এমন সময় ঘ্যাঁচ করে বাসটা এসে থামে। যাত্রীরা সব হুড়মুড় করে উঠে পড়ে। বাস কন্ডাক্টরটা তাকে বলে, ‘তুমি একা?’
‘হ্যাঁ।’
কন্ডাক্টরটা কেমন করে যেন হাসে। ভয় লাগে পলির। লোকটার আবার কোনো মতলব নেই তো?
টেম্পার অ্যাকশন ক্লাবের ছয় সদস্য একটা বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। সবার পেছনে দাঁড়ানো ফাহাদ। শুকনা ধরনের ছেলেটা সম্ভবত দলের নেতা। এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল সে।
দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ভদ্র চেহারার একটা লোক। ওদের দেখে তার ভ্রু কুঁচকে গেল।
‘কী ব্যাপার?’
‘ট্যাকা কই?’
‘কিসের টাকা?’
‘৫০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা। আমগো ক্লাবের চান্দা।’
‘একবার বলেছি তো, আমি কাউকে কোনো চাঁদা দিই না।’
‘দিবেন না?’
‘না।’
এবার শুঁটকা ছেলেটা পেছনে তাকিয়ে বলল ‘টেম্পার ক্লাব, অ্যাকশন...’
ফাহাদ খেয়াল করল, পেছনের দুজন দুটো ছুরি বের করল। ফাহাদের তখন যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে! এরা কি পাগল নাকি? এরা আসলে চাঁদাবাজি করে, ছ্যাঁচড়া ধরনের চাঁদাবাজ পার্টি। আগেই বলেছিলাম, ফাহাদ সাহসী একটা ছেলে। তার সাহসের কারণ হলো, সে ‘ব্ল্যাক বেল্ট কারাতে’ হিসেবে জুনিয়র গ্রুপে দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ঢাকা উত্তরে। নানা রকম চাকু চালাতে তার মতো ওস্তাদ লোক ঢাকা শহরে দ্বিতীয়টি নেই। কারাতে কনভেনশনে সফরে আসা কোরিয়ান ট্রেনার হ্যাং ওয়া একবার তাকে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। ‘ও লেগে থাকলে দেখবে ঠিক একদিন এশিয়ার সেকেন্ড ব্রুস লি হয়ে উঠবে...’ পেছন থেকে ফাহাদ চেঁচিয়ে উঠল, ‘খবরদার!’ সবাই ঘুরে ফাহাদের দিকে তাকাল।
‘কী হইসে?’ শুকনা ছেলেটার মুখে প্রশ্ন।
‘এই তোমাদের ক্লাব? চাঁদাবাজি করো?’
‘ওই তোর কী? ওরে ধর।’
ছুরি হাতে দুজন ঘুরে দাঁড়ায়। ওরা ছুরি হাতে ছুটে আসার আগেই যেন শূন্যে উঠে গেল ফাহাদ, দুপা দিয়ে ছুরি হাতে নেওয়া দুজনের মুখে মারল পরপর, ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই। ‘ও মা গো!’ বলে মুখে হাত দিয়ে বসে পড়ল দুজনই। দুজনের ছুরিই ছিটকে পড়েছে। হতভম্ব শুকনা ধরনের নেতাটা তার পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করল। এটা কি সত্যি পিস্তল, না ভয় দেখানোর জন্য বের করেছে? নকল পিস্তলই হবে, কারণ সত্যি পিস্তল হলে তার ভারে ওর ডান হাতটা এত সহজে ভার্টিক্যালি উঠে আসতে পারত না। এসব তার ট্রেনিংয়ের সময় শেখা। তবে দেরি করল না ফাহাদ। বসে পড়ে পা চালাল। ঘড়ির কাঁটার মতো তার পা দুটো ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে আঘাত হানল শুকনা নেতার দুই পায়ে। ‘ও মাগো’ বলে ছিটকে পড়ল দুহাত পেছনে। তার হাতের পিস্তলটাও ছিটকে পড়ল দরজায় দাঁড়ানো লোকটার পায়ের কাছে। পাশেই বেশ কিছু চ্যালাকাঠ পড়ে ছিল। এবার তার একটা তুলে নিল ফাহাদ। ততক্ষণে টেম্পার ক্লাবের তিনজন পালিয়েছে। দুজন নাকে হাত দিয়ে বসে আছে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্তের ধারা দেখা যাচ্ছে। দলনেতা উঠে বসার চেষ্টা করছে, কোমরে লেগেছে তার। উঠতে কষ্ট হচ্ছে।
যাকে বলে দাবার ছক উল্টে যাওয়া আরকি, সেটাই ঘটেছে। ভদ্রলোক এবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন।
‘এসব কী হচ্ছে?’
