তানিমের এসএসসি পরীক্ষা শেষ। এখন হাতে অফুরন্ত সময়। তার বন্ধুরা সবাই ঘুরতে গেছে। সে-ই কেবল ঘরে বসে ভেরেন্ডা ভাজছে। যদিও তার ধারণা নেই ভেরেন্ডা জিনিসটা আসলে ঠিক কী! নিশ্চয়ই সবজি টাইপের কিছু হবে, যা তেল দিয়ে ভেজে খাওয়া যায়। কে জানে। বিছানায় শুয়ে এই সব হাবিজাবি যখন ভাবছিল, ঠিক সেই সময় মা এসে বললেন, ‘কী রে, তুই দেখি ঘরে বসে থেকে থেকে কুয়ার ব্যাঙ হয়ে যাচ্ছিস। কোথাও থেকে ঘুরেটুরে আয়।’
—কোথায় যাব?
—সেটা আমি কী জানি? তোর যেখানে ভালো লাগে। তবে খুব বেশি দূরে না আবার...
—ছটকু মামার ওখান থেকে ঘুরে আসি?
—হ্যাঁ, তা যেতে পারিস। কাছেই তো আছে, শ্রীমঙ্গল।
‘ওই পাগলা ছোটনের ওখানে গেলে ওর মাথাটা নষ্ট করে দেবে।’ বারান্দায় বসে পেপার পড়ছিলেন বাবা, ফট করে বলে বসলেন। মা-ও রেগে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে।
‘ও, আমার ভাই পাগলা, আর তোমার ভাইটা-ই বা কী করছে...?’ মা–বাবার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মাঝখানেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল তানিম। ছোট মামার ওখানেই যাবে, মানে ছটকু মামার ওখানে। ছটকু মামা থাকেন সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। বাবা ঠিকই বলেছেন। মামাটা একটু পাগলাটে আছে, কিন্তু মজার মানুষ। তাঁর জীবনের একটাই লক্ষ্য, পুরোনো জিনিসপত্র কালেক্ট করা। মানে তিনি একজন অ্যান্টিক কালেক্টর, তাঁর বাড়িটাকে মোটামুটি একটা মিউজিয়ামই বলা যায়। ২৫০ বছরের পুরোনো একটা হাই কমোড আছে তাঁর কাছে। মামার দাবি, এটা নাকি কোনো এক রাজা-বাদশাহ ব্যবহার করতেন। তবে ২৫০ বছর আগে মানুষ হাই কমোড ব্যবহার করত কি না, সেটা নিয়ে তানিমের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে মামার অ্যান্টিক মিউজিয়ামে কিছু কিছু জিনিস আছে, যা সত্যিই ইন্টারেস্টিং। যেমন প্রায় ২০ কেজি ওজনের একটা সিলিং ফ্যান, যা এখনো দিব্যি ঘোরে। কিংবা একটা পিতলের হুক্কা আছে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ছয় ফুট। এই হুক্কার কলকেতে আগুন জ্বালাতে হলে মই দিয়ে ওপরে উঠে দাঁড়াতে হয়।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত মায়ের কথাই ঠিক হলো। তানিম যাচ্ছে ছোট মামা ওরফে ছটকু মামার বাসায়, শ্রীমঙ্গলে। ঢাকা টু শ্রীমঙ্গল। বাবাই রেলের টিকিট কেটে দিলেন। রাত ১২টায় কমলাপুরে এসে তানিমকে তুলে দিলেন ট্রেনে। বললেন, ‘রেলের বুফেতে গিয়ে কাটলেট খাবি। দারুণ জিনিস। ওটা না খেলে মিস করবি।’
‘আচ্ছা খাব।’ ট্রেনে উঠতে উঠতে বলল তানিম।
‘একা একা ঘুরবি না। ছটকুর সঙ্গে সঙ্গে থাকবি।’
‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা।’ বলল তানিম।
