খাটের তলায় কে

সমস্যাটা শুরু হয়েছে দ্বিতীয় রাত থেকেই।

নতুন এই ফ্ল্যাটে তিনুরা এসেছে গতকাল। ফ্ল্যাটটা তিনুর খুব পছন্দ হয়েছে। দক্ষিণ আর পশ্চিম দিক খোলা। ছয়তলা ভবন। ওদের ফ্ল্যাট চারতলায়। এখনো সব ফ্ল্যাটে সবাই ওঠেনি। কেবল তিনুরা আর তিনতলায় পেছনের দিকে একটা পরিবার। ওদের সঙ্গে এখনো চেনাজানা হয়নি। হবে। মাত্র তো এল। গুছিয়ে নিয়েই পরিচিত হবে।

কিন্তু এত সুন্দর একটা বাড়ির প্রায় সব ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। বিষয়টা স্বাভাবিক নয়। যদিও বাড়িটা বেশ নিরিবিলি। একটা আবাসিক প্রকল্পের শেষ বাড়ি। বাড়ির দক্ষিণে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের ওপাশে একটা দিঘি। বিশাল। বারান্দা থেকে দিঘির টলটলে জল দেখা যায়। দিঘিটা হয়তো একসময় থাকবে না। তিনু জানে। দখল হয়ে যাবে। তারপর ওখানেও উঠবে উঁচু উঁচু ভবন। দিঘির ওপারে দিগন্তবিস্মৃত মাঠ। সে মাঠে এখন ধানগাছ। সবুজ।

বেশ সস্তায় ফ্ল্যাটটা পেয়েছে তিনুরা। এত সস্তায় ফ্ল্যাট পেয়ে বেশ অবাকই হয়েছিল ওরা। ফ্ল্যাটের মালিকের নাকি ভীষণ টাকার দরকার ছিল। তাই চটপট বিক্রি করে দিয়েছে।

নতুন ফ্ল্যাটের প্রথম রাতে কিছুই টের পায়নি তিনু। বাতি নিভিয়ে চোখ বুজতেই ঘুম চলে এসেছিল। দ্বিতীয় রাত থেকেই সমস্যা শুরু। বাতি নিভিয়ে কেবল শুয়েছে তিনু, অমনি খাটের তলায় খুটখাট শব্দ। ইঁদুর?

কিন্তু এই নতুন ফ্ল্যাটে ইঁদুর আসবে কোত্থেকে? তাহলে? তেলাপোকা? তেলাপোকারা তো অমন শব্দ করে না। তাহলে?

বাতি জ্বালিয়ে উঁকি মেরে দেখবে? বিছানা থেকে নেমে বাতি জ্বালাতে হবে। শব্দের কারণে বিছানা থেকে নামতে ভয় পাচ্ছে তিনু। শব্দটা অদ্ভুত। ব্যাখ্যা করে বোঝানো যায় না। একই রকম—বাড়েও না, কমে না। পুরো বাড়ি নীরব। সুনসান! রাতও হয়েছে অনেক। মা আর ভাইয়া ঘুমিয়ে পড়েছে।

আগের ফ্ল্যাটে ও মায়ের সঙ্গে ঘুমাত। কিন্তু এই ফ্ল্যাটে ওর নিজের একটা ঘর হয়েছে। এতেই ও ভীষণ খুশি। কিন্তু শব্দটা? যতই সময় যাচ্ছে, অদ্ভুত শব্দে ততই ভয় বাড়তে লাগল তিনুর। মাকে ডাকবে?

ডাকবে না। তিনু জানে মা খুব ক্লান্ত। সারা দিন মায়ের ভীষণ পরিশ্রম গেছে। ঘাপটি মেরে বিছানায় শুয়ে রইল ও। ভয়ে ভয়ে কাটাল সারা রাত। শব্দ আর ভয়ে একফোঁটা ঘুম হয়নি। তবু দুচোখ বুজে শুয়েছিল। ঘুমিয়েছিল কিছুক্ষণ? জানে না। কিন্তু চোখ খুলতেই দেখল পুরো ঘর আলোয় ঝলমল করছে।

বিছানা থেকে নামল তিনু। আর নেমেই উঁকি দিল খাটের তলায়।

কিচ্ছু নেই খাটের তলায়। খাঁ খাঁ। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন।

ঘরের দরজা খুলে বেরোল। দরজার ওপাশেই খাবার ঘর। খাবার টেবিলে মা আর ভাইয়া বসে আছেন। দরজা খোলার শব্দে দুজনই তাকালেন তিনুর দিকে। আর তিনুকে দেখেই চমকে উঠলেন মা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে তিনু? রাতে ঘুম হয়নি?’

