রাফি আর কথা বাড়ায় না, সরে আসে। তার কেন যেন মনে হয়, এখানে তার আপুও ভালো নেই। একদিন দেখল, আপুর ঠোঁটের একপাশে কালো দাগ। খুব ছোট্ট একটা আঘাতের চিহ্ন; কিন্তু বেশ বোঝা যায়।
‘ঠোঁটে কী হয়েছে আপু?’
‘চুপ চুপ।’ আপু মুখে আঙুল দেয়। তাকে নিয়ে বাসার ছাদে চলে যায়। তারপর আঁচলের গিঁট খুলে একটা সাদা কাগজে ভাঁজ করা ছোট্ট চিরকুট বের করে। বলে, ‘পড়ে দেখ তো।’
চিরকুটটায় লেখা, ‘আমি চলে যাচ্ছি রাফিকে নিয়ে। তোমার সঙ্গে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি একটা বাজে লোক। আশা করি, আমাকে আর খুঁজবে না। সময় সুযোগমতো আমি ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়ে দেব।—সুলতানা।’
রাফির বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। তাকিয়ে দেখে, হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে আপু। এই বাসায় এই প্রথম আপুকে হাসিমুখে দেখল রাফি। আপু ফিসফিস করে বলল—
‘কাল সকালে আমরা এ বাসা থেকে চলে যাব। ওদের না জানিয়ে। জানালে যেতে দেবে না।’
‘কোথায় যাব? মামাদের বাসায়?’
‘না। প্রথমে এখান থেকে দূরে কোথাও কোনো একটা হোটেলে উঠব কিংবা আমার এক বান্ধবীর বাসায়ও উঠতে পারি। ওর বাসার ঠিকানা আমার কাছে আছে। তারপর নাহয় ভেবেচিন্তে একটা কিছু ঠিক করব। কিন্তু এই বাসায় আর একমুহূর্তও নয়।’ আপুর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। বেশ টের পায় রাফি।
‘টাকা লাগবে না?’
‘লাগবে।’
‘টাকা পাব কোথায়?’
‘কিছু জমানো টাকা আমার সঙ্গে আছে। ওটা নিয়ে ভাবিস না।’
রাফির বুকটা আবার ধড়ফড় করতে শুরু করল। এখন কী হবে...!!
পলির বয়স কত আর হবে, তেরো বা চৌদ্দ। ব্যারিস্টার আফসান চৌধুরীর বাসায় কাজ করে সে, আফসান চৌধুরীর স্ত্রী মাফরুহা খানম, মানে পলি যাকে ‘খালাম্মা’ বলে ডাকে, তিনি একটি স্কুলের শিক্ষক। এই বাসায় একজন বড় কাজের লোক অবশ্য আছেন, যার নাম হানিফা, হানিফা বুয়া। রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া এসব করেন। আর পলি বাসার টুকটাক ফাইফরমাশ খাটে। বড় স্যারের জন্য দোকান থেকে সিগারেট আনা, লন্ড্রি থেকে কাপড় আনা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, ঘর মোছা, বড় আপুর মশারি টানানো, ছোট ভাইয়ের বিছানা ঝাড়া...এই সব কাজ করতে হয় পলিকে। অন্যান্য রোজকার ফাইফরমাশ তো আছেই।
রাতে হানিফা বুয়া আর পলি রান্নাঘরে বিছানা পেতে ঘুমায়। তখন দুজনে নানা গল্প করে। অধিকাংশ গল্প হানিফা বুয়াই করেন। শুনতে ভালো লাগে পলির। ঘুম ঘুম চোখে শোনে পলি।
‘পলি ঘুমাইছস?’
‘না।’
‘আচ্ছা পলি, ক তো, তুই কি ঢাকা শহরে মরতে আইছস?’
‘ক্যান মরতে হবে?’
‘আরে, এই শহর হইল গরিবের লাইগা মরণফাঁদ। তুই এই শহরে একবার ঢুকছস তো মরছস।’
পলি হাসে। হাসার কারণ, হানিফা বুয়ার কথা বলার ভঙ্গিটা খুবই মজার। পলি ঘুম ঘুম চোখে কুট কুট করে হাসে। হানিফা বুয়া ধমকান।
‘ওই ছেমরি হাসছ ক্যান? যত হাসি, তত কান্না, বলে গেছে রাম সন্না।’
‘আচ্ছা খালা, রাম সন্না কে?’
