রাব্বি যেন হঠাৎ একা হয়ে গেল। স্কুল ছুটি, সব বন্ধু গেছে বেড়াতে। কেউ বান্দরবান, কেউ সিলেট, কেউ কক্সবাজার, কেউবা বিদেশে। শুধু রাব্বির কোথাও যাওয়া হয় না। কোনো ছুটিতেই না। মাকে বললেই বলে, ‘এই তো আগামী ছুটিতেই দেখবি আমরা যাব কক্সবাজার। সমুদ্রের ধারে একটা আস্ত রিসোর্ট ভাড়া করে থাকব শুধু তুই আর আমি।
কেন মজনু মামাকে নেব না?
হ্যাঁ মজনুকে নেওয়া যায়, কিন্তু ও যে শুধু লেকচার মারে।
কেন, মামা তো জ্ঞানের কথা বলে, ভালো ভালো কথা বলে।
ও তোর শুনতে ভালো লাগে?
মাঝে মাঝে বেশ ভালো লাগে।
তাহলে নিস।
আর ক্লানটু?
না ক্লান্টুকে নেওয়া যাবে না। রিসোর্টে তুই মনে করিস কুকুর ঢুকতে দেবে?
তা–ও ঠিক।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কদিন ধরে ক্লান্টুকে পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য এটা ক্লান্টুর একটা বাজে অভ্যাস, মাঝেমধ্যেই সে হাওয়া হয়ে যায়। কই যে যায়। মজনু মামা বলে তোর ক্লান্টু হাওয়া বদল করতে গেছে। তারপর শুরু হয় মামার কুকুরবিষয়ক লেকচার। মজনু মামা জানে না এমন বিষয় নেই। কুকুর যে ১০ হাজার রকমের গন্ধ জানে...এবং কুকুর কেন গাড়ি দেখলে তার পিছে ঘেউ ঘেউ করে ছোটে, তার রহস্য...ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য রাব্বির কিন্তু মামার লেকচার শুনতে বেশ ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে বিরক্তও লাগে। তবে রাব্বির এই মামাটা ইন্টারেস্টিং!
এবার ক্লান্টু বেশ অনেক দিন ধরে নেই। সাধারণত সপ্তাহে একবার সে নিখোঁজ হবেই, কিন্তু দু–এক দিন পর ঠিকই এসে হাজির হয় এবং প্রচণ্ডগতিতে লেজ নাড়তে শুরু করে। ক্লান্টু আসলে একটা দেশি কুকুর, শরীরটা ধবধবে সাদা। কান দুটো লাল। কান লাল থেকেই তার নাম যে কীভাবে ক্লান্টু হলো, সেটা এখন আর রাব্বিও জানে না। তবে দেশি কুকুর হলেও তাকে দেখায় বিদেশি কুকুরের মতো। কান দুটো খাড়া না, ঝোলা কান।
তো যেটা বলছিলাম। রাব্বি একা একাই ঘুরে বেড়ায় পাড়ার ভেতর। করার কিছু নেই। অবশ্য দুপুরের দিকে বই পড়া যায়। কিন্তু বাসার সব বই পড়া শেষ। বন্ধুদের বাসা থেকে যে বই আনবে, সে উপায়ও নেই। তারা কেউ থাকলে তো। বিকেলটা বন্ধুরা থাকলে ফুটবল খেলত বা ক্রিকেট কিংবা কখনো সাত চারা। এখন যেহেতু কেউ নেই কাজেই রাব্বি একা একা ঘুরে বেড়ায় পাড়ার ভেতর। মাঝেমধ্যে পাড়ার শেষ মাথায় লাইব্রেরিতে ঢোকে। অবশ্য এই লাইব্রেরিতে ছোটদের জন্য তেমন কোনো বইটই নেই। সবাই এসে পেপার পড়ে। ম্যাগাজিন পড়ে। তারপরও রাব্বি মাঝেমধ্যে যায়।
আজও হাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরির কাছে চলে এল। তবে লাইব্রেরিতে ঢুকল না। লাইব্রেরি পার হয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে গেল। এ পাশটায় খুব একটা আসা হয়নি। এ পাশটা একটু থমথমে। নির্জন। আরেকটু এগোলে নদী। সবাই বলে বিরুপাক্ষ নদী। কিন্তু এখন আর নদী নেই, যেন ছোট্ট একটা খাল। একসময় নাকি এই নদী দিয়ে পাঁচটনি নৌকা চলত। অবশ্য পাঁচটনি নৌকা কী জিনিস, রাব্বি ঠিক বোঝে না। সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচটনি ট্রাকের মতো কিছু একটা হবে হয়তো, যা পানি দিয়ে চলে।
এই ছেলে, শোন। দুটো লোক রাব্বিকে ডাকল।
রাব্বি এগিয়ে গেল। শার্টপ্যান্ট পরা বেশ ভদ্র গোছের দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে ডাকছেন?
