আমরা তো এখন টিউনিয়ায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মেয়েটার চোখ দুটো মায়াবী। আশ্চর্য মায়াবী। চোখের মণির রং হালকা বেগুনি। ...না, সবুজ। ...না, কমলা। না...। খুবই আজব! চোখের মণির রং বারবার পাল্টাচ্ছে। কে এই মেয়ে? নাকি স্বপ্ন? স্বপ্নে সে এমন একটা রঙিন চোখঅলা মেয়েকে দেখছে! কিন্তু স্বপ্নে তো সাদা-কালো ছাড়া আর কোনো রং দেখার কথা না। তবে?

স্বপ্ন না, বাস্তব। মেয়েটাকে সে দেখছে বাস্তবে।

বিকেলের রোদে রমনা পার্কের একটা জারুলগাছের নিচে এই ঘটনা ঘটছে।

জারুলগাছে ফুল ফুটেছে ঝাঁপিয়ে। হালকা বেগুনি রঙের ফুল রোদে ঝিকোচ্ছে। এমন স্নিগ্ধ রং, চোখ জুড়ায়।

সে দুপুরে ঢুকেছে পার্কে। সান্ত্বনার মায়ের হোটেল থেকে পেট ভরে ভাত খেয়ে ঢুকেছে। শিল্পকলা একাডেমীর রাস্তার ধারে সান্ত্বনার মার বিখ্যাত ইতালিয়ান হোটেল। অতি সুস্বাদু রান্না করে মহিলা। গরম পানি দিয়ে প্লেট ধুয়ে ভাত দেয়। ‘সেরা রান্না’ না ‘সেরা রাঁধুনি’ কী সব হয় টেলিভিশনে, ওসবে এই মহিলা কেন যায় না?

চোখ-মায়াবী মেয়েটা বলল, ‘অ্যাই!’ বলে হাসল।

বাচ্চাকাচ্চাদের খুব পছন্দ করে, কোনোকালেই এমন ব্যক্তি না সে। তার বন্ধু আছে সাবির আর তিনা। থাকে নারিন্দায়। ভূতের গলিতে। মাঝেমধ্যে সে যায় তাদের বাসায়। দুই বাচ্চা সাবির আর তিনার। যমজ ভাইবোন। অমি আর শমি। এই দুটো যে কী জিনিস! সাক্ষাৎ বিচ্ছু। সাবির তিনার সামনে ভাব দেখাতে হয়, বিচ্ছু দুটোকে টানা দুই দিন না দেখে থাকতে পারে না সে। বাস্তব ভিন্ন। বিচ্ছু দুটোকে সে ভয় পায়। তিন বছর বয়সের দুটো বাচ্চা, এরা একদিন তাকে প্রায় কানা করে দিতে যাচ্ছিল। যখন তখন একসঙ্গে দুজন দাড়ি ধরে ঝুলে পড়া তো আছেই। যন্ত্রণার বিরাট ইতিহাস। মোটকথা বাচ্চাকাচ্চারা তার তেমন পছন্দের কোনো বস্ত্ত না কখনো। একেও পছন্দ করে ফেলল এমন না। তবে মুগ্ধ হলো সত্যি। একেবারে পরির বাচ্চার মতো দেখতে। সাবির তিনার বিচ্ছু দুটো দুনিয়ার অ্যানিমেশন ছবি দেখে। ও রকম কোনো একটা ছবিতে একটা পরির বাচ্চা দেখেছিল সে। ঠিক তেমন। মানুষ না, পরির বাচ্চাই নাকি?

না। পরি না, মানুষের বাচ্চাই। তবে অদ্ভুত। খুব অদ্ভুত।

পার্কে ঢুকে জারুলগাছের নিচের বেঞ্চটায় রুটিনমাফিক ভাতঘুম দিয়েছিল সে। উঠে দেখে এ। চোখ বড় বড় করে তাকে দেখছে। এখনো দেখছে। চোখের মণির রংও বারবার পাল্টাচ্ছে। কে জানে, কোনো রকম অসুখ হয়তো। চোখের রং পাল্টানোর অসুখ। কত রকম অসুখ থাকে মানুষের। আজ সকালেই পত্রিকায় একটা অদ্ভুত অসুখের কথা সে পড়েছে। কিছু মানুষ নাকি পেইন্টিং ভয় পায়। এতটাই ভয় পায় যে পেইন্টিং দেখলে অজ্ঞান হয়ে যায় পর্যন্ত। একটা নাম আছে অসুখটার। পত্রিকায় লিখেছে। খটোমটো নাম। সেটা সে এখন মনে করতে পারল না। কী একটা ফোবিয়া।

অদ্ভুত বাচ্চাটা আবার বলল, ‘অ্যাই!’ বলে আবার তাকে মুগ্ধ করে হাসল। মুগ্ধ সে বলল, ‘কি-ই-ই?’

‘তুমি কে?’

সে বলল, ‘আপনি কে?’

‘তুমি আগে বলো, তুমি কে?’

