তুলকালাম
কীর্তিমারীর কোতোয়ালি থানার ওসির বাড়িতে দাওয়াত রাত ৯টায়, কিন্তু ইন্সপেক্টর রইস হাজির হলো আটটার দিকেই। বসের বাড়িতে দাওয়াত কখনোই ঠিক দাওয়াত নয়, অফিসের কাজের আলাপ সেখানে এসেই পড়ে। আর তা ছাড়া আজকের দাওয়াতের প্রধান অতিথি, কীর্তিমারীর বিদায়ী পুলিশ সুপার সাহেবের অভিধানে ‘দেরি’ শব্দটা নেই। বরং সময়ের আগেই হাজির হওয়ার অভ্যাস তাঁর।
বারান্দাটা পেরিয়ে সদর দরজার সামনে জুতার সারি দেখে অবশ্য মুচকি হাসল রইস। বাকিদের অবস্থাও তারই মতো—আগেভাগেই এসে পড়েছে। ঘণ্টাখানেক আগে হাজির হয়েও রইস যে এসপি সাহেবকে পেছনে ফেলতে পারেনি, সেটা বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসা তাঁর বাজখাঁই গলার আওয়াজেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। বাড়ি কাঁপিয়ে গল্প করছেন তিনি, ‘বুঝলে, ওই কেসই সবচেয়ে ভুগিয়েছে আমাকে। তখনকার তুমুল আলোচিত ঘটনা। ওই সন্ত্রাসবাদী নেতার পেছনে এত বছর ঘুরলাম, আর শেষমেশ...’
বসার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে চোখ বোলাল রইস। আসরের মধ্যমণি হয়ে মাঝখানের সোফাটা আয়েশ করে দখল করেছেন বিশালবপু এসপি সাহেব মোবারক আলী। মাথার চুল কমে এলেও জুলফির কাছে কয়েকটা বাদে পাক ধরেনি কোনোটায়ই, ঝোপের মতো গোঁফটা পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সেও কাঁচা। নীল ইউনিফর্ম নয়, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা তাঁর পরনে। গমগমে কণ্ঠে স্বভাববিরুদ্ধ হালকা চালে গল্প করছিলেন এসপি সাহেব, রইসকে দেখে কথার মোড় ঘোরালেন, ‘আরে রইস, এসো এসো। এক্ষুনি বলছিলাম তোমার কথা। বসো।’
একটা আধা অফিশিয়াল সেলুট ঠুকে সামনে এগোল রইস। বসে পড়ল আরেকটা সোফায়। ঘরের সবাই কীর্তিমারী কোতোয়ালি থানায় তার কলিগ, টুকটাক কুশল বিনিময় করল সে এর-ওর সঙ্গে।
রইসের পেছন পেছন ঘরে ঢুকেছে আরেকটা লোক, ঘরের কোণের একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসবে-বসবে করছে। এসপি সাহেব কিন্তু তাকিয়ে আছেন তার দিকেই। লোকটা থতমত খেয়ে ওনাকে সালাম দিয়ে চেয়ারে বসা মুলতবি করে দাঁড়িয়েই রইল।
‘তোমার সঙ্গীটি কে হে, রইস? পরিচয় করিয়ে দাও।’ এসপি সাহেবের কথার ধরন এমনই।
জবাবটা কীর্তিমারী কোতোয়ালি থানার ওসিই জুগিয়ে দিলেন, ‘ও আমাদের এক ইনফরমার, স্যার। বেশ বিশ্বস্ত। রইসের সাথেই ঘোরাঘুরি করে বেশির ভাগ সময়।’
এসপি সাহেবের পরের কথায় বোঝা গেল, তিনি সেটা আগেই আঁচ করেছিলেন। স্মরণশক্তি ভালো না হলে পুলিশগিরি করা যায় না। ‘বুঝেছি, এ হচ্ছে সে—কী যেন ভাই নাম তোমার? করিম?’
