পৃথিবীর সেরা পাড়া কোনটা?
ঘড়িতে মোটে বিকেল সাড়ে চারটা। সূর্য ঢলে পড়েছে, পাড়ার রাস্তায় সোনালি রোদ পড়েছে বাঁকা হয়ে। দূরে কোথায় একটা পাখি ডাকছে। এখনো ভাতঘুম সেরে লোকজন বেরোতে শুরু করেনি বোধ হয়, রাস্তা সুনসান। মোড়ের দিকে এগিয়ে চললাম ধীর পায়ে, বেশি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছি কি না, সেটাই ভাবছি।
পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে বন্ধুদের মেসেঞ্জার গ্রুপটায় ঢুকলাম। আমার ‘কেউ বেরোবি?’ তারপর থুতনিতে হাত রেখে চিন্তা করার ইমোজির মেসেজটা সিন করেছে তিনজন। অভিজিৎ, হাদী আর...ও না, তিন নম্বর জন তো আমি নিজেই। তাহলে, দুজন সিন করেছে মাত্র। আমার পাড়াতুতো আরও চার বন্ধু আছে এই গ্রুপে—ফারহান, নীল, সাকিব আর তৌকির। তাদের কারও খোঁজপাত্তা নেই। যারা সিন করেছে, তারাও টুঁ শব্দটি করেনি। যা ভেবেছি তা–ই, আসলেই বেশি আগে বেরিয়েছি বোধ হয় আজ বাসা থেকে। নাকি বেরোনোই ভুল হয়ে গেছে?
তাতে অবশ্য দুঃখ নেই আমার। এমন চনমনে বিকেলে বাড়িতে বসে থাকলে হাঁপ ধরে যায়। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম আমি।
পাড়ার ছোট রাস্তাটা একটা অপেক্ষাকৃত বড় রাস্তায় গিয়ে মিশেছে সামনের মোড়ে। খানিকটা ব্যস্ততা সেখানে। তিন যাত্রীসমেত একটা অটোরিকশা চলে গেল শহরের দিকে, আবার একটা বেকারির ভ্যান। কে জানে কোন দোকানে মাল সাপ্লাই দিতে যাচ্ছে। একটা ২০০ সিসির মোটরসাইকেল চলে গেল ভটভট শব্দ তুলে। আমি ডানে–বাঁয়ে তাকিয়ে রাস্তা পেরোলাম ধীরে ধীরে। ওধারে আরেকটা সরু রাস্তা ধরে খানিক দূর এগোলে বাড়িঘর পাতলা হয়ে আসতে শুরু করে। খালি প্লট আছে বেশ কয়েকটা, নিচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। একটা বড় শিরীষগাছ ছায়া ফেলেছে যেখানটায়, সেখানে দেয়ালের ওপরে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লাম কষ্টেসৃষ্টে। এটাই আমাদের বিকেলের অলস আড্ডার ঠিকানা। এই মুহূর্তে আড্ডার সদস্য অবশ্য কেবল আমি একাই।
পকেট থেকে ফোন বের করলাম আবার। মেসেঞ্জার গ্রুপের সুনসান নীরবতার নড়চড় হয়নি। আরেকটা মেসেজ দেব কি না ভেবে শেষমেশ বাতিল করে দিলাম চিন্তাটা। একটা অনলাইন বুকশপে দু–তিনটা বই দেখেটেখে ইউটিউবে ঢুকে অলস ব্রাউজিং করছি, চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের একটা গানের সাজেশন দেখে ক্লিক করলাম সেটায়। গান বাজছে আর আমি আনমনে তাকিয়ে আছি দূরের উঁচু পানির ট্যাংকিটার দিকে।
‘ছেঁড়া ঘুড়ি, রঙিন বল
এইটুকুই সম্বল
আর ছিল রোদ্দুরে পাওয়া বিকেলবেলা
বাজে বকা রাত্রিদিন, অ্যাসটেরিক্স-টিনটিন
এলোমেলো কথা উড়ে যেত হাসির ঠেলায়।
সে হাসি ছুটে যেত গোধূলি মিছিলে
সবার অলক্ষেতে তুমিও কি ছিলে
হাওয়ায় হাওয়ায়, হাওয়ায় হাওয়ায়
বন্ধু তোমায় এ গান শোনাব বিকেলবেলায়...’
