ম্যাজিশিয়ান গুড্ডুবুড়া
গুড্ডুবুড়া ছেলেটা ভীষণ বোকা। বয়স ৮ নাকি ১০ বোঝা যায় না। কারণ, সে বাড়ে না। মানে বড় হয় না। হবে কী করে? সে তো কিছুই খেতে চায় না। না খেয়ে খেয়ে তার হাত–পা গেছে শুকিয়ে। তাকে দেখতে মনে হয় দেশলাইয়ের কাঠি।
শুধু যে শরীরটা শুকিয়ে গেছে তা নয়, মনে হয় তার ব্রেনও শুকিয়ে গেছে। সে জন্য সে একটার পর একটা বোকামি করতে থাকে।
স্কুলে একজন ম্যাজিশিয়ান এসেছিলেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের জাদু দেখালেন।
গুড্ডুবুড়া ভাবল, আমিও জাদু দেখাব।
কারণ, জাদুকর তাদের জাদুর মন্ত্রটা শিখিয়ে দিয়েছেন। ছু মন্তর ছু। হিং টিং ছট। এটা বললেই হয়ে যাবে।
তাদের পাশের বাসায় জন্মদিনের একটা দাওয়াতে গেল গুড্ডুবুড়া। সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বেশ কজন এসেছে। গুড্ডু বলল, ‘আমি তোমাদের ম্যাজিক দেখাব।’
সবাই হাততালি দিয়ে উঠল, ‘ম্যাজিক দেখাবে, আচ্ছা দেখাও।’
গুড্ডুবুড়া একটা বাক্সের মধ্যে রাখল কতগুলো কাগজ। তারপর সেটাকে ঢেকে দিল একটা কাপড় দিয়ে। তারপর বলল, ‘এবার আমি মন্ত্র পড়ব। আর কাগজগুলো চকলেট হয়ে যাবে।’
সে মন্ত্র পড়তে লাগল, ‘ছু মন্তর ছু। হিং টিং ছট।’
তারপর সে কাপড় সরাল। দেখা গেল, বাক্সের কাগজ কাগজই রয়ে গেছে। চকলেটে পরিণত হয়নি।
মন্ত্রটা কি ভুল বললাম? সে বলল, মনে হয় ভুল মন্ত্র পড়েছি। আরেকবার চেষ্টা করি।
গুড্ডুবুড়া আবার চেষ্টা করল। কিন্তু কাগজ কাগজই রয়ে গেল।
তখন ওই জন্মদিনের দাওয়াতে আসা বাচ্চারা খিলখিল করে হেসে উঠল।
এবার গুড্ডুবুড়া বলল, ‘আমি আরেকটা জাদু দেখাব। এটা হবেই। কারণ, এটার মন্ত্রটা আমি লিখে রেখেছি।’
অ্যাবরাকাড্যাবরা...সে কাগজ দেখে নিল।
‘এবার আমি একটা পয়সা মুখে ঢোকাব। তারপর বলব, অ্যাবরাকাড্যাবরা। অমনি পয়সাটা আমার ঘাড়ের পেছন দিক থেকে বের হবে। আমি টেনে বের করব।’
বলে সে একটা পয়সা মুখে দিল। আর মুখে বলতে লাগল: অ্যাবরাকাড্যাবরা...
বলতে গিয়ে পয়সা আটকে গেল তার গলায়। সে বুঝি এখনই শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে।
দাওয়াত ছিল পাভেলদের বাসায়। পাভেলের মা–বাবা চিৎকার করে উঠলেন। তাঁরা তাড়াতাড়ি ডেকে আনলেন গুড্ডুবুড়ার মা–বাবাকে। ৯৯৯ নম্বরে কল করা হলো। অ্যাম্বুলেন্স ছুটে এল। গুড্ডুবুড়াকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগ তাকে সঙ্গে সঙ্গে অপারেশনের টেবিলে তুলল। তার মুখ হাঁ করাল যন্ত্র দিয়ে। আর যন্ত্র দিয়ে গলা থেকে পয়সা বের করতে চিকিৎসকদের বেশ কষ্টই করতে হলো।
মরতে মরতে বেঁচে গেল গুড্ডুবুড়া। তার মা–বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
দুদিন পর আরেক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো গুড্ডুবুড়াকে। গুড্ডুর বাবা বললেন, ‘স্যার, আমার ছেলেটা এত বোকা কেন?’