লোকটার একহারা গড়ন, মাথায় এলোমেলো চুল, গাল বসা। চোখ দুটো কিন্তু দারুণ উজ্জ্বল। বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের ভেতর। কথা বলল যখন, উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষার টান প্রকট তাতে, ‘সার, হামার নাম কামাল। সবায় টিকটিকি কামাল কয়া ডাকে।’
ঘরে একটা মৃদু হাসির রোল উঠল। রইস তাতে যোগ দেয়নি অবশ্য, এসপি সাহেবও না, ‘ঠিকই আছে হে। ব্যোমকেশ নিজেকে গুরুগম্ভীর “সত্যান্বেষী” উপাধিতে ডাকে, তুমি নাহয় মানুষের ঠাট্টা করে বলা শব্দটাই নিলে। গায়ে না মাখলেই হলো। তোমার গোয়েন্দাগিরিতে তাতে সমস্যা না হলেই হলো।’
ওসি আনোয়ারুল সাহেবের মন্তব্যটা অবশ্য অত সদয় নয়, ‘কী জানি স্যার, আমি তো কখনো ওকে কোনো রহস্যের সমাধান করতে দেখলাম না। তবে ও মাঝেমধ্যে বড়সড় মাদকের চালান ধরতে সাহায্য করেছে। পুলিশের ইনফরম্যান্ট হিসেবে এটাই ওর কাজ অবশ্য,’ ঠোঁট ওলটালেন ওসি।
রইস এবারে মৃদু কণ্ঠে যোগ করল, ‘ও আসলেই আমাকে কয়েকটা কেস সমাধান করতে সাহায্য করেছে, স্যার। অবজারভেশন পাওয়ার খুব ভালো, চোখকান খুব প্রখর। আর ওর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা না থাকলে কী হবে, প্রচুর বইপত্র পড়ে তো।’
ওসি একবার রইসের দিকে, আরেকবার কামালের দিকে তাকালেন কৌতুকের দৃষ্টিতে, ‘আমার একটা রহস্যের সমাধান করে দিতে পারবে, টিকটিকি কামাল?’
ওসির কণ্ঠে বিদ্রূপের ভাবটা মনে হয় পুরোপুরি লুকানো নয়। কামাল কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বলল, ‘কন, স্যার। চেষ্টা করি দেখব।’
রইস খেয়াল করল, এসপি সাহেব নজর সরিয়ে নিলেন। জায়গাটা যদি অফিস হতো, তাহলে হয়তো ওসি সাহেবকে মানা করতেন, যাতে গোবেচারা কামালকে আর না ঘাঁটান বা হয়তো প্রসঙ্গটাই পরিবর্তন করতেন। কিন্তু কীর্তিমারী ছেড়ে একটা বড় শহরের কমিশনার হয়ে বদলি হয়ে যাচ্ছেন তিনি আগামী সপ্তাহেই, ওসি আনোয়ারুল সাহেবের বাসায় দাওয়াতটাকে বিদায়ী নৈশভোজ বলা যায়। এখন তিনি অফিশিয়াল মেজাজে নেই। তাই গৃহস্বামীকেও কিছু বলবেন না।
ওসি কিন্তু বেশ সিরিয়াস হয়ে উঠলেন যেন এবার, ‘সেদিন রংপুরে গেছি একটা ট্রেনিংয়ে, সপ্তাহখানেকের জন্য। পুলিশ অফিসার্স মেসে উঠেছি। তো প্রতিদিন সকালেই দেখি একই ঘটনা—জুতা পরতে গিয়ে দেখি, জুতার ভেতর রাখা মোজা বদলে গেছে। ডান পায়েরটা বাঁ পায়ের হয়ে গেছে, বাঁ পায়েরটা ডান। প্রতিদিন একই ঘটনা। সাত দিনে তিন জোড়া মোজা পরেছি, প্রতিবারই একই ঘটনা। কেউ যে মোজা বদলে দেবে, সেটার উপায় নেই, জুতা ঘরের ভেতরে ঢুকেই খুলতাম।’ কামালের দিকে ভুরু নাচালেন তিনি, ‘কীভাবে হলো হে? আমি তো কিনারা করতে পারিনি।’
‘স্যার, কেমন করি বুঝলেন যে মুজা বদলায় যাইতেছে? দুই পায়ের মুজা তো দেখতে একই রকম লাগে অনেক সময়।’ কামাল বুকে হাত বেঁধে বিনীত কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
‘আমি গরিব মানুষ হে। সৎ অফিসার হওয়ার জ্বালা, মোজাগুলো পুরোনো। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে কড়া পড়েছে আমার, মোজাতেও ছোটখাটো ফুটো আছে। ভুল হতেই পারে না।’
কামাল সিরিয়াস চেহারায় আরেকটা কী যেন প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, কিন্তু এবার বাগড়া দিলেন এসপি সাহেব, ‘তুমি এই মহা রহস্য পরে সমাধান করিয়ো কামাল মিয়া। যে গল্পটা শুরু করেছিলাম, সেটা শেষ করি আগে।’
সবাই নড়েচড়ে বসল। রইস বুঝল, সে আসার আগে দারুণ মজাদার কোনো গল্প করছিলেন এসপি সাহেব।