একটু আনমনা হয়ে গেছিলাম বোধ হয় শুনতে শুনতে, নইলে কখন যে একদম ঘাড়ের কাছে চলে এসেছে সাকিব, কখন যে বলল, ‘কী রে অমিত, একদম আনমনা হয়ে গেছিস দেখি!’ টেরই পাইনি। চমকে উঠলাম রীতিমতো, হেসে ফেললাম তারপরই। গান বন্ধ করতে করতে বললাম, ‘কী করব বল, তোদের কারও দেখা নেই। মেসেজের সাড়া নেই দেখে কল দিইনি কাউকে। একা একা বসে আছি।’
মাথা দোলাল সাকিব। লম্বা একহারা গড়ন, শ্যামলা চেহারা। ভুরু কুঁচকে রাখে সব সময়। ‘কী করবি বল, সময়টাই এখন এমন। এখনকার যুগটাই ইনডিভিজুয়ালিজমের।’
শব্দটা কোথায় যেন শুনেছি মনে হলো। সেটা নিয়ে কথা না বাড়িয়ে বললাম, ‘বস, কই যাচ্ছিস? দেখে মনে হচ্ছে তাড়া আছে।’
রাস্তার দিকে একবার তাকিয়ে দোনোমনো করে আমার পাশে বসে পড়ল সাকিব। ‘হ্যাঁ রে, ওই পাড়ার আলিফের কাছে যাচ্ছিলাম কেমিস্ট্রির একটা নোট আনতে। থাক, খানিকক্ষণ বসেই যাই। তবে মনে হয় না আর কেউ আসবে।’
সাকিবের সঙ্গে আড্ডা বহুত দিয়েছি, কিন্তু সেটা আর পাঁচজনের সঙ্গে মিশে। মেসেঞ্জার গ্রুপে ওকে ঢুকিয়েছে আমার বন্ধু নীল। সেখানেও খুব একটা কথা হয়নি ওর সঙ্গে, সত্যি বলতে। কখনো কোনো বিষয় নিয়ে ওর সঙ্গে লম্বা আলোচনা করেছি বলে মনে পড়ছে না। ওকে ছোটবেলা থেকে চিনি, স্কুলেও একসঙ্গে যাই, প্রচুর বই পড়ে বলে বেশ কয়েকবার বই অদলবদলও করেছি। কিন্তু আমার পাড়ার সার্কেলের তৌকির কিংবা আমার ভার্চ্যুয়াল জগতের বন্ধু মার্কো পোলো রাসেলের মতো গভীর বোঝাপড়া গড়ে ওঠেনি কখনো। এর কারণও আছে। যে কটা মিল বললাম, সেগুলো বাদে আমার আর সাকিবের ব্যক্তিত্ব পুরোপুরি দুরকম। আমি ঘরকুনো, ইন্ট্রোভার্ট, যাকে বলে মুখচোরা। পরিচিত চার-পাঁচজন বন্ধুদের সামনে ছাড়া গলা তুলে কথাও বলতে পারি না। এদিকে সাকিব যে কারও সঙ্গে সহজ, স্বচ্ছন্দ। যেকোনো আড্ডার মধ্যমণি। দরাজ দিলে হাসছে, গাইছে, পিঠ চাপড়াচ্ছে এর-ওর।
নড়েচড়ে বসলাম আমি। অক্টোবরের বিকেলে ফুরফুরে বাতাস বইছে, রোদে কাঁচা সোনার রং, আমার ব্রেস-পরা পা–টাও ব্যথা করছে না আজ। একটা লম্বা ডিসকাশনে ঢুকে পড়ার উপযুক্ত দিন, তা–ই না?
