রানির ক্ষমতা
দুর্গে অনেকগুলো টাওয়ার থাকলেও ক্রাউন জুয়েলস বা রাজকীয় সব মূল্যবান সম্পদ রাখা ছিল মাটির অনেক গভীরে। উনপঞ্চাশটি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে, একটা প্রায় অন্ধকার করিডর ধরে আমি এগিয়ে চললাম। সেখান থেকেই চুরি হয়েছে রানির রত্ন। ভূগর্ভস্থ জায়গাটা ছিল ঠান্ডা ও নীরব। শুধু শোনা যাচ্ছিল আমার জুতার শব্দ। বারবার হাঁটার শব্দের প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। করিডরের শেষ প্রান্তে একটা দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালাম। দরজার ওপর একটা সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা ছিল ‘দ্য ক্রাউন জুয়েলস: সিম্বল অব কুইনলি পাওয়ার’।
আমি একটা রুমে ঢুকলাম। রুমের ঠিক মধ্যিখানে একটা বিশাল কাচের বাক্স রাখা ছিল। লাল মখমলে মোড়ানো বাক্সটির গায়ে ওপর থেকে আলো পড়ছিল। বাক্সের ভেতরে সাজানো ছিল অমূল্য সব ধনরত্ন—রাজদণ্ড, মুকুট, ডায়াডেম (একধরনের মুকুট), অলংকারখচিত খঞ্জর, টিয়ারা (এটিও একধরনের মুকুট) এবং সোনার গ্লোব। সবকিছুই সোনা বা রুপা দিয়ে তৈরি। সেগুলো থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছিল। সামনে এগিয়ে গিয়ে কাচের বাক্সে হাত রাখলাম।
মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি। আলোয় যেন ঝলসে উঠলাম। কিন্তু একই সঙ্গে বিভ্রান্তও হলাম। কারণ, আমি শুনেছিলাম ক্রাউন জুয়েলস চুরি হয়ে গেছে। আপনমনে যখন এসব ভাবছিলাম, তখনই পেছন থেকে একটা নারী কণ্ঠ বলে বলল, ‘হ্যালো’।
মহামহিম রানি
পেছন ফিরে তাকালাম আমি। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ইংল্যান্ডের রানি। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে চিনতে পারলাম—টাকার নোটে তাঁর ছবি দেখেছি। রানিকে ঘিরে রয়েছে ১২টা ছোট কুকুর। একটা অন্যটার লেজ কামড়াচ্ছে। রানি বেগুনি রঙের পোশাক আর একই রঙের একটা টুপি পরে ছিলেন। টুপির কিনারায় কয়েকটি বিরল পাখির পালক লাগানো ছিল।
মাথা নুইয়ে রানিকে কুর্নিশ করলাম। কারণ, রানির সামনে এমনটাই করা উচিত বলে মনে হলো। রানি ভ্রুকুটি করলেন।
আমি হাঁটু গেঁড়ে বসলাম। কারণ, মনে হলো, মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করা যথেষ্ট হয়নি।
রানি হেসে ফেললেন।
‘দয়া করে উঠে দাঁড়াও,’ বললেন রানি। তারপর একটা টিনের বাক্স এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
‘বিস্কুট খাবে?’
‘বিস্কুট?’ বললাম আমি।
তিনি বাক্সটা ঝাঁকালেন এবং হাসলেন। আমি হাত বাড়িয়ে একটা বিস্কুট নিলাম। খেয়ে দেখলাম একটু।
বিস্কুটটার স্বাদ কাগজের মতো। আমার মুখ শুকিয়ে গেল।
‘সুস্বাদু, তা–ই না?’ জিজ্ঞেস করলেন রানি। ‘একটা মজার তথ্য বলি: তোমরা আমেরিকানরা যেটাকে কুকি বলো, আমরা ইংরেজরা সেটাকে বলি বিস্কুট!’
‘এটা কুকি নয়,’ বললাম আমি। ‘কুকি মিষ্টি হয়। তাতে সুস্বাদু জিনিস থাকে, যেমন চকলেট চিপস।’
রানি ভ্রুকুটি করলেন। ‘তাহলে তোমরা বিস্কুটকে কী বলো?’
‘আমরা যেটাকে বিস্কুট বলি, সেগুলো কুকুরদের খাওয়াই,’ বললাম আমি।
‘বুঝেছি’ বললেন রানি। তিনি বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করে নিজের হ্যান্ডব্যাগে রেখে দিলেন। ‘তোমার ফ্লাইট কেমন ছিল?’