‘আঙ্কেল, আপনি পুলিশে ফোন করেন।’
‘তুমি কে?’
‘আমি এখানে নতুন এসেছি। এরা টেম্পার ক্লাবের সদস্য, আমাকে বলেছে তাদের সদস্য হতে, তারা নাকি এলাকার মানুষের উপকার করে। তারা রবিনহুড। আমি কৌতূহলী হয়ে এসেছিলাম, এরা আসলে কী করে দেখার জন্য। তারপর তো আপনিই দেখলেন।’
‘তোমার তো অনেক সাহস দেখছি, চমত্কার পারফরম্যান্স, তুমি নিশ্চয়ই কুংফু কারাতে জানো?’
‘জি, আমি কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট।’
‘দারুণ ব্যাপার।’
‘আপনি পুলিশকে জানান।’
‘হ্যাঁ, আমি এখনই পুলিশকে ফোন করছি। এরা আমার দোকানে গিয়েছিল চাঁদার জন্য। দিইনি। এখন বাসা চিনে এসেছে এখানে। তবে আমি আগেই থানায় ডায়েরি করিয়েছিলাম।’
‘পিস্তল আর ছুরি দুটো পুলিশকে দেবেন কিন্তু। আমি যাচ্ছি। পিস্তলটা নকল।’
‘না, না, তুমি থাকো।’
‘না, আমি আর এর মধ্যে থাকতে চাচ্ছি না।’
ইতিমধ্যে কিছু লোক চলে এসেছে আশপাশ থেকে। ভদ্রলোকের নিজস্ব কিছু মানুষও চলে এসেছে। একজন আবার উদ্যোগী হয়ে দুজনকে বেঁধে ফেলেছে। চড়-থাপ্পড়ও চলছে বেশ। নেতাকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে কয়েকজন অতি উত্সাহী মানুষ।
পরদিন স্কুলে গিয়ে দেখে হুলুস্থুল ব্যাপার। সবার মুখে একটাই আলোচনা—টেম্পার অ্যাকশন ক্লাবের ফাজিল ছেলেগুলো সব ধরা পড়েছে। ধরিয়ে দেওয়ার নেপথ্যের নায়ক যে ফাহাদ, সেটা অবশ্য কেউ জানল না। এতে ফাহাদ মনে মনে বেশ খুশি হলো। নেপথ্যেই থাকতে চায় সে। ব্যাপারটা যে এত দ্রুত ফয়সালা হয়ে যাবে, তা সে বুঝতে পারেনি।
প্রথম ক্লাসে ইংরেজি স্যার এলেন, এখন তিনি ক্লাস টিচার। তাকে বেশ গম্ভীর মনে হলো। রোলকল না করে কারও দিকে না তাকিয়ে তিনি সোজা বোর্ডের দিকে চলে গেলেন। বোর্ডে চক দিয়ে ঘসঘস করে লিখলেন—‘I to die, you to live, which is better, only god knows.’
‘সক্রেটিসের এই বাক্যের ব্যাখ্যা লেখো। আজ ক্লাস টেস্ট। এর মার্ক ফাইনালে যোগ হবে।’
‘কিন্তু স্যার, এ রকম তো সিস্টেম নেই আমাদের।’ ক্লাস ক্যাপ্টেন সাহস করে বলল।
‘কোন সিস্টেম নেই?’
‘এই যে ক্লাস টেস্টের মার্ক ফাইনালে যোগ হওয়া।’
‘সিস্টেম নেই, আমি সিস্টেম করলাম, অসুবিধা আছে? সময় ২০ মিনিট। লেখো...জলদি...’