‘আমার কী মনে হয় জানিস, মুঠোফোন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে যে মাতামাতি দশ-পনেরো বছর ধরে দেখছি, সেটা বেশি দিন থাকবে না। এগুলোর অপব্যবহার বা অতিব্যবহার কিছু মানুষ করতেই থাকবে, কিন্তু সেটা মোট জনসংখ্যার ভগ্নাংশমাত্র। আমাদের জেনারেশন বুড়ো হয়ে পরের জেনারেশন আসতে আসতেই মোটামুটি একটা ভারসাম্য চলে আসবে।’ আমি গলার সুরে বুঝিয়ে দিলাম, এই ব্যাপারে লম্বা একটা আলাপ শুরু করতে পারলে আমি নাখোশ হবো না।
যা ভেবেছিলাম তা–ই। আমার মতামত নাকচ করে দিয়ে এপাশে-ওপাশে মাথা দোলাল সাকিব। ‘আমার তা মনে হয় না রে। আমি তো দেখছি, আমাদের জীবনটা আরও বেশি করে ডিজিটাল জগতে ঢুকে পড়ছে। করোনা মহামারির লকডাউনের পর সারা দুনিয়ার মানুষ আরও বেশি অসামাজিক হয়ে পড়েছে যেন। অথচ, আগে কিন্তু মানুষ এত খবর পেত না অন্যের জীবন নিয়ে। কে কী খাচ্ছে, কে কোথায় ঘুরছে, কে কী পাস করল—এসব খবর আমরা নিউজফিড স্ক্রল করলেই পেয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তবু যেন কিসের দূরত্ব প্রত্যেক মানুষের মধ্যে। আগের মতো আর আত্মীয় বা বন্ধুদের বাসায় যাওয়া নেই, বিকেলে আড্ডা দেওয়া নেই, খেলার মাঠে ছেলেপেলেদের দৌড়াদৌড়ি নেই...’
আমি মুখ খুলতে শুরু করেছিলাম সাকিবের কয়েকটা যুক্তি খণ্ডাব বলে, কিন্তু তার আগেই ওর একটা কথা আমার মনোযোগ ঘুরিয়ে দিল। ও বলল, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয়, মায়াভরা একটা পাড়ায় যদি থাকতাম, বইতে যেমন পড়ি তেমন, তাহলে বোধ হয় ভাল্লাগত খুব। ঘরের কোনায় বসে বই বা ফোনে মুখ না গুঁজে আরও বেশি ঘুরতাম বাইরে...’ বলতে বলতেই আমার চোখে চোখ পড়ায় অপ্রস্তুত হয়ে কথা থামিয়ে দিল সাকিব।
নিজের আগ্রহ লুকানোর কোনো চেষ্টা করলাম না আমি। ‘কেমন পাড়ার কথা বলছিস রে? বই তো আমিও কম পড়ি না। বল, মিলিয়ে দেখি একটু।’
সাকিবের অপ্রস্তুত ভাবটা কাটেনি। ‘আরে, তেমন কিছু না, এমনিই অলস চিন্তাভাবনা আরকি!’ বলে কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল প্রসঙ্গটা।
আমি নাছোড়বান্দা। বললাম, ‘আমিও কিন্তু ভাবি, আমাদের পাড়াটায় যদি লোকজনের হাঙ্গামা আরও কম হতো, পুরোনো দালানকোঠা আরও বেশি থাকত, আরও ভাল্লাগত।’
এবারে ফাঁদে পা দিল সাকিব। উৎসাহে চকচকে চোখে বলল, ‘আসলেই। লাল ইটের দালান, ছাদে বট–পাকুড়ের চারা থাকলেও থাকতে পারে, টানা বারান্দা, বাসার সামনে ছোট্ট একটু বাগান...পুরো পাড়ার চেহারাই বদলে যেত।’
