পান্না-রহস্য (দ্বিতীয় পর্ব)

কাহিনি রচনা: কাজী শাহনূর হোসেন | তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর: শামসুদ্দীন নওয়াব

তিন

জাদুঘর থেকে কয়েক ব্লক দূরে চারকোনা, ধূসর এক বিল্ডিংয়ে থাকে হিরু চাচা।

সবুজ ইউনিফর্ম পরা লম্বা এক লোক দরজা খুলে দিল।

‘গুড ইভনিং, মি. পাশা,’ বলল লোকটা।

‘হ্যালো, পিটার। ভাতিজারা, এ হচ্ছে পিটার পোলক।’ কিশোরের কাঁধে হাত রাখল হিরু চাচা। ‘এ আমার ভাতিজা, কিশোর, আর এরা ওর বন্ধু মুসা আর রবিন। গ্রিনহিলস থেকে এসেছে।’

ছেলেদের দিকে চেয়ে হাসল পিটার।

‘নিউইয়র্কে স্বাগতম,’ বলল।

‘এদের ব্যাকপ্যাকগুলো একটু দেখে রাখবে? আমরা ডিনারে বাইরে যাব কিনা। কোথায় যাওয়া যায় তুমিই বলো না,’ বলল হিরু চাচা।

পেটে হাত বোলাল পিটার।

‘পান্ডা গার্ডেনে চাইনিজ খেতে নিয়ে গেলে কেমন হয়?’

‘দারুণ!’ বলে উঠল হিরু চাচা। ‘তোরা কী বলিস?’

‘আমাদের কোনো আপত্তি নেই,’ জানাল মুসা। হাসি দুই কানে গিয়ে ঠেকেছে।

ব্রডওয়েতে হেঁটে এল ওরা।

চওড়া সাইডওয়কগুলোতে গিজগিজ করছে মানুষ। দোকানের জানালায় জানালায় জ্বলে উঠছে বাতি। এক বাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে স্যাক্সোফোন বাজাচ্ছে এক লোক। স্যাক্সোফোন কেসটা পায়ের কাছে খোলা। লোকে খুশি হয়ে পয়সা দিচ্ছে সেখানে। হিরু চাচা এক ডলার দিল। ছেলেরা দিল কিছু খুচরো। হাসি ফুটল স্যাক্সোবাদকের মুখে।

‘এসে গেছি,’ একটু পরে বলল হিরু চাচা। লাল, চকচকে এক দরজা নিয়ে পান্ডা গার্ডেন দাঁড়িয়ে, দুপাশে নকল পান্ডা। হাস্যমুখ এক মেজবান ওদের রেস্টুরেন্টে স্বাগত জানাল।

দুই ঘণ্টা পর চেয়ার থেকে পিছে হেলান দিল মুসা।

‘পেটে আর জায়গা নেই,’ বলল ও।

আবারও বাক্সের ঢাকনা খুলল হিরু চাচা। প্রতিটি টুকরা বের করে ড. ক্রুকের হাতে দিল। তিনি সাবধানে সব কটির মোড়ক খুললেন। ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করে প্রতিটা আইটেম পরখ করলেন, তারপর মিলিয়ে নিলেন এক তালিকার সঙ্গে।

ওয়েট্রেস বিল এনে সবার সামনে একটা করে ফরচুন কুকি রাখল।

‘কুকির ভেতর ভাগ্য গণনার স্লিপ পাবি,’ বলল হিরু চাচা। ‘কেউ কেউ মনে করে, কুকি খেলে কপাল খুলে যাবে!’

‘আমি পরে খাব,’ বলল রবিন। ‘পেট একেবারে ঠাসা।’

‘হ্যাঁ, বাসায় নিয়ে গিয়ে খাওয়া যায়,’ বলল হিরু চাচা। বিল মিটিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

‘আচ্ছা, চিকেনে কালো আঠালো জিনিসটা কী ছিল?’ ব্রডওয়ে ধরে হাঁটার সময় বলল মুসা।

‘সামুদ্রিক আগাছা,’ জানাল রবিন।

‘অসম্ভব!’

আরও পড়ুন

‘রবিন ঠিকই বলেছে। সিউইড তো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো,’ জানাল হিরু চাচা।

‘মাছের স্বাস্থ্যের জন্য,’ বলল মুসা।

বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তাই দ্রুত হাঁটল ওরা। অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছালে পিটার ওদের ব্যাকপ্যাক বুঝিয়ে দিল।

‘ডিনার কেমন হলো?’ প্রশ্ন করল।

‘আমি কালো সিউইড খেয়েছি,’ আওড়াল মুসা।

দাঁত বের করে হাসল পিটার।

‘ভালো লেগেছে, তাই না?’