স্যার ঘড়ির দিকে তাকান।
কী আর করা। সবাই লিখতে শুরু করল। ফাহাদ ছাত্র হিসেবে খুব মেধাবী না হলেও একেবারে খারাপ নয়। যতটা পারা যায়, গুছিয়ে লিখল সে। ঘড়ি ধরে ২০ মিনিট পর স্যার খাতা জমা নিলেন সবার এবং স্যার ক্লাসে বসেই খাতা দেখতে শুরু করলেন। পড়াশোনার ব্যাপারে তাকে আজ খুবই সিরিয়াস মনে হচ্ছে। কোনো কারণ ছাড়াই কেন যেন ফাহাদের বেশ হাসি পেল স্যারের ভাব-ভঙ্গি দেখে। খুব দ্রুতই তিনি খাতা দেখে শেষ করে ফেললেন এবং সবাইকে যার যার খাতা দেওয়া শুরু করলেন। মহীন্দ্র ক্লাসের ফার্স্ট বয়। সে পেল ১৫-তে সাড়ে ১৩...অন্যরা পেল কেউ ১০, কেউ ১২, কেউ ১১, কেউ ৯। সবার শেষে খাতা পেল ফাহাদ। সে পেল আড়াই। এমন একটা কিছু যে ঘটতে চলেছে, ভাবছিল সে। স্যার গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। ফাহাদ খাতা উঁচু করে সবাইকে দেখাল। ‘এই দেখ, আমি আড়াই পেয়েছি!’ সবাই কেন যেন আবার হো হো করে হেসে উঠল। স্যার তখনো বেশি দূরে যাননি। তিনি শুনতে পেলেন, তার ক্লাসের ছেলেরা হো হো করে হাসছে।
রাস্তার মোড়ে একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাফি। একটু পরই আপু আসবে। তারপর শুরু হবে তাদের নতুন জীবন। অজানা দুশ্চিন্তায় তার বুকটা ধুক ধুক করে কাঁপছে। সব ঠিকঠাকমতো হবে তো? আপু বের হয়ে আসবে তো? বের হতে পারবে তো? বের হতে গেলেই নিশ্চয়ই তার শাশুড়ি ধরবে, বলবে—
‘সুলতানা, কই যাও?’
‘একটু বাইরে।’
‘বাইরে কোথায়?’
‘দোকানে, আমার কিছু কেনাকাটা আছে।’
‘টাকা পেলে কোথায়? মজিদ দিয়ে গেছে?’
‘আপনার ছেলের হাত থেকে টাকা বের হয়? এটা আমার নিজের টাকা।’
‘ও, মুখে মুখে তর্ক করতে তো ভালোই শিখেছ, আসুক আজ মজিদ। মুখে মুখে তর্ক করা বের করব। বংশের ঠিকঠিকানা নাই, কোত্থেকে একটা মেয়ে ধরে এনে...ঘরের বউ...’
‘মা, আপনাদের বংশ কী?’
‘তা দিয়ে তোমার কাজ কী? বংশের কী বোঝো তুমি?’
‘না, বুঝি না। আপনাদের এত বড় বংশ, তো এ রকম একটা বস্তিমার্কা বাসায় থাকেন কেন?’
‘ভাবি, এটা কী বললে তুমি? ছোট মুখে বড় কথা...’ বড় বোন এসে নাক গলায়। দূর থেকে বারান্দায় বসে থাকা আপুর শ্বশুর চেঁচায়, ‘ঝেঁটিয়ে বের কর এদের...যত সব জঞ্জাল এসে ঢুকেছে ঘরে!’
আসলে প্রায়ই এমন কথাবার্তাই হয় এই বাসায়। কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসে রাফি। তার সামনে একটা বেবি ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায়। রাফি অবাক হয়ে দেখে, ট্যাক্সির ভেতর তার আপু বসে আছে হাসিমুখে।
‘জলদি উঠে আয়।’
রাফি ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়ে।
‘বাসার সামনে ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম।’
‘আপা, কই যামু?’ ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞেস করে।
‘মিরপুরে চলেন।’
‘মিরপুরে কোথায় যাব আপু?’ রাফি জানতে চায়।
‘আমার এক বান্ধবীর বাসায়। তারপর...’
‘তারপর...?’