‘গাছপালা আরও বেশি চাই। বিশেষ করে, একটা লম্বা টানা রাস্তা যদি থাকত; পাকা না হোক, কাঁকরবিছানো বা হেরিংবোন রাস্তা হলেও চলবে। যেটার দুইপাশে বিশাল বিশাল পুরোনো ডালপালা ছড়ানো গাছের সারি। গর্জন, তেলসুর, কৃষ্ণচূড়া, কদম, জারুল। ছায়া ছায়া অন্ধকার একটা পথে আনমনে হেঁটে যাব, কাঁধের ওপর টুপ করে ঝরে পড়বে একটা ফুলের পাপড়ি। বা শুকনা পাতা হলেও আপত্তি নেই। শীতের সকালের কুয়াশায়ও জায়গাটা অপূর্ব লাগবে, গ্রীষ্মের দুপুরেও, শরতের শেষবেলায়ও।’ আমি গড়গড় করে বলে চললাম। কে জানে, মনের কোথায় জমে ছিল ইচ্ছেটা! ফেসবুকে কাব্যিক স্ট্যাটাস লিখতে বসলে এগুলো কোথায় যায়?
সাকিব নড়েচড়ে বসেছে, আলোচনায় ঢুকে গেছে ও পুরোপুরি। ‘আরেকটা জিনিস দরকার পাড়ায়, সেটা হচ্ছে একটা পার্ক। ছোট, বড় না বেশি। সব বয়সের মানুষ আসতে পারবে সকাল–বিকেল, সময় কাটাতে পারবে। বাচ্চাকাচ্চারা দোলনায় দুলবে, আমাদের মতো টিনএজাররা শর্টপিচ ক্রিকেট খেলবে বা আড্ডা দেবে। বয়স্ক লোকেরা মর্নিং বা ইভিনিং ওয়াকে বের হবেন খোশমেজাজে। গলায় বেল্ট পরা পোষা কুকুরটা জিব বের করে দৌড়ে যাবে ছুড়ে দেওয়া টেনিস বল আনার জন্য।’
‘বা পাড়ার বাজারের এককোণে যদি একটা পুরোনো বইয়ের দোকান থাকত। ভেবে দেখ, সামনে থেকে দেখতে পিচ্চি একটা দোকান, সামনে বসা গম্ভীর বুড়ো দোকানি, কথা কম বলেন, কিন্তু বইয়ের নাম বললে খুঁজে দিতে কসুর করবেন না। ফিজিকস বইয়ের এক বছরের পুরোনো সংস্করণ থেকে শুরু করে পঁচাশি সালে প্রকাশিত ফেলুদার হত্যাপুরী, সবই পাওয়া যাবে। দোকানের পেছনে গিয়ে ইচ্ছেমতো বইও ঘাঁটতে পারবি। হুট করে খুঁজে পাবি দুর্লভ সব রত্ন। তিন গোয়েন্দার যে ভলিউম হন্যে হয়ে চাইছিলি, কাকাবাবুর যে বইয়ের কখনো নামই শুনিসনি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে বই তোর পড়ার রুচি ওপরে তুলে দেবে আরেক ধাপ বা আলমগীর তৈমুরের গা–ছমছমে গল্পের সংকলন বা মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিনের রোমাঞ্চ উপন্যাস। কখন সময় কেটে যাবে, টেরই পাবি না। বাইরে বেরিয়ে দেখবি, আকাশ কালো করে ঘনিয়েছে আষাঢ়ের বৃষ্টি। টিপটিপ বৃষ্টির ভেতর দৌড়ে ফিরবি ঘরে, বিছানায় আধশোয়া হয়ে গায়ে কাঁথা চাপিয়ে পড়তে শুরু করবি বইটা...’ আমি বলে গেলাম প্রায় একদমে।