হ্যাঁ, তোমাকেই। তোমার নাম কী?
রাব্বি।
কোথায় থাকো?
ওই দিকে।
আমাদের একটা কাজ করে দেবে?
কী কাজ?
এই যে বাড়িটা দেখছ।
কোনটা?
ওই যে লাল তিনতলা দালান।
হ্যাঁ।
ওটা আমাদের দাদিমার বাড়ি। রাব্বি দেখে একটা তিনতলা লাল ইটের বাড়ি। এই বাড়িটা আগেও দেখেছে, বেশ পুরোনো টাইপ দালান।
আমরা ভুল করে ভেতরে চাবি রেখে দরজা লক করে দিয়েছি। আরেকটা লোক বলে।
ও আচ্ছা।
তুমি একটু উপকার করবে।
কী উপকার?
ভেতরে ঢুকে দরজাটা একটু খুলে দেবে?
ভেতরে ঢুকব কীভাবে?
তোমাকে আমরা জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে দেব। তুমি ভেতরে গিয়ে দরজাটা খুলে দেবে। ঠিক তখনই রাব্বির নজরে পড়ল কোমরে হাত দিয়ে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, তার শার্টের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে প্যান্টে গোঁজা একটা পিস্তল। হঠাৎ রাব্বির বুকটা কেমন যেন ধড়ফড় করে উঠল। বিপদ! এখান থেকে পালাতে হবে...এখনই...
রাব্বি এবার সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছে। সে খুব একটা ভিতু টাইপ না। বাবা মারা যাওয়ার পর তাকে তার মা সেভাবেই তৈরি করেছেন। ভিতুর ডিম হওয়া চলবে না। সাহসী হতে হবে। তার সাহসী হওয়ার প্রথম পদক্ষেপটা বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। আগে যেখানে থাকত তারা, সেখানে তাকে মা একবার পাঠালেন ডিম কিনতে। সে ডিম কিনতে যাচ্ছিল, পথে তিনটা ছেলে তাকে আটকাল, পাড়ারই ফাজিল ছেলে হবে। বলল—
এই ছোঁড়া, তোরা নতুন এসেছিস?
হু।
কই যাস রে?