‘তো, যেটা বলছিলাম,’ বলতে শুরু করলেন এসপি, ‘রইসের জন্য আবার একটু পেছনে ফিরে যাই। বছর পনেরো আগের কথা। আমি তখন সদ্য ট্রেনিং শেষ করে সিলেট বিভাগের একটা অখ্যাত এলাকার সার্কেল এএসপি। সীমান্তবর্তী এলাকা। আর ওসব জায়গায় কী কী সমস্যা হয়, তোমরা এই কীর্তিমারীতে থেকে তো ভালোই জানো। চোরাচালান, মাদক পাচার—এসব হাবিজাবি। কিন্তু আমি গিয়ে পড়লাম জটিল এক পরিস্থিতিতে। কারণ, মোস্ট ওয়ান্টেড এক আসামি তখন এসে লুকিয়েছে আমার এলাকায়; কুখ্যাত সিরিয়াল বম্বার জেলিগনাইট।
‘জেলিগনাইটের আসল নাম কেউ জানে না, কিন্তু তার ছদ্মনামই তখন সবার মুখে মুখে। বাস্তবে জেলিগনাইট একধরনের শক্তিশালী বিস্ফোরক, জানো তো? যাহোক, পাঁচ বছর ধরে সারা দেশের এখানে–ওখানে বোমা ফাটিয়ে আতঙ্কের জাল বিছিয়েছে তখন সে। একই ঘটনা ঘটে চলেছে বারবার। ডাকযোগে বা সরাসরি পার্সেল আসছে দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে। পার্সেল খুলতে গেলেই বিস্ফোরণ। পাঁচজন মারা গেছে তত দিনে, আহত যে কতজন, তার ইয়ত্তা নেই। জেলিগনাইটের টার্গেটদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পুলিশের উঁচু পদের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য—কেউ বাদ যায়নি। ভাগ্যিস, প্রথম কয়েকটা পার্সেল বোমায় বহু লোকজন হতাহত হওয়ার পর সতর্ক হয়ে গিয়েছিল সবাই। তবু কয়েক মাস পরই এখানে–ওখানে বোমা বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যেত। আহত-নিহতের সংখ্যাও বেড়ে চলছিল। বেশির ভাগ বোমার সাথেই থাকত চিঠি। তাতে জেলিগনাইটের হুমকি আর দম্ভোক্তি বুঝিয়ে দিত যে এটা অন্য কোনো সন্ত্রাসী দলের কাজ নয়। প্রতিটা চিঠির নিচে ছদ্মনাম টাইপ করা থাকত—জেলিগনাইট! একজন মাত্র সন্ত্রাসবাদী পুরো দেশকে এমনভাবে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। অবিশ্বাস্য!’
‘পাঁচ বছরেও কেউ ধরতে পারল না?’ ওসি সাহেবের প্রশ্ন।
‘খুব সতর্ক লোক ছিল জেলিগনাইট। বোমাগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষা কম করা হয়নি, কিন্তু এমন কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি, যাতে জেলিগনাইটকে চিহ্নিত করা যায়। চুল, ফাইবার, আঙুলের ছাপ—কিচ্ছু না। ডিএনএ প্রযুক্তি তখনো অত উন্নত নয়, কিন্তু সেটাও চেষ্টা করা হয়েছিল। লাভ হয়নি। বোমাগুলোর সাথে যে টাইপ করা চিঠি থাকত, সেগুলোও ক্লু–বিহীন। নিশ্চয়ই গ্লাভস পরা হাতে খুব সাবধানে করত বোমা বানানো আর চিঠি টাইপ করার কাজ,’ এসপি সাহেব বললেন।
‘জেলিগনাইট আসলে চাইত কী?’ রইস প্রশ্ন করল। জেলিগনাইটের ব্যাপারে পত্রিকায় অল্পস্বল্প পড়েছিল সে বহু আগে। এত দিন পর বিস্তারিত কিছু মনে নেই।
‘সে তো আরেক আশ্চর্য। জেলিগনাইটের দাবি ছিল যে পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর পরিবেশ-প্রকৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এ রকম দাবি তো প্রকৃতিপ্রেমীরা প্রায়ই করে থাকে। কিন্তু জেলিগনাইট এককাঠি বেশি সরেস। সে বলত, পৃথিবী ধ্বংসের পেছনে রয়েছে বিজ্ঞানের উন্নয়ন। বিজ্ঞানের কারণে কলকারখানা, গাড়ি–ঘোড়া তৈরি হয়েছে বলেই বন উজাড় হচ্ছে, পশুপাখির আবাসস্থল বিনষ্ট হচ্ছে, পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে। কাজেই বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রা রুখতে হবে, দুনিয়ার সব কলকারখানা বন্ধ করতে হবে, পৃথিবীকে হাজার হাজার বছর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে!’
