দুই
ঠিক এক ঘণ্টাই লাগল লুসার্ন ভ্যালিতে যেতে। অয়ন-জিমিকে নিয়ে পরদিন সকাল ৯টায় রওনা হলেন ক্যাথারিন, পৌঁছে গেলেন ১০টায়। হাইওয়ে থেকে একটা কাঁচাপাকা সাইড রোড ধরতে হলো তাঁদের, বন-জঙ্গল আর ছোট-বড় পাহাড় পেরিয়ে বেরিয়ে এলেন খোলামেলা মাঠের মতো একখণ্ড জমিনে। সেখানেই দেখা পাওয়া গেল মিসেস মার্গারেট মার্সডেনের বাড়িটার। সামনে সবুজ লন, তাতে নানা ধরনের ফুলের গাছ। পেছনে রয়েছে ছোট একটা পাহাড়, দুই পাশে বড় বড় গাছ। বাড়ির উল্টো দিকে বয়ে চলেছে একটা অপ্রশস্ত নদী। সব মিলিয়ে ছবির মতো এক পরিবেশ। লিজা বাড়িয়ে বলেনি, সত্যিই উপভোগ করার মতো।
ড্রাইভওয়েতে পুরোনো একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে নিজের গাড়ি থামালেন ক্যাথারিন। তিনজন নেমে পড়লেন এরপর। চারদিকে নজর বোলাল অয়ন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাড়িটা নতুন, কিন্তু খুব সুন্দর বলা যাচ্ছে না। কারণ, চারকোনা একতলা ভবনটার এক প্রান্তে বেঢপভাবে বেরিয়ে আছে প্রায় গোল একটা অংশ। এমন বিদঘুটে ডিজাইনের কারণ কী, কে জানে। ছোট্ট একটা কটেজও চোখে পড়ল—মূল বাড়ি থেকে ১০০ গজ দূরে। ম্যানরজাতীয় বড় বড় বাড়ির সঙ্গে এ ধরনের কটেজ থাকে, কর্মচারীদের থাকার জন্য। এখানে বানানোর উদ্দেশ্য কী, বোঝা গেল না। মূল বাড়িটা সে রকম বড় কোনো ইমারত নয়।
‘এসো,’ ছেলেদের ডাকলেন ক্যাথারিন। সদর দরজায় গিয়ে কলিং বেল বাজালেন।
খানিক পরেই খুলে গেল দরজা, লিজাকে দেখা গেল দোরগোড়ায়। ক্যাথারিনকে দেখে হাসিতে উদ্ভাসিত হলো তার চেহারা।
‘এসে পড়েছেন?’ বলল সে। ‘থ্যাঙ্ক গড।’
একাধিক কণ্ঠের উত্তেজিত হইচই ভেসে আসছে বাড়ির ভেতর থেকে। ক্যাথারিন জানতে চাইলেন, ‘কে কথা বলছে? মিসেস মার্সডেনের ভাইপো কি আছেন এখনো?’
‘না, না। মাইকেল আর মিলি বেনেট গত রাতেই চলে গেছেন। চেঁচাচ্ছে আরেক আত্মীয়। ড্যান কোহেন—মিসেস মার্সডেনের স্বামীর দূরসম্পর্কের ভাই। বউসহ এসেছে ঝগড়া করতে। বাইরে ওদের গাড়ি দেখেননি?’
‘দেখেছি। কিন্তু ঝগড়াটা কী নিয়ে?’
‘কী আবার? সম্পত্তি নিয়ে। ড্যানের দাবি, মি. ডেভিড মার্সডেনের মৃত্যুর পর সম্পত্তির একটা ভাগ আইনত তার প্রাপ্য। সেটাও যদি না-ও দেওয়া হয়, অন্তত মাইকেলের বদলে সম্পত্তির কেয়ারটেকার হিসেবে তাকে নিয়োগ করা হোক।’
সরু চোখে ক্যাথারিন আর অয়ন-জিমির দিকে তাকাল কোহেন দম্পতি। ড্যানের স্ত্রী তীক্ষ্ণ গলায় জানতে চাইল, ‘কারা এরা? আগে তো কখনো দেখিনি। সম্পত্তির নতুন ভাগীদার নয়তো?’