ঠিক সময়েই ট্রেন ছেড়ে দিল। অথচ এই ট্রেন ছাড়ার সময় নিয়ে কত মজার জোকসই না পড়েছে তানিম। একটা জোকস তো এখনো মনে আছে...এক যাত্রী ট্রেনের টিটিকে জিজ্ঞেস করছে ‘পাঁচটার ট্রেনটা কটায় ছাড়বে?’ এই প্রথম তানিম একা একা কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে, তা–ও আবার রাতের ট্রেনে। তার বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছে। বাবা বাইরে থেকে চেঁচালেন, ‘আমি ছটকুকে ফোনে বলে দিয়েছি ও স্টেশনে থাকবে।’
‘আচ্ছা।’ জানালা দিয়ে হাত নাড়ে তানিম। আরে বাবা তানিমের নিজের কাছেই তো ফোন আছে, সে যখন–তখন ইচ্ছা করলে মামার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।
ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই খিদে পেয়ে গেল তানিমের। বাবা বলে দিয়েছেন, ট্রেনের কাটলেট না খেলে নাকি বিরাট মিস। সে তার ব্যাকপ্যাকটা ওপরের হ্যাঙারে রেখে চলল ট্রেনের শেষ প্রান্তে বুফেতে। বুফেতে ঢুকে একটু অবাক হলো। মাত্র দু–তিনজন মানুষ বসে আছে। যাত্রীদের কারও কি তার মতো খিদে লাগেনি? এর একটা কারণ হতে পারে, সবাই সিটে বসেই খেতে পারে। বুফের অ্যাটেনডেন্টরা নিজেরাই চাহিদামাফিক খাবার নিয়ে এসে হাজির হয়। তানিম একটা কাটলেট আর চায়ের অর্ডার দিল।
মুহূর্তে কাটলেট চলে এল। কাটলেটটা একটু শক্ত টাইপ কিন্তু খেতে বেশ লাগল তানিমের। ট্রেনের দুলুনিতে কাটলেট চিবাতে মন্দ লাগছিল না, অটোমেটিক চিবানো হয়ে যাচ্ছিল যেন। তানিম খেয়াল করল, একটু বুড়োমতো একটা লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে, সাদা পায়জামা–পাঞ্জাবি পরা লোকটাও একটা চা নিয়ে বসে আছে। চোখাচোখি হতেই বুড়োটা হাসল। তানিমও হাসল। একটু পর বুড়ো লোকটা উঠে এসে তার টেবিলের সামনের চেয়ারটায় বসল।
‘তোমার সঙ্গে চা খেতে খেতে একটু গল্প করি। কী বলো?’ তানিম মাথা নাড়ল। যদিও তার একা থাকতেই ভালো লাগছিল।
—নিশ্চয়ই এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে বেড়াতে যাচ্ছ?
—জি।
—এবং মামার বাড়িতে?
তানিম অবাক হলো। লোকটা বুঝল কীভাবে? হা হা করে হাসল লোকটা।
—এটা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে লাগে না। আমরা বাঙালিরা যখন বেড়াতে বের হই, আমাদের প্রথম চয়েস হচ্ছে মামাবাড়ি না হলে দাদাবাড়ি। সেকেন্ড চয়েস কী বলো তো?
—জানি না। মাথা নাড়ে তানিম।
—সেকেন্ড চয়েস হচ্ছে...
লোকটা কথা শেষ না করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়...কী যেন দেখার চেষ্টা করে। ঠিক তখন কেমন একটা মাছের গন্ধ নাকে আসে তানিমের। তবে বুড়ো লোকটা বেশ মজারই। অনেক তথ্য দিল। যেমন সে যে কাটলেট খাচ্ছে, এটা নাকি ব্রিটিশরাই প্রথম চালু করেছিল, যা এখনো চলছে। যদিও আগের সেই মান এখন আর নেই। তবে একটা জিনিস একটু অস্বস্তি লাগল তানিমের; লোকটা চোখের পাতা ফেলে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ঠিক যেন মাছের চোখ।...একটু ভীতিকর!
—আপনি কোথায় যাচ্ছেন? একটা দুটো প্রশ্ন না করলে হয় না। তাই তানিম জানতে চাইল।
—আমি যাচ্ছি মেঘালয়।
—এটা কোথায়?
—ভারতের মেঘালয়।
—কীভাবে যেতে হয়?
—সিলেট গিয়ে তারপর ডাউকি বর্ডার দিয়ে ঢুকব। তুমি তো শ্রীমঙ্গল নামবে তাই না?
