নয়
টেলিমেট্রি টেবিলটার সামনে বসে আছেন আশফাক খান। চিন্তিত ভঙ্গিতে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন। এই সময় সেখানে এসে হাজির হলেন আবু তাহের। সাংঘাতিক উত্তেজিত। চোখ তুলে তাকালেন আশফাক খান। আবু তাহেরের চেহারা দেখেই অনুমান করলেন, খারাপ খবর আছে।
‘বলে ফেলো,’ বললেন আশফাক খান।
‘সেন্সর রিডিংয়ে কোনো ভুল নেই, কনফার্ম করেছে আমাদের মেইন কম্পিউটার।’
‘তার মানে সত্যিই ধ্বংস হতে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম?’
মাথা ঝাঁকালেন আবু তাহের।
‘কম্পিউটার বলছে, আগামী ১৫ ঘণ্টার মধ্যেই ভয়ংকর ভূমিকম্প হবে এ অঞ্চলে।’
‘পুরো চট্টগ্রামে?’
‘হ্যাঁ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাট অংশ সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। চিটাগাং শহরের ক্ষতি হবে। তার রেশ ঢাকাতেও গিয়ে পড়বে। ওখানে বিল্ডিং ধসে পড়লেও অবাক হব না।’
‘আংশিক মহাপ্রলয়,’ ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছে আশফাক খানকে।
‘আরও একটি খবর জানিয়েছে কম্পিউটার।’
‘আবার আরও আছে নাকি? ব্ল্যাক প্লেগ ফিরে আসার কথা বলছে নাকি বোকা যন্ত্রটা?’
‘না, না ওসব কিছু নয়,’ তাড়াতাড়ি বললেন আবু তাহের। ‘ওই ভূমিকম্পকে দুর্বল করার, চাইলে একেবারে বন্ধ করে দেওয়ারও উপায় একটা আছে।’
লাফিয়ে উঠলেন আশফাক খান। ‘কী উপায়?’
‘নিরাপদ কোনোখানে একটা কৃত্রিম ছোটখাটো ভূকম্পন ঘটিয়ে চাপটা সরিয়ে দিতে পারলে আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না।’
‘কিন্তু কৃত্রিম ভূকম্পন ঘটাবে কী করে?’
‘ওই তো, নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন।’
‘একটা কথা বলো তো, এই এলাকায় ইদানীং ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণ কি এই চাপ?’ জিজ্ঞেস করলেন আশফাক খান।
‘হ্যাঁ। আগেও বলেছি এ কথা।’
‘ব্যাপারটা পুরোপুরি প্রাকৃতিক?’
‘তা ছাড়া আর কী?’
‘ঠিক আছে,’ কফির কাপটা টেবিলে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আশফাক খান। ‘এই ভূমিকম্পটম্প ঘটানো আমার দায়িত্ব নয়। কিন্তু তোমার কথাও ফেলা যায় না। ব্যাপারটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছি। যা করার, তারাই করবে,’ হাত তুলে একজন গার্ডের দিকে ইশারা করলেন তিনি। ছুটে এল লোকটি।
‘স্যার?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল গার্ড।
‘রেডিওম্যানকে বলো ঢাকায় জেনারেল এরফানের সঙ্গে যোগাযোগ করুক। আমার টপ প্রায়োরিটি কোড ব্যবহার করতে বলো। যাও।’
‘যাচ্ছি, স্যার,’ ছুটে চলে গেল লোকটি।
‘মিস্টার খান?’ বললেন আবু তাহের।
‘কী?’
‘ইউসুফ ও শারিতা ওই এলাকাতেই আছে, তাই না?’
মুহূর্তে বদলে গেল আশফাক খানের চেহারা। ধপাস করে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন।
‘যদি ঠিক ওই এলাকায় না-ও থাকে, এর আশপাশেই কোথাও আছে। বিস্ফোরণের ফলে পাথরধস ঘটতে পারে। চাপা পড়ে মারা যেতে পারে ওরা।’ একটা তাঁবুর পাশে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে রেঞ্জার। হাত নেড়ে তাকে ইশারা করলেন আশফাক খান।
দ্রুত এগিয়ে এল লোকটি, ‘কিছু বলবেন, মিস্টার খান?’
‘মিস্টার ইউসুফ আর ডক্টর শারিতা আবদুল্লাহর কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?’
‘না। কোনো চিহ্নই খুঁজে পাচ্ছে না সার্চ পার্টি।’
‘মিস্টার খান, আমাদের হাতে কিন্তু সময় আর বেশি নেই,’ বললেন আবু তাহের।
‘পানির ধারা ছুড়লে কেমন হয়, আবু তাহের? এতেও কাজ হবে, বলেছিলে না?’
‘এখন আর সময় নেই। পাঁচ মাইল পাইপ ফেলে পাম্পে জুড়ে পানি ছোড়া...নাহ্, মিস্টার খান,’ হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন আবু তাহের, ‘অত সময় দেবে না ওই ফল্ট।’
মুখ কালো হয়ে গেছে আশফাক খানের। বনের দিকে চেয়ে আছেন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। বোধ হয় ইউসুফ আর শারিতার কথাই ভাবছেন।
কয়েক মিনিট দীর্ঘ নীরবতা। তারপর দুজন লোক এসে দাঁড়াল সেখানে। হাতে পোর্টেবল রেডিও রিসিভার।
‘জেনারেল এরফান লাইনে আছেন, স্যার,’ রিসিভারটা আশফাক খানের দিকে বাড়িয়ে ধরল রেডিওম্যান।
রিসিভারটা হাতে নিলেন আশফাক খান। আবু তাহেরের দিকে তাকালেন। শেষবারের মতো জানতে চাইলেন, ‘নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই?’
