‘তাহলে তোমাদের পুরোনো বাড়িটা ছেড়ে দিয়েছ তুমি!’ জিজ্ঞেস করলাম রোনাল্ড ডালটনকে। ‘খবরটা শুনে বেশ অবাক হয়েছি।’
মাথা দোলাল ও।
‘খুবই খারাপ লেগেছে যেতে। কিন্তু যে ঘটনা ঘটল, তারপর আর কিছুতেই ওখানে থাকা চলে না। ঘটনাটা তোমাকে বলিনি। পুরোনো কোনো বন্ধুর সঙ্গেও শেয়ার করিনি কথাগুলো। আসলে, নেহাত দরকার না পড়লে এটার আলোচনাই করি না আমরা।’
‘জুনের এক গোধূলি। বাড়ির ভেতরে বসে ছিলাম আমরা। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ ঝরছে গাছ, ছাত, জানালা থেকে। খানিক আগেই হয়ে গেছে তুমুল ঝড়–বৃষ্টি।’
‘তবে ঘটনাটা তোমাকে বলতে চাই আমি,’ বলল রোনাল্ড অপ্রত্যাশিতভাবে। ‘অবশ্য যদি শোনার ইচ্ছা থাকে তোমার।’
‘খবরের কাগজে বিবরণ পড়ে বিস্তারিত জানার কৌতূহল জেগেছিল আমার। কারণ, আজবভাবে আত্মহত্যা করেছিল ওদের এক অতিথি। যা-ই হোক, সহজাত আন্তরিক ভঙ্গিতে বলতে লাগল রোনাল্ড, যা বাড়িয়ে তুলল গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা।’
‘লন্ডনের গ্যাভিন টমসনের সঙ্গে ভালোই দোস্তি হয়েছিল আমার ভাইয়ের। লোকটাকে প্রথম দেখি, যেবার সে আমাদের বাড়িতে এসে থাকল একটা হপ্তা। খুবই আগ্রহ ওর খোঁড়াখুঁড়ির ব্যাপারে। আরামদায়ক একটা জীবন কাটানোর পক্ষে যথেষ্ট টাকা রেখে গিয়েছিল ওর বাপ। কাজেই ভালোভাবে নিজের শখ মেটাতে পারত টমসন।’
‘সুদর্শন সে। বয়স উনত্রিশের মতো। গাঢ়, পুরুষালি চেহারা। অল্প বয়সেই নাম কামিয়ে ফেলেছে। এমনকি অধ্যাপকদের মধ্যেও জনপ্রিয় ছিল টমসন। বেদুইনদের সঙ্গে অনেক দিন কাটিয়েছে। একজন শ্বেতাঙ্গ হিসেবে এই অভিজ্ঞতা অতি দুর্লভ। তবে নিজের এসব কার্যকলাপের কথা সহজে স্বীকার করতে চাইত না লোকটা।’
‘এমনই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল টমসনের যে ভাইয়ের মতো আমিও ঝুঁকে পড়েছিলাম ওর দিকে। স্টোনহেঞ্জ–সম্পর্কিত যাবতীয় পুরোনো বই নাকি সে পড়েছে। জানাল, ড্রুইড তত্ত্ব মন কেড়েছে তার। এলিমেন্টালের কথা আমরা কখনো শুনেছি কি না, জানতে চাইল। তারপর হেসে বলল, আমরা যেন আবার এই ভেবে ভয় না পাই যে সেগুলো ভর করেছে ওর ওপরে। জানতে চাইলাম, জিনিসটা আসলে কী। বলল, এলিমেন্টাল হলো একধরনের কুৎসিত, অশুভ প্রেতাত্মা, যাদের কোনো আকার নেই। বসবাসের জন্য মানুষের শরীর খুঁজে বেড়ায় তারা। শোনা যায়, অশুভ কাজকারবার চলে, এমন জায়গায় মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় এলিমেন্টাল।’
‘বলতে বলতে আচমকা থেমে গেল সে। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বলতে লাগল, কীভাবে চাঁদের আলোয় ভেসে যায় স্টোনহেঞ্জের সমাধিকক্ষগুলো। এ বিষয়ে অদ্ভুত এক তত্ত্ব ফেঁদে বসল সে, যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। কেন যেন মনে হলো, ইচ্ছা করেই আমাদের মাথা গুলিয়ে দিয়েছে ও, যেন আগের প্রসঙ্গগুলো ভুলে যাই।’