‘পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কী!’ রইসের এক কলিগ বিস্ময়ের সুরে বলল।
‘তার কাছে ওটাই ছিল জীবনের লক্ষ্য, মহাসংগ্রাম। কাদের কাছে এবং কেন বোমা পাঠাত, সেটাও বোঝা যায় এ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টার্গেট করত, যাতে তাঁরা বিজ্ঞানের গবেষণা বন্ধ করেন; কলকারখানার মালিক আর ম্যানেজারদের পাঠাত, যাতে সব ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়া হয়; পুলিশ আর প্রশাসনের লোকদের কাছে পাঠানো হতো, যাতে তাঁরা তার দাবি মেনে নিয়ে পৃথিবী থেকে সব বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেন!’ এসপি সাহেব হাসলেন।
রইস ফোড়ন কাটল, ‘অন্য অনেক সন্ত্রাসবাদী এর চেয়ে ভয়ানক সব দাবি করেছে, স্যার। বহু মানুষের সমর্থনও পেয়েছে।’
‘তা বটে।’ বলে গল্পে ফেরত গেলেন আবার এসপি সাহেব, ‘এদিকে পুলিশ কিন্তু পাঁচ বছর ধরে কম চেষ্টা করছে না তাকে ধরার। ফরেনসিক কোনো ক্লু শুরুতে না পাওয়া গেলেও, পরে মিলতে শুরু করল একটা-দুটো করে। যেমন, তার বোমার প্রায় সব কটি প্যাকেটই বাক্সের মতো, আর সেগুলো তৈরি করা হয়েছে কাঠ দিয়ে। ল্যাবরেটরির গবেষণায় বের হলো, ও রকম কাঠ বাংলাদেশের একটা অঞ্চলেই পাওয়া যায়—উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনাঞ্চলে; অর্থাৎ সিলেট বিভাগের দিকে কোথাও। সব প্যাকেটেই ওই কাঠ।
‘তথ্যটা গোপন রাখা হয়। আরও ক্লু বের করার চেষ্টা চলছিল। এবার দেখা হচ্ছিল, বোমার কলকবজা কোন ধরনের। বোমাগুলো টাইম বোমা নয়; বরং এমন পদ্ধতিতে বানানো, যাতে সুন্দর করে মোড়ানো আর সুতা দিয়ে বাঁধা প্যাকেটটা খুলতে গেলেই বোমাটা ফাটে। প্রথম দিককার কয়েকটা বোমার গড়ন দেখে বোঝা গিয়েছিল, বেশ কাঁচা হাতে বানানো পাইপ বোমা ওগুলো। মানে, যে বোমায় একটা লোহা বা অন্য কোনো ধাতুর পাইপের ভেতর বিম্ফোরক পুরে বোমা বানানো হয়। ভালোমতো ফাটতও না ওগুলো। পরের দিকেরগুলোও পাইপ বোমা, আধুনিক কোনো বিস্ফোরক নয় বরং বারুদ পুরেই তৈরি, কিন্তু ওগুলোর দক্ষতা বেশি। বিস্ফোরণশক্তিও। তা যা–ই হোক, এখান থেকে আমরা কীভাবে পরের ক্লুটা পেলাম, তোমরা কেউ আন্দাজ করতে পারো?’ এসপি সাহেব সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন।
সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল আন্দাজে ঢিল ছুড়তে। চিঠিতেই কোনো ক্লু ছিল? নাকি অসতর্ক হয়ে গিয়েছিল জেলিগনাইট, আঙুলের ছাপ রেখে গিয়েছিল কোথাও? এ-ওর কথার ওপর দিয়ে কথা বলছে, একমত হতে পারছে না কেউ।
রইস কিছু বলছে না, শুনছে সবাই কী বলে। দরজার পাশে দাঁড়ানো কামালের দিকে চোখ পড়ল তার। কামাল তাকিয়ে ছিল এদিকেই, রইসের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মৃদু গলায় বলল, ‘পাইপ দেখিয়া ক্লু পাইছে, স্যার।’
‘রাইট!’ বলে উঠলেন এসপি সাহেব। একবার কামালের দিকে তাকিয়েই গল্পে ফেরত গেলেন তিনি আবার, ‘বলেছিলাম না, প্রথম দিকের বোমাগুলো ঠিকমতো ফাটেনি? পাইপ বোমার পাইপগুলো মোটামুটি অক্ষত ছিল। সেগুলোর দুটোয় পাওয়া গেল প্রস্তুতকারকের ছাপ। খুব দ্রুত সেই কারখানা খুঁজেও পাওয়া গেল। দেশি কোম্পানি, বেশ ছোট, কারখানা চট্টগ্রামে। ব্যবসা খুব বেশি ছড়ায়নি, চট্টগ্রাম বিভাগে আর ঢাকার বাইরে ব্যবসা করেনি কখনো।’