এবার তানিম সত্যি সত্যিই অবাক হলো। লোকটা জানল কী করে সে শ্রীমঙ্গল নামবে? তানিমের কেমন যেন একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো! ইচ্ছা ছিল ধীরে ধীরে চা–টা খাবে; কিন্তু সেটা আর হওয়ার নয়। সে দ্রুত চা’টা শেষ করল। চা’টা অবশ্য খুব গরমও ছিল না। চা শেষ করে ‘আচ্ছা আঙ্কেল আসি’ বলে উঠে পড়ল। লোকটা মাছের চোখে তাকিয়ে রইল। তবে মুখের হাসিটা তখনো ঝুলে রইল দুই ঠোঁটের মাঝে।
ভোর পাঁচটা নাগাদ শ্রীমঙ্গল পৌঁছে গেল তানিম। দেখে ঠিক তার ‘ছ’ বগির দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন ছটকু মামা।
—কিরে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
—না।
—গুড, চল। তোর মাকে একটা মেসেজ করে জানিয়ে দে তুই ঠিকঠাকমতো পৌঁছে গেছিস।
—আচ্ছা। তানিম অবশ্য মেসেজ করল না, ফোনই দিল মাকে। ‘মা, পৌঁছে গেছি। এখন ছটকু মামার সঙ্গে যাচ্ছি।’
—সাবধানে থাকিস। একা একা ঘুরিস না, ছটকুর সঙ্গে ঘুরিস।
—আচ্ছা।
—ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করবি।
—আচ্ছা, আচ্ছা।
তিন চাকার একটা অদ্ভুত মোটরগাড়িতে উঠে ওরা রওনা দিল। গাড়িতে ওঠার সময় দেখে, টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বুড়ো লোকটা। লোকটা না বলল সে সিলেট যাচ্ছে, তারপর ভারতের মেঘালয় যাবে? তাহলে শ্রীমঙ্গলে নামল কেন! শিরশিরে অনুভূতিটা আবার হলো তানিমের, যেন একটা ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে গেল তাকে।
ছটকু মামার বাসাটা সত্যি দারুণ। প্রতি এক ইঞ্চি পরপর প্রাচীন সব জিনিসে ভরা। বহু আগে, তানিম যখন সিক্সে পড়ত, তখন একবার মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল, তখনো এত জিনিস ছিল না। এখন মনে হচ্ছে অ্যান্টিক জিনিসপত্র আরও বেড়েছে। সবচেয়ে অবাক হলো ফ্রিজটা দেখে। ঘরের প্রায় মাঝখানে একটা বিশাল ফ্রিজ!
—মামা, তুমি না ফ্রিজ একবারেই পছন্দ করো না?
—হ্যাঁ, করি না তো। আমি বাসি খাবার একদম খেতে পারি না। তাই ফ্রিজ পছন্দ করি না।
—তাহলো এটা? এটা তাহলে অ্যান্টিক ফ্রিজ?
—না, এটা সত্যি ফ্রিজ। তবে প্রায় অ্যান্টিক। জানিস তো আমি আবার ঠান্ডা পানি ছাড়া খেতে পরি না। তাই এই ফ্রিজটা কিনলাম, সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্রিজ। দাম খুবই কম। তবে এই ফ্রিজের একটা ইতিহাস আছে
—কী ইতিহাস?
