ভুলভুলাইয়া
‘গাইড লাগবে, সাহেব?’— প্রশ্নটা এল বাঁ পাশ থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক অল্প বয়সী ছেলে করেছে প্রশ্নটা। মনে মনে ভাবছি, কীভাবে না করা যায়, আমার ইতস্তত করা দেখে নিজেই বলল, ‘পয়সা কম নিব, সাহেব। ভুলভুলাইয়ার একেবারে ভেতরে নিয়ে যাব তোমাকে।’
এবার আমি পূর্ণ মনোযোগ দিলাম তার প্রতি। গায়ের রং ফরসা, দোহারা গড়ন আর উচ্চতায় প্রায় আমার সমান, পরনে মলিন হয়ে যাওয়া লাল চেক শার্ট। বয়স আন্দাজ করে মনে হলো, গাইড হিসেবে খুব বেশি দিনের অভিজ্ঞতা তার নেই। কিন্তু ভুলভুলাইয়ার ভেতর পর্যন্ত দেখানোর সাহস যখন করেছে, তখন কিছুটা হলেও বোধ হয় চেনে।
ভারতের লক্ষ্ণৌ এসেছি দিন দুয়েক হলো। এর মধ্যে অনেকটা খরচ হয়ে গেছে, কম পয়সায় গাইড পেলে আমারও সুবিধা। আগ্রহ নিয়ে তাই দরদাম করলাম। কেবল ভুলভুলাইয়াই দেখব ওকে নিয়ে, তাই ৩০ রুপিতে রাজি করানো গেল।
লক্ষ্ণৌর বড় ইমামবাড়ার ছাদে সেই বিখ্যাত ভুলভুলাইয়া। নবাব আসাফ-উদ-দৌলার নির্দেশে মোগল স্থাপত্যের অনুপ্রেরণায় তৈরি বড় ইমামবাড়া দেখে এমনিতেই আমার চোখ ছানাবড়া। বিরাট এক কমপ্লেক্স, যার মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক প্রাসাদ—সেই আঠারো শতক থেকে।
মাথার ওপরে সূর্য বেশ তেজ নিয়ে আলো ছড়াতে শুরু করেছে। গাইড ছেলেটার নাম সাহিল। ওর পিছু নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে সোজা পা বাড়ালাম ভুলভুলাইয়ার দিকে। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার! বাইরের তেজ ছড়ানো আলো ঢোকার গলিপথে ঠিকমতো আসে না। দেখা যায় না এক হাত সামনেও। দিনের বেলা অথচ গা ছমছম করে।
সাহিল ততক্ষণে বলতে শুরু করেছে, ‘এখানে একই রকম দেখতে হাজারখানেক গলি আছে। আমরা কেবল বাইরের দিকের গলিতে পা রাখলাম। আস্তে আস্তে যাব ভেতরের দিকে। যত ভেতরে যাব, গলি আরও সরু হবে, জটিল হবে। একই রকম দেখতে দরজা আর সিঁড়িও বাড়বে। পেছনে ফিরতে গেলে দেখবে সব পথই একই রকম! কিন্তু এর মধ্যে মাত্র দুটো দিয়েই বের হওয়া যাবে, বাকিগুলো নিয়ে যাবে কানাগলিতে—যেগুলো বন্ধ হয়ে আছে দুই শ বছর ধরে!’
শুরুতে রোমাঞ্চ নিয়ে ঢুকেছিলাম ভেতরে। কিন্তু ওর কথায় রোমাঞ্চ আর রইল না। প্রায় দুই শ বছরের এই গোলকধাঁধার নাম এ জন্যই ভুলভুলাইয়া; যেখানে মানুষ ভুল পথে হারিয়ে যায়।
প্রথম দিকে সূর্যের আলো না এলেও চোখের আন্দাজে কিছুটা পথ এগোনো যাচ্ছিল। কিন্তু একবার একটা দরজা দিয়ে ভেতরের গলিতে যাওয়ার পর সেটাও নেই। ঘুটঘুটে গভীর অন্ধকার! পকেট থেকে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে আলোর ব্যবস্থা করতে চাইলাম। বাধা দিল সাহিল। শুদ্ধ উর্দুতে বলল, ‘মোবাইলের আলোয় ভুলভুলাইয়া দেখে মজা পাবে না, সাহেব। ব্যবস্থা করছি দাঁড়াও!’
একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে পকেট থেকে মোমবাতি বের করে ধরাল। মোমবাতির হলদে আলোয় প্রথমবারের মতো গলির দেয়াল দেখলাম। চুনাপাথরের মসৃণ দেয়াল, কিছু দূর পরপর দেয়ালের গায়ে ছোট্ট ঘরের মতো কাটা। সাহিল জানাল, ‘এখানে নবাব মোমবাতি জ্বেলে বেগমদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন।’
কিছুটা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘লুকোচুরি? এই গলিতে?’
‘হ্যাঁ! লোকে বলে, সে জন্যই বানিয়েছিলেন এটা। একই রকম দেখতে এসব পথ ধরে বেগমরা খুঁজে বেড়াতেন নবাবকে।’
আনমনে মাথা নেড়ে বললাম, ‘এ কেমন ইচ্ছা! লুকোচুরি খেলবেন বলে এমন ভুতুড়ে গোলকধাঁধা?’
আমার কথায় হাহা করে হেসে উঠল ছেলেটা। বলল, ‘আমার দাদাজান অবশ্য বলতেন অন্য কথা…’
‘কী?’, কৌতূহলে প্রশ্ন করে বসলাম।
আর এই কৌতূহল টের পেয়ে যেন রহস্য শুরু করল সে, ‘শুনবে শুনবে! চলো এগোই।’
গলিপথ এতটাই সরু যে পাশাপাশি দুজন হাঁটা যায় না। মোমবাতি হাতে নিয়ে সামনে চলছে সাহিল, আর আমি তার পেছনে পেছনে।
‘এখানে এসে কত মানুষ যে হারিয়ে গেছে! ইংরেজদের সময় প্রায়ই বাজি ধরে একেকজন ঢুকে পড়ত এর মধ্যে। খুব কমই পেরেছে বেরিয়ে আসতে!’
এসব কথা যে আমি একটু-আধটু জানতাম না তা না। কিন্তু ওই সব পথেই হাঁটছি টের পাওয়ার পর মনে হতে লাগল, এত ভেতরে গিয়ে আর কাজ নেই, সময় থাকতে থাকতে বরং বের হয়ে আসি।
কেবল সঙ্গে থাকা এই ছেলে আমাকে ভিতু ভাববে বলে এই প্রস্তাব তুললাম না।
সামনে একটা মোড় ঘুরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার পর মনে হলো, বহুদিনের পুরোনো একটা বদ্ধ বাতাস আমাদের গায়ে লাগল। কত দিনের পুরোনো, কতকাল এখানে কেউ আসে না, কে জানে!
গলার স্বর নেমে গেছে, বললাম, ‘সাহিল, এদিকটায় না ঢুকলে চলে না?’
মোমবাতির আবছা আলোয় ওর মুখ এখন চেনা যাচ্ছে না। আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘নবাবের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করত, তাদেরকে এখানকার গলিতে এনে ছেড়ে দিত। আর বের হতে পারত না ওরা। পথ হারিয়ে এখানেই আটকা পড়ে থাকত।’
আমার শরীর দরদর করে ঘাম ছেড়ে দিল। কেন যে এত সাহস করে এর মধ্যে ঢুকতে গেছি! একের পর এক দরজা পার হচ্ছি, নতুন মোড়ে গিয়ে মনে হয় এই পথ তো কেবলই পার হলাম! লোকগুলো যে কেন বের হতে পারত না, তা পদে পদে টের পাচ্ছি।
ফোন বের করে সময় দেখতে গিয়ে টের পেলাম দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, টেরই পাইনি! কিন্তু যেটা সবচেয়ে দুশ্চিন্তার সেটা হলো, এখানে একদমই নেটওয়ার্ক নেই। ফ্লাইট মোডের মতো নেটওয়ার্ক অপারেটরের নাম, চিহ্ন সব গায়েব।
‘এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না?’ প্রশ্ন করে বুঝলাম আমার সামনে কেউ নেই।
মোবাইল দেখতে গিয়ে একটু ধীরগতিতে এগোচ্ছিলাম, সাহিল যে কখন এগিয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। নিজেকে বোকার হদ্দ মনে হতে লাগল। কীভাবে এমন বেখেয়ালি হলাম!