‘মাঝেমধ্যে অবশ্য ওর কথা আমাদের বোধগম্য হলো, যখন সে ব্যাখ্যা করল ড্রুইডদের আচার-প্রথা সম্পর্কে। চাঁদের বিশেষ বিশেষ তিথিতে নিজেদের আচার পালন করত ড্রুইডরা।’
‘সে জন্যই আমাকে বেশির ভাগ কাজ করতে হয় রাতের বেলা,’ বলল ও।
‘ওকে আমরা একটা চাবি দিয়ে রেখেছিলাম, যাতে যখন খুশি বাড়ি ফিরতে পারে।’ টমসন বলল, সে এমন এক আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে, যা ইতিহাস সৃষ্টি করবে।
‘দিন পনেরো আমাদের সঙ্গে কাটানোর পর কয়েকটা কাজ সারতে ব্রিটানি চলে গেল ও, তার আগে কী যেন লিখল পাতার পর পাতা। তিন মাস পর ফিরে এল সে আবার। অনেক শুকিয়ে গেছে। শরীরে যেন ভর করেছে অসুস্থতা। চোখ দুটো বসা, জ্বলজ্বল করছে জ্বরের প্রকোপে। সে রাতটা বিশ্রাম নিতে বললাম ওকে। পাত্তাই দিল না। স্টোনহেঞ্জের কথা বলতে গিয়ে ধকধক করতে লাগল ওর চোখ জোড়া।’
‘রাতে বেরিয়ে যাওয়ার পর ওর কামরায় ঢুকলাম আমি। উদ্দেশ্য: দরকারি সব জিনিস লোকটার হাতের কাছে রয়েছে কি না, দেখা। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বই; একটা পড়ে আছে টেবিলের ওপরে, কী যেন গোঁজা সেটার ভেতরে। জায়গাটা খুলতেই দেখতে পেলাম, পাতার ভাঁজে রাখা একটা ছুরি; বাঁকা, নিখাদ সোনায় তৈরি। বলি দেওয়ার ছুরি ছিল ওটা। ছুরিটা এত ধারালো যে বিশ্রীভাবে কেটে গেল আমার আঙুল।’
‘প্রচণ্ড কৌতূহলে পড়তে লাগলাম পাতাটা:
...যদিও অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে ড্রুইডদের যুগ, রাত্রি এখন আর শিহরিত হয় না তাদের শিকারের বুকচেরা চিৎকারে, বলির বেদি থেকে ঝরে না ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত, তবু আজও পূর্ণ চাঁদের সময়ে স্টোনহেঞ্জে গেলে বিপদ হতে পারে। কারণ, অশুভ শক্তির আনাগোনা সেখানে। খ্যাপার মতো মানুষের শরীর খুঁজে বেড়ানো এসব অশরীরী আতঙ্ক একবার যদি কারও ওপর ভর করে, ভীষণ শক্ত হয়ে পড়ে তাদের তাড়ানো।’
‘কয়েক শ বছরের পুরোনো বইটা। অন্যগুলো উল্টেপাল্টে দেখলাম। সব একই বিষয়ের ওপরে। ভাইকে ব্যাপারটা জানাতে বলল ও, গ্যাভিন বোধ হয় কোনো কারণে উত্তেজিত।’
‘সম্ভবত ভূতের আসর হয়েছে ওর ওপরে,’ বলল ও।
দুজনেই হেসে উঠলাম।
‘পরবর্তী রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম, ওকে অনুসরণ করব আমরা। যথারীতি বেরিয়ে গেল ভাইয়ের বন্ধুটি। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কুকুরটা আমাদের অবাক করে দিয়ে লাফিয়ে উঠল গ্যাভিনের গাড়িতে। অমানুষিক শক্তিতে জানোয়ারটাকে বাইরে ছুড়ে ফেলল গ্যাভিন। আমাদের বলল ওটাকে সামলে রাখতে। চেষ্টা করে কোনো লাভ হলো না। কুকুরটা যেন অস্থির হয়ে উঠেছে, গাড়ির পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল পাগলের মতো। শিগগিরই ও দুটো চলে গেল চোখের আড়ালে।’