‘মামাবাড়ির আবদার নাকি?’ ফস করে বলে বসল জিমি।
‘আর বোলো না!’ বিরক্তি ফুটল লিজার চেহারায়। ‘আস্ত খচ্চর। দু-চার দিন পরপরই এসে হাজির হয়, ঘ্যানঘ্যান করে। একটা অসুস্থ মানুষকে যে এভাবে বিরক্ত করতে হয় না, কে বোঝাবে তাকে?’
‘ঘাড় ধরে বের করে দেন না কেন?’
‘পারলে তো দিতামই। কিন্তু মিসেস মার্সডেন বড্ড নরম মনের মানুষ, কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে চান না। আমাকে মানা করেছেন ওদের কিছু বলতে।’
‘খুব অন্যায়,’ মাথা নেড়ে বললেন ক্যাথারিন।
‘আপনারা ভেতরে আসুন।’ দরজা ছেড়ে দাঁড়াল লিজা। ‘আমি মিসেস মার্সডেনকে গিয়ে বলছি আপনাদের আসার কথা। দেখি, খচ্চরটাকেও তাড়ানো যায় কি না।’
বাড়ির ভেতরে ঢুকে দাঁড়াল ওরা, লিজা চলে গেল মিসেস মার্সডেনকে খবর দিতে। খানিক পরেই আবার দেখা মিলল তার, হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাকে অনুসরণ করে মাঝারি আকারের একটা ড্রয়িংরুমে ঢুকল অতিথিরা। দুই সেট সোফা, কয়েকটা শোকেস আর ফ্লোর ল্যাম্প দিয়ে সজ্জিত কামরাটা। মেঝেতে বিছানো হয়েছে দামি কার্পেট, দেয়ালে ঝুলছে কিছু ফটোগ্রাফ আর পেইন্টিং।
একটা সোফায় বসে আছেন সৌম্য চেহারার শুভ্রকেশী এক বৃদ্ধা। দেখলেই শ্রদ্ধা জাগে। পরনে সাদামাটা পোশাক। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেঁটে, মোটাসোটা এক লোক; পাশে তার রোগা শরীরের স্ত্রী। দুজনের চেহারাসুরতই বিতৃষ্ণা জাগানোর মতো। বিদায় নিতে উদ্যত তারা।
‘...আবারও বলছি,’ ড্যানকে বলতে শোনা গেল, ‘হয় সম্পত্তির ভাগ বুঝিয়ে দিন, নয়তো মাইকেলকে সরিয়ে সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্বটা দিয়ে দিন আমাদের। নইলে আমরা মামলা ঠুকব!’
‘যা খুশি করো,’ ক্লান্ত গলায় বললেন মিসেস মার্সডেন। ‘এখন যাও তো। মেহমান এসেছে, ওদের সামনে আর হইহল্লা কোরো না।’
সরু চোখে ক্যাথারিন আর অয়ন-জিমির দিকে তাকাল কোহেন দম্পতি। ড্যানের স্ত্রী তীক্ষ্ণ গলায় জানতে চাইল, ‘কারা এরা? আগে তো কখনো দেখিনি। সম্পত্তির নতুন ভাগীদার নয়তো?’