ডিম কিনতে
দেখি টাকা। বলে ডিম কেনার টাকাগুলো ছিনিয়ে নিল। রাব্বি তখন ফোঁপাতে ফোঁপাতে বাসায় ফিরল। মা সবটা শুনলেন। তারপর ফের ডিম কেনার টাকা দিলেন, যা আবার, যা, ডিম কিনে আনবিই আজ। আর তার শখের ক্রিকেট ব্যাটটা ধরিয়ে দিলেন।
ব্যাট দিয়ে কী হবে? এটাও তো ওরা কেড়ে নিয়ে নেবে।
না, এবার ডিমের পয়সা নিতে হলে এই ব্যাট দিয়ে তুই ওদের পিটাবি, পারবি না? অবশ্যই পারবি, যা। বলে মা ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিলেন। সেই প্রথম রাব্বি টের পেল মা কেমন যেন বদলে গেছে। তারপর ব্যাট হাতে বাইরে এসে ওই গলির মোড়টায় এসে দেখে, ওরা আইসক্রিম খাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওর টাকা দিয়ে, ভাবল রাব্বি। তারপর নিজেকে প্রস্তুত করল। ছেলে তিনটা তখন ওকে দেখে হি হি করে হাসতে শুরু করেছে।
দেখ দেখ ছোঁড়াটা ক্রিকেট খেলতে বের হয়েছে। তারা আইসক্রিম চাটতে চাটতে ওকে ঘিরে ধরল। রাব্বি দেরি করল না, হঠাৎ ব্যাটটা ঘুরিয়ে দলের সাগরেদটাকে মেরে বসল। ছেলেটা মোটেই প্রস্তুত ছিল না। হাতের আইসক্রিমটা ছিটকে পড়ল আর হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল পাশেরটার ওপর, দুটোই একসঙ্গে হুড়মুড় করে পড়ল, পাশের ড্রেনটায়। কাদাপানিতে দুটোরই মাখামাখি অবস্থা। ফের ব্যাট ঘুরিয়ে মারল তিন নম্বরটাকে। তিন নম্বরটা মার খেয়ে ছুটে পালাল।
ড্রেন থেকে উঠলেই ফের মারব। হুংকার দেয় রাব্বি।
এই নে তোর ডিমের টাকা। একটা ছেলে ৫০ টাকার নোটটা ছুড়ে দেয়।
আর আমাকে ছোঁড়া বলবি?
এই ছোঁড়া, কথা কানে যায় না? রাব্বি বাস্তবে ফিরে আসে।
অ্যাঁ, না আমার একটু কাজ আছে, এখনই যেতে হবে। বলে রাব্বি।
কী কাজ?
অ্যাঁ, ইয়ে, কোচিং আছে স্কুলে।
তখনই খপ করে কোমরে পিস্তল গোঁজা লোকটা রাব্বির একটা হাত ধরে ফেলে।
কোচিং পরে, আয় আমার সঙ্গে। বলে হিড়হিড় করে রাব্বিকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে। লোকটা এত জোরে রাব্বির হাত চেপে ধরেছে যে মনে হয়, ওর হাতের হাড্ডি ভেঙে দুটুকরা হয়ে যাবে। ওরা ওকে নিয়ে তিনতলা লাল দালানটার একটা জানালার সামনে দাঁড় করায়।
এই জানালা দিয়ে তুই ঢুকবি। এবার ওরা তুই তুই করে বলছে। এবং হুকুমের সুরে কথা বলছে।
কীভাবে ঢুকব?
মাথা ঢুকলেই শরীর ঢুকবে। দুই শিকের মাঝখান দিয়ে তোর মাথা ঢুকবে। বলে ওরা দুজনে রাব্বিকে তুলে ধরে। কী আশ্চর্য, সত্যি সত্যিই ওর মাথা ঢুকে যায় দুই কানে একটু লাগে তারপরও দিব্যি মাথাটা ঢুকে গেল। তবে কষ্ট হলো। কিন্তু একপর্যায়ে রাব্বি নিজেকে বাড়িটার ভেতরে আবিষ্কার করল। জানালার বাইরে থেকে লোক দুটো ফিসফিস করল।
ডান দিকে যা, ওখানে একটা বড় দরজা আছে। ওটার সবগুলো ছিটকিনি খুলে দে। কাঠের হুড়কোটা খুলবি আগে। কিন্তু ওরা যে বলল দরজা লক করে চাবি ফেলে গেছে। এখন বলছে ছিটকিনি কাঠের হুড়কো!