‘তারপর দেখি না কী হয়। ভাবিস না।’
আপু হাসিমুখে তাকায় রাফির দিকে। এক হাতে ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে। ফিসফিস করে বলে,
‘বুঝলি, আমাদের নতুন জীবন শুরু হতে যাচ্ছে, হয়তো কঠিন হবে জীবনটা, কিন্তু আমাদের পারতে হবে। কি, আমরা পারব না?’
‘পারব পারব...’ ফিসফিস করে রাফি।
ঠিকানা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগল। শেষমেশ ঠিকানা মিলিয়ে দোতলা একটা বাসায় এসে হাজির হলো দুজন। সুন্দর একটা বাসা। বাসা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এরা খুব বড়লোক। বাসার সামনে একটা বড় অ্যাকুয়ারিয়াম। একটা প্যাঁচানো সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদে। চারদিকে নানা রকম গাছ। রংবেরঙের ফুল ফুটে আছে।
‘এটা ইসমাতদের বাসা না?’
‘হ্যাঁ, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’ বাসার দারোয়ান জানতে চায়।
‘আমি ওর বান্ধবী সুলতানা, ওকে বললেই হবে। সকালে ওর সঙ্গে কথা হয়েছে।’
‘আচ্ছা।’
দারোয়ান ভেতরে চলে গেল। একটু পরই ছুটে এল আপুর বান্ধবী ইসমাত। সে আসতেই জড়িয়ে ধরল একজন আরেকজনকে। কত বছর পর দেখা ওদের!
ওরা ব্যাগট্যাগ নিয়ে ড্রইংরুমে বসল। একটু পরই চা-নাশতা চলে এল। গরম শিঙাড়া আর নিমকি। মিষ্টিও ছিল কয়েক পদের। সকালে নাশতা করা হয়নি, রাফি আরাম করে খাচ্ছিল, প্রতিটা খাবারই সুস্বাদু। আর দুই বান্ধবীর হড়বড় করে কথা বলাও শুনছিল। সব কথা কানে আসছিলও না।
‘সত্যি কত বছর পর দেখা বল তো?’
‘সাত-আট বছর তো হবেই।’
‘না, পাঁচ বছর।’
‘হবে হয়তো, তোর বাসাটা এত সুন্দর।’
‘সুন্দর না হাতি। নে, খা তো!’
আপু খায় না। কথা বলে আর দুজন মিলে হি হি করে হাসে। এমন সময় এক লোক ঢুকলেন। লোকটা লম্বা, চওড়া, সুন্দর। আপু উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। আপুর দেখাদেখি রাফিও উঠে দাঁড়ায়। আপুর বান্ধবী পরিচয় করিয়ে দেয়—
‘আমার হাজব্যান্ড। আর এ আমার বান্ধবী সুলতানা।’ লোকটা কথা বলে না। একনজর ওদের দুজনকে দেখে; কার্পেটের ওপর রাখা ওদের ব্যাগটাও দেখে একনজর। তারপর ভেতরে ঢুকে যায়। আপুর বান্ধবীও যায় পেছন পেছন।
রাফির হুঁশ নেই। একটার পর একটা খেয়েই যাচ্ছে। দুটো শিঙাড়া শেষ করে এখন সে স্পঞ্জ রসগোল্লা খাচ্ছে। আরেক হাতে মজার একটা কেক। ঠিক তখনই আপু ফিসফিস করল—
‘জলদি ওঠ।’ রাফি অবাক হয়ে তাকাল।
‘কেন?’
‘পরে শুনিস।’
বলে আপু ব্যাগটা নিয়ে ঝড়ের বেগে গেটের বাইরে চলে আসে। রাফিও এল পেছন পেছন। বাইরে এসে দেখে, সেই বেবি ট্যাক্সিটা তখনো এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে, সিগারেট টানছে ড্রাইভার।
‘যাবেন?’ আপু জিজ্ঞেস করে।
‘উঠেন।’
ওরা দ্রুত উঠে পড়ে।
‘আমরা চলে এলাম কেন আপু?’
‘পরে শুনিস।’ রাফি খেয়াল করে দেখে, আপুর দুচোখ ভেজা। আপু কাঁদল কখন? আশ্চর্য লাগে রাফির।
চলবে...