যতক্ষণ খুশি।’ তারপর যেই না সিঁড়ি বেয়ে হাত বাড়িয়ে ওদের ধরতে যাব, অমনি ওরা উধাও হয়ে গেল। বিলীন হয়ে গেল ওদের রাজ্যে। আমারও ওদের সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে মহাশূন্যে হারিয়ে যেতে, নক্ষত্ররাজ্যে, তারকাপুরীতে! কিন্তু ওরা এত আলোকবর্ষ দূরে যে সেখানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তবু ছুটে যেতে চায় এই অবাধ্য মন। কিন্তু সত্য হলো এটাই-
‘সেথা যাওয়ার নেই তো সাধ্য
তবু মনটা ভীষণ অবাধ্য’
২
শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে দারুণ এক অ্যাডভেঞ্চারের বই হাতে নিয়ে খানিক কাঁপতে কাঁপতে স্কুলের পথে রওনা দিলাম। মাঝপথে বইটা হঠাৎ খুলে দেখতে ইচ্ছা হলো। একটু পড়তেই সেই কল্পনায় এমনভাবে হারিয়ে গেলাম যে সত্যি সত্যিই নিজের অজান্তেই এসে পড়লাম এক অচেনা স্টেশনে। উঠে পড়লাম ট্রেনে। আমি তখনো বইয়ের ভেতর গভীর মগ্নতায় ডুবে ছিলাম। ঝকঝক করে ট্রেন ছুটছে তো ছুটছেই! বইয়ের পাতা যখন ফুরিয়ে গেল, তখন নিজেকে ট্রেনে আবিষ্কার করে আচমকা চমকে গেলাম আমি। কত দূরে চলে এলাম কে জানে! নাহ! আর বেশি দূর যাওয়া চলবে না। সামনের স্টেশনেই নেমে যাব।
ট্রেন এসে যে স্টেশনে থামল, তা এক পাহাড়ি অঞ্চলের কাছাকাছি। এটা বুঝতে পারলাম যখন এক শিশু তার বাবাকে বলল, ‘চলো না বাবা, এবার ওই পাহাড়ে যেতে হবে তো আমাদের!’ মনে মনে বললাম, ‘এত দূর যখন চলেই এসেছি, তখন ওই পাহাড়ি এলাকায় ঘুরে আসাই যায়। ওদের অনুসরণ করলেই আমি পৌঁছাতে পারব ওই পাহাড়চূড়ায়।’
পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে হেঁটে যখন ক্লান্ত হয়ে থেমে যাই, তখন দেখি এক পাহাড়ি বালিকা হেঁটে আসছে। আমাকে এসে কী যেন বলল। ভাষা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ইশারা করে বোঝালাম যে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সে-ও ইশারা করে জানতে চাইল, আমি কোথা থেকে এসেছি এবং একা নাকি। বললাম, ‘অনেক দূর থেকে একাই এসেছি।’ মেয়েটি আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। পাহাড়ের ওপর কী সুন্দর মাটির বাড়ি! গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সঙ্গে নানা ধরনের ভর্তা আর মাছভাজি পরিবেশন করা হলো। ভীষণ মজার! এই নৃগোষ্ঠী পরিবারের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। তাদের সঙ্গে ইশারায় কথা বলেও বেশ মজা পাচ্ছিলাম। যখন ইশারা বুঝতেও ব্যর্থ হচ্ছিলাম উভয় পক্ষ, তখন দারুণ হাসাহাসি হচ্ছিল। আমাকে তাদের সাজপোশাকে সাজিয়ে দেওয়া হলো। এখন নাকি তাদের একটা উৎসব হবে। নাচ, গান আর নানা মজার খেলা। আমাকে নাচতে বলা হলো। বললাম, ‘আমি নাচতে পারি না।’ এটা শুনে আমাকে অদ্ভুত সব মজার নাচ শেখাতে লাগল মেয়েটি। দারুণ লাগল তাদের এই অদ্ভুত নাচ। পাহাড়ের ওপর চিৎকার করে যেসব শব্দ উচ্চারণ করছিলাম, তা-ই প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। বেশ লাগল শুনতে! আর ওদের সঙ্গে অদ্ভুত সব মজার খেলায় মেতে উঠতে লাগলাম। কিন্তু এসবের মধ্যেও হঠাৎ মনে পড়ল, ‘হায় হায়! আমার স্কুলে অনুপস্থিত থাকার মেসেজ তো সেই কোন সময় বাড়িতে চলে গেছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই শহরজুড়ে খোঁজাখুঁজি করা শুরু করেছে সবাই। এতটা আনন্দ-উল্লাসে মেতে ছিলাম যে ভুলেই গিয়েছিলাম সেসব কথা। আম্মু নিশ্চয়ই চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। এবার আমায় ফিরে যেতে হবে আসল ঠিকানায়।
তবে কি এবার পারব বাড়িতে ফিরতে? নাকি হারিয়ে যাব আবারও?