রাব্বি এখন কী করবে? দরজা খুলে দেবে? বাড়িটা বাইরে থেকে দেখলে সাধারণ একটা পুরোনো তিনতলা বাড়ি মনে হয়, কিন্তু ভেতরে ঢুকে চমকে গেল রাব্বি, ঝকঝক করছে, তকতক করছে। সব দামি দামি আসবাব। খুব বড় লোকের বাড়ি হবে। একটা বিশাল ঘড়ির দিকে চোখ আটকে গেল রাব্বির। এটাকেই বোধ হয় গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক বলে। টকটক করে পেন্ডুলামটা দুলছে একটা মুগুরের মতো করে। রাব্বি দু–এক পা এগিয়ে গেল। তখনই তার বুকটা ফের ধড়ফড় করে উঠল। একটা বৃদ্ধ মহিলা বসে আছে হুইলচেয়ারে, তার পাশে একটা সাদা কুকুর। কুকুরটা বসে ছিল, রাব্বিকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল। রাব্বি হতভম্ব হয়ে দেখে তার সামনে ক্লান্টু লেজ নাড়ছে।
তুই এখানে!
এটা তোমার কুকুর? বুড়ো মহিলা কথা বলে উঠল।
হ্যাঁ, ওর নাম ক্লান্টু। ক্লান্টু গলার ভেতর একটা আদুরে আওয়াজ তুলে এগিয়ে এসে রাব্বির পা চাটতে শুরু করল।
তাই তো বলি, আমাদের বাঘা হঠাৎ হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে কোথায় যায়।
এ আপনার কুকুর? নাম বাঘা? বুড়ো মহিলা রাব্বির প্রশ্নের উত্তর দিল না। বলল—
তুমি কীভাবে এখানে ঢুকলে? তখনই সব মনে পড়ে গেল রাব্বির। হায় হায়, ওই পাজি লোক দুটো বাইরে অপেক্ষা করছে। এই বৃদ্ধ মহিলাকে সব খুলে বলা দরকার এখনই।
বৃদ্ধ মহিলা ঠান্ডা মাথায় সবটা শুনলেন। তবে খুব অবাক হলেন বলে মনে হলো না, যেন এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। হাসিমুখে তাকালেন রাব্বির দিকে।
তুমি এখন কী করবে?
আমাকে বলছেন?
তো আর কে আছে এখানে? তোমাকেই বলছি, তুমি এখন কী করবে? ওদের দরজা খুলে দেবে?
না না বললাম, না, ওরা আমাকে জোর করে ঢুকিয়েছে।
ওই জানলার শিক গলে তোমার এত বড় শরীরটা ঢুকল?
হ্যাঁ, ওরা বলছিল মাথা ঢুকলেই নাকি শরীর ঢুকবে।
হুম...তাহলে এক কাজ করো, ওই টেবিলের নিচের ড্রয়ারটা খোলো তো।
তাই করল রাব্বি। ড্রয়ার খুলে রাব্বি হতভম্ব। একটা পিস্তল।
ওটা নিয়ে এসো।
সাবধানে জিনিসটা নিয়ে এল রাব্বি বুড়ির কাছে।
তুমি পিস্তলে গুলি চালিয়েছ কখনো?
না না।
সিনেমায় তো দেখেছ গুলি চালাতে?
তা দেখেছি।
তাহলেই হবে। আজ গুলি চালাবে। এটা কোনো জটিল ব্যাপার না। নাও, হাতে নাও পিস্তলটা...
না না।
আহ, যা বলছি করো। হাতে নাও...বুড়ি যেন হিপনোটাইজ করে ফেলল রাব্বিকে। রাব্বি পিস্তলটা হাতে নিল।
ট্রিগারে আঙুল দাও। রাব্বি দুহাতে পিস্তল ধরে ট্রিগারে আঙুল দিল।
না না, আমার দিকে না। হেসে ফেলল বুড়ি। এবার ওই খোলা জানালার কাছে যাও। লোক দুটিকে দেখা যাচ্ছে?
না।
না দেখা গেলে নেই। তুমি দুরাউন্ড গুলি করো। ফাঁকা গুলি, আকাশের দিকে।