‘বা চিন্তা কর, একটা ছায়া ছায়া পুকুর, বাঁধানো ঘাটসমেত। গাছপালায় বোঝাই পাড়, ডালপালা ঝুঁকে আছে পানির দিকে। একটা ঝিঁঝি ডাকছে কোথাও, পানির ওপর ভাসছে পাতলা কুয়াশার জাল, তুই বসে আছিস পাড়ে, গুনগুন করছিস একটা গানের কলি।’ সাকিব যোগ করল আমাদের কাল্পনিক পাড়ার সৌন্দর্যে।
‘এই, এ রকম একটা জায়গা আমি চিনি তো।’ কানের কাছে একটা নতুন কণ্ঠ শুনে চমকে তাকালাম। হাদী—আমার বৈকালিক আড্ডার আরেক সঙ্গী। কখন যে এসে বসেছে প্রাচীরের ওপর আমার পাশে, সাকিবের সঙ্গে আলোচনায় মগ্ন থাকায় খেয়ালই করিনি। ও একা নয়, সঙ্গে অভিজিৎও আছে। ও বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, চিনি আমি। ওই তো, পুবদিকের মেসবাড়িগুলো পেরোলেই।’
সাকিব একটা ‘ঠিক বলেছিস তোরা দুজনই’ গোছের দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বলে চলল, ‘কল্পনার পাড়া সাজাচ্ছি যখন, সাজাতে থাকি আরও। একটা নদী এঁকেবেঁকে চলে যাক না আমাদের পাড়ার মাঝখান দিয়ে! মেঘনা বা নীল বা দানিউবের মতো কোনো দানবীয় ব্যাপার নয়। ছোট নদী, ঢালু পাড়, কাশবন; অনেকটা রবি ঠাকুরের কবিতার নদীটার মতোই, আবার তেমনটাও নয়। এই নদীর ওপর ছোটখাটো একটা পুল থাকবে। ঠিক গোড়ায় বসানো একটা বিরাট কড়ইগাছের ছায়া পাবে ওটা, আর রিকশা বা ভ্যানের চেয়ে বড় কোনো যানবাহন চলবে না বলে পুলের ওপর বসে আড্ডাও দেওয়া যাবে যত খুশি। ফুরফুরে হাওয়ার বিকেল বা চাঁদনি রাতে স্বর্গ হয়ে উঠবে জায়গাটা। স্মার্টফোন যদি কেউ নিয়ে আসেও, ওটার দিকে তাকানোর সময়ই পাবে না!’
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললাম আমি। কীর্তিমারী শহর ত্রিস্রাতা নদীর তীরে বটে, কিন্তু সেটা ঠিক শহরের পাশে নয়, বেশ অনেকটা দূরে। সেটা যে আমাদের পাড়ার মধ্য দিয়ে যায়নি, তা বলাই বাহুল্য। এখানে একটা ছোট শাখানদীও নেই।
‘আরেকটু বাড়িয়ে নিই কল্পনাটা,’ অভিজিৎ বলল হাসিমুখে। ‘আমাদের পাড়াটা ধর সমতলে নয়, সাত হাজার ফুট ওপরে। পাহাড়ের গায়ে থাকে থাকে সাজানো বাড়ি–ঘরগুলো। গরমের দিনেও গা জুড়ানো শীতলতা চারদিকে। রাস্তার পাশ দিয়ে শিস তুলে চলে যাচ্ছে বাষ্পচালিত রেলগাড়ি। যেদিকে তাকাই, সারি সারি নীলাভ পাহাড়। সবার ওপরে মাথা উঁচু করে আছে তুষারধবল কাঞ্চনজঙ্ঘা।’
‘অসাধারণ সুন্দর, কিন্তু আমি কীর্তিমারীতেই পাড়াটা চাই, দার্জিলিংয়ে না,’ মাথা নেড়ে বলল সাকিব। ‘কী করব? ভাগ্যে নেই!’