তিনু স্বীকার করল, ‘না।’

‘অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলি?’

‘না।’

‘তাহলে?’

বলেই মুখটা মলিন করলেন বাবা। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন লাগল তিনুর। ভীষণ অনুশোচনা হতে লাগল। অন্য রকম এক খারাপ লাগা শুরু হলো ওর। আর সেই খারাপ লাগা থেকেই ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। মা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দিলে তো মেয়েটাকে কাঁদিয়ে।’

এড়িয়ে যেতে চাইল তিনু। কিন্তু মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে পারল না। মা বললেন, ‘আমি তো জানি তুই রাত জাগতে পারিস না। কিন্তু তোকে দেখে বুঝতে পারছি, গত রাতে তোর ঘুম হয়নি। কিছু হয়েছে?’

‘রাতে আমার ভীষণ ভয় লেগেছে মা। ভয়ে ঘুম আসেনি।’

‘ভয়!’ আরও অবাক হলেন মা। ‘ভয়ে ঘুম আসেনি! তুই তো সাহসী মেয়ে! কিসের ভয়?’

‘জানি না। মনে হয়েছে আমার খাটের তলায় কেউ ছিল। সারা রাত ছোটাছুটি করেছে। ছোটাছুটির শব্দে ঘুম আসেনি।’

‘বলিস কী! আমাকে ডাকিসনি কেন?’

‘ডাকলে কী হতো?’

তিনুর এ কথার জবাব দিলেন না মা। হয়তো অভিমান করেই তাকে ডাকেনি তিনু। তিনু এখন বেশ অভিমানী হয়েছে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও এমন ছিল না। বয়সটাই এমন। এই বয়সে এক-আধটু এমন হয়। একটুতেই অভিমান করে। গাল ফোলায়। অকারণ কান্নাকাটি করে। হইচই করে। অদ্ভুত আচরণ করে। তবে সবাই না। কেউ কেউ। এই কেউ কেউয়ের একজন তিনু।

টিপু আবার অন্য রকম। সকালের নাশতায় রুটির সঙ্গে আলু আর ডিমভাজি খাচ্ছিল ও। এমনিতে খাবারের সময় টিপু কোনো কথা বলে না। চুপচাপ খেয়ে নেয়। কিন্তু এখন ফোড়ন না কেটে থাকতে পারল না। ‘মওনে অয় ভূ-উ-ত!’

মুখের খাবারটুকু তখনো গিলতে পারেনি টিপু।

চমকে উঠল তিনু, ‘কী!’

মুচকি হেসে মা বললেন, ‘নাহ্‌! ভূত বলে কিছু নেই। ওটা কিছু না। মনের ভুল।’

মনের ভুল! মানতে পারছে না তিনু। কিছু একটা বলতে চাইল। পারল না।

ততক্ষণে খাবারটা গিলে ফেলেছে টিপু। বলল, ‘পেটে দিলে মাথায় সয়, বুঝলি?’

তিনু বলল, ‘মানে?’

‘রাতে তোর খিদে পেয়েছিল?’

‘জানি না।’

‘নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছিল।’

আরও পড়ুন

বলেই আরেক টুকরা রুটি মুখে পুরল টিপু। তারপর আয়েশ করে চিবোতে লাগল। রুটির সঙ্গে ডিম আর আলুভাজি তিনুর খুব প্রিয়। টিপুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তিনু। খাওয়া দেখছে। কী মজা করে খাচ্ছে টিপু!