‘আমি? আমি মোবারক হোসেন সিকদার।’

‘কিহ্‌? মোবারক হোসেন সিকদার। হিঃ! হিঃ! হিঃ! আমি কিন্তু জানি তুমি কে। তুমি হলে কাজী মুনাবিল। আমি কে, তুমি জানো? জানো না, জানি। আমি হলাম একটা টিউন।’

‘আপনি হলেন একটা টিউন! টিউন। টিউন কী? সুর?’

‘সুর কী? হিঃ! হিঃ! আমি কি গানের সুর নাকি, অ্যাই? কী বোকা রে! বলেছি না আমি টিউন।’

সে মুনাবিল, বলল, ‘ও।’

বাচ্চাটা আবার বলল, ‘আমি টিউন। গানের সুর না। টিউন বুঝেছ? আমি টিউনিয়ার বাসিন্দা, বুঝেছ?’

‘বুঝেছি। টিউনিয়া। এটা কোথায়?’

‘টিউনিয়া আমাদের গ্রহ!’

‘আপনাদের গ্রহ?’

‘হ্যাঁ-এ-এ। টিউনদের গ্রহ টিউনিয়া।’

‘টিউন বলে আপনাদের গ্রহের মানুষদের?’

‘আমরা মানুষ না, আমরা টিউন।’

তারা টিউন। মানুষ না, টিউন। সীমা থাকা উচিত আজগুবির। মুনাবিল ভাবল। দেখতে শুনতে একদম মানুষের বাচ্চা, বলছে সে একটা টিউন! টিউন কী? নাকি ইয়ার্কি? সাবির তিনার বিচ্ছু দুটোর মতো ছটফটে না, কী শান্তশিষ্ট মায়াবী দেখতে, কিন্তু এ-ও তো একটা বাচ্চা, ব্র্যাকেটে লেজবিশিষ্ট নির্ঘাত। কিন্তু... কিন্তু... তার সঙ্গে এ ইয়ার্কি করছে? এইটুকু বাচ্চা মেয়েটা? না বোধ হয়। ইয়ার্কি করার মতো বয়স এর হয়নি। ইঁচড়েপাকা বলে একটা বাগধারা আছে বাংলায়। মেয়ে হিসেবে এ যদি ‘ইঁচড়েপাকি’ হয়ে থাকে তবে অবশ্য কথা ভিন্ন। কিন্তু তাও মনে হচ্ছে না। বয়স কত হবে? সাবির তিনার বিচ্ছু দুটোর মতো ছোট না। আট-নয় বছর? হবে। সে বলল, ‘আপনি টিউন, এখানে কী?’

‘কী-ই-ই?’

মুনাবিল বলল, ‘আপনার নাম কী?’

‘ইশ্ রে! বললাম তো, আমি টিউন।’

‘ঠিক আছে, আপনি টিউন। কিন্তু আপনার কোনো নাম নেই?’

‘নাম? নাহ্‌! আমি টিউন। আমরা টিউন। তুমি বলো দেখি তোমার নাম কী?’

‘একবার বলেছি।’

‘আবার বলো।’

আজব একটা ঘটনা ঘটল। হয়তো কয়েক অনুপলের জন্য, মুনাবিলের মনে হলো, তার নাম ভুলে গেছে সে। মনে হলো, সে টিউন। মুহূর্তে আবার সবকিছু স্বাভাবিক। মুনাবিল বলল, ‘আপনার মনে নেই?’

‘মনে আছে, কাজী মুনাবিল। আচ্ছা, শোনো,’ একেবারে বড় মানুষের মতো নিচের ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করল কী যে? চিন্তা করে বলল, ‘তোমার মনে হলে তুমি আমার একটা নাম রেখে দিতে পারো এখন।’

অদ্ভুত কথা। কিন্তু আজব, মুনাবিলের অদ্ভুত মনে হলো না। উল্টো তার হঠাৎ মনে হলো, ঘাসফুল। সে বলল, ‘আচ্ছা, আপনি হলেন শ্রীমতী ঘাসফুল।’

‘ঘাসফুল! হিঃ! হিঃ! হিঃ! ঘাসফুল বুঝি মানুষের নাম হয় কখনো?’

‘আপনি তো মানুষ না, আপনি টিউন।’ মুনাবিল বলল, ‘এখন আপনার মতো একটা টিউনের নাম ঘাসফুল হতেই পারে।’

‘হ্যাঁ-এ-এ-এ পারে। ঠিক আছে, তুমি বলো, ঘাসফুল।’

‘ঘাসফুল’, মুনাবিল বলল, ‘আপনি এখানে কী করছেন?’

ঘাসফুল বলল, ‘কোথায়? কোথায়?’

‘এই পার্কে?’

‘তোমাকে দেখছি। হিঃ! হিঃ! হিঃ!’

কী সুন্দর করে হাসে রে বাচ্চাটা! মুনাবিল ভাবল। বলল, ‘আপনি একজন টিউন ঘাসফুল। আপনি এই পার্কে মানে টিউনিয়া থেকে... মানে, পৃথিবীতে কী করছেন আপনি?’

