আইজ্যাক আসিমভের বিজ্ঞান কল্পগল্প 'প্রিয় বন্ধু'
‘জিমি, কোথায় তুই?’
‘খাদে গেছে,’ ছেলের হয়ে জবাব দিলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। ‘চিন্তা করো না, রোবাট আছে ওর সঙ্গে। এসেছে নাকি ওটা?’
‘হ্যাঁ, এসে পড়েছে। আপাতত রকেট স্টেশনে রেখে পরীক্ষা করা হবে। সামনাসামনি কখন যে দেখব! ১৫ বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে আসার পর আর দেখিনি। ছবি দেখে বাস্তবতা অনুভব করা যায় না।’
‘আর আমাদের জিমির তো এ ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই,’ মিসেস অ্যান্ডারসনের কণ্ঠেও আবেগের ছোঁয়া।
‘ওর জন্মই তো চাঁদে। পৃথিবীতে যায়নি কখনো। এ জন্যই ওটাকে এখানে নিয়ে এসেছি। এর আগে এ রকম কিছু চাঁদে আসেনি।’
‘খরচও হয়েছে প্রচুর,’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মিসেস অ্যান্ডারসন।
‘রোবাটের পেছনে কি আমরা কম খরচ করি?’ মি. অ্যান্ডারসন বললেন।
***
মা যে রকমটা বলেছে, জিমি আসলেই খাদে ছিল। চাঁদের খাদগুলোকে অবশ্য এখানে ক্রেটার বলা হয়। পৃথিবীর ১০ বছর বয়সী বাচ্চাদের তুলনায় ও বেশ লম্বা। হাত-পাগুলো সরু, প্যাকাটে। স্পেসস্যুট পরলে অবশ্য বেশ স্বাস্থ্যবান মনে হয়। কিন্তু পৃথিবীবাসীর তুলনায় চাঁদের মাধ্যাকর্ষণে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারে ও। কোনো সমস্যা হয় না। একসঙ্গে হাঁটার সময় হাঁপিয়ে ওঠে বাবা। অনেকটাই ক্যাঙারুর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলে জিমি।
এই খাদের বাইরের দিকটা অনেকটাই দক্ষিণ দিকে হেলানো। এ কারণে পৃথিবীর আকাশটাও নিচু মনে হয় (চাঁদের সব শহর থেকেই অবশ্য এমন দেখায়)। দূর পৃথিবীর আভা ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে, তাই খাদের ভেতরটাও ঈষৎ আলোকিত।
ঢালটা মৃসণ হওয়ায় স্পেসস্যুট পরেও উঠতে কষ্ট হলো না জিমির। একদম ভেসে ভেসে বেরিয়ে এল সে। দেখে মনে হবে বুঝি মাধ্যাকর্ষণ একদমই নেই।
‘রোবাট, এদিকে আয়,’ জোরে ডাকল ও। রেডিও মাধ্যমে ওর ডাক শুনতে পেল রোবাট। লাফিয়ে চলে এল কিছুক্ষণের মধ্যে।
রোবাট জিমির চেয়ে ক্ষিপ্রগতির, তার স্পেসস্যুটের দরকার পড়ে না। রোবাটের পা চারটি। স্টিলের তৈরি। জিমির মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল রোবাট। ডিগবাজি খেয়ে এসে থামল জিমির পায়ের কাছে।
‘এখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই তোর বাহাদুরি দেখার, রোবাট। ছাড় এসব।’ জিমি বলল, ‘চোখের আড়াল হবি না।’
ডেকে উঠল রোবাট, বিশেষ একধরনের ডাক যার অর্থ, ‘আচ্ছা।’
‘তোকে বিশ্বাস নেই আমার।’ চেঁচিয়ে বলল জিমি। এরপর এক লাফে উঠে পড়ল খাদের চূড়ায়।
খানিক বাদে আড়ালে ডুব দিল পৃথিবী। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ঘনাল চারদিকে। চাঁদের মাটি এবং আকাশের মধ্যে এখন গভীর অন্ধকার। মিটমিটে তারার দল আছে অবশ্য।
খাদের অন্ধকার দিকটায় আসলে যাওয়ার কথা নয় জিমির। প্রতিদিন এ সময় এক্সারসাইজের জন্য বের হয় ও। সে জন্য ওদিকটায় যাওয়ার দরকার নেই। বড়রা বলে কাজটা বিপজ্জনক। কিন্তু জিমি জানে যে ভেতরে মাটি মসৃণ। প্রতিটি পাথরের সঠিক অবস্থান জানা আছে ওর।
তা ছাড়া রোবাট সঙ্গে থাকলে অন্ধকার ভয় পায় না জিমি। সে ওর চারপাশে লাফাবে, ঘেউ ঘেউ করে ডাকবে। জ্বলতে থাকতে জ্বলজ্বল করে। এমনকি যদি না-ও জ্বলে, রোবাট ঠিকই নিজের রাডারের মাধ্যমে সে এবং জিমি কোথায় আছে, তা জানিয়ে দিতে পারবে। রোবাট আশপাশে থাকলে জিমি কখনো উল্টোপাল্টা কিছু করে না। মাঝেমধ্যে রোবাট একটা বড় পাথর দেখে পেছনে গিয়ে লুকায়। লাফাতে লাফাতে জিমিকে ঘিরে ডাক ছাড়ে। চারপাশে ঘুরঘুর করে। আবার জিমি যখন পাথরের আড়ালে লুকাবে, তখন যদি বুঝতে পারে যে ও কোথায় আছে, পেছন থেকে সন্তর্পণে এসে ভয় দেখাবে।
