ল্যুবকার স্থির বিশ্বাস ছিল যে একবার চৌকাট পেরলেই অমনি শুরু হয়ে যাবে একটা অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চার, মোড় নিতেই শোনা যাবে ফুর্তির ঘণ্টা, উন্মোচিত হবে সেই রহস্য যা তাকে খুব একটা সানন্দ বিস্ময়ে আচ্ছন্ন করে দেবে। তাই সিড়ির চত্বরে যখন সে দেখল বরকা বেরুচ্ছে শিল্পীর ফ্ল্যাট থেকে, তখন সে মনে মনে ভাবলে: "শুরু হয়েছে..." 'ক. প. রোগভ' দরজার ওপর নেমপ্লেটটার দিকে বিজ্ঞের মতো তাকিয়ে সে তার সন্ধানী দৃষ্টি ফেরালে বরকার দিকে, দুষ্টুর মতো চোখ টিপে বোঝালে যে সে সব জানে। কিন্তু আসলে যেহেতু কিছুই জানত না, তাই বলবার সময় শুধু বললে: 'বরকা, স্কেট করতে যাবি?'
মেয়েটার দিকে দৃষ্টিপাত না করে বরকা নামতে লাগল সিড়ি দিয়ে। নীরবেই এসে দাঁড়াল ওরা রাস্তায়। দিনটা বরিবার, রোদ্দুরে ভরা, কনকনে ঠান্ডা নয়, মচ মচ শব্দ উঠছে স্কি থেকে, কিচির মিচির করছে চড়ুই। ল্যবকার ইচ্ছে হয়েছিল বলে, "নে, খুব হয়েছে, আর রাগ করতে হবে না।" কিন্তু গেনাকে দেখে সে থেমে গেল। উদ্ভাবকের মুখখানা এমন ফ্যাকাশে যেন কোনো বড় অসুখ থেকে উঠেছে। লু্যূবকা ভাবলে, "ওরও কষ্ট হচ্ছে বৈকি, বরকার সঙ্গে ওর ভাব করিয়ে দেওয়া দরকার।"
'স্কেট করতে যাবি?' গেনা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিল যে লু্যবকার প্রশ্নটা অসম্ভব একটা বোকার মতো প্রশ্ন। খুব কাজের লোকের মতো গলায় বললে, 'কেন আমার কি কাজকম্ম কিছু নেই?' 'চাঁদে যাবার তোড়জোর করছিস বুঝি,' হল ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলে ল্যবকা।
'দেখিস, বেশি জ্ঞান ফলাতে গিয়ে আবার বুড়িয়ে না যাস,' এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বরকার দিকে চকিত দৃষ্টিপাত করে জবাব দিলে গেনা। অমন ধারা জবাব শুনে বরকা শিষ দিয়ে এগিয়ে গেল।
না, ল্যবকার কপাল আজ মন্দ। বুঝলে দিনটা হবে নীরস, মামুলী। রহস্যময় একটা কাণ্ড যে তার কয়েক পা দূরেই অপেক্ষা করছে, সেদিকে কোনো খেয়ালই ছিল না তার।
গেনা কারাতভ সত্যি সত্যিই ওড়বার আয়োজন করছিল। আগ্নে থেকেই সে নিজেকে ট্রেনও করছিল, নিজের ওপর পরীক্ষা চালাচ্ছিল। বলা তো যায় না, উড়ন্ত রকেটে কত কী কষ্ট সইতে হবে। একদিন দুদিন নয় হয়ত বা গোটা বছর ধরে উড়তে হবে তাকে, কোনো দূর তারায় পৌঁছতে হবে। আর এই গোটা সময়টা ধরে খেতে হবে, পান করতে হবে আর নিশ্চয় নিঃশ্বাসও নিতে হবে। গেনা হিসেব করে দেখল, মানুষ দিনে নিঃশ্বাস নেয় চব্বিশ পিপে বাতাস - ঘণ্টায় এক এক পিপে। আর যদি এক বছর উড়তে হয় তাহলে কত পিপে দরকার? একটা রকেটে তা ধরবেই বা কী করে? মহাকাশযাত্রীর বাঁচার একমাত্র উপায় হল ক্লরেলা, অক্সিজেন ছাড়ে তা, খাওয়াও যায়- আর দিনে দিনে নয়, বাড়ে যেন ঘণ্টায় ঘণ্টায়।
এই জলজ উদ্ভিদটার চাষ গেনা করেছিল তার অ্যাকোয়ারিয়মে। নিজের ওপর ক্লরেলার ক্রিয়া পরীক্ষা করার জন্যে ও ঠিক করলে তিন দিন কিছুই খাবে না; খাবে শুধু ক্লরেলা কিচ্ছু নয়। আর গেনা যখন ল্যবকার সঙ্গে কথা কইছিল তখন ক্ষিদেয় মাথা ঘুরছিল তার, কিন্তু ও কিছুতেই বুঝতে দেয়নি যে সুস্থ বোধ করছে না। ল্যবকা বেশ স্থির সংকল্পেই পোড়ো মাঠটার দিকে এগিয়ে গেল, দেখে হিংসে হচ্ছিল তার, কিন্তু সে কিছুতেই যাবে না। মহাকাশযাত্রীকে হতে হবে দৃঢ়চিত্ত হিম্মৎওয়ালা লোক। আফশোস, যে সবাই তা বোঝে না, এমন কি মাও না। অনবরত মা কেবল তার কাটলেট নিয়ে জেদাজেদি করছে: খা রে, নে খেয়ে নে...