‘পৃথিবী!’ এমন আশ্চর্য হলো ঘাসফুল। মুনাবিল বুঝতে পারল না, কেন? বলল, ‘পৃথিবী। আমাদের পৃথিবী। আমাদের গ্রহ।’

‘ইশ্ রে! জানি তো রে বাবা।’ এমনভাবে বলল, হেসে ফেলত মুনাবিল। না হেসে গম্ভীর হয়ে থাকল। ভাবল, হ্যাঁ, তুমি তো জানবেই। তুমি হলে পণ্ডিত গ্রিফিনের দূরসম্পর্কের ফুফাতো বোন।

পণ্ডিত গ্রিফিন রূপকথার পাখি। জ্ঞানপক্ষী গ্রিফিন। এই পাখি সব জানে দুনিয়ার। আর একটু সহজ করে কীভাবে বলা যায়, একটু চিন্তা করে মুনাবিল বলল, ‘আপনি আপনাদের গ্রহ থেকে আমাদের গ্রহে কেন এসেছেন ঘাসফুল?’

‘তোমাদের গ্রহ! ইশ্ রে! তোমাদের গ্রহে আসব কেন হ্যাঁ?’

‘এই যে এখানে, আপনি যে এখানে, এটা তো আমাদের গ্রহ পৃথিবী, নাকি?’

‘পৃথিবী! নাহ্‌। কখনো না।’

‘ও। এটা পৃথিবী না? এই পার্ক পৃথিবীতে না?’

‘নাহ্‌। তুমি তো এখন আছো টিউনিয়ায়। তুমিও এখন টিউন।’

বলে কী রে!

আসলে কী? পাগলি মেয়েটা? ছিট আছে মাথায়? না হলে এসব কী বলছে? আহা রে! এত মায়াকাড়া চেহারার একটা বাচ্চা। পাগলি! বাবা-মা কোথায় এই পাগলি মেয়েটার? মা-বাবার কথা মাথায় আসতে আবার ভালো করে মেয়েটাকে দেখল মুনাবিল। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ বলপ্রিন্টের ফ্রক পরে আছে। পা খালি। কপালে টিপ...! এটা তো ছিল না। কখন পরল? লাল রঙের টিপ। লাল না নীল।... নীল না কমলা। ... কমলা না, সবুজ। চোখের মণির মতো কাণ্ড। ঘটনাটা কী? ধরে নেওয়া যাক পাগলিই মেয়েটা, চোখের মণির রং পাল্টায় এমন একটা বিচিত্র অসুখ তার আছে। কিন্তু টিপের রং পাল্টাবে কেন?

হ্যালুসিনেশন? তা কেন হবে? এ হয় সাধারণত মাদকদ্রব্য নিলে বা বিশেষ রকমের অসুস্থ অবস্থায়। কাজী মুনাবিল সিগারেটও খায় না। তবে কি সে বিশেষ রকমের অসুস্থ নাকি? গত তিন দিনের মধ্যে তো তার একবার মাথা পর্যন্ত ধরেনি। তবে? হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই এমন হ্যালুসিনেশন হতে যাবে কেন তার? হ্যালুসিনেশন না, সে যা দেখছে তা সত্যি ঘটছে। পার্কের আর কেউ কি এই ঘটনা দেখছে না? পার্কের ঘাসে, বেঞ্চে বসে আছে কতজন, কতজন হাঁটছে। কেউই কি কিছু দেখছে না?

কী দেখবে? কী দেখবে? ওরাও তো টিউন। সব টিউন। অদ্ভুতভাবে এ রকম মনে হলো মুনাবিলের। মনে হলো সেও টিউন। এই যে সে কাজী মুনাবিল, তা নয়, সেও একজন টিউন। পৃথিবী না, এখন টিউনিয়ায় সে। টিউনদের নাম হয় না। তারা টিউন। সবাই টিউন। যা দেখা যাচ্ছে, মানুষ, পাখি, গাছ, ঘাসফুল সব টিউন। ঘাসফুল!

ঘাসফুল বলল, ‘অ্যাই-ই-ই!’

আশ্চর্য! মুনাবিল ভুলে গেল কী সে ভাবছিল। একদম কিছু তার মনে থাকল না। বিকেলের রূপ এখন যাই যাই। একটু পর সন্ধ্যায় সব রূপ নেমে আসবে পার্কের সব ঘাসে। ঘাসফুলে। মুনাবিল টিউন ঘাসফুলকে দেখল। টিপ উধাও। চোখের মণির রং এখন সবুজ। এই কমলা হয়ে গেল। এই নীল, এই হলুদ...। কার মেয়ে এ? হারিয়ে গেছে? কোনোভাবেই একে তাহলে এখানে রেখে চলে যাওয়া যাবে না। বলছে টিউন, আসলে মানুষের বাচ্চাই তো! আগে এই এলাকায় খুঁজে দেখতে হবে। এর বাবা-মা কি আত্মীয়স্বজন কারোরই যদি খোঁজ না পাওয়া যায়, সাবির তিনার বাসায় নিয়ে রেখে দেওয়া যাবে দিন কয়েক। ফেসবুক, পত্রিকা, অনলাইন পত্রিকা, রেডিও-টিভিতে নিউজ করে দিলে যাদের মেয়ে তারা এসে নিয়ে যাবে নিশ্চয়। তার আগে কোনো মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে কথাবার্তা বলে রাখতে হবে। ইনফর্ম করে রাখতে হবে এলাকার থানাকেও। এটা অবশ্য কোনো সমস্যা না। এই এলাকার থানার এসআই মীর হাসিবুল হাসান মুনাবিলের যথেষ্ট পরিচিত ব্যক্তি।

হয়েছে। যথেষ্ট চিন্তাভাবনা হয়েছে। মুনাবিল বলল, ‘শোনেন ঘাসফুল, আপনার মা-বাবা এরা কোথায়? আপনারা কোন এরিয়ায় থাকেন?’