একদিন জিমি রোবাটের সামনে অভিনয় করে যেন ব্যথা পেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রোবাট রেডিও অ্যালার্ম বাজিয়ে দেওয়ায় লোকজন ছুটে এসেছিল লুনার সিটি থেকে। জিমির বাবা ভীষণ বকুনি দিয়েছিলেন এই কাজের জন্য। এরপর থেকে জিমি আর এমন কিছু করেনি।
আনমনে এসবই ভাবছিল জিমি, এমন সময় হেডফোনে শুনতে পেল, ‘বাসায় আসো, জিমি। জরুরি কথা আছে।’
***
বাড়ি ফিরে স্পেসস্যুট খুলে হাতে–মুখে পানি দিল জিমি। বাবার কড়া নির্দেশ—বাইরে থেকে আসার পর হাত–মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হতে হবে। এমনকি রোবাটকেও স্প্রে করে পরিষ্কার করা হয়। এটা রোবাটের ভীষণ পছন্দের। যখন রোবাটকে স্প্রে করা হয়, তখন সে চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। ফুটখানেক লম্বা শরীরটা কাঁপতে থাকে। হালকা আলো নিঃসৃত হয় শরীর থেকে। মুখবিহীন ছোট মাথায় বসানো বড় বড় দুটি গ্লাসের চোখ জ্বলজ্বল করে। রোবাটের ব্রেন যেখানে, সেখানটা হালকা উঁচু। ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না মি. অ্যান্ডারসন কড়া সরে বলবেন, ‘চুপ করো, রোবাট।’
মি. অ্যান্ডারসনের মুখে হাসি। ‘তোমার জন্য একটা জিনিস আনা হয়েছে, জিমি। এখন রকেট স্টেশনে আছে ওটা। তবে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আগামীকাল আমাদের হাতে এসে পৌঁছাবে। তোমাকে এখন বলা যায় কথাটা।’
‘পৃথিবী থেকে এসেছে, বাবা?’
‘হ্যাঁ, আব্বু। একটা জীবন্ত কুকুরছানা। স্কচ টেরিয়ার জাতের। চাঁদে আসা প্রথম কুকুর। তোমার আর রোবাটের দরকার হবে না। আসলে দুটি কুকুর একসঙ্গে রাখতে পারব না আমরা। অন্য কোনো বাচ্চাকে দেওয়া হবে ওকে।’ জিমি কিছু বলবে ভেবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন তিনি। এরপর আবার বললেন, ‘জিমি, তুমি তো জানো কুকুর কী। একদম রক্তমাংসের প্রাণী। আর রোবাট হলো যান্ত্রিক ডুপ্লিকেট মাত্র। এ কারণেই ওর নাম রোবাট।’
জিমি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘রোবাট একদম আসল, বাবা। ডুপ্লিকেট না। ও আমার কুকুর।’
‘আসল কুকুর তো নয়, জিমি। রোবাট হচ্ছে স্টিলের তৈরি। ভেতরে তারবোঝাই। ব্রেনটা পজিট্রনিক। ও নিষ্প্রাণ।’
‘আমি যেভাবে যা চাই, ও সেভাবেই আচরণ করে বাবা। আমাকে বোঝে। ও একদম জীবন্ত।’
‘না, আব্বু। রোবাট একটি রোবট। ওকে প্রোগ্রামই করা হয়েছে ওভাবে কাজ করার জন্য। আর আসল কুকুরের ব্যাপারটাই আলাদা। সেটা এসে পড়লে তুমিই আর রোবাটকে চাইবে না।’
‘কুকুরটার তো স্পেসস্যুট লাগবে, তাই না?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিছুটা বাড়তি খরচ হলেও একটা কুকুর কাছে থাকলে সেটা বাড়তি ঝামেলা মনে হবে না। তা ছাড়া শহরের ভেতরে ঘুরতে তো আর সমস্যা হবে না। ওকে দেখলে রোবাটের সঙ্গে ওর পার্থক্যটা বুঝতে পারবে।’
রোবাটের দিকে তাকায় জিমি। নিচু স্বরে ধীরে ধীরে ডাকছে ও। ভয় পাচ্ছে খুব সম্ভবত। জিমি হাত বাড়াতেই একলাফে উঠে পড়ল কোলে। ‘রোবাট এবং জীবন্ত কুকুরের মধ্যে পার্থক্যটা কী?’ জানতে চায় জিমি।
‘সেটা ব্যাখ্যা করা কঠিন,’ মি. অ্যান্ডারসন বলেন। ‘কিন্তু তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। কুকুরটা সত্যি সত্যি ভালোবাসবে তোমাকে। রোবাট তোমাকে ভালোবাসে, কারণ ওটাকে ওভাবেই তৈরি করা হয়েছে।’
‘কিন্তু বাবা আমরা তো আর কুকুরটার অনুভূতি জানতে পারব না। অথবা সে কী ভাবছে, এটাও বুঝব না। এমনও তো হতে পারে সে-ও অভিনয়ই করছে।’
ভ্রু কুঁচকে ফেললেন মি. অ্যান্ডারসন। ‘জিমি, ভালোবাসা কী জিনিস, সেটা তুমি বুঝতে পারবে যখন জীবন্ত একটা কুকুর পুষতে শুরু করবে।’
রোবাটকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল জিমি। ওর কপালেও ভাঁজ। চেহারার কাঠিন্যে এটা স্পষ্ট যে মত পরিবর্তন করবে না। ‘কিন্তু ওদের আচরণের পার্থক্যে কী আসে–যায়? আমার অনুভূতিটাই তো আসল, তাই না? আমি রোবাটকে ভালোবাসি, আর সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
ছোট্ট রোবাটকে এর আগে এত শক্ত করে জড়িয়ে ধরেনি কেউ। উঁচু স্বরে ডাকতে শুরু করল সে।
ডাকটা আনন্দের।