‘না,’ মাথা নিচু করলেন আবু তাহের। ‘আমি দুঃখিত, মিস্টার খান।’
‘হুঁ,’ রিসিভার কানে ঠেকালেন আশফাক খান।
আবার আধো ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে ইউসুফকে। কিন্তু এবারে অপারেশন টেবিলে নয়, ইজিচেয়ারের মতো একটা চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায়। হেয়ার ড্রাইয়ারের মতো দেখতে একটা যন্ত্র তার মাথায় লাগিয়ে রাখা হয়েছে। আগের জায়গাতেই শুয়ে আছে ভিটু। তার মাথায়ও একই ধরনের আরেকটা যন্ত্র লাগানো।
পরীক্ষাগারে দারুণ কর্মব্যস্ততা। টেকনিশিয়ানরা ব্যস্তভাবে আসছে–যাচ্ছে। দুধসাদা অদ্ভুত একটা আভা বের হচ্ছে ঘরের দেয়ালগুলো থেকে। দুই হাতে দুমুঠো রেকর্ডিং ক্যাসেট নিয়ে শান্তভাবে ঘরে ঢুকল টোরা। একপাশের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। বসানো দেয়ালে সারি সারি কম্পিউটার কনসোল। একটি পটে একটি ক্যাসেট বসিয়ে দিল টোরা। যন্ত্রটির পাশের তিনটি বোতাম টিপল। সঙ্গে সঙ্গেই দেয়ালে বসানো বিশাল এক টিভি মনিটরের পর্দায় কতকগুলো আঁকাবাঁকা রেখা ফুটে উঠল। দীর্ঘ এক মিনিট রেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখল সে। মৃদু হাসল। পট থেকে ক্যাসেটটি বের করে পাশে দাঁড়ানো একজন সহকারীর হাতে দিল। হাতের অন্য ক্যাসেটগুলোও দিয়ে দিল কী ভেবে।
‘কাউন্সিল চেম্বারে নিয়ে যাও এগুলো,’ নির্দেশ দিল টোরা।
হাতে তুড়ি দিয়ে ঘরের মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল টোরা। ‘আমাদের কাজ শেষ। যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে যাও।’
কেউ কোনো প্রশ্ন করল না। কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আধা মিনিটের মধ্যেই ভোজবজির মতো যন্ত্রপাতিগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল ঘর থেকে। ইউসুফ, ভিটু আর টোরা বাদে সবাই চলে গেছে।
ধীরে ধীরে পুরো জেগে উঠল ইউসুফ। যন্ত্রের আবেশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে তার ওপর থেকে। টোরার দিকে তাকাল সে।
‘উঠুন। চলুন যাই আমরা,’ বলল টোরা। ‘এখানে আর থাকার দরকার নেই আপনার।’
ভিটুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল ইউসুফ, ‘ওকে জাগাচ্ছ না কেন? সঙ্গে নেবে না?’
‘আপাতত দরকার নেই ওকে।’
‘আসুন,’ হাত বাড়িয়ে দিল টোরা।
টোরার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল ইউসুফ। টলছে। ‘পায়ে জোর পাচ্ছি না কেন?’
‘যান্ত্রিক ঘুমের প্রতিক্রিয়া,’ বলল টোরা। ‘ভয় নেই, মিনিটখানেকের মধ্যেই চলে যাবে।’
‘এ ধরনের ঘুমের নাম দিয়েছেন আমাদের বিজ্ঞানীরা ইলেকট্রপিপ।’
‘জানি।’
‘প্রায় একটি বছর ইলেকট্রপিপ পদ্ধতিতে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল আমাকে।’
‘আপনাকে বায়োনিক ম্যান বানানোর সময়ে?’