‘ইশ্ রে, তুমি তো আচ্ছা মানুষ। বললাম না আমি টিউন। টিউনিয়ায় থাকি। কেন, তুমি কি আমার চোখের মণি দেখছ না? এমন চোখের মণি কোনো মানুষের হয়? বলো? তুমি কী মনে করেছ জানি। এটা কোনো রকমের অসুখ। উঁহুঁ। অসুখ হলে চোখের মণির রং কেন বদলাবে?’

‘তাহলে কেন বদলাবে?’

‘টিউনরা যা চায় তা হয়।’

‘বুঝলাম না। বুঝতে পারলাম না।’

‘বুঝে যাবে। তুমিও টিউন তো।’

‘আমিও টিউন?’

‘হুঁ-উ-উ।’

‘আমি যা চাই তা হবে?’

‘হুঁ-উ-উ হবে। তুমি চাইলে তোমার চোখের মণির রংও আমার মতো করে পাল্টাবে। আরও কত অদ্ভুত ঘটনা যে ঘটবে। মানে মানুষের হিসাবে অদ্ভুত আর কী। তুমি কী চাও, আমি জানি। বলে দেব? তুমি না আমাকে নিয়ে কী দুশ্চিন্তায় পড়েছ। এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই, বাবা। তুমি তোমার বাসায় চলে যাও। নিশ্চিন্তে চলে যাও।’

বাচ্চা না একটা বড় মানুষ এ? ইঁচড়েপাকি!

আবার হেসে ফেলতে গিয়ে হাসল না মুনাবিল, বলল, ‘তখন না বললেন আমরা এখন টিউনিয়ায় আছি।’

‘তা তো আছিই। টিউনিয়ায় তোমার বাসা নেই নাকি?’

‘তাও তো কথা। আপনারও তো বাসা আছে তাহলে?’

‘থাকবে না? এমা! আমিও তো বাসায় ফিরে যাব এখন। সন্ধ্যার পর বাইরে থাকলে মা বকে।’

‘আপনার মা?’

‘আমার মা না তো আমাকে কী তোমার মা বকবে? ইশ্ রে! তুমি যে কী। আচ্ছা আমি যাই। আর একটা কথা শোনো। তুমি কিন্তু এসব স্বপ্নে দেখছ না।’

‘কী? স্বপ্ন দেখছি, আমি বলেছি?’

‘বলোনি। কিন্তু একবার ভাবোনি, বলো? বোকা!’

‘কে বোকা? আমি?’

‘বোকা না তুমি! বোকা না হলে কেউ ভাবে স্বপ্নের রং সাদাকালো ছাড়া হয় না?’

‘হয় নাকি?’

‘হয় না আবার। শোনো, সাদা-কালো স্বপ্ন মাত্র ১২ শতাংশ মানুষ দেখে। বাকিটা রঙিন। সম্পূর্ণ রঙিন।’

‘তাই নাকি?’

‘জি, জনাব। আচ্ছা, তুমি তো রোজ এই পার্কে আসো। এই পার্কের গেট কয়টা বলো তো?’

‘গেট? কয়টা? চারটা? ছয়টা? নাহ্‌, পাঁচটা...।’

‘জানতাম তো বলতে পারবে না। আমি বলি। এই পার্কে গেট আছে আটটা। এর মধ্যে নাম আছে সাতটার। অরুণোদয়, অস্তাচল, বৈশাখী, উত্তরায়ণ, উদয়ন আর স্টারগেট। মনে থাকবে, বলো?’

‘মনে থাকবে।’

‘গুড। এখন বলো দেখি জারুলগাছের নিচে বসে আছো তো, বলো দেখি, এই পার্কে জারুলগাছ কয়টা?’

‘জারুলগাছ? কয়টা...?’

‘ইশ্ রে! তুমি তো দেখি কিচ্ছু জানো না। তিপ্পান্নটা জারুলগাছ আছে এই পার্কে। আচ্ছা, জারুলগাছের কথা বাদ দাও। সব মিলিয়ে এই পার্কে কতটা গাছ আছে, জানো? জানো না তো? পাঁচ হাজার পঞ্চাশটা। হুঁ হুঁ। বুঝেছ?’

‘বুঝেছি, ধন্যবাদ।’ মুনাবিল বলল, ‘রমনা পার্ক সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান লাভ হলো।’ বলল আর মনে মনে ভাবল, এ তো সত্যি সত্যিই দেখি পণ্ডিত গ্রিফিনের ফুফাতো কি খালাতো বোন হয়। দূরসম্পর্কের না, একেবারে আপন। এইটুকু একটা মেয়ে, এত কথা কি করে জানল? পাগলি না তবে। পাগলি হলে এসব কথা এত ঠিকঠাক করে বলতে পারত না। কিছু একটা আছে ঘটনা। কী সেটা ধরতে পারল না মুনাবিল। বলল, ‘আপনি কি সত্যি সত্যি এখন বাসায় চলে যাবেন, ঘাসফুল?’