‘আমি একজন ডাক্তার, ম্যাম,’ বললেন ক্যাথারিন। ‘মিসেস মার্সডেনকে দেখতে এসেছি। ওনাকে এ অবস্থায় উত্তেজিত করা ঠিক নয়। আপনারা চলে গেলে ভালো হয়।’
অতিথিদের নিয়ে ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে এলেন বৃদ্ধা। লম্বা একটা করিডর পেরিয়ে চলে এলেন বাড়ির এক প্রান্তে। দরজা খুলে ঢুকলেন নিজের বেডরুমে। ভেতরে পা রেখে একটু থমকাল অয়ন। বেশ বড়সড় একটা বৃত্তাকার রুম। এই রুমটার কারণেই বাড়ির আকৃতি অমন বেঢপ হয়ে গেছে, বুঝতে পারল ও।
কয়েক মুহূর্ত আগুনঝরা চোখে তাকিয়ে রইল জামাই-বউ। শেষে ড্যান বলল, ‘ঠিক আছে, যাচ্ছি।’ তাকাল মিসেস মার্সডেনের দিকে। ‘তবে আবার আসব। আমাদের দাবির একটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত নিস্তার পাচ্ছেন না আপনি।’
স্ত্রীকে নিয়ে গটমট করে বেরিয়ে গেল সে।
‘কী অসভ্য রে, বাবা!’ নিচু গলায় মন্তব্য করল জিমি।
এবার বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে গেল লিজা। একে একে পরিচয় করিয়ে দিল অতিথিদের। স্মিত হেসে ওদের অভিবাদন জানালেন তিনি।
বললেন, ‘আমার চেকআপ করতে এসেছেন, ডাক্তার? লাভ কী? আমাকে বোধ হয় হাসপাতালেই ফিরে যেতে হবে।’
‘আগে আমাকে একটু দেখতে তো দিন,’ বললেন ক্যাথারিন। ‘আপনার ব্লাডপ্রেশার, পালস, সুগার...এসব চেক করব। ড্রয়িংরুমে হবে না। আপনার বেডরুম কোথায়? ওখানে চলুন।’
আপত্তি করলেন না বৃদ্ধা। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, চলুন। লিজা, এদের জন্য একটু চা-নাশতার ব্যবস্থা করো।’
‘আনছি,’ বলে চলে গেল লিজা।
অতিথিদের নিয়ে ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে এলেন বৃদ্ধা। লম্বা একটা করিডর পেরিয়ে চলে এলেন বাড়ির এক প্রান্তে। দরজা খুলে ঢুকলেন নিজের বেডরুমে। ভেতরে পা রেখে একটু থমকাল অয়ন। বেশ বড়সড় একটা বৃত্তাকার রুম। এই রুমটার কারণেই বাড়ির আকৃতি অমন বেঢপ হয়ে গেছে, বুঝতে পারল ও।
রুমের ঠিক মাঝখানে ঘুমানোর বিছানা। চারদিকে দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ওয়ার্ডরোব, রিডিং টেবিল ও চেয়ার, আলনা ইত্যাদি। কিছু ফুলের টবও রয়েছে, যাতে শোভা পাচ্ছে ঘরের ভেতরে রাখার উপযোগী ছোট ছোট গাছ। সামনে বড় একটা জানালা, সেখান দিয়ে চোখে পড়ে বাইরের সুন্দর দৃশ্য। একপাশে অ্যাটাচড বাথরুমের দরজা। দেয়ালের বাকি অংশ রঙিন ওয়ালপেপারে ঢাকা, তবে কোনো ছবি বা পেইন্টিং ঝোলানো নেই কোথাও।
ক্যাথারিনের অনুরোধে বিছানায় শুয়ে পড়লেন মিসেস মার্সডেন। সঙ্গে নিজের ডাক্তারি ব্যাগ নিয়ে এসেছেন ক্যাথারিন, সেখান থেকে বের করে আনলেন স্টেথিস্কোপ ও রক্তচাপ মাপার যন্ত্রসহ অন্যান্য জিনিস। খাটের পাশে রুমের চেয়ারটা এনে দিল জিমি, সেটায় বসে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বৃদ্ধাকে পরীক্ষা করতে।
খানিক দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল অয়ন আর জিমি, হঠাৎ ওদের দিকে তাকিয়ে মিসেস মার্সডেন বললেন, ‘ডাক্তার তো তার কাজ করছে...তোমরাও তোমাদেরটা শুরু করো!’
থতমত খেয়ে গেল দুই বন্ধু। জিমি বলল, ‘ইয়ে...আমরা কেন এসেছি, আপনি জানেন?’
‘লিজা বলেছে,’ মৃদু হেসে বললেন বৃদ্ধা। ‘কিন্তু সত্যিই কি তোমরা ভাবছ, যা ঘটছে তার পেছনে অন্য কারও হাত থাকতে পারে?’
‘আপনিই বলুন,’ বলল অয়ন। ‘কোনো শত্রু আছে আপনার?’