টিপু বলল, ‘ডিম আর আলুভাজি দিয়ে রুটি খেয়ে দেখ, দারুণ মজা!’

‘ডিম আমার ভালো লাগে না।’

‘এ জন্যই তো ভূতেরা তোকে ভয় দেখায়।’

বলেই খিকখিক করে হাসতে লাগল টিপু। রাতে ঘুম না হওয়ায় ওর মেজাজ এমনিতেই খিটখিটে হয়ে আছে। তার ওপর টিপুর হাসিটা ভীষণ অসহ্য লাগছে। রেগে গেল তিনু। ভীষণ রেগে গেলে ওর দুচোখ ভিজে ওঠে। তিনুর গাল বেয়ে জল গড়াতে লাগল।

টিপু চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। এগিয়ে এসে বোনের মাথা বুকের মধ্যে চেপে ধরল। বলল, ‘তোকে রাগানোর জন্য বলেছি। ও কিছু না। পেট খালি থাকলে আমাদের মগজ ঠিকঠাক কাজ করে না। মগজের স্নায়ুগুলোর কানেকশন ক্রস হয়ে যায়। আর কানেকশন ক্রস হলে বুঝিসই তো, শর্টসার্কিট হয়ে যায়। তোর সেটাই হয়েছে। আজ তোর ঘরে আমি ঘুমাব। আর তুই আমার ঘরে। দেখব শব্দ করে কে? খুশি? এবার নাশতা খেয়ে নে!’

সঙ্গে সঙ্গে তিনুর রাগ পানি হয়ে গেল। আলুভাজিও ওর ভালো লাগে না। তবু রুটির সঙ্গে ডিম আর আলুভাজি মিশিয়ে খেতে লাগল।

তিনুর ঘরটা পশ্চিমে। পাশেই টিপুর ঘর। মা আর বাবার ঘর দক্ষিণমুখী। যদিও বাবা থাকেন দূরে। ছুটি পেলেই চলে আসেন। দু–তিন দিন থেকে আবার চলে যান। তিনটা ঘরে ওরা তিনজন একা একা থাকে। তবে তিনু ছাড়া রাতে আর কেউ কোনো শব্দ পায়নি। কাজেই বিষয়টাকে মা আর টিপু অতটা গুরুত্ব দিলেন না।

সে রাতে খাবারের পর টিপু বলল, ‘ঘর বদলাবদলি করবি না?’

সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে গেল তিনু। বলল, ‘অবশ্যই।’

টিপুর ঘরে ঢুকল তিনু। আর ঢুকেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বড্ড অগোছালো। সেই সকালে বিছানা ছেড়েছে। এখনো বিছানাটা গোছায়নি। মশারির কেবল একটা কোনা খুলেছে। বাকি তিন কোনা তখনো আটকানো।

টিপুর ঘর দেখেই তিনুর গা কাঁটা দিয়ে উঠল। বলল, ‘নোংরা ঘরে আমি থাকব না!’

রেগে গেল টিপু। বলল, ‘তাহলে নিজের ঘরে যা! ভূতের সঙ্গেই থাক।’

‘যাবই তো!’ বলেই গটগট করে নিজের ঘরে চলে গেল ও।

শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে গল্পের বইয়ের পাতা ওল্টাল। কিন্তু মনোযোগ দিতে পারল না। আলো থাকলে ও ঘুমাতে পারে না। তবু ঠিক করেছে, আজ রাতে বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাবে।

হঠাৎ...ঠক ঠক ঠক।

আলতো একটা শব্দ।

শব্দ! ভয় পেল তিনু। অপেক্ষা করতে লাগল। ভুল শোনেনি তো!

ঠক-ঠক, ঠক-ঠক, ঠক-ঠক।

কানফাটানো আওয়াজ। শব্দটা আসছে ঘরের দরজার ওপাশ থেকে। সঙ্গে মায়ের গলা, ‘তিনু ঘুমিয়ে পড়েছিস?’

এতক্ষণে যেন প্রাণ ফিরে পেল তিনু। মায়ের কণ্ঠ শুনে ভয় চলে গেল। জোরে বলে উঠল, ‘না, মা। এখনো ঘুমাইনি।’

‘দরজা খোল!’