‘হ্যাঁ,’ বায়োনিক রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে অবস্থানের দিনগুলোর কথা ভাবছে ইউসুফ।
হাত ধরে ইউসুফকে দরজার কাছে নিয়ে গেল টোরা। নিঃশব্দে আপনা–আপনি খুলে গেল দরজা। কম্পাউন্ডে বেরিয়ে এল দুজনে।
ইউসুফকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে টোরা। ভূগর্ভে জটিল এক রহস্যভুবন গড়ে তোলা হয়েছে। আশ্চর্য! অদ্ভুত! দেখেশুনে ইউসুফও অবাক না হয়ে পারছে না। কঠিন পাথর খুঁড়ে বিশাল এক গুহা বানিয়ে দেয়ালে ক্রিস্টালের আস্তরণ লাগানো হয়েছে। এরপর ওই গুহায় তৈরি হয়েছে বাড়িঘর।
টোরার হাত ধরে এগিয়ে চলেছে ইউসুফ। একের পর এক অসংখ্য করিডর পেরোচ্ছে। দুই পাশে সারি সারি ঘর। কোনোটা ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্টে ঠাসা, কোনোটাতে ভরে রাখা হয়েছে শাকসবজি আর অন্যান্য খাবার, কোনোটা মেডিকেল রুম, কোনোটা লিভিং রুম।
অবশেষে একটা বিশাল ডিম্বাকৃতি ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে।
‘কাউন্সিল চেম্বার,’ বলে ইউসুফকে ভেতরে ঠেলে দিল টোরা।
বিরাট একটা টেবিল ঘিরে বসে আছে সাতজন নারী–পুরুষ। দুজনকে চেনে ইউসুফ। একজন হিগ। তার মাথায় এখন আবরণ নেই। ধূসর সাদা চুল। ঘরের লোকজনের মধ্যে সে-ই বয়স্ক। টেবিলের একমাথায় বসে আছে।
ইউসুফের চেনা দ্বিতীয়জন রাটিন। বয়সে তরুণ। ইউসুফের দিকে একবার চেয়েই ক্লান্তভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। অন্যরা গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ইউসুফের দিকে।
টেবিলের একপাশে মাঝামাঝি জায়গায় রাখা একটা চেয়ার এনে ইউসুফকে বসিয়ে দিল টোরা। তারপর ঘুরে গিয়ে টেবিলের অন্য মাথায় রাখা একটা খালি চেয়ারে বসল।
উঠে দাঁড়িয়ে ইউসুফের দিকে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাত নাড়াল হিগ। ইউসুফ বুঝল, আজব এই লোকগুলো বাইরের লোককে এভাবেই অভ্যর্থনা জানায়। এটা ওদের রীতি।
‘আমি হিগ,’ বলল সে। ‘আমাদের কলোনিতে আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছি।’
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল ইউসুফ। মৃদু হাসল হিগের দিকে তাকিয়ে।
‘স্বাগতম, মিস্টার ইউসুফ,’ বলল হিগ, ‘আপনার সঙ্গে আমাদের অনেক মিল আছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালোই লাগবে।’
‘পৃথিবীর লোক নন আপনারা, তাই না?’ জিজ্ঞেস করল ইউসুফ।
‘না। মহাকাশ থেকে এসেছি।’
‘মহাকাশের কোন গ্রহ থেকে?’
‘আপনাদের আর আমাদের গ্যালাক্সি একটাই। পৃথিবীর উল্টো দিকে এই গ্রহ। স্যাজিট্যারিয়াস আর্মে অবস্থিত, এখান থেকে ৬০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে।’
‘৬০ হাজার আলোকবর্ষ!’ ভ্রু কোঁচকাল ইউসুফ। ‘ওখান থেকে আসতে তো সুপারলাইট স্পিড দরকার।’
‘হ্যাঁ,’ বলল টোরা।
‘আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি আপনাদের?’ হিগের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ইউসুফ।
‘না।’
‘আপনাদের মতো ভোঁতা স্পেসক্র্যাফট নিয়ে তো আর চলাফেরা করি না আমরা,’ বলল রাটিন।
‘পৃথিবীতে কী উদ্দেশ্যে এসেছেন?’ জিজ্ঞেস করল ইউসুফ। রাটিনের কথায় কান দিল না।
‘আপনাদের জীবজগৎ পরীক্ষা করে দেখতে এসেছি,’ হিগের কণ্ঠে মৃদু উত্তেজনা। ‘বিশেষ করে আদিম জীবের বংশধর কিছু আছে কি না, জানা প্রয়োজন আমাদের। দুটি গ্রহেরই লাইফ সাইকেল প্রায় এক। ইভল্যুশনও নিশ্চয় এক হবে।’
‘বিজ্ঞানে আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছেন আপনারা, ধরে নিতে পারি,’ বলল ইউসুফ।
‘অনেক!’ হিগ জবাব দিল।
‘দেখেশুনে বিরক্তি ধরে গেছে আমার। বাইরের যেকোনো গ্রহ থেকে যে-ই আসুক, দেখা যাচ্ছে, সবাই আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান। এই গ্যালাক্সিতে আমরাই সবচেয়ে পিছিয়ে আছি।’
‘এর কারণ, আপনাদের গ্রহটা ওই সব গ্রহের তুলনায় নতুন।’
‘তা-ই হবে। আর সে জন্যই আমাদের বোকা ভাবা হয়, আদিমতার গন্ধ লেগে আছে মনে করে গিনিপিগ বানানো হয়। সেটাও কি আমাদের ভালো লাগে মনে করেছেন?’
‘না, করিনি,’ জবাবটা দিল টোরা। ‘আমাদের সঙ্গে কেউ এ রকম আচরণ করলে আমাদেরও ভালো লাগত না। তবে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। যাদের ধরে এনে পরীক্ষা করি আমরা, ছেড়ে দেওয়ার আগে কিন্তু তাদের স্মৃতি থেকে সব কথা মুছে দেওয়া হয়।’
‘তাতে লাভটা কী?’ ভ্রু নাচাল ইউসুফ। ‘আধা পাগল হয়ে যায়।’
চেয়ারে ঝুঁকে বসেছে হিগ। ‘সমগোত্রীয় অন্য সবার চেয়ে আপনি আলাদা, মিস্টার ইউসুফ, তাই এটা বুঝতে পারছেন। বাকি যাদের ধরে এনেছি, তারা কিন্তু একদমই কিছু বুঝতে পারে না। রাটিন তো বলে, ওরা এক্কেবারে আদিম।’
‘পৃথিবীতে একটি প্রবাদ আছে,’ বলল ইউসুফ, ‘সেটা হলো, পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়।’
‘মিস্টার ইউসুফ,’ থমথমে গলায় বলল রাটিন, ‘কথাটা তুললেনই যখন, তখন বলি, পৃথিবী ছাড়ার আগে আপনাদের একটি বড় শহরে পাগলামি দেখিয়ে যাওয়ার খুবই ইচ্ছা আমার। সেটা আপনাদের চিটাগাং কিংবা ঢাকা শহরও হতে পারে।’
‘ধন্যবাদ,’ ব্যঙ্গের হাসি হাসল ইউসুফ। ‘পাগলদের এড়িয়ে যেতে জানে পৃথিবীর মানুষ।’
‘থাক থাক, ঝগড়া–বিবাদ করে লাভ নেই,’ বাধা দিল হিগ। ‘তা মিস্টার ইউসুফ, একটা কথার জবাব দেবেন? আমাদের এত আন্ডার এস্টিমেট করার কারণটা জানতে পারি?’