‘যাব না? বারে! তুমিও যাও, আমিও যাই।’

‘কী? কোথায়?’

‘কী কোথায় মানে? বাসায়!’

‘ও। আপনার বাসাটা কোথায়?’

‘তোমাকে নিয়ে যাব একদিন।’

‘টিউনিয়ায়?’

‘আর কোথায় হবে, হ্যাঁ? আচ্ছা, যাই।’

হাওয়া দিচ্ছে। উত্তরের হাওয়া। পাতারা উড়ছে। একটা পাতা উড়ে এমন করে মুনাবিলের দুই চোখের ওপর পড়ল, অল্পক্ষণ মুনাবিল কিছু দেখল না। কিন্তু সে কতক্ষণ আর? পাতা চোখে পড়ে আবার উড়ে যেতেই মুনাবিল দেখল, নেই ঘাসফুল! নেই তো নেই-ই। এদিক ওদিক অনেক সে দেখল। উধাও মেয়েটা। তাজ্জবের ঘটনা। আরও তাজ্জবের ঘটনা হলো, এমন তাজ্জব একটা ঘটনা দেখেও একটুও তাজ্জব হলো না মুনাবিল। কেন যে হলো না, ভাবলও না।

বিকেল থেকে পার্কে যারা হাঁটেন, তাঁরা হাঁটা সেরে চলে গেছেন এর মধ্যে। মানুষজন একটু কম এখন পার্কে। উঠে অরুণোদয় গেটের দিকে যেতে যেতে যে কটা বাচ্চা মেয়েকে দেখল, চোখ তীক্ষ্ণ করে দেখল মুনাবিল। না, কেউ টিউন নয় এরা। ঘাসফুল নয়। হবে অবশ্য সে চিন্তাও করেনি। যেভাবে হোক যেখানে হোক, তার বাসায় চলে গেছে টিউন ঘাসফুল। চলে যাবে সেও। তার বাসায়। সে থাকে সেগুনবাগিচায়। আজবভাবে এখনো টিকে থাকা তিনতলা একটা পুরোনো বিল্ডিংয়ে। বিল্ডিংয়ের নাম ‘পান্থনিবাস’। নামকরণ সার্থক হয়েছে বলা যায়। তিনতলা মিলিয়ে ২৪টা রুম। বাসিন্দা ১৩ জন। ‘পান্থ’ ১৩ জন। এই ১৩ জনের একজন হলো আবিদুর। ‘পান্থনিবাস’ এই আবিদুরের ছোট চাচার সম্বন্ধীর বিল্ডিং। ছোট চাচার সম্বন্ধী থাকেন সিডনিতে। পুরাতত্ত্ব পড়ান কলেজে। দেশে তাঁর আত্মীয়স্বজন আর কেউ নেই বলে, তিনতলা এই পুরোনো বিল্ডিংটা ছেড়ে রেখেছেন আবিদুরের জিম্মায়। বেঁচে থাকতে ডেভেলপারদের ডেভেলপ করতে দেবেন না। পাঁচ কাঠা জায়গা। নানা রকম গাছগাছালি আছে। করমচা, চালতা, জাম, কড়ই, আম, খেজুর, বিচিত্রমাদার, অপরাজিতা, বোগেনভেলিয়া আর কিছু জবাফুলের গাছ। রাজার হালে আছে বলা যায় ‘পান্থনিবাসে’ বসবাসকারী পান্থরা। এরা কেউ আবিদুরের বন্ধু, কেউ ছোট, কেউ বড় ভাই। কমন মামাও আছেন একজন। দুই তলায় থাকেন। মীর্জা শিহাব উদ্দিন ঠাকুর। বিশিষ্ট হস্তরেখাবিশারদ তিনি। মুনাবিলের হাত দেখে বলেছেন, মুনাবিল দেশে থাকবে না, দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকবে। প্রবাস! পাসপোর্টই নেই মুনাবিলের। প্রবাসে যাবে কী করে সে? কোন দুঃখে বা কী করতে? আবিদুর আর সে ছেলেবেলার বন্ধু। বড় হয়েছে একই মহল্লায়। একসঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়েছে। পরে আবিদুর জাহাঙ্গীরনগর, সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবিদুর ইংলিশ, সে স্ট্যাটিসটিকসে। আবিদুর এখন একটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ায়। আর সে যা করে, আজব মনে হতে পারে অনেকের। মনে হতে পারে, হয় নাকি এমন? কী করে সে? গল্প বানায়। লিখে না বানায়। বানিয়ে বিক্রি করে। তিনজন লেখক ক্লায়েন্ট আছেন। যথেষ্ট দাম দিয়ে মুনাবিলের বানানো গল্প কিনে নেন তাঁরা। মুনাবিল বলে, তাঁরা রেকর্ড করে রাখেন এবং লেখেন। এটা নিয়ে মহা খাপ্পা আবিদুর।

‘তোর খবর তো আর্টিস্ট মাসুক হেলালকে দেওয়া দরকার। উনি তোর পোর্টে্রট করবেন আর তোকে নিয়ে লিখবেন পত্রিকায়। রাস্তাঘাটের বিচিত্র মানুষদের নিয়ে একটা কলাম আগে লিখতেন না উনি! তোকে দিয়ে রিস্টার্ট করবেন। তুই এসব কী করিস?’