‘কই, না তো। হাসপাতালেই তো ছিলাম এতগুলো বছর। শত্রু তৈরি হবে কীভাবে?’
‘যাদের দেখলাম একটু আগে, তারা শত্রু নয়?’
‘ড্যান আর ওর বউয়ের কথা বলছ? আরে নাহ, শত্রু হতে যাবে কেন? স্বভাবচরিত্র ছোটলোকের মতো বটে, কিন্তু ওদের শত্রু ভাবি না।’
‘বদমাশ দুটোকে কেন যে আপনি পাত্তা দেন, বুঝি না,’ লিজার কণ্ঠ শোনা গেল। নাশতার ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকেছে সে। অতিথিদের হাতে কফির কাপ আর স্ন্যাকসের প্লেট তুলে দিতে দিতে বলল, ‘শুধু হুকুম করুন, ওদের এই বাড়িতে আর ঢুকতে দেব না।’
‘না, না, অত নিষ্ঠুর হতে পারব না,’ বললেন মিসেস মার্সডেন। ‘হাজার হোক, আমার স্বামীর পক্ষের আত্মীয়। অমন কিছু করতে গেলে আত্মীয়স্বজনের মাঝে দুর্নাম হবে আমার।’
‘কিন্তু ওদের দাবি কি যুক্তিসংগত?’ জানতে চাইল জিমি। ‘সত্যিই কি সম্পত্তির ভাগ পাবে ওরা?’
‘আইনের কথা যদি বলি...না, পাবে না। কিন্তু আমার স্বামীর সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল ড্যানের। সে জন্য আশা করেছিল, ও হয়তো উইল করে কিছু রেখে যাবে ওদের জন্য। বাস্তবে তা ঘটেনি। কোনো উইলই করেনি ডেভিড। তাই ওর মৃত্যুর পর সব সম্পত্তির মালিকানা আমি পেয়ে গেছি। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমার নিকটাত্মীয় হিসেবে মাইকেলকে কেয়ারটেকারের দায়িত্ব দেয় আদালত। কাজেই ওদিক থেকেও হতাশ হতে হয়েছে ড্যানকে। এখন চোটপাট দেখিয়ে যদি আমার কাছ থেকে কিছু আদায় করে নিতে পারে...এটাই ওর আশা।’
‘আপনাকে রাজি করানোর জন্য শয়তানি করতে পারে না?’
‘কী জানি। কিন্তু আমাকে পাগল বানিয়ে কী লাভ ওদের? তাতে তো সম্পত্তি পাবে না।’
‘হয়তো পাগল বানাতে চাইছে না,’ অনুমান করল জিমি। ‘ভয় দেখাতে চাইছে, যাতে ভয়ের চোটে নিজ থেকেই ওদের দাবি আপনি মেনে নেন।’
‘ওরা এতটা বাড়াবাড়ি করবে বলে তো মনে হয় না।’
‘সে ক্ষেত্রে অন্যদিকে নজর ফেরানো যাক,’ এবার বলল অয়ন। ‘ব্যক্তিগত জীবনে না হোক, ব্যবসায়িক জীবনে তো শত্রু থাকার কথা। আফটার অল, বিশাল একটা ব্যবসা রেখে গেছেন আপনার স্বামী।’
‘ব্যবসায়িক শত্রু নিশ্চয়ই আছে,’ স্বীকার করলেন মিসেস মার্সডেন। ‘সমস্যা হলো, তাদের কাউকেই আমি চিনি না। গত পাঁচ বছর হাসপাতালে ছিলাম। তার আগেও ডেভিডের ব্যবসায় আমি কখনো নাক গলাইনি। নিজের মতো থেকেছি।’
‘না চিনুন, কিন্তু আপনি ফিরে আসায় তাদের শঙ্কিত হবার মতো কি কিছু আছে?’