এগারো তলায় এলিভেটরে চড়ে উঠে এল হিরু চাচা আর তিন বন্ধু। এবার হল ধরে হেঁটে ধূসর এক দরজার কাছে চলে এল।

‘আয়,’ বলে ওদের পেছনে নিয়ে ভেতরে ঢুকল হিরু চাচা।

হিরু চাচার লিভিং রুম পুরোনো, আরামদায়ক চেহারার আসবাব দিয়ে ঠাসা। মেঝের কার্পেটটা পুরু আর নরম। উপচে পড়া বুককেসের মাঝখানের দেয়ালে পেইন্টিং ঝুলছে।

‘দারুণ জায়গা, হিরু চাচা,’ বলল রবিন।

‘ধন্যবাদ, রবিন। কিশোর, তুই গেস্ট রুমে থাকবি,’ বলল হিরু চাচা। ‘রবিন আর মুসা লিভিং রুমের ফোল্ড-আউট সোফাটা শেয়ার করতে পারো।’

সবার পরনে যখন পায়জামা, ডাইনিং রুমের টেবিলে জড়ো হলো ফরচুন কুকি খোলার জন্য।

‘সবচাইতে বয়স্কজন আগে পড়বে,’ বলে কুকি খুলল হিরু চাচা।

নিঃশব্দে ভাগ্য গণনা পড়ে জোরে হেসে উঠল।

‘আমারটা এর মধ্যেই ফলে গেছে। বলেছে, আজকে সুন্দর মনের মানুষদের সঙ্গে আমার দেখা হবে। হয়ে গেছে!’

‘এবার আমি!’ বলে কুকি ভাঙল মুসা। পাতলা কাগজটা বের করে আনল। জোরে জোরে পড়ল, ‘অচেনা খাবার পছন্দ হবে তোমার।’

মুখ বানাল মুসা।

‘এর মধ্যেই সিউইড খেয়েছি। আর কী বাকি আছে কে জানে!’

‘আমার পালা,’ বলল রবিন। কুকি খেয়ে ভেতরের কাগজটা দেখল ও। ‘ওরে বাবা, বলছে অপ্রত্যাশিত জায়গায় গুপ্তধন খুঁজে পাব আমি!’

‘এবার তুই, কিশোর,’ হিরু চাচা বলল। ‘তারপর সোজা বিছানা। কালকে ব্যস্ত দিন কাটবে আমাদের।’

কিশোর কুকিটা ভেঙে আপন মনে পড়ল।

‘বুঝলাম না,’ বলল।

‘জোরে পড়ো,’ বলল মুসা।

পড়ল কিশোর, ‘তোমার চোখ তোমাকে ধোঁকা দেবে।’

হিরু চাচা মুচকি হাসল।

‘তোর চোখ দেখে মনে হচ্ছে, ঘুম পেয়েছে। শুয়ে পড়!’

আরও পড়ুন

পরদিন নাশতা খেয়ে হিরু চাচা আর তিন বন্ধু হেঁটে গেল জাদুঘরে। এখনো বৃষ্টি পড়ছে, কাজেই দুটো ছাতার নিচে জড়াজড়ি করে চলেছে ওরা।

সিঁড়ির মাথায় ছোট ল্যান্ডিংটায় ভেজা ছাতা দুটো রাখল ওরা। ছাতার স্ট্যান্ডে আরেকটা ভেজা ছাতা দেখা গেল। হিরু চাচা দরজা খুললে ওরা অফিসে প্রবেশ করল।

দরজার ঠিক ভেতরেই এক লোক অভ্যর্থনা জানাল ওদের।

‘ওহ, জেমস, তুমি এসে গেছ?’ হিরু চাচা বলল। ‘ছেলেরা, ইনিই জেমস ব্রাউন, আমার সহকারী। জেমস, এ আমার ভাতিজা কিশোর, আর এরা ওর বন্ধু রবিন আর মুসা।’