‘আধা ঘণ্টা পর একই রাস্তা ধরে অনুসরণ শুরু করলাম আমরা। রাতটা ছিল চমৎকার, উষ্ণ, আকাশ ভরা মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল চাঁদ। খানিকটা দূরে গাড়ি ছেড়ে হাঁটতে লাগলাম ঘাসের ওপর দিয়ে। জ্যোৎস্নায় ম্লান করছে লম্বা লম্বা উঁচু সমাধি কক্ষগুলো। কেন যেন মনে হলো, কারও ওপর পড়ে তাকে পিষে মারার তাল করছে ওগুলো।’
‘কাছাকাছি না যেতেই বড় পাথরগুলোর আড়াল থেকে চুপিসারে বেরিয়ে এল একটা মূর্তি। আবছা আলোয় ওটাকে দেখাল কুয়াশায় মোড়া প্রেতের মতো। গভীর শ্বাস টানার শব্দ পেলাম ভাইয়ের।’
‘বলির বেদির সামনে থামল ওটা। বেদিটা তখন ঘন ছায়ায় ঢাকা। আবছা আলোয় ঝিকিয়ে উঠল কী যেন। একটা ছুরি! তারপরই বেদির পেছন থেকে ভেসে এল রক্ত জল করা চিৎকার।’
‘মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল চাঁদ। পালালাম আমরা ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে। তাড়াহুড়োয় প্রথমটায় না পেলেও শেষমেশ খুঁজে পেলাম গাড়ি।’
‘সোজা বাড়ি ফিরে এলাম। ততক্ষণে শুয়ে পড়েছিল গ্যাভিন, দরজা খুলে দিতে নেমে আসতে হলো ওকে নিচে। ভীষণ ক্লান্ত ছিল। সে জন্য লক্ষ করল না কিছুই। আমরাও স্রেফ বললাম যে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম।’
‘রাতে ঘুম হলো না ভালো। রাতের কথা ভেবে পরদিন খুব লজ্জিত হলাম।’
‘সে রাতে আবার অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম গ্যাভিনকে। সারা দিনই সমাহিত আর স্বপ্নাচ্ছন্ন মনে হলো ওকে। মুখে সেই আবিষ্কারের কথা, যার নাকি বেশি দেরি নেই আর।’
‘টমসন বেরিয়ে যাওয়ার এক ঘণ্টা পর ওকে অনুসরণ করলাম আমরা। সেদিন চাঁদ নেই আকাশে, কিন্তু আমাদের আছে একখানা ইলেকট্রিক টর্চ। শিগগিরই দেখতে পেলাম গ্যাভিনকে, হাঁটু মুড়ে বসে আছে বেদির পাশে। ভুল হওয়ার জো নেই, পরনে তার টুইডের পোশাক।’
‘ঠিক ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম, কিন্তু ফিরে তাকাল না টমসন। একটা হাত রাখলাম কাঁধে, তা-ও নড়ল না। জ্ঞান নেই ওর। আমি ওর মাথাটা তুলে ধরতেই আলো গিয়ে পড়ল চকচকে এক জোড়া চোখের ওপর। হা, ঈশ্বর, ও আর নেই এ জগতে! ওকে বেদির ওপর শুইয়ে দিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা করলাম। হ্যাঁ, মারাই গেছে গ্যাভিন টমসন। জামায় লেগে আছে রক্ত, দেখা যাচ্ছে ছোট একটা ছুরির হাতল।’
‘বলির বেদির ওপর পড়ে রইল টমসনের মৃতদেহ, এলোমেলো চুল, রক্তশূন্য মুখটা ওপর দিকে ফেরানো। বড় পাথরগুলো ঘিরে রয়েছে ওকে। ভাইয়ের হাতে ধরা আলোটা কেঁপে যেতে লাগল। ফলে নাচতে লাগল বিচিত্র ছায়াগুলো।’
‘মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। তারপর সাহস ফিরে পেয়ে লাশটাকে ধরাধরি করে তুললাম গাড়িতে।’
‘বেশ ঝামেলায় পড়তে পারতাম। কিন্তু গ্যাভিনের লিখে রেখে যাওয়া একটা চিঠি আমাদের মুক্তি দিল যাবতীয় দোষ কিংবা ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার দায় থেকে।’
