দুষ্টু ছেলে
ওরিয়েন্ট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বায়োলজি শিক্ষক আবদুল মোতালেব মোটামুটি ঝড়ের বেগে হেডস্যারের রুমে ঢুকলেন।
‘স্যার আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’ হেডস্যার অবাক হয়ে তাকালেন!
‘কী ব্যাপার?’
‘স্যার, ওই যে ক্লাস নাইনের রুবেল ছেলেটার প্রসঙ্গে...’
‘কেন, সে আবার কী করেছে?’
‘স্যার, সে কী করেনি! অসম্ভব প্রবলেমেটিক একটা ছেলে, একে স্যার টিসি দেন।’
‘করেছেটা কী আগে বলবেন তো?’
‘স্যার ও তো ক্লাসে ঢুকেই সিসি ক্যামেরা ঘুরিয়ে দেয়, তারপর তার যত দুষ্ট কর্ম করতে থাকে।’
‘সিসি ক্যামেরা ঘোরায় কীভাবে? ওটা তো অনেক ওপরে সেট করা।’
‘স্যার চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে।’
‘আর দুষ্ট কর্ম কী করে?’
‘স্যার, একেক সময় একেক কাণ্ড করে...এবার যেটা করেছে...’ এই পর্যায়ে মোতালেব স্যার গলা নামিয়ে ফেলেন, ‘স্যার, এই ছেলে সব স্যার-ম্যাডামের আজেবাজে নাম দিয়েছে। সবাই হাসাহাসি করছে নামগুলো শুনে।’
‘বলেন কী! কী রকম নাম বলুন তো দু–একটা।’
‘যেমন ধরেন, মিজান স্যার তো একটু মোটাসোটা, ওনার নাম দিয়েছে “মিনিকেট চালের বস্তা।”
‘হোয়াট?’
কেমেস্ট্রির মিজান স্যার যে হেডস্যারের রুমের এক কোনায় বসে খাতা দেখছিলেন, তা খেয়ালই করেননি মোতালেব স্যার। মিজান স্যার হুংকার দিয়ে উঠলেন—
‘কী! আমার নাম দিয়েছে মিনিকেট চালের বস্তা? কে? কে? নামটা দিয়েছে জলদি বলেন...’
‘আহ মিজান সাহেব!’ শান্ত করার চেষ্টা করলেন হেডস্যার। ‘প্লিজ, আপনি খাতাগুলো দেখে শেষ করুন জলদি। আমি দেখছি...আর কার কী নাম দিয়েছে?’ আগ্রহী চোখে তাকালেন হেডস্যার।
‘রফিক স্যারের নাম দিয়েছে “পেনসিল ব্যাটারি।”’
‘পেনসিল ব্যাটারি কেন?’
‘উনি একটু চিকনচাকন ছোটখাটো মানুষ...’
‘হুম! হেডস্যার গম্ভীর হয়ে গেলেন। গলা নামিয়ে বললেন, ‘আমার কি কোনো নাম দিয়েছে?’
‘দিয়েছে স্যার...।’ মোতালেব স্যার ইতস্তত করেন। হেডস্যার বেশ লম্বা মানুষ। তিনি আগ্রহের সঙ্গে বললেন, ‘কী নাম দিয়েছে আমার?’
‘ইয়ে মানে স্যার...’
‘আহ বলুন না।’
‘বাত্তি নাই বিদ্যুতের খাম্বা।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হেডস্যার। বিড়বিড় করে বললেন, ‘এত বড় নাম!’ তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা আপনারা যান। আমি দেখছি কী করা যায়।’
‘স্যার, এই ছেলেকে টিসি দেন।’
‘উফ! টিসি দেওয়া এত সোজা? এই ছেলে বেতন দেয় মাসে মাসে কত? ২৫০০০ টাকা। আর আপনার বেতন ১৫০০০। আপনি কি মনে করেন ওকে টিসি দিলে আপনার-আমার বেতন হবে? না স্কুল কমিটি আমাদের রাখবে? অন্য বুদ্ধি বের করতে হবে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে। আচ্ছা যান দেখি কী করা যায়।’
বায়োলজি স্যার চলেই যাচ্ছিলেন। হেডস্যার ডাকলেন।
‘স্যার, কিছু বলবেন?’
‘হ্যাঁ, একটা জিনিস কিন্তু ভালো লাগল।’
‘কী স্যার?’
‘ছেলেটা নামগুলো দিয়েছে কিন্তু সব বাংলায়…’
‘আচ্ছা, আপনি আসুন।’
টিফিনের পর হেডস্যার তাঁর রুমে ডেকে পাঠালেন ক্লাস নাইনের রুবেলকে।
‘স্যার, স্লামালিকুম।’
‘ওয়ালাইকুম...। তুমি নাকি ক্লাসে ঢুকে সিসি ক্যামেরা ঘুরিয়ে দাও?’
‘জি স্যার।’
‘কেন?’
‘স্যার, ক্যামেরাটা খুলে পড়ে যেত, তাই আমি ঠিক করে দিয়েছিলাম।’
‘তোমাকে ঠিক করতে কেউ বলেছিল?’
‘না স্যার। তারপরও আমাদের ক্লাসের ক্যামেরা খুলে পড়ে যাচ্ছে, তাই ভাবলাম, নিজেই...’
‘স্যারদের নাকি আজেবাজে নাম দাও...মিজান স্যারের কী নাম দিয়েছ?’