নিঃশ্বাস ফেললে গেনা, বরফের দলা ছুড়ে মারলে জানলায় বসা একটা চড়ুইয়ের দিকে, তারপর বাড়ি চলে গেল।
বাড়িতে মা আস্তিন গুটিয়ে রান্নায় লেগেছে। মুখটা লাল। আপেল পিঠের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা ফ্ল্যাটে। গেনার মুখের ভেতরটা লালায়িত হয়ে উঠল। যে দিকেই তাকায় সেদিকেই কেবল বড়ো বড়ো গোল গোল লালচে পিঠে, হলদে জ্যাম। মাথা পর্যন্ত ঝাঁকাল গেনা, দৃশ্যটা তাড়াতে চাইল তার চোখ থেকে।
মনের দৃঢ়তা অটুট রাখার জন্যে সে চলে গেল লেখার টেবলে, খুলে বসল বিখ্যাত বিজ্ঞানী ৎসিওলকভস্কির ডায়েরি।
"নিজের ওপর পরীক্ষা চালালাম..."' ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে এবং সর্বক্ষণ পিঠের
কথা ভাবতে ভাবতেই জোরে জোরে পড়তে লাগল সে, "... কয়েক দিন কিছুই পানাহার করলাম না।" দ্যাখো তাহলে! কয়েক দিন। আর আমি? একদিন উপোস দিয়েই হার মানতে বসেছি। ৎসিওলকভস্কির পক্ষে অবশ্য সহজ ছিল, কেউ তার পেছনে লাগেনি। আমার মতো বাপমায়ের সঙ্গে যুঝতে হয়নি তাকে। তিশকা না থাকলে তো সমস্ত পরীক্ষাই পণ্ড হয়ে যেত...'
'তিশকা, তিশকা...' ডাক দিল গেনা।
লোমশ একটা সাইবেরীয় বেড়াল আলস্যে উঠে বেরিয়ে এল আলমারির পিছন থেকে। গেনা যবে থেকে ক্লরেলা খেতে শুরু করেছে, তখন থেকেই স্পষ্টতঃ মুটোতে শুরু করেছে ও।
'এবার আমাদের ভোজন হবে কিন্তু,' বেড়ালটাকে হাঁশিয়ার করে দিল গেনা।
অ্যাকোয়ারিয়মের কাছে এসে নীরস দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে দেখল সবজে মতো ঘোলা জলের দিকে। ক্লরেলা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তা হলেও একটা গেলাস নিয়ে ফানেলের মধ্যে ফিলটার পেপার দিয়ে জল ছাঁকতে লাগল। সেই সঙ্গে সে তিশকাকে আশ্বাস দিলে: 'ক্লরেলার ভেতরে তো সবই আছে; প্রোটিন, স্নেহপদার্থ, কার্বন, ভিটামিন এ, বি, সি। তাই ভাবনার কিছু নেই তিশকা।' সবেতেই সায় দিল তিশকা। গেনার ঘোষণায় অনুমোদন জানাল ঘড়ঘড় আওয়াজ করে।
বীরের মতো ক্লরেলা গলাধঃকরণ করে গেনা উবু হয়ে বসল। টেবলের তল থেকে টেনে বার করলে কাটলেটের ডিশ।
'এদিকে আয় তিশকা, আয় দেখি,' আদর করে বেড়ালটাকে ডাকল সে।
তিশকা শকে দেখল কিন্তু খেল না। (এর আগেই গেনার প্রাতরাশ আর ডিনার খেয়ে শেষ করতে হয়েছে তাকে।)
'সে কীরে? আমায় ডোবাবি নাকি?' ককিয়ে উঠল গেনা, আর একটু হলেই অভিমানে কোঁদে ফেলত সে। ভয় পেয়ে বেড়াল ঢুকল আলমারির নিচে। কিন্তু পরাজয় মানবে না গেনা। লেজ ধরে টেনে বার করলে বেড়ালটাকে, জোর করে বসালে ডিশের সামনে।
'খা, খা বলছি বেইমান!' হুকুম দিল সে।
গোলমাল শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে উপোসী গেনাকে মা দেখল ওই অবস্থায়- উবু হয়ে বসা, কোলে তার অনিচ্ছুক বেড়াল, সামনের প্লেটে ঠান্ডা কাটলেট।
সবই কবুল করতে হল। এক্ষুনি যদি সে না খেতে শুরু করে তাহলে অ্যাকোয়ারিয়ম সমেত সমস্ত ক্লরেলা জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলা হবে এই হুমকি শুনে পিঠেতেই রাজী হল সে।
আপেল পিঠে ক্লরেলার চেয়ে শতগুণ মিষ্টি হলেও ভাবী তারকাযাত্রী কিন্তু তা মুখে তুললে বেশ ধীরে ধীরেই আর সারাক্ষণ নিজেকে বোঝালে মহাকাশযাত্রায় পিঠের চেয়ে ক্লরেলাতেই কত সুবিধা।