চিকিৎসক গুড্ডুবুড়ার চোখ দেখলেন। জিব দেখলেন। পেটে, বুকে স্টেথোস্কোপ চেপে ধরে নিজের কানে শব্দ শুনলেন। নাড়ি পরীক্ষা করলেন। রক্তচাপ মাপলেন।
সব দেখেশুনে শেষে চিকিৎসক বললেন, ‘ভয় নেই। গুড্ডুবুড়ার কোনো অসুখ নেই। তবে ওর সমস্যাটা মনে হয় আমি ধরতে পেরেছি। ও কি ঠিকমতো খায়?’
মা বললেন, ‘না স্যার। ও কিছুই খেতে চায় না।’
চিকিৎসক বললেন, ‘গুড্ডু, তোমাকে ঠিকমতো খেতে হবে। তোমাকে ভাত খেতে হবে, রুটি খেতে হবে, ডিম খেতে হবে, দুধ খেতে হবে, শাক খেতে হবে, সবজি খেতে হবে, মাছ খেতে হবে, মাংস খেতে হবে, ফল খেতে হবে, মূল খেতে হবে।’
গুড্ডুর মা বললেন, ‘স্যার, মূল জিনিসটা কী?’
চিকিৎসক বললেন, ‘মূল হলো শিকড়। যেমন ধরুন, গাজর। এটা কিন্তু আসলে শিকড়। তেমনি মুলা। মাটির নিচে হয়, এটা ফল নয়, এটা মূল।’
গুড্ডু বলল, ‘যেমন আলু।’
চিকিৎসক বললেন, ‘না গুড্ডু। আলু মূল নয়। আলু হলো কাণ্ড। এটা তুমি বুঝতে পারবে, যখন তুমি ঠিকভাবে খাবে। আর হ্যাঁ, শুধু যে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে তা–ই নয়, প্রচুর খেলাধুলা করতে হবে। পানিও ঠিকমতো খেতে হবে।
‘আর রেস্টুরেন্টের জিনিস কম খাবে। আর প্যাকেটের খাবার কম খাবে। কারণ, ওগুলো সাধারণত স্বাস্থ্যকর হয় না। তবে মাঝেমধ্যে একবার–দুবার খেলে ক্ষতি নেই।’
গুড্ডুবুড়া জাদু দেখাতে গিয়ে মরতে বসেছিল। সেই দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়তেই সে চিকিৎসকের উপদেশ পালন করতে লাগল। ঠিকমতো খেতে শুরু করল।
গুড্ডুবুড়া এখন রোজ ঠিকমতো ভাত খায়। রুটি খায়।
মাছ খায়, মাংস খায়।
দুধ খায়, ডিম খায়।
ফল খায়, সালাদ খায়।
শাক আর সবজি খায়।
পানি খায়।
আর অনেক খেলাধুলা করে। বিকেল হলেই সে বাসার নিচে চলে যায়। সেখানে একটা খোলা জায়গা আছে। শিশুরা খেলাধুলা করে। গুড্ডুবুড়াও তাদের সঙ্গে খেলে। ছোটাছুটি করে।
কিছুদিনের মধ্যেই গুড্ডুবুড়ার স্বাস্থ্য হয়ে গেল ভালো। আর তার মাথার বুদ্ধি গেল খুলে। এখন সে আর বোকা গুড্ডুবুড়া নয়। এখন সে চালাক গুড্ডুবুড়া।
গুড্ডুবুড়া এবার ঠিক করল, জাদুকরদের জাদুর গোপন রহস্য বের করে ফেলবে। তারপর সেটা শিখে দেখাবে বন্ধুদের।
গুড্ডুবুড়া ইউটিউবে সার্চ দিয়ে অনেক জাদুর গোপন রহস্যই বের করে ফেলল। বাসায় নিজে নিজে চর্চা করে সে জাদু রপ্ত করে ফেলল।
তারপর মা–বাবাকে ডেকে সে দেখাতে লাগল তার জাদু।
‘প্রথমে আমি দেখাব পয়সার জাদু। এই পয়সা আমি মুখে ঢোকাব, আর বের করব মাথার পেছন দিক থেকে।’ মা–বাবা চিৎকার করে উঠলেন, ‘না না। পয়সা মুখে দেবে না। খাবার ছাড়া কোনো কিছুই মুখে দেবে না। পয়সা গলায় আটকে বহু শিশু মারা যায়।’
গুড্ডুবুড়া বলল, ‘আগে দেখো। তারপর ভয় পাও।’
মা–বাবা ভয়ে এতটুকুন হয়ে গেলেন।
গুড্ডুবুড়া বলল, ‘আমি তো আর বোকা গুড্ডু নই, আমি তো চালাক গুড্ডু।’
তখন মা–বাবা দুজনই খানিকটা ভরসা পেলেন। তাঁদের ছেলে এখন ঠিকঠাক খায়দায়। এবার সে নিশ্চয়ই আগের মতো বোকামি করে বসবে না।
গুড্ডুবুড়া হাতের মধ্যে পয়সা মুঠো করে ধরে মুখে নিল বলেই মনে হলো। গালে জিব এনে গাল ফুলিয়ে এমন ভাব করতে লাগল যেন পয়সাটা তার মুখে।
এরপর সে দেখাল, তার দুই হাত ফাঁকা।
তারপর সে হাতটা মাথার পেছনে নিয়ে টান দিতেই ঝপ করে শব্দ হলো। আর পয়সাটা গিয়ে পড়ল মেঝেতে।
বাবা বললেন, ‘গুড্ডু, কী করে করলি?’