৩
ছোটবেলায় ভাবতাম মেঘের রাজ্যে হয়তো কোনো দানব আসে, তাই ভয় পেয়ে অশ্রু ঝরায় মেঘেরা, যা আমরা বৃষ্টিরূপে দেখতে পাই। মেঘের ভয়ংকর গর্জন শুনে ভয় লাগত ঠিকই, তবে মেঘের রাজ্যে আসলে হচ্ছেটা কী, তা দেখে আসতে খুব ইচ্ছা করত। আচ্ছা, দানবটা কি খুব বেশি ভয়ংকর? তাকে দেখতে পেলে কি আমিও কেঁদে ফেলব?
বৃষ্টি শেষে আবার আকাশে যখন রংধনু দেখা যায়, তখন ইচ্ছা করে রঙপরি হয়ে রংধনুর দেশে যেতে। শুভ্র মেঘের রাজ্যে মনের বাড়ি বানিয়ে নিতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা জাগে পূর্ণিমা রাতে সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে ভেসে জোছনাবিলাস করতে। মনের ঘরে চান্দের আলো চুইয়ে চুইয়ে পড়বে আর আমি গলা ছেড়ে গান গাইতে থাকব। আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, নক্ষত্র, তারারা মুখর হবে সেই গানের সুরে। আবার হঠাৎ বোহেমিয়ান হয়ে উড়াল দিয়ে যাব আরেক অচিন ঠিকানায়।
রিকশায় চড়ে শহর ঘুরে দেখা দারুণ রোমাঞ্চকর ব্যাপার হলেও আমার মাঝেমধ্যে ছদ্মবেশী রিকশাওয়ালা হতে ইচ্ছা করে। শহরের অলি-গলি ঘুরে দেখব আর একেক জায়গা থেকে যাত্রী কুড়াব। তারা আমার রিকশায় বসে নানা ছন্দে-গল্পে মশগুল থাকবে আর আমি সেসব গল্প আমার গল্পের ঝুড়িতে সাজিয়ে রাখব। রিকশা একপাশে রেখে পথশিশুদের সেসব গল্প শোনাব। গল্প শুনতে শুনতে তারা ঘুমিয়ে যাবে এবং আমি সেই রিকশা নিয়ে আবার বোহেমিয়ান হয়ে ছুটব অজানা ঠিকানায়...
এসব সামাজিক ধরাবাঁধা নিয়ম ছেড়ে ছুটে যেতে ইচ্ছা করে পাহাড়ে, যার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে নাম না জানা নদী। মনমাঝি নিয়ে নদীতে ভাসব নৌকা নিয়ে। নদী পার হলেই বন। সেই বনের বানরদের এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফালাফি দেখব। কত দ্রুত তারা এক গাছ থেকে আরেক গাছের আড়ালে হারিয়ে যায়, তা দেখতে পাওয়া ভারি মজার। গাছের ডালে নানা পাখি নানা সুরে গাইতে থাকবে। আমিও তাদের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা করব। আবার সেই বন পেরিয়ে উত্তাল সমুদ্র। সমুদ্রের জল ছুঁয়ে যাবে আমার পা। কিন্তু সেই পা আমি আবার কোন অচিন ঠিকানায় ফেলব, তা ঠিক জানা নেই।
কিন্তু এসব কিছুই বাস্তবে সম্ভব নয়। এসব অবাস্তব আগ্রহই আমাদের মধ্যে জন্মায় বেশি। আসলেই বড্ড বোহেমিয়ান হতে ইচ্ছা করে। বদ্ধ ঘর ছেড়ে এই ব্রহ্মাণ্ডে ভবঘুরের মতো বাঁচতে ইচ্ছা হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বাদশ শ্রেণি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা