গজনি রহস্য
শিবিরময় নিস্তব্ধতা। চারদিকে জ্বলছে মশাল। তাঁবুর বাইরে কড়া পাহারা। এর মধ্যে ইতস্তত চলাফেরা করছে কোনো কোনো সৈন্য। সতর্ক পদক্ষেপ তাদের। কেননা এরই মধ্যে সবাই জেনে গেছে, মোগল শিবিরে ঘটে চলেছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। খুনের শিকার হয়েছে শাহজাদা দারা শুকোহর অন্যতম দেহরক্ষী আমিন খাঁ বাদাখশানি।
এ সকালের ঘটনা। কান্দাহার অভিযানের দ্বিতীয় মাস। গজনিতে যাত্রাবিরতি করেছে শাহি সৈন্যদল। পাঁচ দিন হলো শাহজাদা এখানে যাত্রাবিরতি করেছেন। পুরো শিবিরে শ খানেক তাঁবু বসানো হয়েছে। এর মধ্যখানে আছে শাহজাদার তাঁবু। দুই মহলা তাঁবুর রং লাল। তার তাঁবুকে ঘিরে আছে আরও আটটি তাঁবু। এসব তাঁবুতে বাস করছেন আলী মর্দান খাঁ, বুলন্দ সরফরাজ খাঁ, সফিউদ্দিন মোরাদাবাদি, উলুঘ খাঁ ও অন্যরা। এঁরা সবাই মোগল বাদশাহর বিশ্বস্ত সেনাপতি। তবে হালফিল১ সরফরাজ খাঁর সঙ্গে নানা সময় মতবিরোধ ঘটছে শাহজাদার।
১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ। সিংহাসনে বাদশাহ শাহজাহান। পৃথিবীর অধীশ্বর। মোগল বাদশাহির স্বর্ণযুগ চলমান—এ কথা সবাই বলছে। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে চলেছে বেশ কিছু ঘটনা। যেমন রাজকোষে পড়ছে টান। বাদশাহ অবশ্য সে বিষয়ে চিন্তিত নন। তাঁর চিন্তা বিস্তৃত মোগল বাদশাহিকে একীভূত অবস্থায় রক্ষা করা। তাঁর আরেক স্বপ্নের নাম কান্দাহার। সেই কান্দাহার আবার হাতে এসেছে খুব সহজে।
কিন্তু তাতে আক্রমণের সম্ভাবনা কমে না। কেননা পশ্চিম হতে পারস্য শকুনের দৃষ্টি দিয়ে রাখছে কান্দাহারে। আলী মর্দান খাঁ কান্দাহার অর্পণ করেছিলেন স্বার্থে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, যেকোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই মোগল বাদশাহর ছত্রচ্ছায়াই উপকারী মনে করেছিলেন তিনি। অবশ্য ভরসা করতে পারেননি শাহজাহান। কেননা উত্তরে বিদ্রোহ করছে নানা উপজাতি। সেই কারণেই প্রিয় পুত্র দারা শুকোহকে পাঠিয়েছেন কান্দাহারে।
এই প্রথম কোনো বড় দায়িত্ব নিয়ে অভিযান করছেন দারা। তাই হরবখত২ এক দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত। শিবিরে সুগন্ধি শামা৩ জ্বেলে তিনি চেষ্টা করছেন মনকে একীভূত করতে। তাঁর সামনে উপনিষদের একটি নকল। তিনি এটি সংগ্রহ করেছেন জলন্ধর থেকে। দিল্লিতে থাকতেই শুনেছিলেন বাবা কাশেম বাদাখশানির কাছে আছে উপনিষদের একটি পুরোনো হাতে লেখা পুঁথি। সে কথা জেনেই খোদ যাত্রা করেছিলেন জলন্ধর। দরবেশের খানক্বাহ্য়৪ বসে নিজ হাতে নাস্তালিক লিপিতে লিখেছিলেন সেটি। এ মুহূর্তে নকলটির একটি পৃষ্ঠায় নজর রাখেন দারা। কিন্তু চিন্তাস্রোত বয়ে যায় অন্য খাতে।
দারা মুহূর্তমাত্র সময় নিলেন। তারপর বললেন, ‘পোশাক বদলে দিন। রাজপুতদের মতো জোব্বা পরতে বলুন। তারপর ওই সেনাদের মধ্যে গিয়ে কাজ করতে বলুন। সন্দেহ করি, উত্তরের ওই শিবিরের পাহারাদারকে হত্যা করে কোনো প্রকারে শিবিরে প্রবেশ করেছে শত্রু। আর আমার ইয়াকিন১২ হলো তাদের সাহায্য করেছে আমাদেরই শিবিরের কেউ।’
চার রোজ আগে যখন পাহারার এক সৈন্য মারা গেল, সবার ধারণা হয়েছিল অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে মারা গেছে সে। লাশটি পড়ে ছিল শিবিরের সীমানা থেকে কিছুটা অন্দরে। তার পাশে ছিল সুরার পাত্র। যদিও কাগজে–কলমে সুরা নিষিদ্ধ, দারা শুকোহ জানেন সুরা ছাড়া এই রকম যুদ্ধে বহু সৈন্য টিকে থাকতে পারে না। সে কারণে সুরার আগমন নিষেধ করেন না তিনি। তবে এই দফায় কোনো সাকি৫ আনেননি দারা। অনুমতিও দেননি আনার।
রাজপুত সৈন্যটির মৃত্যু সহজভাবেই গ্রহণ করেছিল সবাই। কারও মধ্যে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। হাকিম অবশ্য তাঁর লাশ পরীক্ষা করে বলেছিলেন, ‘সুরার সঙ্গে অন্য কোনো বস্তু মেশানো হয়নি। সুরার সুবাস থেকেই তা বোঝা যায়।’
‘জেহের?’, প্রশ্ন করেছিলেন দারা শুকোহ। ফের নিজেই বলেছিলেন, ‘কিন্তু জেহের৬ হলে তো ঠোঁট বা মুখের কোনো অংশের রং বদলের কথা।’
সেই কথায় মাথা ঝাঁকিয়েছিলেন হাকিম মুদাসসর বুখারি। দারা আন্দাজ করে নিলেন, এ মৃত্যু নিয়ে হাকিমের তেমন কোনো কৌতূহল নেই। তিনিও খুব একটা বোধ করলেন না। আর সেই সময় আহাদি এসে বলেছিল, ‘গোস্তাকি৭ মাফ, শাহজাদা। কিন্তু আপনার জন্য জরুরি খত৮ আছে।’
‘কার খত?’, প্রশ্ন করেছিলেন দারা। আহাদি সসম্ভ্রম মস্তক ঝুঁকিয়ে বলেছিল, ‘দিল্লি থেকে মহান মোগল সাম্রাজ্যের হাজির–নাজির বাদশাহ, বাদশাহ সালামত শাহজাহান খত পাঠিয়েছেন শাহজাদাকে।’
কোনো নির্দেশনা নয়, মূলত দারার কুশল সম্বন্ধেই আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন বাদশাহ। খত হাতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন দারা। সেই কারণেই জেহেন৯ থেকে হারিয়েছিল একটি সদ্য মৃত্যুর ঘটনা।
উপনিষদের পৃষ্ঠায় নজর রেখে দারা চিন্তা করেন, সে রোজই কোনো ব্যবস্থা নিলে এ ঘটনা ঘটত না। আমিন খাঁ বাদাখশানি দারা শুকোহর কেবল সিপাহসালারই নন, বন্ধুও। যদিও আমিন খাঁ সুফি তরিকা বোঝে না, উপনিষদ বোঝে না, কিন্তু দারার সত্য সন্ধানে সমর্থন দেয়। সেই কারণে আমিনের সঙ্গে বহু সময় ব্যয় করেছেন দারা। এমনকি এই শিবিরের কোন স্থানে কোন সেনার তাঁবু বসানো হবে, সেই পরিকল্পনাও আমিনের করা। সে কথা চিন্তা হতেই দারা শুকোহর মধ্যে নতুন এক আশঙ্কা তৈরি হয়। তিনি তাঁবুর বাইরে উপস্থিত আহাদিকে নির্দেশ দিলেন দ্রুত যেন সরফরাজ খাঁকে শাহজাদা সকাশে১০ আসার নির্দেশ প্রদান করা হয়।
সেই মোতাবেক দ্রুততম সময়ের মধ্যে উপস্থিত হলেন সরফরাজ। বললেন, ‘শাহজাদা, এই অসময়ে তলব করেছেন, তার মানে জরুরি কোনো বিষয়। আদেশ করুন।’
দারা লক্ষ করলেন বুজুর্গ এই পাঠানের সঙ্গে তাঁর যতই মতবিরোধ হোক, হুকুম করামাত্র তামিলে উপস্থিত হয় সে। পাঠানদের এই রকম আচরণ পছন্দ করেন বাদশাহ শাহজাহান। যদিও প্রপিতামহ আকবর নাকি বলেছিলেন, পাঠানেরা উচ্চতায় দীর্ঘ হলেও বুদ্ধিতে বামন। সেই সঙ্গে তিনি সতর্ক করেছিলেন গুজরাটিদের বিষয়ে। কখনো কখনো দারার মনে হয়, এ সবার অর্ধেক কথা মূলত আবুল ফজলের।
সে যা–ই হোক, বর্তমানে মনোযোগ দিলেন দারা। সরফরাজকে বললেন, ‘শিবিরের উত্তরে রাজপুত সেনাদের তাঁবু আর দক্ষিণে আপনার পাঠান সেনাদের।’
‘জি হুজুর’, বলে থামেন সরফরাজ। বুঝতে পারেন না, কী কারণে এমন জানা তথ্য আবার বলছেন শাহজাদা।
দারা একটা খাগের কলম হাতে নিয়ে বললেন, ‘রাত্রি কত ঘড়ি?’
‘দুই ঘড়ি পার করেছে। তারপর দ্বিতীয় ঘড়িও অর্ধেক পার করেছে’, জবাব দিলেন পাঠান।
উঠে পায়চারি শুরু করলেন দারা শুকোহ। তারপর থেমে থেমে বললেন, ‘আপনাকে একটি অতি খুফিয়া১১ কাজ করতে হবে সরফরাজ খাঁ। কিন্তু এ মুহূর্তে তা অতিজরুরি। আপনি আপনার সেনাদের মধ্য থেকে দুজন বিশ্বস্ত সেনাকে দায়িত্ব দেবেন উত্তরের রাজপুত সেনাদের মধ্যে অবস্থান নেওয়ার।’
‘কিন্তু শাহজাদা, রাজপুতরা তো জলদি সমঝে যাবে তারা আমার সৈন্য’, অবাক হয়ে বললেন সেনাপতি।
দারা মুহূর্তমাত্র সময় নিলেন। তারপর বললেন, ‘পোশাক বদলে দিন। রাজপুতদের মতো জোব্বা পরতে বলুন। তারপর ওই সেনাদের মধ্যে গিয়ে কাজ করতে বলুন। সন্দেহ করি, উত্তরের ওই শিবিরের পাহারাদারকে হত্যা করে কোনো প্রকারে শিবিরে প্রবেশ করেছে শত্রু। আর আমার ইয়াকিন১২ হলো তাদের সাহায্য করেছে আমাদেরই শিবিরের কেউ।’
এবার বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারলেন সরফরাজ। তিনি বললেন, ‘জো হুকুম শাহজাদা। বান্দা তা তামিল করবে। লেকিন, এক সাওয়াল১৩ আছে। মনজুর করেন তো আরজ করি।’
ইশারা করেন দারা। তারপর পাঠান বললেন, ‘আমিন আমার ছোট ভাইয়ের মতো ছিল। আমার ইয়াকিন তার মতো সিপাহসালার১৪ এই শিবিরে কম। তার তাকতও ছিল অনেক। কিন্তু লাশ দেখে বোঝাই যায় গর্দান ভেঙে দিয়ে মারা হলো তাকে। এ কী প্রকারে সম্ভব?’
দুঃখের মধ্যেই হাসেন দারা। সরফরাজ সেনাপতি, তাই সে যুদ্ধই বোঝে। এর বাইরে তার বুদ্ধি কাজ করে কম। দারা বললেন, ‘আপনি দেখেছেন, আমিনের আপাদমস্তক কোনো জখম ছিল?’
একটু চিন্তা করে সরফরাজ বললেন, ‘না। কোনো জখম ছিল না। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন শাহজাদা?’
‘সরফরাজজি’, বাবার আমলের এই সেনাপতিকে সম্মান করেই দারা বললেন, ‘কারও গর্দান মোচড় দিয়ে তাকে হত্যা করতে হলে প্রয়োজন শারীরিক সংঘর্ষ। তাহলে কোনো না কোনো সময় দুজনেরই মাটিতে পড়ার কথা। জখম না হোক, জোব্বা পরিপাটি থাকতে পারে না। কিন্তু আমিনের এমন কিছুই হয়নি।’
‘এর কী অর্থ, শাহজাদা?’, আবারও প্রশ্ন করলেন সরফরাজ।
দারার কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। তিনি বললেন, ‘আমার ইয়াকিন, সিপাহসালার, আমিন পরিচিত ছিলেন তাঁর খুনির সঙ্গে। মূলত তাকে জেহের দেওয়া হয়েছে এবং তারপর গর্দান মটকে হত্যা করা হয়েছে আমাদের প্রিয় দোস্তকে। সেই কারণে আমিনের শরীরে নেই কোনো জখম। নেই কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন।’
দারা লক্ষ করলেন, ক্রোধে কাঁপছেন সরফরাজ। দারা বললেন, ‘খুনিকে আমরা পাকড়াও করব, সরফরাজজি। আপনি আপনার দুজন বুদ্ধিমান সেনা প্রেরণ করুন রাজপুত শিবিরে। দুই রোজ পর এমনই সময় তাদের আনবেন আমার কাছে এই তাঁবুতে।’
জহির ও হাশিম উপস্থিত দারা শুকোহর সামনে। এ দুজনকেই রাজপুত শিবিরে মোতায়েন করেছিলেন সরফরাজ। দারা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওরা তোমাদের ওপর শক১৫ করেনি তো?’
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দুজনই বলল, ‘না, শাহজাদা।’
জহির বলল, ‘আমি একসময় রাজপুত ঘোড়সওয়ার বাহিনীতে ছিলাম। ওই বাহিনীর কেউ এখানে নেই। কিন্তু আমি জানি ওদের রীতি–রেওয়াজ। সেই কারণে মুশকিল হয়নি।’
হাশিম বলল, ‘শাহজাদা, আমরা যথাসম্ভব লক্ষ করেছি, শিবিরে কোনো প্রকার অনুপ্রবেশ ঘটে কি না। প্রথম রাতে সে প্রকার কোনো কিছু হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় রাতে দেখলাম উত্তরের রাস্তা ধরে অন্দরে এল কয়েকটা ছায়ামূর্তি। আমাদের শিবিরের ভেতর প্রবেশ করল না, কিন্তু ইন্তেজার করছিল। কিছুক্ষণ পার হতে শিবির থেকে এক ছায়ামূর্তির আগমন। আগন্তুকদের সে প্রদান করল দুটো বস্তা।’
শাহজাদা বুঝলেন মূলত শিবির থেকে শিবিরের বাইরে পাচার হচ্ছে কিছু। সরফরাজ বললেন, ‘কী হতে পারে শাহজাদা?’
দারা একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন। বললেন, ‘এই শিবিরের কোন অংশে কারা থাকবে, তা নিশ্চিত করেছিলেন আমিন। উত্তরের শিবিরে সৈন্যের মৃত্যু তাঁর জেহেনে সওয়াল তৈরি করেছিল। সেই সওয়াল করেছিলেন হাকিমকে। আর হাকিম সাহাব এক রাতে আলোচনায় বসার ছলে জেহের পান করিয়ে দেন আমিনকে। কিন্তু দুই খুনের আলাগ তরিকা দেখাতে গর্দান ভেঙে দেন আমিনের।’
উত্তর দিলেন না দারা। জহির ও হাশিমকে বললেন, ‘এ মুহূর্তে তোমাদের ইনাম১৬ দেওয়ার মতো বেশি কিছু আমার কাছে নেই। তবে দিতে পারি কিছু মোহর। এর সঙ্গে আমি জবান দিচ্ছি, দিল্লি ফিরে বাদশাহর কাছে আমি খোদ তোমাদের হয়ে সুপারিশ করব।’
হৃষ্টচিত্তে দুজন বিদায় নিলে সরফরাজকে শাহজাদা বললেন, ‘আপনার প্রশ্নের জওয়াব দিতে আমাদের দরকার উলুঘ খাঁর সহযোগিতা।’
উলুঘের মস্তকে আজ পাগড়ি নেই। কী কারণ সে প্রশ্নও করলেন না শাহজাদা। বরং বললেন, ‘খাঁ সাহাব, আপনার তহবিলের কী খবর?’
সদা হাসিমুখ উলুঘ। তবে এ সময় শাহজাদার প্রশ্ন শুনে একটু বিস্মিতই হলেন। বললেন, ‘শাহজাদা, আমরা যুদ্ধ শুরু করিনি। সেই কারণে গোলাবারুদ যথেষ্ট আছে। খাদ্যের পরিমাণও ঠিক আছে।’
‘আপনি কি নিশ্চিত উলুঘ খাঁ?’, কর্তৃত্বের সুরেই বলেন দারা। আহত হলেন উলুঘ। তিনি বললেন, ‘আমাকে সময় দিন শাহজাদা। তদারক করে আপনাকে খতিয়ান প্রদান করব।’
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে দারা আবার বললেন, ‘খাঁ সাহাব, এ অঞ্চলে মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তি বৃদ্ধি করতে হলে স্থানীয়দের কী প্রয়োজন?’
উলুঘ জবাব দেওয়ার আগেই সরফরাজ বললেন, ‘শক্তি, লস্কর১৭।’
এবার উলুঘ বললেন, ‘ওদের লস্করের কমিয়া নেই। বহোত ইনসান আছে এই পর্বতে। কিন্তু তারা মোগল বাহিনীর মতো শিক্ষিত না। আর তাদের নেই গোলাবারুদ।’
এ কথাটিই শুনতে চাইছিলেন দারা। তিনি বললেন, ‘উলুঘ খাঁ, খাদ্য ও অন্য রসদের হিসাব করার প্রয়োজন নেই। আপনি গোলা, সোরা আর বন্দুকের হিসাব নিন।’
পরের দিন মোগল শিবিরের মাঝখানে একটি বিশেষ দরবার বসালেন দারা। সেখানে উপস্থিত দারার সব সভাসদ। সামনে উপস্থিত সৈন্যবাহিনী। নেই কেবল আমিন খাঁ বাদাখশানি। তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করলেন দারা। তারপর বললেন, ‘হারেজান১৮, আপনারা সবাই জানেন আমাদের শিবিরে দুটি মউত হয়েছে। এক রক্ষীর। আরেক, আমাদের সিপাহসালার আমিন খাঁ বাদাখশানির। তবে আমাদের বিশ্বাস, এ দুটি মউতের কোনোটিই স্বাভাবিক না। আমার ইয়াকিন, এই দুটি মউতই খুন।’
গুঞ্জন উঠল সবার মধ্যে। দারা হাত তুললেন। গুঞ্জন স্তিমিত হলো। এরপর তিনি বললেন, ‘আমি গত রাতে উলুঘ খাঁ সাহাবকে আরজ করেছিলাম গোলাবারুদের হিসাব করার জন্য। তিনি আমাকে বলেছেন আতশখানা১৯ হতে চুরি হয়েছে দুই বস্তা সোরা, চারটি মাস্কেট ও একটি জিজায়েল২০।’
অমাত্যদের মধ্যে চাঞ্চল্য। তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছেন না এমন ঘটেছে। এর মধ্যে উলুঘ খাঁ হাত তুললেন। শোর থামলে তিনি বললেন, ‘মির আতিশের অনুপস্থিতিতে এ কাম আমাকেই সঁপেছিলেন বাদশাহ। সে কামে নাকাম হয়েছি। এর জন্য যেকোনো সাজাই গ্রহণ করতে প্রস্তুত।’
দারা বসে ছিলেন। এবার দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সাজা তো দেওয়াই যায়, খাঁ সাহাব। কিন্তু তাতে অপরাধের সুরাহা হয় না। অপরাধীরও না। আজ এই দরবার আহ্বান করা হয়েছে অপরাধীকে পাকড়াও করতে।’
‘অপরাধী কি আমাদের মধ্যেই উপস্থিত?’ প্রশ্ন করলেন সরফরাজ।
দারা কেবল হাসলেন। বললেন, ‘উলুঘ খাঁ সাহাবই আমাকে বলেছিলেন এই অঞ্চলের লোকের যদি মোগল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় তাহলে তাদের প্রয়োজন হবে গোলাবারুদ। তাদের গোলা-বন্দুক নেই। সেটা চুরি করিয়েছে তারা আমাদেরই শিবির থেকে। আর সে কাজ করে দিয়েছে মোগল অমাত্যদেরই কেউ।’
‘এর সঙ্গে খুনের কী সম্পর্ক?’, প্রথমবারের মতো প্রশ্ন করলেন আলী মর্দান খাঁ।
দারা বললেন, ‘সোরা২১ ও বন্দুক পাচার করার জন্য জরুরত ছিল একটি রাস্তা। সেই রাস্তা তৈরি করতে খুন করা হয় রাজপুত শিবিরের পাহারাদারকে। কেননা রাজপুতরা মোগল মিত্র। তাদের প্রতি আমাদের ইয়াকিন ও ভরসা বেশি। অন্যদিকে তাদের শিবির উত্তরে। পাচারের উপযুক্ত স্থান। পাহারাদারকে হত্যা করে সেই স্থানে বসানো হয়েছিল চোরাকারবারির সহযোগী সৈন্যকে। আমার ধারণা, সে রাজপুত সৈন্যদেরই কেউ। তার সঙ্গে মূল অপরাধীর যোগাযোগ ছিল।’
‘হত্যা কী প্রকারে হয়েছিল?’, প্রশ্ন সরফরাজের।
দারা আহ্বান করলেন হাকিমের সহকারী রাশিদকে। সে এগিয়ে গেলে দারা বললেন, ‘রাশিদ এক কাহানি বয়ান করবে।’
রাশিদ বলতে আরম্ভ কললেন, ‘এই উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চলে একপ্রকার গুল্ম জন্মে। তার ঔষধি গুণ আছে কিন্তু সুরার সঙ্গে মিশ্রণ করলে পরিণত হয় জেহেরে। লেকিন সুবিধা হলো ওই জেহেরের না আছে কোনো রং, না কোনো সুবাস। সেই কারণে কেউ বুঝতে পারে না। আর মুর্দার শরীরেও এ জেহের কোনো রং ফোটায় না।’
বলে শেষ করল রাশিদ। তার আর বলার প্রয়োজন হলো না হাকিম মুদাসসর বুখারি এ জেহের প্রস্তুতে মাহির২২। কেননা সবাই জানে গজনিতে হাকিম বুখারি বাস করেছে ১০ বছর। দারা লক্ষ করলেন তার দিকে। আর রাশিদের দিকে তাকিয়ে বুখারি বলে উঠল, ‘নেমক হারাম।’
এই প্রথম ক্রোধ প্রকাশ করলেন দারা। বুখারির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রাশিদ আপনার না, মোগল বাদশাহর নেমক খায়। নেমক হারাম আপনি।’
একটু সময় নিয়ে দারা আবার বললেন, ‘সেই রোজ সৈন্যের দেহ পরীক্ষা করায় আপনার অবহেলা দেখে মনে করেছিলাম সামান্য সেনা বলেই আপনি অনিচ্ছুক। কিন্তু উলুঘ খাঁ সাহাব যখন বললেন বিদ্রোহীদের প্রয়োজন গোলাবারুদ, আমার ইয়াদ হলো, সেদিন আপনি গভীর রাতে আমার শিরঃপীড়ার দাওয়াই২৩ দিতে যখন এসেছিলেন, আমি সোরার২৪ বু২৫ পেয়েছিলাম আপনার জোব্বায়। সেদিনই রাশিদকে তলব করি। আপনার দাওয়াখানার দুই শিশি জেহের এখন আমার জিম্মায়।’
বুখারি থরথর করে কাঁপছিলেন। ভয়ে নয়, ক্রোধে। বলে উঠলেন, ‘কান্দাহার মোগলদের দখলে যাবে না। কান্দাহার হবে মুক্ত। আমরা মুক্ত করব কান্দাহার।’
দারা বললেন, ‘তাগতের বলে ফতেহ্ করুন বুখারি সাহাব। নেমক হারামি করে নয়।’
সরফরাজ এর মধ্যে প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু আমিন খাঁ?’
দারা একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন। বললেন, ‘এই শিবিরের কোন অংশে কারা থাকবে, তা নিশ্চিত করেছিলেন আমিন। উত্তরের শিবিরে সৈন্যের মৃত্যু তাঁর জেহেনে সওয়াল তৈরি করেছিল। সেই সওয়াল করেছিলেন হাকিমকে। আর হাকিম সাহাব এক রাতে আলোচনায় বসার ছলে জেহের পান করিয়ে দেন আমিনকে। কিন্তু দুই খুনের আলাগ তরিকা দেখাতে গর্দান ভেঙে দেন আমিনের।’
মুদাসসর বুখারি সে সময় আপন জানু পেতে বসে পড়েছেন। আর সরফরাজ কোষমুক্ত করছেন সমশির। দারা নিজের তাঁবুর দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। গজনি–রহস্য সমাধান হলো। দারা সিদ্ধান্ত বিলেন, বাদশাহ শাহজাহানকে জানাবেন, বাদশাহির কোণে কোণে তৈরি হয়ে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ নেমক হারাম। কিন্তু দারা তখনো জানেন না, এই কান্দাহার অভিযানেই আরও বিশ্বাসঘাতক দেখতে হবে তাঁকে। হাকিম ছিল প্রথম বিশ্বাসঘাতক।
টীকা: গল্পে বেশ কিছু উর্দু-ফারসি শব্দ আছে, যা এখন প্রায় অপ্রচলিত। এসব শব্দের কারণে অনেক বাক্য বুঝতেও অসুবিধা হতে পারে। কিছু শব্দের অর্থ এখানে দেওয়া হলো।
টীকা
গল্পে বেশ কিছু উর্দু-ফারসি শব্দ আছে, যা এখন প্রায় অপ্রচলিত। এসব শব্দের কারণে অনেক বাক্য বুঝতেও অসুবিধা হতে পারে। কিছু শব্দের অর্থ এখানে দেওয়া হলো।
১. সম্প্রতি, এই সময়।
২. সব সময়।
৩. প্রদীপ, বাতি।
৪. সুফি, দরবেশদের অবস্থান ও আলোচনার জায়গা।
৫. সুরা পরিবেশনকারী।
৬. বিষ।
৭. বেয়াদবি।
৮. চিঠি।
৯. মন।
১০. নিকটে, কাছে।
১১. গোপন।
১২. বিশ্বাস।
১৩. প্রশ্ন।
১৪. সেনাপতি।
১৫. সন্দেহ।
১৬. পুরস্কার।
১৭. সেনাবাহিনী।
১৮. উপস্থিত সকল।
১৯. গোলাবারুদ রাখার স্থান।
২০. ছোট ধরনের কামান।
২১. একধরনের রাসায়নিক। বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
২২. দক্ষ।
২৩. মাথাব্যথার ওষুধ।
২৪. বারুদ তৈরির রাসায়নিক পদার্থ
২৫. গন্ধ