মুনাবিলের উত্তর, ‘মজা। মজা করি বন্ধু।’

খেপাটে রকমের আছে একটু মুনাবিল। কিন্তু টিউন! কিন্তু ঘাসফুল! ঘটনাটা কী? ঘটনাটা কী?

অরুণোদয় গেট দিয়ে বেরিয়ে, রাস্তা পার হলো মুনাবিল। ‘পান্থনিবাস’ হাঁটা দূরত্ব। যেতে সান্ত্বনার মায়ের হোটেল ডানদিকে পড়ে। বন্ধ হয়ে গেছে। এই ত্রি-সন্ধ্যায়? কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে? সান্ত্বনার মায়ের সেলফোনের নম্বর আছে তার সেলফোনে। দুপুরে যখন পার্কে ভাতঘুম দেয়, সেলফোন বন্ধ করে রাখে সে। আজ উঠে ওপেন করতে মনে নেই। যা সব ঘটনা ঘটল। কি না, ঘাসফুল মানুষ না, টিউন! মুনাবিলও টিউন! টিউনরা যা চায় সব পারে! আর কত অদ্ভুত ঘটনা যে ঘটে। কী অদ্ভুত ঘটনা ঘটে? ওসব কিছুই আসলে ঘটেনি। কিছুটা স্বপ্নে দেখেছে হয়তো, বাকিটুকু বানিয়ে নিয়েছে মুনাবিল। ঘুমের মধ্যেই বানিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া কী হতে পারে আর? হ্যাঁ?

প্যান্টের ডান পকেট থেকে সেলফোন বের করল মুনাবিল। অত্যন্ত দামি নকিয়া সেট। সাবির দিয়েছে। থ্রিজি সিম। ব্লুটুথ আছে। ওপেন করে প্রথমেই সান্ত্বনার মাকে কল দিল সে।

কল যাচ্ছে।

কোম্পানির রেকর্ড বলল, এই গানটি ডাউনলোড করতে চাইলে স্টার প্রেস করুন। চার্জ প্রযোজ্য। বলামাত্র গান শুরু হলো,

ওপা গ্যাংনম স্টাইল

গ্যাংনম স্টাইল...।

সান্ত্বনার মা কি জানে তার সেলফোনের এখনকার হ্যালোটিউন দুনিয়া কাঁপানো এই গানটা? জিগ্যেস করবে কয়েকবার ভেবেছে মুনাবিল। কিন্তু কখনোই জিগ্যেস করতে মনে থাকে না সান্ত্বনার মাকে। এখনই জিগ্যেস করে নিতে হবে। কল ধরল। সান্তনার মা না, সান্ত্বনা। রিনরিনে গলায় বলল, ‘হ্যালো?’

মুনাবিল বলল, ‘কে রে?’

‘আপনে কে?’

‘আপনি কে? সান্ত্বনা বিবি?’

‘ও মাম্মা! সেলামালিকুম। কেমন আছেন, মামা? কত দিন ফোন করেন না দেখি।’

‘ওয়ালিকুম সালাম। ফোন করি না, এই তো করলাম। তুই কেমন আছিস? বুজি কোথায় রে?’

‘আমি ভালো আছি, মামা। আপনে কেমন আছেন কইলেন না? মায়ের তো জ্বর। উথালপাতাল জ্বর।’

‘কখন থেকে? দুপুরে তো দেখলাম ভালো।’

‘দুপুরের পর থিকাই। হোটেল বন্ধ কইরা দিছে দেখেন নাই?’

‘ওষুধ খেয়েছে?’

‘হ। ওষুধ খাইয়া ঘুম পাড়তেছে এখন।’

‘ঘুমাক। বলিস আমি ফোন করেছিলাম। আচ্ছা, তুই কি এখন সেভেনে না?’

‘না, মামা। আমি তো এখন এইটে। আপনেরে এর আগেও দেখি কইছি। আইজকাইল কিছু আপনের মনে থাকে না মামা।’

‘বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো, বুঝেছিস...।’

‘কী? কী? কী? হিঃ! হিঃ! হিঃ! আপনে বুড়া! আপনে বুড়া হইয়া যাইতেছেন! হিঃ! হিঃ! হিঃ!’