আরও পড়ুন

বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলল। মা বললেন, ‘আমি আজ তোর ঘরে ঘুমাব। দেখি কে তোকে ভয় দেখায়? তুই শুয়ে পড়। আমার একটু কাজ আছে। কাজ শেষ করে আমি এসে তোর পাশে শুয়ে থাকব।’

বলেই মা চলে গেলেন।

মশারি তুলে খাটের ওপর উঠতে গেল তিনু। হঠাৎ থেমে গেল। খাটের তলায় কি কেউ আছে? ভীষণ কৌতূহল হলো ওর। দিনের বেলা বেশ কয়েকবার খাটের নিচটা দেখেছে। কিছুই দেখতে পায়নি।

শরীর বাঁকিয়ে খাটের নিচে উঁকি দিল তিনু। সরাসরি বাতির আলো না পড়লেও খাটের তলা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু একি! কী দেখছে ও!

টেনিস বলের সমান দুটো চোখ! গোল গোল। চোখ দুটোর ওপরে কপাল নেই। এমনকি ভুরুও নেই। দুচোখের মাঝে নিচের দিকে নাকও নেই। শুধুই দুটো চোখ।

চোখ দুটো বোজা। ইয়া বড় বড় পাপড়ি। পাপড়িগুলো কাঁপছে। হঠাৎ... টাস!

চোখ দুটো একসঙ্গে খুলে গেল। মণিহীন টকটকে লাল দুটো চোখ—অপলক তাকিয়ে রইল তিনুর দিকে!

ভয়ে–আতঙ্কে জমে গেল তিনু। পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। তারপর হঠাৎ...

হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চোখ দুটো এগিয়ে আসতে লাগল ওর দিকে। আর তখনই ওর কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে এল তীব্র আর্তচিৎকার। ‘মা-আ-আ!’

চোখ মেলে তাকিয়ে আবারও চমকে উঠল তিনু। দুই জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তবে এই চোখগুলো একটু আগে খাটের তলায় দেখা চোখের মতো বড় নয়। এই চোখগুলোর নিচে নাক আছে। চোখের ওপর ভুরু আছে। ভুরুর ওপর কপালও আছে। চেহারাও আছে। আরে তাই তো! এ তো মা আর টিপুর চোখ! কী হয়েছে ওর?

মা জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে? ভয় পেয়েছিস?’

তিনু বলল, ‘খাটের তলায় কে?’

সঙ্গে সঙ্গে খাটের তলায় উঁকি দিল টিপু। তারপর হাসতে হাসতে বলল, ‘কই? কেউ নেই।’

ফিসফিস করে বলল তিনু, ‘আছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি।’

এবার মা উঁকি দিলেন। বললেন, ‘কিছু নেই। তুই ভুল দেখেছিস তিনু।’

‘না। আমি নিজের চোখে দেখেছি।’

টিপু বলল, ‘তাহলে তুই নিজের চোখেই আরেকবার দেখে আয়।’

নিজের বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে ছিল তিনু। মা আর টিপু ওকে ধরে বসালেন। এবার নিজেই ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামল তিনু। আর ভয়ে ভয়ে উঁকি দিল খাটের তলায়। তিনুর সঙ্গে মা আর টিপুও উঁকি দিল।

মা বললেন, ‘কিছু আছে?’

অবাক হলো তিনু। বলল, ‘একটু আগেও ছিল!’

টিপু বলল, ‘কিছুই ছিল না। সবই তোর চোখের ভুল।’

চোখের ভুল! কিন্তু চোখের ভুল হয় কী করে?

মা বললেন, ‘নিজের চোখেই তো দেখলি, খাটের তলায় কিচ্ছু নেই। এবার ঘুমিয়ে পড়।’

তিনু বলল, ‘মা, আমি তোমার সঙ্গে ঘুমাব।’

মা মুচকি হেসে বললেন, ‘খুব তো হামবড়া ভাব দেখিয়েছিস। বড় হয়েছিস বলে আলাদা ঘরে একা থাকতে চাইলি। এখন?’

তিনু বলল, ‘আমি এ ঘরে থাকব না। তোমার ঘরে তোমার বিছানায় ঘুমাব।’

‘আচ্ছা, চল।’

সে রাতে দারুণ ঘুম হলো তিনুর। মায়ের ডাকে চোখ মেলে তাকাল। মা যে কখন বিছানা থেকে উঠে গিয়েছেন, টেরই পায়নি ও। মা বললেন, ‘স্কুলে যাবি না?’

‘যাব।’

‘তাহলে উঠে পড়। সময় নেই।’

আরও পড়ুন

ঘুম ঘুম চোখে নিজের ঘরে ঢুকল। আর নিজের বিছানার ওপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল। একছুটে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। ‘মা, দেখে যাও!’

বলেই টানতে টানতে মাকে নিয়ে এল নিজের ঘরে। বিছানার ওপর আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে বলল, ‘দেখো, বিছানায় কে?’

বলেই মায়ের মুখের দিকে তাকাল তিনু। মায়ের মুখে কিন্তু মুচকি হাসি। বললেন, ‘তুই নিজের চোখেই দ্যাখ!’

আর বিছানায় তাকিয়েই অবাক হলো তিনু। আর ভীষণ খুশি হলো। আর চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাবা! কখন এসেছ?’

ততক্ষণে ঘুম থেকে জেগে উঠে বসেছেন বাবা। বাবাকে জড়িয়ে ধরল তিনু। বাবা বললেন, ‘ভোরে। ফিরেই ভুতুড়ে ঘরটায় এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।’

বলেই হো হো করে হাসতে লাগলেন বাবা। তারপর বললেন, ‘চল, আজ তোকে আমি স্কুলে নিয়ে যাব।’

ভীষণ খুশি হলো তিনু। বাবার সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার মজাই অন্য রকম। তিনুর কী যে খুশি লাগছে!

নাশতা খেতে খেতে বাবা বললেন, ‘ভূতটা দেখতে কেমন রে?’

এখন আর তিনুর ভূতের সেই ভয়টা নেই। কেন নেই কে জানে! বাবার কথা শুনে হেসে ফেলল তিনু। অভিমানী কণ্ঠে বলল, ‘বাবা, তুমিও!’

বাবা বললেন, ‘তোর বিছানায় আমাকে দেখে তো ভূতই ভেবেছিলি!’

কথাটা সত্যি। আর সে কারণে লজ্জা পেল তিনু। বাবা থামলেন না, ‘শেষ পর্যন্ত নিজের বাবাকেও ভূত মনে করলি? ভালো।’

বলেই মুখটা মলিন করলেন বাবা। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন লাগল তিনুর। ভীষণ অনুশোচনা হতে লাগল। অন্য রকম এক খারাপ লাগা শুরু হলো ওর। আর সেই খারাপ লাগা থেকেই ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। মা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দিলে তো মেয়েটাকে কাঁদিয়ে।’

ব্যস। অমনি আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন বাবা। হাসতে হাসতে বললেন, ‘পাগলি মেয়ে কোথাকার! তোর সঙ্গে দুষ্টুমি করছিলাম।’

বলেই তিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ততক্ষণে তিনুর ডান গাল বেয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়াতে শুরু করে দিয়েছে।

বাবা ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন, ‘শিগগির খেয়ে নে। সময় নেই। তোকে স্কুলে রেখে কিছু কাজ সারব। তারপর আবার তোকে স্কুল থেকে নিয়ে আসব।’

স্কুলের পরে আবার কোচিং। আর কোচিং শেষ করে স্কুলের গেটে এসে দাঁড়াল তিনু। ওই তো বাবা। রিকশায় করে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরল তিনু। কিন্তু একি! ওদের বাড়ির সামনে এত ভিড় কেন? একটা পুলিশ ভ্যানও দাঁড়িয়ে আছে ভবনের সদর দরজায়!

চমকে উঠল তিনু। বাবার দিকে তাকাল। বাবার কপালে ভাঁজ। ওই তো বাড়ির কেয়ারটেকার। বুড়ো হলেও বেশ শক্তসমর্থ। তিনু চেনে। তার কাছে গিয়ে জানতে চাইল তিনু, ‘কী হয়েছে আঙ্কেল?’

কিন্তু জবাব দিতে পারল না লোকটি। তার আগেই বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন দুজন পুলিশ। কেয়ারটেকারকে বললেন, ‘সময় নেই। জলদি গাড়িতে ওঠো। যা বলার থানায় গিয়ে বলবে।’

পেছন–পেছন কম্বলে মোড়ানো কিছু একটা নিয়ে বেরিয়ে এলেন আরও দুই পুলিশ। আকার দেখে বোঝা যায়, কোনো মানুষের মৃতদেহ। কম্বল মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। পুলিশ ভ্যানের ভেতরে পায়ের কাছে ফাঁকা জায়গায় লম্বালম্বি করে রাখা হলো সেটা।

বাবার সামনে এগিয়ে এলেন এক পুলিশ অফিসার। বললেন, ‘দেখুন তো, একে চেনেন কি না?’

বলেই বাবাকে পুলিশ ভ্যানের পেছনে নিয়ে গেলেন। তিনুও গেল বাবার সঙ্গে। ভ্যানের ভেতরে থাকা এক পুলিশকে বললেন, ‘চেহারা থেকে কম্বল সরাও!’

আরও পড়ুন

বলেই ইশারায় কম্বল মোড়ানো মৃতদেহটা দেখালেন। সঙ্গে সঙ্গে এক পুলিশ কম্বলের মোড়ক সরিয়ে ফেললেন। অফিসার এবার বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চেনেন একে?’

ততক্ষণে বিকেল পেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যা হব হব করছে। পুলিশ ভ্যানের ভেতরে আবছা আলো। সেই আবছা আলোয় চেহারাটা দেখলেন বাবা। বললেন, ‘না। আমরা এই ফ্ল্যাটে এসেছি কয়েক দিন হলো। এখনো সবাইকে...’

বাবার বাকি কথাগুলো আর শুনতে পেল না তিনু। ততক্ষণে মৃতদেহের চেহারায় উঁকি দিয়েছে ও। ইয়া বড় থুতনি। চোখা। পাতলা ঠোঁট। ছোট্ট মুখ। নাকটা বেশ খাড়া। আর চোখ...

চোখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠল তিনু। এই তো সেই চোখ! টেনিস বলের মতো বিশাল। খাটের তলায় এই চোখ দুটোই তো ও দেখেছিল! প্রথমবার যখন দেখেছিল, তখনকার মতো এখনো চোখ দুটো বোজা। কোনো চোখের ওপরই ভুরু নেই!

ভয়ংকর এক আতঙ্ক গিলে খেতে লাগল তিনুকে। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওর পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করল। আতঙ্কিত ঘোরের মধ্যে চলে গেল ও। ওর দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেল। ঘোলাটে দৃষ্টিতে আরেকবার তাকাল চোখ দুটোর দিকে।

কিন্তু এ কী দেখল তিনু!

টেনিস বলের মতো দুটো খোলা চোখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। টকটকে লাল মণিহীন দুটো চোখ!

হঠাৎ তুমুল একটা শব্দ হলো। আর সেই শব্দে তিনুর ঘোর কাটল। আর ঘোর কাটতেই দেখল ওর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগল চোখ দুটো। চোখ দুটোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ভ্যানটাও দূরে যেতে লাগল। পুলিশ ভ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল তিনু। ওর চোখ দুটো তখন পলক ফেলতেও ভুলে গেছে।

হঠাৎ পুলিশের ভ্যানটা ডান দিকে বাঁক নিয়ে একটা ভবনের আড়ালে চলে গেল। তবু সেদিকেই তাকিয়ে রইল তিনু। আর তখনই হঠাৎ...

সেই বাঁকে দুটো চোখ দেখতে পেল তিনু। সামান্য দূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ও। টকটকে লাল আর মণিহীন দুটো চোখ। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে চোখ দুটো...

অলংকরণ: এআই আর্ট

আরও পড়ুন