একটু ভাবলেন বৃদ্ধা। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, সে সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। কদিন আগেই মাইকেলকে বলেছিলাম, যত শিগগির সম্ভব আমি অফিসে যেতে চাই, ব্যবসাটা বুঝে নিতে চাই। ও-ও তা-ই চাইছিল। এটা তো জানা কথা, আমি দায়িত্ব নিলে কারও কারও অসুবিধা হবে। এত দিন সব যেভাবে চলেছে, সেভাবে হয়তো চলবে না।’
সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল অয়ন। ‘এই তো একটা ক্লু পাওয়া গেল। এখন শুধু খুঁজে দেখতে হবে, অমন শত্রু আপনার কজন আছে।’
‘তাতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, অয়ন,’ বলল লিজা। ‘অদ্ভুত যেসব ঘটনা ঘটছে, তার ব্যাখ্যা কী? কীভাবে ঘটানো হচ্ছে ওসব?’
‘ঠিক কী কী ঘটছে, একটু খুলে বলবেন?’ অনুরোধ করল অয়ন।
‘ডেভিড...মানে আমার স্বামীর গলা শুনতে পাই রাতের বেলায়,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন মিসেস মার্সডেন। ‘সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর দেখি, ঘরের আসবাব এদিক-সেদিক সরে গেছে। ধরো জানালার দিকে পা দিয়ে ঘুমালাম, সকালে দেখি পা চলে গেছে দরজার দিকে...নড়ে গেছে পুরো বিছানাটাই। কাউকে যদি ডেকে এনে দেখানোর চেষ্টা করি, তখন আবার সব আগের মতো হয়ে যায়।’
‘শুধু বিছানাই নড়ে, নাকি অন্য ফার্নিচারগুলোও?’
‘সবই সরে যায়, অয়ন। ফার্নিচার, ফুলের টব...সব।’
‘অথচ আপনি কিছু টের পান না?’
মাথা নাড়লেন বৃদ্ধা।
লিজা বলল, ‘বুঝতেই পারছ, এসব একেবারেই অসম্ভব। যদি ধরেও নিই, রাতের বেলা ওনার ঘুমের মধ্যে জিনিসপত্র সরিয়ে রাখা হয়, সকালে অত অল্প সময়ে আবার ঠিক করে কীভাবে? এত সব ফার্নিচারের ওজন তো কম না। অন্তত আট-দশজন লোক লাগবে এসব নাড়াচাড়া করতে।’
‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা জটিল,’ স্বীকার করল অয়ন। ‘শুধু ভুতুড়ে কণ্ঠস্বর হলে সহজে ব্যাখ্যা করা যেত। কিন্তু ঘর এলোমেলো হওয়াটা...আচ্ছা, অন্য কোনো কামরায় থাকলেও কি একই অভিজ্ঞতা হয় আপনার? মানে, রোগটা যদি মনের হয়ে থাকে, তাহলে তো অন্য জায়গাতেও আপনার হ্যালুসিনেশন হবে।’
লিজার সঙ্গে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন মিসেস মার্সডেন। তারপর বললেন, ‘ইয়ে...সেটা তো পরীক্ষা করে দেখিনি। আসলে এই বাড়িতে বাড়তি কোনো কামরা নেই। একটামাত্র গেস্টরুম, তাতে লিজা থাকে। হাসপাতাল থেকে আসার পর আমি এই রুমেই থাকছি। রুমটা বিশেষভাবে আমার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।’
‘হ্যাঁ, সেটা লক্ষ করেছি,’ বলল অয়ন। ‘পুরো বাড়িতে এই একটা রুমই শুধু গোল। বিশেষ কোনো কারণ আছে তার পেছনে?’
‘তেমন কিছু না। গোল কামরা অনেক বেশি খোলামেলা দেখায়। তা ছাড়া জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্যও অনেক বেশি চোখে পড়ে। মন প্রফুল্ল রাখার জন্য নাকি কাজে দেয় এসব—আমাকে এমনটাই বলেছে মাইকেল।’
‘হুম।’
‘নাহ্, কোনো কারসাজি নেই,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল জিমি। ‘ফুলের টব আর চেয়ার-টেবিল সহজে সরানো যাবে, চেষ্টা করলে ড্রেসিং টেবিলটাও হয়তো কষ্টেসৃষ্টে নড়ানো যায়...কিন্তু বাকি জিনিসগুলো সম্ভব না। প্রচুর সময় আর লোকবল লাগবে।’
‘তোমাদের এই জিজ্ঞাসাবাদ একটু থামাবে?’ বেরসিকের মতো বললেন ক্যাথারিন। ‘কাজ করতে অসুবিধে হচ্ছে আমার।’
‘ঠিক আছে,’ বলল অয়ন। ‘আমরা নাহয় এই ফাঁকে রুমটা একটু পরীক্ষা করে দেখি।’
জিমিকে নিয়ে রুমের এক প্রান্তেও চলে এল ও।
‘কী ভাবছিস?’ জানতে চাইল জিমি। ‘এখনো কি তোর ধারণা, কেউ শয়তানি করছে মিসেস মার্সডেনের সঙ্গে?’