জীবনে অনেক বড় হবে এই মেয়েটা। সান্ত্বনা। স্কুলে তার নাম চমন আরা। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। গণিত অলিম্পিয়াডে একবার রানারআপ হয়েছে। সান্ত্বনার মায়ের আর ছেলেপুলে নেই। ছেলেও এই সান্ত্বনা, মেয়েও এই সান্ত্বনা। বছর ছয় আগে সান্ত্বনার বাবাকে মেরে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা। ধরা পড়েছিল খুনিদের দুজন। ছাড়া পেয়ে গেছে। সান্ত্বনার মা বেঁচে আছে শুধু তার মেয়েকে নিয়ে বা মেয়েটার জন্য। সেও সিক্স পর্যন্ত পড়েছে। মেয়েকে যত দূর পারে পড়াবে।

কিন্তু মুশকিল হয়ে গেল একটা। রাতে তাহলে কোথায় খাবে মুনাবিল? তিন বেলা সান্ত্বনার মায়ের হোটেলে খায় সে, যদি সাবির তিনার বাসায় না যায় বা অন্যত্র না থাকে। পিকনিক হয় কখনো কখনো, এ ছাড়া ‘পান্থনিবাসে’ রান্নাবান্না হয় না। আবিদুরের খাবার তার বাসা থেকে আসে। অন্যদের যে যার মতো ব্যবস্থা। আচ্ছা, দেখা যাক।

শিল্পকলা একাডেমীর গেট পার হতে হতে মুনাবিল বিখ্যাত আর্টিস্ট মনিরুল ইসলামকে দেখল। মনিরুল ইসলাম এবং আর একজন। মনিরুল ইসলামের হাতে বাদামের ঠোঙা। বাদাম খাচ্ছেন তিনি, সঙ্গীকে দিচ্ছেন। তাকালেন এদিকে। এ কী! মনিরুল ইসলামের চোখের মণি কি সবুজ? না কমলা? না...। চমকে বোকা হলো মুনাবিল। শিল্পকলা একাডেমীর গেটের আলো, গাড়ির আলো চোখে পড়ে এ রকম দেখাচ্ছে। না হলে মনিরুল ইসলাম কি টিউন? টিউন। ঘাসফুল! সত্যি না বিভ্রম?

বিভ্রম। আর কি! কিন্তু ঘাসফুল? পরির মতো দেখতে মেয়েটা বিভ্রম? উধাও হয়ে গেল যে রকম! বিভ্রম তবে। ঘাসফুল বিভ্রম। রাতে একবার ফোন করে একটু কথা বলতে হবে আনিসের সঙ্গে। আনিসুল হক। লেখক না, মনস্তাত্ত্বিক। বন্ধুমানুষ। সে ব্যাখ্যা দিতে পারবে হয়তো ঘটনার।

মেসেজ সিগন্যাল বাজল সেলফোনে।

1 NEW TEXT MESSAGE

এখন দেখবে না। মুনাবিল ভাবল। কিন্তু দেখল।

TUI KOTHY?

FROM: SABIR

সাবির-তিনার বাসায় চলে যাবে নাকি?

রিপ্লাই লিখল মুনাবিল, ‘COMING SOON.’

আবার ফোন বাজল।

মেসেজ না, কল।

SP

CALLING...

মুনাবিল ধরল, ‘হ্যালো?’

‘মুনাবিল। তুমি কোথায়?’

‘এই তো, বাসায় ফিরছি।’

‘এই সন্ধ্যায়? তুমি ফ্রি আছো নাকি এখন?’

‘আছি। আসব?’

‘হ্যাঁ, আসো। আমি বাসায়।’

এই এসপি (SP) কে, বলা যাবে না। ইনি সেই তিন ক্লায়েন্টের একজন। শান্তিনগরের অরনেট কমপ্লেক্সে থাকেন।

আধঘণ্টা পর অরনেট কমপ্লেক্সে দেখা গেল মুনাবিলকে। ড্রয়িংরুমে এসপির, বসে আছে একা। কাজের মেয়ে নূরুননাহার দরজা খুলে দিয়ে গেছে। এসপি আসছেন।

বলতে হয় না, বিস্তর টাকাপয়সা এসপির। ড্রয়িংরুমে যেসব শোপিস, কোনোটা মরক্কোর, কোনোটা রাশিয়ার, কোনোটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার। কারুকাজ করা মস্ত আয়নাটা বেলজিয়ান। অর্ধেকটাজুড়ে আছে দেয়ালের। দুনিয়ার অর্ধেক দেশ ঘুরেছেন এসপি। যেখানে যান কিছু না কিছু স্যুভেনির নিয়ে আসেন। ড্রয়িংরুমটাকে মিউজিয়াম বানিয়ে রেখেছেন।

‘মুনাবিল।’

এসপি এসে একটা সোফায় বসলেন।

‘কফি দেয়নি?’

‘না, ঠিক আছে।’

‘ঠিক আছে মানে? কী আশ্চর্য! নূরুন! নূরুন! অ্যাই-ই-ই নূরুন!’

নূরুননাহার উপস্থিত হলো দরজায়, ‘জি’।

‘কফি দিসনি কেন, ভাইয়াকে? কফি দে জলদি।’

‘জি।’

‘চলে যায়! এই শোন, বিস্কুট দিবি। কাল যে বিস্কুটের টিনটা আনলাম না...।’

‘জি।’

চলে গেল নূরুননাহার।

এসপি বললেন, ‘তারপর? তোমার কী খবর, মুনাবিল।’

‘ভালো, আপা।’ মুনাবিল বলল, ‘আপনি কেমন আছেন?’