‘ইয়ে স্যার...’
‘বলো।’
‘স্যার...মিনিকেট চালের বস্তা। আসলে স্যার, মিনিকেট চাল বাজার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। অন্য মোটা চাল মেশিনে চিকন করে বাজারে দাম বাড়িয়ে মিনিকেট চাল বলে বিক্রি হচ্ছে...টিভিতে খবরে বলেছে। এটা শুনে ভাবলাম হারিয়ে যাওয়া চালটার নাম যদি কোনোভাবে ধরে রাখা যায়, স্মৃতি হিসেবে। মিজান স্যার আমাদের খুব প্রিয় স্যার। তাই তার নামেই...’ রুবেল মাথা চুলকায়।
‘এগুলো যে বাজে রকমের দুষ্টুমি, তা বুঝতে পারছ তুমি?’
‘ইয়ে স্যার... মানে...’
‘তুমি বুঝতে পারছ তুমি কী করছ?’
‘স্যার, একটু–আধটু দুষ্টুমি হয়তো হয়ে যাচ্ছে... তবে স্যার একটু–আধটু দুষ্টুমি স্যার যদি না-ই করি, পরে বড় হয়ে স্যার আফসোস হবে যে ছোটবেলায় কোনো দুষ্টুমিই করলাম না।’
রুবেলের বক্তব্য শুনে যেন বাক্যহারা হয়ে গেলেন হেডস্যার। কথাবার্তা অবশ্য ইংরেজিতেই হচ্ছিল। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, তাই স্কুলের ভেতরে বাংলা বলা নিষেধ। ছেলে ভালোই ইংরেজি বলে। হেডস্যার ভাবলেন, এ ছেলেকে সাইজ করা কঠিন হবে; একে সাইজ করতে হবে অন্যভাবে। শাস্তি দেওয়া হবে; কিন্তু কী শাস্তি দেওয়া যায়? এমন শাস্তি দিতে হবে যেন সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।
স্কুল ছুটির পর রুবেলের শাস্তির বিষয়ে অন্য স্যার-ম্যাডামদের নিয়ে মিটিং বসল হেডস্যারের রুমে। মোটামুটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকই বলা যায়।
‘স্যার, ছুটির পর ওকে দশ পাতা অঙ্ক করতে বলুন। তারপর ওর ছুটি হবে।’ বললেন বাংলার ম্যাডাম।
‘না লাভ নাই। ও অঙ্কে ভালো। বরং বাংলা রচনা লিখুক দশ পাতা। এরা সব বাংলায় খুব দুর্বল। ওর খবর হয়ে যাবে।’ বললেন হেডস্যার।
‘স্যার... এসবে হবে না; ফিজিক্যাল শাস্তি হওয়া দরকার। তাহলে মনে থাকবে।’
‘কী রকম?’
‘ছুটির পর টানা এক-দুই ঘণ্টা বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকুক।’
‘কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে...’
ঘণ্টা দুয়েক নানান রকম শাস্তির আলোচনা-পর্যালোচনার পর শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো—
১. সে নতুন কোনো দুষ্টুমি করতে পারবে না
২. দুষ্টুমি করলে তাকে এক ক্লাস নিচে নামিয়ে দেওয়া হবে।
৩. প্রতিদিন স্কুলে এসে তাকে একটা ভালো কাজ করতে হবে। এবং সেটা হেডস্যারকে রিপোর্ট করতে হবে।
ক্লাস নাইনের রুবেল অবশ্য খুশিমনে তার তিন দফা শাস্তি মেনে নিল। প্রথম দিন কোনো ভালো কাজ করতে না পারলেও দ্বিতীয় দিন একটা ভালো কাজ করল।
ওই দিন স্কুলে হঠাৎ করে সকাল থেকেই স্কুলের দারোয়ান নেই। দারোয়ান না থাকায় প্রচণ্ড অসুবিধা হতে থাকল সবার। কিন্তু দারোয়ান গেল কোথায়! শেষ পর্যন্ত জানা গেল, এই কাজ রুবেলের। তাকে ডাকা হলো হেডস্যারের রুমে।
‘স্যার, আপনি বলেছিলেন স্কুলে এসে একটা ভালো কাজ করতে। তাই দারোয়ান আঙ্কেলকে ছুটি দিয়েছি।’
‘তুমি ছুটি দেওয়ার কে?’ হুংকার দিয়ে উঠলেন হেডস্যার।
‘স্যার, ওনার ছেলের জ্বর। আপনি ছুটি দেন নাই। তাই আপনার নাম বলে আমিই...বলেছি হেডস্যার আপনাকে চলে যেতে বলেছেন।’
‘উফ!’ দুহাতে মাথা চেপে ধরে ধুপ করে বসে পড়লেন হেডস্যার। তারপর দ্বিতীয় দফায় হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘গেট আউট! গেট আউট!’
তবে শেষ পর্যন্ত দুষ্টু রুবেল সত্যি সত্যিই একটা ভালো কাজ করল। সে স্কুল থেকে হেডস্যারের কথামতো গেট আউট হয়ে গেল। মানে গেট আউট হয়ে গেল নিজে নিজেই। এ ধরনের স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা নাইন–টেনে উঠলে অনেক সময় স্কুল ছেড়ে কোচিংয়ে চলে যায়, সে-ও তা–ই করল। স্যাররা অবশ্য ঠিক বুঝলেন না শাস্তিটা আসলে ঠিক কার হলো!