‘প্রথমত, অনেক অদ্ভুত এবং আশ্চর্য জিনিস দেখেছি আমি জীবনে। দ্বিতীয়ত, আপনাদের ভাষায় “বর্বর” হলেও মহাকাশ সম্পর্কে যৎসামান্য জ্ঞান আমাদেরও আছে। তাই জানি, মহাকাশের অসংখ্য গ্রহে অতি বুদ্ধিমান জীবের বাস সম্ভব। তৃতীয়ত, আপনারাই প্রথম নন।’
‘প্রথম নই মানে?’
‘আপনারাই শুধু নন, এর আগেও ভিনগ্রহবাসী বুদ্ধিমান জীবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে আমাদের। একটু আগেই তো বললাম।’
টেবিলের চারধারে বসা প্রত্যেকটি লোক অবাক হয়ে ইউসুফের মুখের দিকে তাকাল। ওরা যেন ভেবেই রেখেছিল, পৃথিবীর বাজার ওরাই প্রথমে দখল করেছে।
‘অন্য গ্রহবাসী আগেই এসেছে?’ জিজ্ঞেস করল টোরা।
‘এসেছে,’ ইউসুফ বলল। ‘আমেরিকার কেপ কেনেডিতে দেখা হয়েছে তাদের সঙ্গে। বছর দেড়েক আগে!’
‘কোন গ্রহের বাসিন্দা?’ জানতে চাইল হিগ।
‘কাছাকাছি একটি গ্যালাক্সি থেকেই এসেছিল। গ্রহটির নাম তাউ সেতি।’
‘ওহ্ ওরা!’ নাক সিটকাল রাটিন, ‘ওরা তো সবাই পাগল। গ্রহের নামই দিয়েছি আমরা পাগলা গ্রহ। অদ্ভুত একটা রেডিয়েশন দিয়ে সারাক্ষণ গ্রহটিকে ঘিরে রেখেছে ওরা। বাইরের কেউ যাতে ঢুকতে না পারে।’
‘ঠিকই তো করেছে। তার মানে, আরও অনেকেই আছে এই সৌরজগতে, যারা জু-কিপারদের পছন্দ করে না।’
‘মাথামোটার দল!’
‘তুমি থামো রাটিন!’ এবারেও বাধা দিল হিগ। ‘হ্যাঁ মিস্টার ইউসুফ, কী করে সেতিয়ানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো আপনাদের?’
‘একটা স্পেস শাটল ভেঙে পড়েছিল সাগর উপকূলে। চারজন লোক ছিল ভেতরে। একজন আগেই প্যারাস্যুট–জাতীয় একটি জিনিস পরে লাফিয়ে নামে। কোনো ক্ষতি হয়নি তার। অন্য তিনজন মারা গেছে রেডিয়েশনে। আমাদের মহাকাশযানে করে লোকটিকে তার মাদার শিপে পৌঁছে দেওয়ার সৌভাগ্য আমারই হয়েছিল।’
‘সে যা–ই হোক,’ কথার মোড় ঘোরাল হিগ। ‘আপনি একটি অসাধারণ সৃষ্টি, মিস্টার ইউসুফ।’
‘কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমি,’ টোরার দিকে চোরাদৃষ্টি হানল ইউসুফ, ‘অত খাতির–তোয়াজ করা হচ্ছে কেন আমাকে?’
‘আপনাকে বেশ কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসার আছে টোরার,’ ইউসুফের প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল হিগ। ‘ওর স্পেশালিটি নায়োসিনথেটিক, মানে অতি উন্নত বায়োনিক কনস্ট্রাকশন। ভিটু ওরই সৃষ্টি।’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টোরার দিকে তাকাল ইউসুফ। ‘ট্যালেন্টেড লেডি। পরীক্ষার জন্য এত দিনে নিজের সাবজেক্ট পেয়েছে।’
দশ
বেস ক্যাম্প। কাঁটাতারের বেড়ার এক পাশে এসে দাঁড়িয়েছে একটি জিপ। জোরে হর্ন বাজাল। তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন আশফাক খান। জিপটি দেখেই ছুটে গেলেন। সার্চ পার্টির জনাপাঁচেক লোক বসে আছে জিপে। ড্রাইভিং সিটের পাশে বসা শারিতা। মুখ শুকনো, চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। কিন্তু দেহ অক্ষতই আছে।
‘শারিতা!’ আশফাক খানের কণ্ঠে খুশির আমেজ।
ভোঁতা দৃষ্টিতে আশফাক খানের দিকে তাকাল শারিতা। কোনো অভিব্যক্তি নেই চেহারায়। যেন আশফাক খানকে চিনতেই পারছে না।
‘শারিতা, চিনতে পারছ না, আমি আশফাক।’
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই শারিতার।
অবাক হলেন আশফাক খান। ওদিকে পাঁচজন জিপ থেকে নেমে এসেছে। একজনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘ওকে কোথায় পেয়েছ?’