‘সাহিল?’ জোর গলার ডাক হারিয়ে যাচ্ছে ভেতরে। কিন্তু কোনো উত্তর ভেসে আসছে না।
বাধ্য হয়ে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে এগোতে লাগলাম। কয়েক পা এগোনোর পর আমার সামনে তিনটি পথ—হুবহু একই রকম দেখতে! কোনটা ধরে এগোতে হবে! ভুল পথে এগোলে যে পথ হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি, তা টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
তিনটার মধ্যেই আলো ফেললাম, কিন্তু কোথাও আলো গিয়ে বাধা পাচ্ছে না। অতল এক রাস্তা যেন! মনের সব সাহস জড়ো করে ডান পাশের পথ বেছে নিলাম। কোনো একটা পথ দিয়ে এগিয়ে খুঁজতে হবে সাহিলকে, ভুল হলে ফেরত এসে আরেকটা পথে ঢুকে খুঁজব।
কিছুদূর এগিয়ে দুটো মোড় ঘোরার পর নাকের মধ্যে আরও বদ্ধ এক বাতাস এসে লাগে। এ পথে হয়তো কেউ আসেনি। ফিরে যাব বলে পেছন ঘুরে দেখি, আমার সামনে একই রকম দেখতে দুটো পথ। কোনটা দিয়ে এসেছি আমি? ভয়ে, উত্তেজনায় কোন দিকে কতবার মোড় ঘুরেছি, তার হিসাব রাখতে ভুলে গেছি। এবার কী হবে? চিৎকার করলেও বাইরে আওয়াজ পৌঁছাবে না। তাহলে কীভাবে…?
মরিয়া হয়ে একটা পথ ধরে ছুটতে থাকলাম, তার সামনে আরেকটা পথ, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আরেকটা। মেঝে কোথাও হঠাৎ নিচু, কোথাও আবার হুট করে উঁচু। ছুটতে গিয়ে বার কয়েক মুখ থুবড়েও পড়েছি। কনুইতে ব্যথা পেয়েছি, হয়তো ছিলেও গেছে, কিন্তু ওসবে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। প্রাণপণে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছি—প্রাণ নিয়ে বের হতে চাই এই অন্ধকার গোলকধাঁধা থেকে।
প্রায় তিন-চারবার বন্ধ গলির শেষ প্রান্তে গিয়ে ধাক্কা খেতে হলো। ফিরে এসে খোলা পথ ধরে এগোলেও কোনো ফল মিলছে না। হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছি একই জায়গায় কিংবা ঘুরতে ঘুরতে চলে গেছি আরও গভীরে। অবস্থান বের করার কোনো উপায় নেই।
মোবাইলের চার্জ যে মাত্র ১০ শতাংশে নেমে এসেছে, টের পাইনি। ভয় আর হতাশা—দুটোই জেঁকে বসেছে। মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়া মানে আমার কাছে আলো নেই, ভয়ংকর এ পথে চিরদিনের জন্য আটকে থাকতে হবে…ওই পথ হারানো মানুষদের মতো।
হাঁটতে হাঁটতে সামনে আরেকটা কানাগলি। সামনে কোনো রাস্তা নেই, একটা দেয়াল নেমে এসেছে সিলিং থেকে। গলার কাছে পেঁচিয়ে থাকা কান্নায় দমবন্ধ হয়ে আসছে। ফিরে আসতে যাব, ওই সময় ফ্ল্যাশলাইটের আলো পড়ল বন্ধ দেয়ালের দিকে থাকা মেঝের ওপর। একটা কাপড় দেখা যাচ্ছে। হাঁটু ভেঙে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে আলো ধরলাম—একটা লালরঙা মলিন শার্ট, যেটায় আবছাভাবে কালো রঙের চেক বোঝা যাচ্ছে।
আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। তবে এটুকু মনে আছে, এই শার্ট দেখেছিলাম সাহিলের গায়ে, যে আমাকে ভুলভুলাইয়া দেখাবে বলে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখানে শার্টটা যার গায়ে, তাকে চেনার কোনো উপায় নেই। কতগুলো হাড় উঁকি মারছে শার্টের গলার ফাঁক দিয়ে। তার ওপরে বসে আছে একটা কোটরহীন খুলি। মেঝেতে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া একটা মোমের টুকরাও দেখা যাচ্ছে।
ভয় কিংবা আতঙ্ক কোনোটাই আর টের পাচ্ছি না। হাত-পায়ের শক্তিও সব লোপ পেয়েছে, আর মনে হচ্ছে দম আটকে…।
*
রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। এক আলাভোলা ভদ্রলোক অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছেন ইমামবাড়ার সৌন্দর্য। এগিয়ে গেলাম তাঁর দিকে, ‘গাইড লাগবে, সাহেব? কম পয়সায় ভুলভুলাইয়া ঘুরিয়ে দেখাব তোমাকে...’