মা বললেন, ‘তাজ্জব ব্যাপার তো!’
গুড্ডু বলল, ‘যদি কাউকে না বলো, তাহলে আমি তোমাদের শিখিয়ে দিতে পারি। প্রথম কথা হলো, ম্যাজিক হলো কৌশল। কোনোটাই মন্ত্রের ব্যাপার নয়। তোমাকে কৌশলে মানুষকে বোকা বানাতে হবে।
‘এই জাদুটা কীভাবে করেছি, বলব? আমি পয়সা মুখে পুরিনি। পয়সাটা আমি দেখো, এইভাবে আমার ডান হাতের কনুইয়ের উল্টো ভাঁজের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। তখন আমার হাত ফাঁকা। সেটা তোমাদের দেখালাম। বললাম, দেখো, আমার হাতে পয়সা নেই। পয়সা আমার মুখে। জিব গালে এনে ফোলা গাল দেখালাম। তারপর হাতটা মাথার পেছনে নিয়ে এক ঝটকায় কনুইয়ের উল্টো দিকের ভাঁজে রাখা পয়সাটা ঝেড়ে ফেলে দিলাম পেছনে। শব্দ হলো। লোকে কিন্তু বুঝবে না যে পয়সা মাথার পেছন থেকে বের হয়নি, আসলে হয়েছে আমার কনুইয়ের ভাঁজ থেকে। তারা ভাববে, ঘাড়ের পেছন থেকে পয়সা পড়ল।
‘এবার আমি দেখাব, একটা বাক্সে রাখলাম কাগজের অনেক টুকরা। সেটাকে কাপড় দিয়ে ঢাকলাম। দেখো দেখো। বলো, ছু মন্তর ছু।
‘এক দুই তিন।
‘কাপড় সরালাম। কিন্তু কোথায় বাক্সে কাগজ। তার বদলে কতগুলো চকলেট।’
মা–বাবা দুজনই হাততালি দিয়ে উঠলেন!
মা বললেন, ‘কী করে পারলি গুড্ডু? তাহলে কি আমাদের আর বাজার করতে হবে না? কাগজ থেকেই আলু, পটল, মাছ, মাংস, চকলেট, ডিম তুই বানিয়ে দিতে পারবি?’
‘না মা। এটাও আসলে ট্রিক। কৌশল।
‘এই যে বাক্সটা দেখছ, এটার ভেতর চকলেটগুলো আগে থেকেই রেখে দিয়েছিলাম। তার ওপরে আরেকটা ছোট্ট বাক্স এইভাবে বসানো ছিল।’
কাগজভরা একটা ছোট বাক্স চকলেটের বাক্সের ওপরে রাখল গুড্ডু, ‘দেখো, এই কাগজের বাক্স মাত্র এক ইঞ্চি গভীর, কিন্তু কাগজ দিয়ে ঢাকা থাকায় মনে হচ্ছে পুরা বাক্সটাই কাগজ দিয়ে ভরা। আমি এখন এটা কাপড় দিয়ে ঢাকলাম। কাপড়টা তোলার সময় ওপরের কাগজের বাক্সটাসহ সরালাম। কাপড়ের মধ্যে কিন্তু কাগজের বাক্সটা রয়ে গেছে। আর সেটা সরানোর সঙ্গে সঙ্গে চকলটভর্তি বাক্সটাই সামনে এল। সবাই ভাবল, কী আশ্চর্য, কাগজগুলো চকলেট হয়ে গেল।’
মা–বাবা বললেন, ‘হ্যাঁ। এইবার তুমি এই ম্যাজিক বন্ধুদের দেখাতে পারো।’
এবার গুড্ডুবুড়াই দাওয়াত দিল পাশের বাসাগুলোর বন্ধুদের।
তাদের বলল, ‘শোনো, তোমাদের আমি ম্যাজিক দেখাব।’
বন্ধুরা বলল, ‘আবার! না, তুমি পয়সা খাবে আর মারা যাবে। তা হবে না।’
গুড্ডুবুড়া বলল, ‘আমি তো এখন চালাক গুড্ডুবুড়া। এখন তো খাই। খেলাধুলা করি। এখন আমার স্বাস্থ্য ভালো। মনে হয়, ব্রেনও কিছুটা ভালো হয়েছে।’