‘ও লিখেছে: স্টোনহেঞ্জে খোঁড়াখুঁড়ি করার প্রথম কয়েকটা রাত শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে সম্পূর্ণ শান্ত ছিল ও। তারপরই ওর ভেতরে আসে অদ্ভুত এক পরিবর্তন। মনে হতে থাকে, শত শত বছর আগে ও যেন বাস করত এই স্টোনহেঞ্জে; জানে এখানকার সব গোপন রহস্য।’
‘তখন ওর ভেতরে দেখা দিল ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটানোর আকাঙ্ক্ষা। নিজেকে ও প্রশ্ন করেছে, পাগল হয়ে যাচ্ছে কি না। নাকি স্টোনহেঞ্জের প্রেতাত্মা দাবি করছে একটা শিকার! এই সময় ওর মাথায় এল এলিমেন্টালের ধারণা, হয়তো সেগুলো সম্বন্ধে খুব বেশি পড়াশোনা করার কারণেই।’
‘কাজে ডুবে গিয়ে এসব ভুলে থাকার জন্য চলে গেল ও ব্রিটানিতে। কিন্তু স্টোনহেঞ্জ যেন ডাকতে লাগল হাতছানি দিয়ে। ধীরে ধীরে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল যেন টমসন। অবশেষে নির্ঘুম বহু রাত কাটানোর পর ফিরে এল ও। মনের গভীরে জানত, ফিরতে ওকে হবেই।’
‘এক রাতে বলির বেদির ওপর একটা কুকুরকে শুয়ে থাকতে দেখে হত্যার এমনই নেশা চাপল ওর মাথায় যে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারল না। রক্তপাতের পর অনুভব করল অদ্ভুত এক আনন্দ আর গভীর তৃপ্তি। কে যেন ফিসফিস করে জানিয়ে দিল, ওর ওপর লক্ষ রাখা হচ্ছে। কুকুরের মৃতদেহটা নিয়ে দৌড়ে গেল ও গাড়ির দিকে। সংক্ষিপ্ত একটা সোজা রাস্তা আবিষ্কার করেছিল টমসন, বেশ কয়েক মাইল কম পাড়ি দিতে হয় তাতে। সেই রাস্তা ধরেই আমাদের আগে বাড়ি ফিরে এসেছিল ও।’
‘পরদিন সকালে জাগল ও গভীর রক্তপিপাসা নিয়ে। অনুভব করল, স্টোনহেঞ্জে ওর কাছাকাছি কেউ এলে তাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ওর। সারা দিন চলল এই মানসিক যুদ্ধ। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পরিকল্পনা করতে বসল ও, কীভাবে আমাদের প্রলুব্ধ করে মেটানো যায় এই রক্ততৃষা।’
‘কিন্তু আমরা সেখানে যেতেই হিমশীতল আতঙ্ক পেয়ে বসল ওকে। সাবধান করে দিতে চাইল সে আমাদের, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো স্বর ফুটল না। তখন ওর ভেতরে যেটুকু শুভ তখনো অবশিষ্ট ছিল, তা-ই নিয়ে রুখে দাঁড়াল অশুভের বিরুদ্ধে। আমাদের বাঁচানোর তখন একটাই মাত্র পথ খোলা ওর সামনেÑআমাদের রক্তপাতের পরিবর্তে ওর নিজের রক্তপাত।’
‘সুতরাং সে রাতে নিজেকেই উৎসর্গ করল সে অশুভকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে।’
‘চিঠিটা পাওয়ার ফলে মুক্ত হলাম আমরা সন্দেহ থেকে। ঘটনাটাকে বলা হলো...মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে আত্মহত্যা। এরপর আমি আর আমার ভাই বব ভয়াবহ সেই এলাকা ত্যাগ করলাম।’
‘রোনাল্ড গল্পটা শেষ করার পর বসে রইলাম আমরা চুপচাপ। তারপর ঘণ্টা বাজলে যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠে ছাই ঝাড়তে লাগলাম পাইপ থেকে।’