ছেলেদের দিকে চেয়ে হাসল জেমস।

‘হিরন তোমাদের সাইটসিয়িংয়ে নিয়ে গেছে?’ জিজ্ঞেস করল।

‘এখনো নিইনি,’ বলল হিরু চাচা। ‘তবে কথা দিয়েছি, বৃষ্টি থামলে সেন্ট্রাল পার্কের মধ্য দিয়ে ওদের বাগি রাইড দেব।’

কাঠের বাক্সটায় টোকা দিল জেমস।

‘এটার ভার তোমার ওপরই থাকল, হিরন। আমি পেপারওয়ার্কে পিছিয়ে গেছি।’ নিজের অফিসে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

এ সময় বাইরের অফিসে টোকা পড়ল। হিরু চাচা দরজা খুলতেই ভেজা রেইনকোট পরা এক লোক উদয় হলেন।

‘আমি ড. ক্রুক,’ লোকটি বললেন। ‘মি. পাশার সাথে আমার দেখা করার কথা।’

‘আমিই পাশা!’ হিরু চাচা বলল। লোকটির হাত ঝাঁকিয়ে দিল। ‘ভেতরে এসে গা শুকোন। চা চলবে?’

‘না, ধন্যবাদ। হোটেলে ব্রেকফাস্ট করে এসেছি,’ জানালেন ড. ক্রুক। অফিসের চারধারে নজর বুলিয়ে বড় বাক্সটার কাছে হেঁটে এলেন। ‘পৌঁছে গেছে দেখছি।’

‘হ্যাঁ, কালকে এসেছে। কোট ঝুলিয়ে রাখুন, আমরা কাজে লেগে পড়ি,’ বলল হিরু চাচা।

আবারও বাক্সের ঢাকনা খুলল হিরু চাচা। প্রতিটি টুকরা বের করে ড. ক্রুকের হাতে দিল। তিনি সাবধানে সব কটির মোড়ক খুললেন। ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করে প্রতিটা আইটেম পরখ করলেন, তারপর মিলিয়ে নিলেন এক তালিকার সঙ্গে।

আরও পড়ুন

ছেলেরা রির৵াপিংয়ে সাহায্য করল। আরও কয়েকটা সোনার কাপ, কটা খোদাই করা জন্তু, কিছু বাসনকোসন, আর জেড আর পালকে তৈরি রঙিন মুখোশ দেখা গেল।

‘চমৎকার কন্ডিশনে আছে,’ বলে তালিকায় চোখ রাখলেন ড. ক্রুক। ‘কিন্তু জাগুয়ারটা কোথায়, মি. পাশা?’

বাক্সে হাত ঢুকিয়ে দিল হিরু চাচা।

‘কিশোর, একটু সাহায্য করবি?’

তরতর করে এগিয়ে গেল কিশোর। দুজন মিলে লম্বা, ভারী প্যাকেজটা বের করল বাক্স থেকে।

‘ওটা এখানে রাখুন, প্লিজ,’ বললেন ড. ক্রুক। হিরু চাচার ডেস্কের ডান পাশে দাঁড়িয়ে তিনি।

‘মাছের ট্যাংকটায় যেন না লাগে, কিশোর,’ বলল হিরু চাচা। ভারী প্যাকেজটা দুজন মিলে নামিয়ে রাখল ডেস্কে।

ড. ক্রুক বাদামি কাগজটা খুলতেই সবাই তাঁকে ঘিরে এল।

প্লাস্টিক বাবল র৵াপ খোলা হতেই, ‘খাইছে,’ বলে উঠল মুসা।

জাগুয়ারটা খাঁটি সোনার তৈরি। রুবির চোখ মেলে শুয়ে রয়েছে। দুই থাবার মাঝে গলফ বলের সমান এক পান্না। আলোয় ঝিকমিক করছে সবুজ পাথরটা।

‘কী দারুণ না?’ বলে উঠল হিরু চাচা। ‘কী অদ্ভুত সুন্দর হাতের কাজ!’

রুমালে হাত মুছে নিলেন ড. ক্রুক। এবার সোনার বাঘটার গায়ে হাত বোলাতে লাগলেন।

‘কী এটা?’ বলে ঝুঁকে পড়লেন রত্নটার ওপর।

‘কোনো সমস্যা?’ বলল হিরু চাচা।

ম্যাগনিফাইং গ্লাস ভেদ করে রত্নটা জরিপ করলেন ড. ক্রুক।

এক মিনিট পর মাথা তুলে হিরু চাচার দিকে চাইলেন।

‘স্যার, পাথরটা নকল!’

চলবে...

আরও পড়ুন