‘হিম পাহাড়ের পশ্চিম দিকের ঢালে। হারিয়ে যাওয়া সেন্সরটাও ওর সঙ্গেই ছিল,’ এগিয়ে গিয়ে জিপের ড্যাশবোর্ড থেকে কালো কাগজের একটি প্যাকেট নিয়ে এল লোকটা। ‘ওকে অপ্রকৃতিস্থ দেখে সামলে রেখেছি জিনিসটা,’ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা আশফাক খানের হাতে দিতে গেল লোকটা।
নিলেন না আশফাক খান। শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঠিক আছে তো?’
‘তা তো জানি না, স্যার। যে অবস্থায় পেয়েছি, সেভাবেই রেখে দিয়েছি।’
‘টেকনিশিয়ানরা দেখলেই বুঝতে পারবে, খারাপ হয়ে গেছে কি না,’ আবার শারিতার দিকে ফিরলেন আশফাক খান, ‘কোথায় ছিলে তুমি, শারিতা?’ এগিয়ে গিয়ে আলতোভাবে তার হাত স্পর্শ করলেন। দুচোখ বড় বড় করে তাকাল শারিতা। যেন আশফাক খানকে ভয় পাচ্ছে সে।
‘কোথায় ছিলাম?’ আনমনে বিড়বিড় করল শারিতা, ‘তা তো জানি না। সেন্সরটা বসিয়ে রিডিং নিচ্ছিলাম আমরা।’
‘হ্যাঁ, তারপর? মনে করার চেষ্টা করো,’ নরম গলায় বললেন আশফাক খান।
মনে করার চেষ্টা করছে শারিতা। ‘রিডিং নিচ্ছিলাম...তারপর...তারপর...। নাহ্, কিছুই জানি না আমি। জাফর কোথায়?’
‘ওর কাছে যাবে, শারিতা? ঠিক আছে নিয়ে যাবে ওরা তোমাকে। ইউসুফ কোথায় বলতে পারো?’
‘কেন, ও তো বেস ক্যাম্পেই ছিল! আমাদের সঙ্গে কথা বলছিল রেডিওতে,’ থেমে গেল শারিতা।
‘হুঁ!’ হতাশা ঢাকার চেষ্টা করলেন আশফাক খান। ‘যাও, ওরা তোমাকে জাফরের কাছে নিয়ে যাবে।’
আশফাক খানের আদেশ পেয়ে আবার জিপে উঠে বসল পাঁচজন।
ধুলা উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে জিপটা। সেদিক তাকিয়ে ভাবছেন আশফাক খান। স্বামীর কাছে ফিরে যাচ্ছে শারিতা। ওদের দুজনের জন্য এই অভিযান শেষ। কিন্তু তার জন্য, আবু তাহেরের জন্য সবে শুরু। আরও একজনের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না আশফাক খান। সে ইউসুফ পাশা।
ভূগর্ভকক্ষে ভিনগ্রহবাসীদের সঙ্গে ইউসুফের দীর্ঘ মিটিং চলছে।
‘কত দিন ধরে আছেন আপনারা পৃথিবীতে?’ জিজ্ঞেস করল ইউসুফ।
‘দুই বছর,’ জবাব দিল হিগ। ‘এই দুই বছরে পরীক্ষার জন্য অনেক লোককে ধরে এনেছে ভিটু। এদের দেহের ভেতরে বাইরের প্রতিটি মিলিমিটার পরীক্ষা করে দেখেছি আমরা। ওদের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলেছি, যেমন আপনার সঙ্গে বলছি এবং তাদের নিরাপদে আবার ফিরিয়ে দিয়ে এসেছে ভিটু, যেখান থেকে তুলে এনেছিল।’
‘শারিতার কী অবস্থা?’
‘ওকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে,’ বলল টোরা।
‘ফিরে যাওয়ার পর জাফর কিন্তু এখানকার কোনো কথাই বলতে পারেনি।’
‘শারিতাও পারবে না। কারণ, ভিটু তাদের তুলে আনার পর থেকে ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত মাঝখানের এই সময় মুছে দেওয়া হয়েছে তাদের স্মৃতি থেকে,’ হিগ বলল।
‘ফিরিয়ে দেওয়ার আগে আমার স্মৃতি থেকেও নিশ্চয় তোমাদের কথা মুছে দেওয়া হবে?’
‘তা তো দিতেই হবে।’
‘হুঁ,’ ধীরে ধীরে মাথা দোলাল ইউসুফ। ‘আচ্ছা, একটা কথা জানতে বড় ইচ্ছা করছে। তুমি তখন হঠাৎ করে উধাও হয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিলে। নিশ্চয় কোনো যন্ত্রের সাহায্যে। যন্ত্রটা কী, বলবে?’
‘স্মৃতি থেকে যখন সব কথা মুছেই দেওয়া হবে আপনার, বলতে আর অসুবিধা কী?’ টোরার হয়ে জবাবটা দিল হিগ। পকেট থেকে ছোট্ট একটা জিনিস বের করল। আকারে সিগারেটের প্যাকেটের সমান। ‘আমাদের বিজ্ঞানীদের সৃষ্টি একটা চমৎকার জিনিস,’ বাক্সমতো জিনিসটা ইউসুফকে দেখিয়ে বলল সে, ‘উন্নত মানের স্পেসক্র্যাফট নিয়ে গবেষণার সময়েই এটি আবিষ্কার করে তারা। এর নাম দিয়েছি আমার টাইম লাইন কনভার্টার। সংক্ষেপে টিএলসি। এর সাহায্যে ইচ্ছা করলে অতীত-ভবিষ্যৎ যেকোনো সময়ে চলে যেতে পারবেন আপনি।’
‘তা-ও কি সম্ভব?’
হাসল হিগ। ‘কেন সম্ভব না?’
বিস্ময়ে ভুরু কুঁচকে গেছে ইউসুফের। কপালে ভাঁজ পড়েছে কয়েকটা।
টেবিলের চারপাশে বসা সবার দিকে একবার করে তাকাল ইউসুফ। সবার মুখেই হাসি। তবে রাটিনের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি।
ব্যাপারটা লক্ষ করল হিগ। রাটিনের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করল। তারপর ইউসুফের উদ্দেশে লেকচার চালিয়ে গেল আবার, ‘সময়ের মধ্যে বিচরণ করা ছাড়াও আরও অনেক কিছু করতে পারে টিএলসি। যেমন এর সাহায্যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া যায়।’
হিগের কথা শেষ হওয়ার আগেই পকেট থেকে নিজের টিএলসিটা বের করে একটা সুইচ টিপল রাটিন। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। এদিক–ওদিক তাকিয়ে শেষে তাকে দরজার কাছে দাঁড়ানো দেখতে পেল ইউসুফ। দাঁত বের করে হাসছে রাটিন।
‘অবাক হয়ে গেছ, না?’ বলেই আবার সুইচ টিপে অদৃশ্য হয়ে গেল রাটিন।
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকাল ইউসুফ। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে রাটিন। মুখে ব্যঙ্গ আর তাচ্ছিল্যের হাসি বিদ্যমান। লোকটার ওপর বিষিয়ে গেছে ইউসুফের মন। এক চড়ে সব কটা দাঁত খসিয়ে দেওয়ার ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে রোধ করল সে।
‘নিজের চেয়ারে গিয়ে বসো, রাটিন,’ গম্ভীর গলায় আদেশ দিল হিগ।
হিগের কর্তৃত্ব সহ্য করতে পারল না রাটিন। খনখনে গলায় বলল, ‘দেখো হিগ, তুমি...’
‘যাও, বসো!’ কড়া গলায় হুকুম দিল হিগ। চোখে চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল দুজনে। শেষ পর্যন্ত হার মানল রাটিন। চোখ নামিয়ে নিয়ে টিএলসির সুইচ টিপে ফিরে গেল নিজের চেয়ারে। যন্ত্রটা পকেটে রেখে দিয়ে টেবিলে টাট্টু বাজাতে শুরু করল। এই দলের ‘দুষ্টু ছেলে’ সে, আকারে–ইঙ্গিতে এটাই যেন জানাচ্ছে।
‘যা–ই বলুন, মিস্টার ইউসুফ,’ হিগের গলায় ক্ষোভ। ‘ইয়াং জেনারেশনটাই এমন উদ্ধত। পাঁচ বছরের মিশন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি। এমনিতেই কঠিন কাজ। তার ওপর এদের সামলাতে...’ ইঙ্গিতে বাকি কথাটা বুঝিয়ে দিল সে।
‘এসব বলে আর লাভ নেই। আমাদের ইয়াং জেনারেশনের অনেকেও বোধ হয় সেদিকেই যাচ্ছে,’ বলল ইউসুফ।
‘আসলে সব গ্রহের মানুষেরই স্বভাব-চরিত্রই কমবেশি এক রকম,’ মন্তব্য করল টোরা।
‘ইয়াং জেনারেশন থাকুক,’ ইউসুফ বলল, ‘আসল কথায় আসা যাক। তিন মাসে ৬০ হাজার আলোকবর্ষ পেরিয়েছেন আপনারা। অথচ আমাদের সবচেয়ে দ্রুতগামী স্পেসক্র্যাফটেরও এ দূরত্ব পেরোতে লাখ লাখ বছর লেগে যাবে। গতিবেগ কত ছিল আপনাদের যানের?’
‘সাবলাইট টার্মে সুপারলাইট গতিবেগের হিসাব দেওয়া যায় না,’ বলল হিগ। ‘তা ছাড়া পৃথিবীতে এর কোনো পরিভাষা নেই। আমাদের মাপটা বলতে পারি, কিন্তু দুর্বোধ্য লাগবে আপনাদের কাছে। আরও অন্তত দুই হাজার বছর পরে এই মাপ শিখবে পৃথিবীর লোকে।’
‘এক কাজ করুন না,’ হালকা গলায় বলল ইউসুফ, ‘আপনাদের ওই টিএলসির সাহায্যে দয়া করে আমাকে দুই হাজার বছর ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দিন না। আমাকে ভিটুর মতো রোবট বানিয়ে পাঠালেও আপত্তি করব না। ভবিষ্যতের পৃথিবী আর এর উন্নতি দেখার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছি আমি।’
ইউসুফের কথার ধরনে রাটিন ছাড়া সবাই হেসে উঠল।
‘আরেকটা কথা,’ ইউসুফ বলল, ‘ভিটুর হাত ছিঁড়ে ফেলার জন্য সত্যিই দুঃখিত আমি। ছিঁড়তে আমি চাইনি। ওর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম শুধু। ও কেমন জীব জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও কোনো উত্তরই দেয়নি। আমাকে আক্রমণ করা ছাড়া আর কোনো চিন্তাই যেন ছিল না ওর মাথায়।’
‘ওর জন্য ভাববেন না,’ অভয় দিল টোরা। ‘আবার মেরামত করে ফেলা হয়েছে ওকে। দরকার পড়লেই ঘুম থেকে জাগিয়ে দেব।’ হিগের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখনকার মতো ওঠা যাক, নাকি?’
মাথা নেড়ে সায় দিল হিগ।
এগারো
শারিতাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে জিপটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন আশফাক খান। পাশে এসে দাঁড়ালেন আবু তাহের।
‘নিউক্লিয়ার ডিভাইস এসে গেছে,’ বললেন আবু তাহের। ‘ছোট্ট। এক মেগাটন। কিন্তু এটাই মাঝারি আকারের একটি পাহাড় উড়িয়ে দিতে যথেষ্ট।’
‘কোন জায়গায় বসানো হবে বোমাটা?’ জানতে চাইলেন আশফাক খান।
‘হিমপাহাড়ের মাইল দুয়েক উত্তর-পশ্চিমে, ফল্ট লাইন ঘেঁষে। হাই-ইনটেনসিটি লেজার ড্রিলের সাহায্যে গর্ত খোঁড়া হবে মাটিতে। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই বসানো হয়ে যাবে বোমা। সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণ ঘটাব।’
‘শারিতাকে তো পেলাম,’ থমথমে আশফাক খানের গলা। ‘শুধু ইউসুফকে পাওয়া গেলেই নিশ্চিন্তে বোমা ফাটানো দেখতাম আমি এখন।’
‘উপায় নেই মিস্টার খান,’ সান্ত্বনা দেওয়ার মতো করে বললেন তাহের। কিন্তু জোর নেই গলায়। ‘কম্পিউটার প্রিন্ট আউট তো নিজের চোখেই দেখেছেন।’
‘দেখেছি, তাহের, কিন্তু!’ আশা ছাড়তে পারছেন না আশফাক খান। ‘ফল্টের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের ধারণা তো ভুলও হতে পারে। ধরো, এইবারের মতো ভুল করে বসল কম্পিউটার? ওটা তো যন্ত্র। সব সময়ই নির্ভুল সমাধান না-ও তো দিতে পারে?’
‘তা পারে,’ বললেন আবু তাহের। ‘কিন্তু সে সম্ভাবনা লাখে এক ভাগ। তবু অন্য একটা টেস্টের ব্যবস্থা করেছি।’
‘কী টেস্ট?’ আগ্রহে সামনে ঝুঁকে এলেন আশফাক খান।
‘সেন্সর জানাচ্ছে, মূল ফল্ট–সংলগ্ন আরও কয়েকটা সাবফল্টে আগে ছোটখাটো ভূকম্পন শুরু হবে। এগুলো থেকেই কম্পনটা মূল ফল্টে ছড়িয়ে পড়বে।’ হাতঘড়ির দিকে তাকালেন আবু তাহের। ‘আর ১৭ মিনিটের মধ্যেই শুরু হবে প্রথম কম্পন। কম্পন শুরু হলেই...’ কথা শেষ না করে থেমে গেলেন তাহের।
‘শুরু হলে কী হবে?’
‘বুঝতে হবে প্রচণ্ড ভূমিকম্প হবে।’
আবু তাহেরের চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন আশফাক খান।
‘আর ১৭ মিনিট পরেই পুরোপুরি শিওর হয়ে যাব কম্পিউটার মিথ্যা তথ্য দিয়েছে কি না,’ আবু তাহের বললেন।
করিডর ধরে এগিয়ে চলেছে টোরা আর ইউসুফ।
‘আর কত দিন পৃথিবীতে থাকবে তোমরা?’ জিজ্ঞেস করল ইউসুফ।
‘কমপক্ষে তিন বছর। তার আগে শিপ আসবে না।’
‘তোমাদের শিপটা দেখতে ইচ্ছা করছে আমার।’
‘তাহলে তিনটি বছর অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে,’ হাসল টোরা। দ্বিধা করে শেষে বলেই ফেলল, ‘বাইরে চলে না গিয়ে তিনটি বছর যদি আমাদের সঙ্গে থাকেন আপনি, খুশি হব। কারণ, আপনি একজন প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী স্পেশাল মানুষ।’
‘বরং বলো, স্পেশাল রোবট,’ কিছুটা দুঃখের সঙ্গেই বলল ইউসুফ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘স্বাভাবিক মানুষ যখন ছিলাম, এখনকার চেয়ে ভালো ছিলাম। অন্তত মনের দিক থেকে তো সুখে ছিলাম। যাকগে ওসব কথা। আমি থাকলে তুমি খুশি হবে কেন?’
‘আমাদের গবেষণায় অনেক সাহায্য করতে পারবেন।’
‘গবেষণা পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে তো? কী করে ভাবলে নিজের জাতের সঙ্গে বেইমানি করব আমি?’
‘না, ভাবিনি। আমি জানি, আপনি তা মরে গেলেও করবেন না। তবে ভিটুর অপারেশনে সাহায্য করতে নিশ্চয় আপত্তি নেই আপনার?’
‘না, তা নেই। চলো, কী সাহায্য করতে হবে।’
হিমপাহাড় বেস। একটা ওয়ার্ক টেবিল ঘিরে উদ্বিগ্নভাবে দাঁড়িয়ে আছেন আশফাক খান, আবু তাহের এবং আরও কয়েকজন। প্রথম ভূকম্পনের অপেক্ষায় সবাই।
‘১৫ সেকেন্ড আর,’ ঘড়ি দেখে বললেন আবু তাহের। হাতটা মৃদু মৃদু কাঁপছে তার। ডান হাত রাখা একটা কফি কনটেইনারের ওপর।
কাঁধ আর গালের মাঝখানে টেলিফোন রিসিভার চেপে ধরে আছেন আশফাক খান।
‘হ্যাঁ, জেনারেল,’ জেনারেল এরফানের সঙ্গে কথা বলছেন আশফাক খান, ‘যদি প্রথমে এই ছোটখাটো ভূকম্পন ঘটে, তো আবু তাহের বলছেন, মেজর আর্থকোয়েকে আর ৭ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের মধ্যেই কয়েকটা বড় বড় শহর হারাব আমরা।’
‘আট সেকেন্ড,’ ঘোষণা করলেন আবু তাহের।
‘প্লিজ, স্ট্যান্ডবাই, জেনারেল,’ অনুরোধ করলেন আশফাক খান।
‘ছয় সেকেন্ড,’ হাতঘড়ির দিক থেকে চোখ সরাচ্ছেন না আবু তাহের, ‘পাঁচ চার তিন দুই এক...’
অস্বস্তিকর নীরবতা। থমথম করছে টেবিল ঘিরে দাঁড়ানো লোকগুলোর মুখ। কিন্তু কিছুই ঘটছে না। পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করলেন—আবু তাহের আর আশফাক খান।
আরও এক সেকেন্ড দেখলেন আবু তাহের। তারপর এগিয়ে গিয়ে খটাখট কয়েকটা বোতাম টিপে দিলেন কম্পিউটারের। রিডিং ডায়ালের দিকে একনজর তাকিয়েই আশফাক খানের দিকে তাকালেন, ‘ঠিকই আছে। কম্পন অনুভব করব আমরা, কনফার্ম করেছে কম্পিউটার।’
‘ভোঁতা যন্ত্রটা ভুল বকছে,’ বললেন আশফাক খান।
‘কী জানি।’ অনিশ্চিত আবু তাহেরের গলা।
‘ভূমিকম্পই হবে না,’ দৃঢ় গলায় বললেন আশফাক খান। ‘না এখন, না সাত-আট ঘণ্টা পর।’
‘হয়তোবা,’ জোর নেই আবু তাহেরের গলায়।
‘থ্যাংক গড,’ বললেন আশফাক খান। ‘নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডগুলো আর্সেনালে ফিরিয়ে নেওয়ার আদেশ দিচ্ছি আমি এক্ষুনি। রিলিজ পেপার সই করে দিচ্ছি।’
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল টেবিল ঘিরে দাঁড়ানো সব লোক।
রিলিজ পেপারটার দিকে তাকিয়ে আছেন আবু তাহের। তার ধারণা যে ঠিক হলো না, এতে বরং খুশিই তিনি। ইউসুফের জন্য ভাবনা অনেকখানি কমে গেল ভূমিকম্প না হওয়ায়।
‘জেনারেল,’ ফোনে আবার কথা বলছেন আশফাক খান, ‘সুসংবাদ!’ খুশি উপচে পড়ছে তাঁর গলায়, ‘ভূকম্পন হয়নি! মনে হচ্ছে কম্পিউটার ভুল করেছে...’
কথা শেষ হলো না তার। আচমকা থেমে গেলেন তিনি। পাহাড়ের দিক থেকে একটা অদ্ভুত চাপা শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভয় পেয়ে আকাশে উঠে গেছে পাখির দল। রেডিওর ওপরে কফিভর্তি কাপ রেখেছিলেন আবু তাহের, কাঁপতে শুরু করেছে কাপটা। ছলকে রেডিওর ওপর পড়ল বাদামি তরল। কম্পন শুরু হয়ে গেছে। ছোট ছোট লাফে রেডিওর একেবারে কিনারায় চলে এল কাপটা, তারপর কাত হয়ে টেবিলে গড়িয়ে পড়ে গেল। ভেঙে চুরমার হলো। কফিতে ভিজে গেল রিলিজ পেপার।
মিনিট তিনেক থাকল কাঁপুনি। শুধু আবু তাহেরেরটাই নয়, টেবিলে রাখা আরও অনেকের কফির কাপ স্থানচ্যুত হয়েছে। এ ছাড়া আর কোনো ক্ষতি হয়নি।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আশফাক খান। কানে ঠেকানোই আছে টেলিফোন রিসিভার। ওপাশ থেকে সমানে চেঁচাচ্ছেন জেনারেল এরফান। কী ঘটছে জানতে চাইছেন।
জেনারেলকে নয়, নিজেকেই ফিসফিস করে বললেন আশফাক খান, ‘ইউসুফকে আর বাঁচানো গেল না। খোদা!’
শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন আবু তাহের।