—রাতে বলব। এখন যা হাত–মুখ ধুয়ে আয়। চাইলে গোসলও করতে পারিস। গিজারে গরম পানি আছে। আমি তোর জন্য নাশতা রেডি করি। মামার বাসায় কোনো কাজের লোক নেই। সবকিছু তিনি দশ হাতে একাই করেন।
গোসল করে ফেলল তানিম। গিজারের হালকা গরম পানিতে গোসল করতে মন্দ লাগল না। গোসল করে নতুন এক সেট জামাকাপড় পরে বের হয়ে এল নিজের রুম থেকে। ফ্রিজটা যেখানে আছে তার ঠিক পাশের রুমটা তানিমের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, আরেক পাশে মামার রুম। বাড়িটা পুরোনো কিন্তু অনেকগুলো রুম এবং প্রতিটা রুমে যথারীতি প্রাচীন সব জিনিস। যেমন তানিমের রুমেই আছে প্রায় ১০–১২টি প্রাচীন জিনিস, ছোট ছোট টুলের ওপর সাজানো। একটা কেটলি টাইপের জিনিস, যেটাকে মামা বললেন রাশিয়ান সামোভার আর আছে একটা গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক, যদিও নষ্ট। মামা অবশ্য বলেন, একটা নষ্ট ঘড়িও দিনে দুবার সঠিক সময় দেয়...।
—কিরে তোর হলো? মামা চেঁচান। ডাইনিংয়ে চলে আয় জলদি।
—এই আসছি।
ডাইনিং টেবিলে এসে তানিমের মাথা নষ্ট হওয়ার জোগাড়। কী নেই! পরোটাভাজি ডিম তো আছেই, আছে ফ্রেঞ্চফ্রাই, কেক, আরও আছে কুমিল্লার প্যাড়া, টাঙ্গাইলের চমচম...আর নেত্রকোনার বিশাল সাইজ বালিশ মিষ্টি। সেই সঙ্গে নানা জাতের আম।
—এত কিছু কোথা থেকে আনলে মামা?
—আরে তুই একমাত্র ভাগনে, তোর জন্য না আনলে কার জন্য আনব। তুই তো মিষ্টি পছন্দ করিস।
—তা করি, তাই বলে এত মিষ্টি?
যাহোক, খেতে খেতে নানা গল্প হলো। মামা জানালেন তিনি খুব শিগগির একটা ‘কগনিটিভ রেভল্যুশন’ যুগের পাথরের তৈরি অস্ত্র পেতে যাচ্ছেন।
—কগনিটিভ রেভল্যুশনট কী?
—এটাকে বাংলায় বলা যায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব।
—বুঝলাম না।
—ধর, প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে মানুষ আর প্রাণীদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে হোমোসেপিয়েন্সদের মধ্যে একটা কগনিটিভ রেভল্যুশন হলো। মানে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব ঘটল ওদের মাথায়। আচ্ছা বাদ দে এখন। এটা নিয়ে পরে বলব তোকে। এখন বালিশ মিষ্টিটা খা।
ছটকু মামা মাঝেমধ্যে এমন সব বিষয় নিয়ে কথা বলে যে তানিমের মাথার ওপর দিয়ে যায়।
—এত বড়টা খেতে পারব না।
—যতটুক পারিস খা।
এখানে বলে নেওয়া ভালো, ছটকু মামা বিয়ে করেননি। কাজেইু তানিমের কোনো মামি নেই। মামার যুক্তি হচ্ছে, এই যে আমার অ্যান্টিক কালেকশন যদি আমার বউ আই মিন তোর মামি পছন্দ না করে, তখন লাগবে ভেজাল। আমি আমার এই সব প্রাচীন জিনিস ছাড়া থাকতেই পারব না।
যাহোক, নাশতা শেষ করে, শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত চা খেয়ে মামার সঙ্গে ঘুরতে বের হলো তানিম। সেই অদ্ভুত গাড়িতে করে প্রথমে গেল একটা ঝাউবনে, জায়গাটার নাম হরিণছড়া। পাহাড়ের ওপর বিশাল বিশাল আকাশছোঁয়া ঝাউগাছ। সত্যি অসাধারণ জায়গা। তারপর দেখল বিশাল প্রান্তরজুড়ে ফিনলের চা–বাগান, শুধু ফিনলে নয়, আরও অনেক অনেক বড় কোম্পানির চা–বাগান। সেই সব বাগান থেকে নারীরা চা–পাতা সংগ্রহ করছেন। তারপর মাথায় মস্ত একটা ঝুড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছেন চা–পাতা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারল ২১ কেজি পাতা তুললে তাঁরা পান ১৭০ টাকা। আগে পেতেন ১৪০ টাকা, তাঁরা আন্দোলন করে ৩০ টাকা বাড়িয়েছেন। মামার কাছ থেকে আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেল, যেমন কাঁচা কচি চা–পাতার ওজন অনেক বেশি, আর ‘নিশিগাছ’ নামে একটা গাছ আছে, এই গাছ যেখানে থাকে, সেখানেই চা–বাগান হয় বা চা–বাগান করা যায়।
চলবে...