‘আছি রে ভাই। কানাডা থেকে ছেলে এসেছে। মাস খানেক থাকবে। ব্যস্ততার কি আর আগামাথা আছে? এর মধ্যে দেখ দুটো ঈদসংখ্যায় উপন্যাস লিখে দিতে হবে। ঈদ তো আর মাত্র দুই মাস। বুঝতে পারছি না কী যে করব?’

‘এখন কি একটা গল্প শুনবেন, আপা?’

‘শুনতে তো হবেই, ভাই। উপায় কী? রাতে আমাদের সঙ্গে ডিনার করে যাও তুমি।’

নিঃশব্দে কফি আর বিস্কুট রেখে গেল নূরুননাহার। এক মগ কফি। আর প্লেটে কয়েকটা বিস্কুট।

‘নাও, ভাই।’

‘আপনি কফি খাবেন না, আপা?’

‘না রে ভাই, আমার বিপি হাই। ছেলে, ছেলের বউ, তাদের বাচ্চা, সব সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি একদম। দাঁড়াও ট্যাবলেটটা দিতে বলি। তারপর তুমি বলো গল্পটা। কী গল্প?’

‘গল্পটা একটু অদ্ভুত, আপা।’

‘এ কী!’

কী হয়েছে বুঝল না মুনাবিল। তার দিকে তাকিয়ে আছেন এসপি। কী হয়েছে?

‘তুমি হঠাৎ চশমা পরে ফেললে কেন?’ এসপি বললেন, ‘কী হয়েছে? চোখে সমস্যা?’

চশমা পরেছে! কোত্থেকে? জীবনে চশমা পরেনি মুনাবিল। এখন চশমা কোত্থেকে পাবে যে পরবে? ভুলভাল দেখছেন মহিলা। নাকি ঘাসফুল বলেছিল যা, আরও কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে!

কানের পাশে হাত দিল মুনাবিল। চশমার ডাঁটি। আয়নায়ও দেখল। সত্যি একটা চশমা পরে আছে সে। কালো গ্লাসের চশমা। এটা কীভাবে, কখন সে পরল? খুলে ফেলবে?

‘চোখ উঠেছে মনে হয় আপা।’ মুনাবিল বলল। বলে চশমা খুলে তাকাল। আবার বলল, ‘সকাল থেকে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে কী রকম।’

‘লাল!’ এসপি বললেন, ‘তোমার চোখের রং তো সবুজ দেখছি... না নীল... না কমলা...। স্ট্রেঞ্জ!’

মুনাবিল অল্প হাসল। মনে মনে ভাবল, সে কি চেয়েছে তার চোখের মণি রঙিন হোক এমন? কখন চেয়েছে?

এদিকে স্ট্রেঞ্জ বললেও মনে হয় আসলে স্ট্রেঞ্জ হননি এসপি। শান্ত গলায় কেউ একজনকে ডাকলেন, ‘জেফি! জেফি! জেফি, ডিয়ার!’

ছোট্ট একটা মেয়ে। দরজায় দেখে চমকাল মুনাবিল। এর নাম জেফি? কিন্তু এ তো, এ তো ঘাসফুল! বিকেলবেলার পার্কের সেই ঘাসফুল! ছোট্ট সেই টিউন!

‘জেফি।’ এসপি বললেন, ‘লুক, হি ইজ... কী বলব, বলো তো মুনাবিল? তোমার যা বয়স। না হলে সম্পর্কে তো এর নানাভাই হও তুমি, এ হলো আমার নাতনি জেফি। জেফিরেনথাস। দাদা বলি? ...জেফি, হি ইজ ইউর ব্রাদার। দা দা।’

‘হাই, দাদা।’ জেফি বলল।

ঘাসফুল! একদম টিউন ঘাসফুলের কণ্ঠ!

মুনাবিল বিড়বিড় করে বলল, ‘ঘাসফুল’।

‘ঘাসফুলের ল্যাটিন নাম জেফিরেনথাস।’ এসপি বললেন।

তাকাল মুনাবিল।

চোখের মণির রং বদলাচ্ছে জেফির। জেফিরেনথাসের। এই নীল, এই কমলা, এই সবুজ, এই পার্পল...। জেফিরেনথাস না, ঘাসফুলই এ। টিউন ঘাসফুল। কিন্তু এসপি কী দেখছেন না ব্যাপারটা?

এসপি! আরও বোকা হয়ে গেল মুনাবিল। চোখের মণির রং বদলাচ্ছে এসপিরও। এই নীল, এই সবুজ...। কী হচ্ছে! কী হচ্ছে এসব!

‘কী মুনাবিল?’ এসপি বললেন, ‘কী হয়েছে?’

‘না, আপা...।’

‘বোকা ছেলে! আরে...।’ এসপি হাসলেন, ‘আমরা তো এখন টিউনিয়ায়।’

মুনাবিল এসপিকে দেখল। জেফিরেনথাস... ঘাসফুলকে দেখল। নিজেকেও দেখল। আয়নায়। ঠিক। তারা তো এখন টিউনিয়ায়ই। মানুষ না, টিউনদের গ্রহ টিউনিয়ায়।