‘সে ছিল এক বিরাট সাধু...’
হানিফা বুয়া তখন সেই কল্পিত সাধুর গল্প বলতে শুরু করেন। গল্প শুনতে শুনতে পলির নিজের প্রিয় ছোট্ট শহরটার কথা মনে পড়ে, যার পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট নদী বয়ে গেছে, যেখানে তার মা আছে, আর প্যারালাইসিসে আক্রান্ত অসুস্থ বাবা, আর আছে একটা ছোট্ট ভাই। তারা কেমন আছে? তারা কি পলির কথা ভাবে? অন্ধকারে পলির চোখ ভিজে ওঠে কোনো কারণ ছাড়াই।
সকালে ঘুম থেকে উঠে পলির একঘেয়ে জীবন শুরু হয়। বাথরুম ধোয়া, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা। নাশতার টেবিলে হাজির থাকা নানা কাজ। মেশিনের মতো কাজ করে যায় পলি। এই করতে করতে দুপুর। তারপর বিকেল। বিকেলের দিকে একটু বিশ্রাম হয়। সে আর হানিফা খালা বারান্দায় বসে চা খায়। চায়ের সঙ্গে তাদের জন্য একটা টোস্ট বিস্কিট বরাদ্দ। তাই বা মন্দ কী? সেদিন বিকেলে হানিফা খালা কী যেন বলছিলেন, হঠাৎ খালাম্মা ডাকলেন পলিকে।
‘পলি?’
‘জি খালাম্মা।’
‘যা তো, দোকান থেকে একটা মার্কস দুধের প্যাকেট নিয়ে আয়। বলবি দাম লিখে রাখতে।’
‘আচ্ছা।’
দোকানে গিয়ে দেখে, দোকানের বাইরে সেই ছেলেটা বসে আছে। ছেলেটা তার বয়সী; সম্ভবত আশপাশেই থাকে। মুখ চেনা। কেন যেন আশপাশের সবাই ছেলেটাকে সমীহ করে। কারণটা পলি ধরতে পারে না। পলিকে দেখে ছেলেটা একটা হাসির ভঙ্গি করল। যেন কত পরিচিত! অবশ্য এই ছেলে একবার একটা ছোট্ট ঝামেলা থেকে তাকে বাঁচিয়েছিল, বেশ মনে আছে।
মার্কস দুধ নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ফাইভ বি ফ্ল্যাটে উঠতে উঠতে কেমন একটা চেঁচামেচি শুনল পলি। এই ফ্ল্যাটবাড়িতে কাজের বুয়া, ড্রাইভার, হকার এদের লিফটে চড়া নিষেধ, পলিরও নিষেধ। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চেঁচামেচিটা যেন আরও বাড়ল। চিত্কার-চেঁচামেচিটা আসছিল ঠিক ওদের বাসা থেকেই। দ্রুত দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখে ভয়ংকর দৃশ্য! খালাম্মার হাতে একটা বেশ বড়সড় পর্দা টাঙানোর লাঠি। সেটা দিয়ে তিনি হানিফা খালাকে ঠাসঠাস করে মারছেন। হানিফা খালা ছোটখাটো মানুষ। বিশালদেহী খালাম্মার সঙ্গে পেরে উঠছেন না তিনি। মার খেতে খেতে শুয়ে পড়েছেন প্রায়। পলিকে দেখে হানিফা খালা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওরে পলি, আমারে বাঁচা...আমারে মাইরা ফালাইল রে...’ পলির মাথার ভেতর যেন বিস্ফোরণ হলো। সে চিলচিত্কার দিল একটা—
‘খালাম্মা, থামেন বলছি!’