‘এখন বরং আরও দৃঢ় হয়েছে ধারণাটা,’ বলল অয়ন। ‘ওনার কথাবার্তা তো শুনলি। মানসিক রোগীদের মতো লেগেছে?’
‘উঁহু,’ মাথা নাড়ল জিমি। ‘একদম স্বাভাবিক কথাবার্তা। কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না কিছুই। অদ্ভুত ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটছে?’
‘ভুতুড়ে কণ্ঠস্বরের ব্যাখ্যা খুব সহজ। ওনার স্বামীর গলা নকল করে, কিংবা পুরোনো কোনো অডিও হয়তো বাজানো হচ্ছে রাতের বেলায়। কিন্তু ফার্নিচার নড়ার ব্যাপারটা সত্যিই কঠিন। আয়, চেক করে দেখি, ওগুলো সহজে নড়ানোর কোনো কায়দা আছে কি না।’
‘কী কায়দা?’
‘হয়তো চাকাটাকা লাগানো আছে তলায়, অথবা অন্য কোনো কৌশল খাটানো হয়েছে। আমি এদিকটা দেখছি, তুই ওদিকে যা।’
রুমে দুই ধারে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল দুই বন্ধু। প্রতিটি ফার্নিচারের তলা চেক করছে, টানাটানি করছে, খুঁটিয়ে দেখছে মেঝে। ফুলের টবগুলোও বাদ গেল না। ক্লান্ত হয়ে একসময় মুখোমুখি হলো দুজন।
‘নাহ্, কোনো কারসাজি নেই,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল জিমি। ‘ফুলের টব আর চেয়ার-টেবিল সহজে সরানো যাবে, চেষ্টা করলে ড্রেসিং টেবিলটাও হয়তো কষ্টেসৃষ্টে নড়ানো যায়...কিন্তু বাকি জিনিসগুলো সম্ভব না। প্রচুর সময় আর লোকবল লাগবে।’
‘আমারও তা-ই মনে হচ্ছে,’ সায় জানাল অয়ন। ‘কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা পেলাম না।’
‘আমি অবশ্য একটা পেয়েছি,’ বলল জিমি। ‘তবে তার সঙ্গে ফার্নিচারের কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘কী পেয়েছিস?’
‘এদিকে আয়।’
একটা টব সরিয়ে উবু হলো জিমি। আঙুল তুলে দেখাল। ‘দেয়াল আর ফ্লোরের জয়েন্টটা দেখ।’
‘কোথায় জয়েন্ট?’ ভ্রুকুটি করল অয়ন।
‘সেটাই তো দেখাচ্ছি। দেয়ালটা ফ্লোরের সঙ্গে মিশে যায়নি। সামান্য ফাঁকা আছে, দেখতে পাচ্ছিস না?’
ভালো করে তাকাল অয়ন। ভুল বলেনি জিমি, সত্যিই কয়েক মিলিমিটার ফাঁক দেখা যাচ্ছে দেয়াল আর মেঝের সংযোগস্থলে। ঠোঁট কামড়ে কয়েক মুহূর্ত ভাবল ও, এরপরই দুচোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর। তাড়াতাড়ি রুমের আরও দুই জায়গায় গিয়ে চেক করল। সবখানেই ওই একই রকম ফাঁক। জিমির পিঠ চাপড়ে দিল ও। বলল, ‘শাবাশ! কাজের কাজ করেছিস একটা!’
জিমির কপালে ভাঁজ পড়ল। ‘ঠিক শুনছি তো? তুই কি আমার প্রশংসা করলি?’