‘তাহলে কাছাকাছির মধ্যে সীমান্তের ওপারের জলপাইগুড়ির মতো হলে ভালো হতো না আমাদের পাড়াটা?’ আমি বললাম। ‘সমরেশ মজুমদারের অর্জুন সিরিজের বইগুলোয় পড়েছিস না! ছোট ছোট পাহাড় আর টিলার গায়ে চমৎকার চা–বাগান আর জঙ্গল। মানুষগুলোও আমাদের মতো করে কথা বলে, শহরটাও আমাদের কীর্তিমারীর মতোই; এদিকটায় তো আগে থেকেই মিলে আছে।’
‘ভালো কথা, কালকের আইপিএল দেখেছিস?’ হাদী বলল। ‘ঋদ্ধিমান সাহা দারুণ ফিফটি করেছেন। জলপাইগুড়ির কথায় মনে পড়ল। ওনার বাড়ি তো ওদিকেই।’
ক্রিকেটের দিকে ঘুরে গেল আমাদের আলাপ। সেখান থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগে। মেসি সৌদিতে যাবে না আমেরিকায়? আর হ্যাঁ, নেটফ্লিক্সের নতুন সিরিজটা কে কে দেখেছে?
কথায় কথা বাড়ে। এলোমেলো অলস আলাপে কীভাবে যে কেটে যায় ঘণ্টা দেড়েক, টেরই পাই না। মাগরিবের আজানের সুরেলা আওয়াজে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কীর্তিমারী শহরের কেরাণীপাড়ার বাস্তবে ফিরলাম আমরা।
সবার আগে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল সাকিব। ‘উফ, বিকেলগুলো কীভাবে যে কাটে, টেরই পাই না। যাই, ফিজিকসের দুটো অধ্যায়ের অঙ্ক করা বাকি আবার। কাল সকালে পড়া বুঝিয়ে দিতে হবে শাহজাহান স্যারকে।’
পাঁচিলের ওপর থেকে প্রথমে ভালো পা-টা, তারপর ধীরে ধীরে ব্রেসলাগানো পা–টা নামাতে নামাতে হুট করে মনে পড়ে গেল আমার, ‘আরে, সাকিব, তোর না আলিফের কাছে যাওয়ার কথা কেমিস্ট্রির নোট আনতে?’
সাকিব উত্তর দেওয়ার আগেই আগেই হাদী বলে উঠল, ‘তবে যা-ই বলিস না কেন, অমিত, তোরা আজ যেটা নিয়ে আলোচনা করছিলি, তেমন গল্পের মতো মনোরম আর ছবির মতো সুন্দর না হলেও আমাদের এই কেরাণীপাড়াটাও খুব একটা মন্দ নয়। অমন পাহাড়-নদী হয়তো নেই, ষাটের দশকের মতো আমেজভরা রাস্তাঘাট হয়তো নেই, কলেজ স্ট্রিটের চেয়ে সমৃদ্ধ বইয়ের দোকান হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু এই যে ফাঁকা মাঠটুকু, এই যে শিরীষগাছের তলে বসে আড্ডা দেওয়া, পাড়ার প্রাইমারি স্কুলের সবুজ ঘাসের ওপর অলস হেঁটে বেড়ানো—খারাপ কী?’