‘ভয়ংকর!’ বললাম আমি। ‘কেউ আমার গেমবয় চুরি করেছে!’
‘ওটা কী জিনিস?’ জিজ্ঞেস করলেন রানি।
‘ওহ!’ বললাম আমি। ‘এটা একটা ছোট্ট ভিডিও গেম কনসোল। নিনটেন্ডো এসব তৈরি করে।’
‘যেকোনো ভিডিও গেমকেই আমি বাজে জিনিস মনে করি,’ বললেন রানি।
‘আসলে, গেমগুলো খুব মজার!’ বললাম আমি। ‘অনেক গেম তো ছোটগল্পের মতোই! যেমন মারিও, সে একজন প্লাম্বার, যে একদিন—’
‘তোমাকে একটা পরামর্শ দিই,’ বললেন রানি। ‘কেউ যখন জিজ্ঞেস করবে, তোমার ফ্লাইট কেমন ছিল, তার জবাবে তারা শুধু সংক্ষিপ্ত উত্তর যেমন “ভালো” বা “মন্দ” আশা করে। কেউ তোমার গেমবয় হারিয়ে যাওয়া বা প্লাম্বারের গল্প শুনতে চায় না।’
‘ওটা হারিয়ে যায়নি, চুরি হয়েছে! আপনার মনে হয় না, ক্রাউন জুয়েলস চুরির সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকতে পারে?’ রত্নভর্তি বাক্সের দিকে ইশারা করে কথাটা বললাম।
‘তা ছাড়া আমি তো ভেবেছিলাম, আপনি বলেছিলেন কেউ ক্রাউন জুয়েলস চুরি করেছে।’
‘হ্যাঁ বলেছিলাম।’
‘কিন্তু…’
আমি আবার রত্নভর্তি বাক্সের দিকে ইশারা করলাম।
‘কিন্তু কী?’
‘কিন্তু... এখানে তো অনেক রত্ন আছে।’
‘ম্যাক, ক্রাউন জুয়েলসে ১৪০টি বস্তু আছে। সব কটা চুরি হয়নি।’
‘বুঝলাম,’ বললাম আমি।
তারপর আমার নোটবুক বের করলাম যাতে চুরির বিষয়টা লিখে রাখতে পারি। ‘তাহলে কী চুরি হয়েছে?’
‘আমার চামচ,’ বললেন রানি।
‘আপনার কী?’
‘আমার চামচ,’ আবার বললেন রানি।
হাসতে শুরু করলাম আমি।
কিন্তু রানির মুখ দেখে বুঝলাম, কাজটা ভালো হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে গেলাম।
ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
রানি গলা খাঁকালেন। আবার মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলাম রানিকে, নিজে নিরাপদ থাকার জন্য।
তারপর বললাম, ‘এই চামচের ব্যাপারে আমাকে আরও বলুন।’
‘চামচটি খুব বিশেষ। রাজা-রানিদের অভিষেকের সময় এটি ব্যবহৃত হয়। এর নাম, ‘করোনেশন স্পুন।’
‘ভালো নাম,’ বললাম আমি।
‘রাজপরিবারের সংগ্রহে এই চামচ ৮০০ বছরের বেশি সময় ধরে আছে।’
‘তাহলে তো অনেক পুরোনো চামচ!’ বললাম আমি।
‘নিশ্চয়ই,’ বললেন রানি। ‘এটা রুপার তৈরি আর সোনায় মোড়ানো। এর গায়ে পাতার নকশা ও দানবের মুখ খোদাই করা আছে। হাতলে আছে পানির মতো চকচকে চারটি মুক্তা।’
সব খাতায় লিখে নিলাম।
‘চামচটা কত বড়?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘১০ ইঞ্চি লম্বা।’
‘ওহ, ভালোই লম্বা চামচ!’
‘নিঃসন্দেহে,’ বললেন রানি।
পেনসিলটা নামিয়ে রাখলাম। ‘দেখুন, এটা নিঃসন্দেহে খুব সুন্দর একটা চামচ!’
‘নিশ্চয়ই,’ বললেন রানি।
‘কিন্তু এটা নিয়ে এত হইচই কেন? এটা তো একটা চামচমাত্র।’
‘তোমাকে একটা গল্প বলব আমি,’ বললেন রানি। ‘এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে...’
‘ওহ না, আবার গল্প!’ বললাম আমি।