‘কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না?’
‘না, মানে...সব সময় তো গালাগালি করিস।’
‘ভালো কিছু করলে প্রশংসা করব না কেন? গালি তো দিই গাধামি করলে।’
‘কী!’ চোখ লাল করল জিমি। ‘আমি গাধামি করি? এক ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দেব, শালা!’
‘আরে, আরে, খেপিস কেন? ভালো কাজ দেখালি, এখন তো খুশি হবি।’
‘কী যে করলাম, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’
‘পরে বোঝাচ্ছি। আগে শিওর হয়ে নিই।’
চেকআপ শেষ হয়েছে মিসেস মার্সডেনের। জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে ক্যাথারিন বললেন, ‘শারীরিক কোনো সমস্যা নেই আপনার। সবই নরমাল। ব্লাডপ্রেশারটা শুধু একটু বেশি, সেটা সম্ভবত টেনশনের কারণে।’
‘মানসিক সমস্যা?’ জানতে চাইল লিজা।
‘বিশেষজ্ঞরা সেটা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি যত দূর দেখলাম, ওনাকে তো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।’
‘তাহলে রাতবিরাতে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে কেন?’
কাঁধ ঝাঁকালেন ক্যাথারিন। জবাবটা তাঁর জানা নেই।
অয়ন এগিয়ে এল। বলল, ‘এবার আমি আরও কয়েকটা প্রশ্ন করি?’
‘কী জানতে চাও?’ বললেন মিসেস মার্সডেন।
‘ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো হওয়ার ব্যাপারটা। ঠিক কীভাবে এলোমেলো হয়? ফার্নিচারগুলো কি উল্টেপাল্টে থাকে? কিংবা এক জায়গায় জড়ো হয়?’
‘না,’ মাথা নেড়ে জানালেন বৃদ্ধা। ‘দেয়ালের পাশেই থাকে; কিন্তু যেটা যেখানে থাকার কথা, সেখানে থাকে না।’
‘সিরিয়াল ঠিক থাকে? নাকি উল্টোপাল্টা হয়?’
‘মানে?’
‘বলতে চাইছি, যেটার পাশে যেটা এ মুহূর্তে আছে...ধরুন আলমারিটার পাশে ড্রেসিং টেবিল, তারপর একটা টব দেখতে পাচ্ছি...এলোমেলো হওয়ার পর কি এই সিরিয়ালটা ঠিক থাকে, নাকি উল্টেপাল্টে যায়?’
‘তা তো খেয়াল করিনি।’
‘পরেরবার খেয়াল করবেন।’
‘তুমি কি কিছু বুঝতে পেরেছ, অয়ন?’ জিজ্ঞেস করলেন ক্যাথারিন।
‘ছোট্ট একটা সন্দেহ, আন্টি,’ বলল অয়ন। ‘শিওর না হয়ে বলতে চাইছি না।’ লিজার দিকে তাকাল। ‘বেজমেন্টটা কোথায়? আমাদের একটু দেখিয়ে দেবেন?’
‘এ বাড়িতে কোনো বেজমেন্ট নেই,’ জানাল লিজা। ‘বানানোই হয়নি।’
‘সেকি! কেন?’
‘জানি না। বেজমেন্টের বদলে ওপরতলাতেই একটা স্টোররুম বানানো হয়েছে, সেখানে স্টোরেজের সব মালামাল রাখা হয়।’
কপালের ভাঁজ গভীর হলো অয়নের। জানালার কাছে হেঁটে গেল ও। তাকাল বাইরে। কয়েক মুহূর্ত পর প্রশ্ন করল, ‘ওই কটেজটায় কে থাকে?’