শান্তশিষ্ট পলির মুখে এ রকম একটা চিত্কার শুনে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেন খালাম্মা। তারপর সামলে নিয়ে বললেন, ‘তবে রে...তোকে ফপর দালালি করতে বলেছে কে? তোকেও দু-ঘা দিতে হবে মনে হচ্ছে...’ বলে লাঠিটা নিয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসতে লাগলেন পলির দিকে। লাঠি তুলে একটা বাড়িও দিলেন...খপ করে দুহাতে ধরে ফেলল পলি লাঠিটা, তারপরই হেঁচকা টান দিল নিজের দিকে। আশ্চর্য কাণ্ড, খালাম্মা হুড়মুড় করে আছড়ে পড়লেন টেবিলে ওপর, চট করে সরে না গেলে পলির ওপরই পড়তেন; যাকে বলে একবারে মুখ থুবড়ে পড়া। নিজের শহরে পলি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। বিজ্ঞান তার প্রিয় বিষয় ছিল। সেখানে নিউটনের বিখ্যাত তিনটি সূত্রের ওপর একটা অধ্যায় ছিল। মনে হচ্ছে, খালাম্মার বিশাল শরীরটা নিউটনের গতিজড়তার কথাটা নতুন করে মনে করিয়ে দিল পলিকে। ঠিক তখনই ভার্সিটি থেকে ফিরলেন বড় আপু। ঘরের ভেতর ঢুকে ব্যাপার দেখে হকচকিয়ে গেলেন যেন। চেঁচিয়ে উঠলেন—
‘এসব কী হচ্ছে?’
পলি সঙ্গে সঙ্গে সব বলল, ‘খালাম্মা এই লাঠি দিয়ে বুয়াকে মারছিলেন। আমি আটকাতে গেছি...তখনই উনি পড়ে গেছেন।’ খালাম্মা হাঁসফাঁস করে তখন উঠে বসেছেনমাত্র। হিংস্র গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন—
‘এই মুহূর্তে এই দুটোকে বের করে দে। এই বদ দুটোকে আমি আর রাখব না এই বাসায়।’
‘হ, আমরাও এই জালেমের বাড়িতে থাকুম না। চল রে পলি, নাকি তুই থাকবি?’
‘না না!’
বড় আপু নিজেকে সামলে নিয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল মায়ের দিকে। মুখে বলল, ‘ছি, মা...আবার!’
পলি চট করে তার রেক্সিনের ছোট্ট ব্যাগটা নিয়ে আসে। এই ঘটনার পর সে-ও আর এই বাসায় থাকবে না, কখনোই না। বুয়ার পিছু পিছু বের হয়ে আসে সে। ‘আয় আইজকা লিফটে নামি।’
‘খালা, তোমার গায়ে কেন হাত দিল খালাম্মায়?’
‘বিরাট হিস্টরি। পরে শুনিস। তয় একটা কথা কই, এই বেডি খুব খারাপ, ডাইনি একটা। আগের কাজের লোকরেও মাইরা বিদায় করছে। তখন বিশ্বাস যাই নাই; এখন বুঝলাম।’
বলে পলির হাত ধরে জোর করে লিফটে ঢুকে পড়েন। পলি ভাবে, এখন নিশ্চয়ই দারোয়ান ধরবে, কেন লিফটে করে নেমেছে ওরা। দারোয়ান কী বুঝল, কে জানে। চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে, কিছু বলল না।
পলি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। রাত নয়টায় একটা বাস আছে তাদের শহরে যাওয়ার। বাসটা নাকি এখনই আসবে। হানিফা বুয়া অবশ্য বলেছিলেন, তার বাসায় রাতটা থেকে সকালে বাড়িতে যেতে। রাজি হয়নি পলি। হানিফা বুয়া অন্য বাসায় কাজ ঠিক করে দেবেন বলেছিলেন। পলি সেটাতেও রাজি হয়নি। সে এখন সোজা তার বাড়িতে যাবে। এই শহরে আর না। দরকার হলে তাদের ছোট্ট শহরটায় সে ভিক্ষে করবে, তারপরও এই ঢাকা শহরে আর না। অনেক হয়েছে। ভাগ্যিস কিছু জমানো টাকা ছিল। সেটা দিয়ে তার বাড়িতে যাওয়ার ভাড়া হয়ে যাবে। বাসের লোকজন অবশ্য বারবার জিজ্ঞেস করছিল, তার কাছে ভাড়া আছে কি না। সে বলেছে, আছে। এত রাতে একা একা যেতে একটু ভয় ভয় করছে। কিন্তু উপায় কী! তাকে যেতেই হবে। পলির চোখের সামনে ভেসে উঠল তাদের ছোট্ট ভাঙা বাড়িটার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সোমনাথ নদ। আহা কত দিন সোমনাথ নদের পারের সেই বটগাছটায় বসে বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করা হয় না। কে জানে, বটগাছটা আছে তো? নাকি নদীর স্রোতে ভেঙে পড়েছে।
চলবে...