অভিজিৎ সায় দিল ওর কথায়। ‘আর মনের চোখ থাকলে নিজের পাড়ায় বসেই বিশ্ব দেখা যায়। বিভূতিভূষণ নিজের অজপাড়াগাঁয়ে স্বর্গের রূপ দেখেছিলেন, পথের পাঁচালির সৃষ্টি সেখান থেকেই।’
সাকিব তাকাল আমার দিকে, মুখে হাসি। ‘তবে ভালো একটা পয়েন্ট বলেছিস তুই আজকে অমিত। সবাই যেমনটা মনে করে, আমাদের জেনারেশনটা বোধ হয় তেমন ‘ফোনের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে থাকা’ হবে না। এই যে আমরা এতক্ষণ আড্ডা দিলাম মুখোমুখি, একটুও কি বোরিং লেগেছে? মোটেই না। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাজে সময় খরচ না করে আরও বেশি বেশি বাইরে বেড়াতে হবে রে! চোখে–মুখে খোলা হাওয়ার ঝাপটা লাগার আরাম ফেসবুকের বাজে তর্কাতর্কিতে নেই।’
‘একদম ঠিক বলেছিস। তবু, বুঝলি, মাঝেমধ্যেই জানতে ইচ্ছা করে, পৃথিবীর সেরা পাড়া কোনটা?’ ঠাট্টার সুরে বললাম আমি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পশ্চিম আকাশে লালচে আর পুবের আকাশে বেগুনি আভার ছড়াছড়ি। অলস পায়ে হাঁটছি আমরা জেনারেশন জি’র দল। বড় রাস্তায় উঠে এলাম এবার, বাড়ির পথ ধরেছি চারজনই।
সদ্য আলো জ্বলে ওঠা ল্যাম্পপোস্টটার নিচ দিয়ে আসছে তিনটি ছেলে, আমাদেরই সমবয়সী। একজনের হাতে একটা ফুটবল, লোফালুফি করছে সেটা নিয়েই। ওদের খুব ভালোমতোই চিনি আমরা। ফুটবল হাতে ছেলেটা নীল, চুইংগাম খেতে থাকা ছেলেটা ফারহান আর আমাদের দেখে চকচকে চোখে ‘আরে! তোদের সঙ্গে দেখা হয়েই গেল!’ বলে ওঠা ছেলেটা তৌকির।
‘কে জিতলি?’ অভিজিতের প্রশ্ন। আমি বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম, এখন ধাঁ করে মনে পড়ল। আমাদের পাড়ার সঙ্গে পাশের জুম্মাপাড়ার ফুটবল ম্যাচ ছিল আজ। আমার সব বন্ধুই কমবেশি ফুটবল খেলে, আর এই তিনজন তো পাড়া-স্কুল-কলেজের ফুটবল টিমের নিয়মিত মুখ। জন্ম থেকেই পায়ে সমস্যা আমার, ফুটবল খেলতে পারি না বটে, তবে মাঠে গিয়ে সমর্থন দিতে কসুর করি না। কিন্তু জুম্মাপাড়ার মাঠের পাশে বসার কোনো ব্যবস্থা নেই, এর আগে একদিন গিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
খেলার কথা আমি বেমালুম ভুলে গেলেও অভিজিৎ, হাদী ভোলেনি যে আজ আমাদের ম্যাচ আছে, আর আমি তাতে যেতে পারব না। ওরা চায়নি, আমি বিকেলটা একা একা কাটাই।
আমাদের দলই জিতেছে। হাসছে সবাই। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি যেন চোখে পানি না আসে; চোখ যেন ভিজে না যায়। বন্ধুদের সামনে চোখ ভিজতে দেব না কিছুতেই!
গলার কাছে দলার মতো কী যেন আটকে আছে। তবু হেসে বললাম কোনোমতে, ‘সাকিব, তোর না কাল ফিজিকস পরীক্ষা? আর তুই আজ যাচ্ছিলি আলিফের কাছে কেমিস্ট্রির নোট আনতে?’
সাকিব চোখ মটকে বলল, ‘কেন, আমার কি আর অন্য সাবজেক্ট পড়ার দরকার নেই নাকি? হে!’ তারপরই হেসে উঠল ওর অজুহাতটা ধরা পড়ে গেছে বলে।
বাড়ির পথে ফিরছি আমরা। আমার মুখে হাসি। একটু আগেই প্রশ্ন করছিলাম, পৃথিবীর সেরা পাড়া কোনটা।
এখন, এই মায়াময় সন্ধ্যায় উত্তরটা বোধ হয় নিজেই দিতে পারব আমি—আমার নিজের পাড়া।