গতকাল যে দুটো লিপস্টিক কিনেছিলেন ক্যাথারিন, সেগুলো এখনো রয়ে গেছে পার্সে। একটা বের করে দিলেন তিনি। সেটা নিয়ে দেয়ালের কাছে গেল অয়ন। টব সরিয়ে দুই জায়গায় লম্বা দুটো রেখা আঁকল লিপস্টিক দিয়ে—দেয়ালের নিচের অংশ থেকে শুরু করে মেঝে পর্যন্ত গেল রেখা দুটো। কাজ শেষে টব দুটো আবার রেখে দিল আগের জায়গায়।
‘কেউ না,’ বলল লিজা। ‘সার্ভেন্টস কোয়ার্টার হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। আপাতত খালি। বাড়িতে চাকরবাকর নেই কিনা। একটা ক্লিনিং সার্ভিসের সঙ্গে চুক্তি করা আছে, সপ্তাহে তিন দিন লোক এসে বাড়ির ভেতর আর বাইরে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। রান্নাবান্না আর ধোয়াধুয়ির কাজটা আমরা নিজেরাই করি।’
‘কটেজের ভেতরটা কি দেখা যাবে?’
‘তালা দেওয়া। চাবি মি. বেনেটের কাছে। স্পেয়ার একটা চাবি থাকার কথা...খুঁজে দেখতে হবে। বেশি জরুরি?’
‘না। তবে চাবিটা খুঁজে রাখবেন। কাজে লাগতে পারে।’ আবার ঠোঁট কামড়াতে শুরু করল অয়ন। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘একটা চক দিতে পারেন?’
‘চক? কেন?’
‘একটা এক্সপেরিমেন্ট করব।’
‘সরি, অয়ন, চক নেই বাড়িতে।’
ক্যাথারিনের দিকে ফিরল অয়ন। ‘আপনার কাছে লিপস্টিক আছে, আন্টি? লিপস্টিক হলেও চলবে।’
গতকাল যে দুটো লিপস্টিক কিনেছিলেন ক্যাথারিন, সেগুলো এখনো রয়ে গেছে পার্সে। একটা বের করে দিলেন তিনি। সেটা নিয়ে দেয়ালের কাছে গেল অয়ন। টব সরিয়ে দুই জায়গায় লম্বা দুটো রেখা আঁকল লিপস্টিক দিয়ে—দেয়ালের নিচের অংশ থেকে শুরু করে মেঝে পর্যন্ত গেল রেখা দুটো। কাজ শেষে টব দুটো আবার রেখে দিল আগের জায়গায়।
উঠে দাঁড়াল ও। ক্যাথারিনকে লিপস্টিকটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ব্যস, এতেই চলবে।’ লিজার দিকে তাকাল। ‘দাগ দুটো মুছবেন না। পরে আবার চেক করে দেখতে হবে। কখন, সেটা আমি জানাব।’
‘কী এক্সপেরিমেন্ট করছ, জানতে পারি?’ জিজ্ঞেস করলেন মিসেস মার্সডেন।
‘এখনো বলার সময় আসেনি। আমার থিওরি ভুলও হতে পারে।’
‘কী থিওরি?’
জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে হাসল অয়ন।
‘জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, ম্যাম,’ বলল জিমি। ‘বলতে না চাইলে পেটে বোমা মেরেও লাভ নেই। এটাই ওর স্বভাব।’
‘আর কোনো এক্সপেরিমেন্ট করতে চাও?’ জানতে চাইলেন ক্যাথারিন। ‘নইলে বাড়ি ফিরতে চাই। এখানে আমার কাজ শেষ।’
‘আমাদের তদন্তও আপাতত শেষ,’ বলল অয়ন। একটা কাগজে নিজের সেলফোন নম্বর লিখে দিল লিজাকে। ‘আবার যদি হ্যালুসিনেশন হয় মিসেস মার্সডেনের, জানাবেন আমাকে।’
লিজা ও বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিল ওরা। বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। গাড়িতে চড়ে ফিরতি পথ ধরল।
‘এবার তো বল, কী বুঝলি ওখান থেকে,’ বন্ধুকে অনুরোধ করল জিমি।
মাথা নাড়ল অয়ন। ‘স্রেফ একটা থিওরি...এখুনি বলার মতো না। আগে অকাট্য প্রমাণ পেয়ে নিই।’
‘সেই প্রমাণ কখন পাওয়া যাবে?’
‘দেরি হবে না। নিশ্চিত থাক, খুব শিগগির আবারও এখানে আসতে হবে আমাদের।’
চলবে...