গুড্ডুবুড়া সবাইকে দুটো ম্যাজিক দেখাল। মুখ দিয়ে পয়সা ঢুকিয়ে মাথার পেছন দিক দিয়ে বের করা। আর এক বাক্স কাগজকে চকলেট বানানো।
সবাই অবাক হলো। হাততালি দিতে লাগল।
গুড্ডুবুড়া চকলেটগুলো বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করে দিল। তারা খেয়ে দেখল, সত্যিকারের চকলেট।
তারা সবাই বলল, ‘গুড্ডু, এই ম্যাজিকটা শিখিয়ে দে না।’ গুড্ডু বলল, ‘না। এটা শেখানো যাবে না। চকলেট বেশি খাওয়া উচিত নয়। চিনি আর লবণ কম খেতে হয়। তাই এটা আমি তোমাদের শেখাতে পারব না।’
আবারও চিকিৎসকের কাছে গুড্ডুবুড়াকে নিয়ে গেলেন মা–বাবা। কোনো অসুখ-বিসুখ সমস্যার জন্য নয়। ছেলে কত চালাক আর স্বাস্থ্যবান হয়েছে, তা দেখানোর জন্য।
গুড্ডু চিকিৎসককে বলল, ‘স্যার, এবার আমি বলতে পারব, আলু কেন মূল নয়।’
‘পারবেই তো! আচ্ছা বলো, আদা কী?’
‘আদা, আদা হলো কাণ্ড। এটা তো সোজা। কারণ, আদায় পর্ব বা গিঁট থাকে।’
চিকিৎসক হাসতে লাগলেন, ‘তুমি তো সত্যি সত্যি অনেক স্মার্ট হয়ে গেছ গুড্ডু।’
গুড্ডুদের ফ্ল্যাটবাড়িতে একটা বড় সমস্যা হয়েছে। একটা বিড়াল কীভাবে যেন ছয়তলা বাড়ির ষষ্ঠ তলার একটা সানশেডে চলে গেছে। আর নামতে পারছে না। মিউ মিউ করে কাঁদছে। সেই বিড়াল দেখতে রাস্তায় ভিড় হয়ে গেছে। প্রাণী অধিকার সমিতি ফেসবুকে লাইভ প্রচার করছে।
এখন ফায়ার সার্ভিস ডাকা হবে। তারা মই এনে পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে বিড়ালটাকে নামাবে।
গুড্ডু ছিল স্কুলে। ফেরার সময় বাড়ির সামনে ভিড় দেখে সে জিগ্যেস করল, ‘ব্যাপার কী?’ সবাই বলল, ‘বিড়ালটাকে উদ্ধার করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ডাকতে হবে।’
গুড্ডু বলল, ‘একটা লাঠির মাথায় শক্ত করে একটা ঝুড়ি বেঁধে তাতে একটা মাছের টুকরা রেখে ছাদ থেকে নামিয়ে দিলেই তো হয়। দেখো, বিড়াল ঝুড়িতে উঠে আসে কি না।’
তাই তো! এত সহজ সমাধান কারও মাথায় এল না। দারোয়ান ভাইয়েরা বড় লাঠি জোগাড় করে ফেলল। তার মাথায় একটা ফলের দোকানের ঝুড়ি বাঁধা হলো। ঝুড়িতে রাখা হলো রান্না করা মাছের দুটো টুকরা। তারপর সেটাকে বিড়ালের সানশেড বরাবর নামানো হলো ছাদ থেকে। নিচের দর্শকেরা বাঁয়ে–ডানে করে নির্দেশনা দিতে লাগল।
ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেল ঝুড়ি। বিড়ালটা খানিকক্ষণ দেখল। ঝুড়িটা নড়ছে না দেখে সে আস্তে করে উঠে পড়ল ঝুড়িতে। ঝুড়ি টেনে তোলা হলো ছাদে।
প্রাণী সমিতি শাবাশ শাবাশ বলে উঠল।
একজন বললেন, ‘এই বুদ্ধিটা তো আমারও ছিল। গুড্ডুবুড়া বলেছে, আমি বলিনি, এতটুকুনই পার্থক্য।’