‘লেগে গেল প্যাঁচ!’ ওসি সাহেব বলে উঠলেন।
‘ঠিক তা–ই। কাঠ বলছে বোমাটা সিলেটের, পাইপ বলছে চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও। ফরেনসিক বিভাগে, পুলিশের অন্দরমহলে তুমুল মতবিভেদ। কেউ বলছে কাঠের ক্লুটা ভুল ছিল, কেউ বলছে বোমা আসলে বানানো হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে, কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের দ্বারা। জেলিগনাইটের লেখা চিঠিগুলো আসলে ধোঁকা। কেউ একমত হতে পারছে না।’ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কথার বোমা ফাটালেন এবার এসপি সাহেব। ‘কিন্তু আসল সমস্যাটা অন্যখানে। যে পাইপের কোম্পানির কথা বললাম, দেখা গেল, সেটা চার বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।’
সবাই থ। মুখ চাওয়াচাওয়ি চলছে সমানে। রইস নিজেও বিস্মিত। একঝলক তাকিয়ে দেখল, কামাল টানটান হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, চেহারা ভাবলেশহীন।
‘কারও মাথায়ই খেলছিল না, ব্যাপারটা চলছে কী। পাইপের ক্লুটা কি ভুল ছিল? নাকি কাঠের ক্লুটা? তখন তরুণ এক অফিসার ওই পাইপের কোম্পানির চালানের কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে আবিষ্কার করে বসলেন আরেকটা ক্লু। সব খটকা দূর হয়ে গেল ওতেই,’ এসপি সাহেব রহস্যময় কণ্ঠে বললেন। গল্প বলতে জানেন বটে ভদ্রলোক।
সবার আগ্রহ চরমে তুলে এসপি সাহেব বললেন, ‘তরুণ সেই অফিসার কোম্পানিটার কাগজ ঘেঁটে দেখলেন, তাদের পাইপের সবচেয়ে বড় চালান ছিল সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা গ্যাসক্ষেত্রের খনিতে।
‘পুলিশের গোয়েন্দারা চটজলদি খোঁজ নিতে গেলেন গ্যাসের খনিতে। হ্যাঁ, ওই পাইপ এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে খনিতে। তাহলে কি খনির কোনো কর্মকর্তাই আসলে জেলিগনাইট? ওখানকার বড়কর্তা থেকে শুরু করে শ্রমিক, সবাইকেই জেরা করে অতিষ্ট করে ফেলা হলো। কিন্তু আবারও শুধু কানাগলিতেই ঘুরপাক খাচ্ছিলেন তদন্তকারীরা। বোমা হামলার সাথে কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেল না।
‘কারণ, আসল রহস্য লুকিয়ে ছিল গ্যাসক্ষেত্রের বাইরে। আক্ষরিক অর্থেই বাইরে। খনির সীমানার ঠিক পাশেই ছিল একটা পাহাড়-টিলায় ভরা বন। যে তরুণ অফিসার গ্যাসক্ষেত্রের সংযোগটা খুঁজে পেয়েছিলেন, উনিই খুঁজতে খুঁজতে বনের গভীরে গিয়ে পেয়ে গেলেন একটা কাঠের কুটির। গাছপালার আড়ালে এমনভাবে লুকানো যে ওখানকার আঞ্চলিক লোকদেরও চোখে পড়েনি কখনো ওটা। কিন্তু কুটিরটা নয়, তরুণ অফিসারের চোখ কপালে উঠল কুটিরের পাশে একগাদা জঞ্জাল দেখে। এটা-ওটা টুকিটাকি বাতিল সরঞ্জামের সঙ্গে পড়ে আছে অনেকগুলো জং ধরা পাইপ। যে পাইপ তাঁকে সিলেটের গ্যাসক্ষেত্রে টেনে এনেছে, ঠিক সেই পাইপ।’
ঘরের সবাই একসাথে শ্বাস টানল।
‘পুলিশ ঘিরে ফেলল কুটিরটা। ওটায় কে থাকে, সেটা কিন্তু জানা যায়নি তখনো। ওয়ারেন্ট নিয়ে এসে কুটিরের দরজা ভাঙতে সময় লাগল না এবং জেলিগনাইটের ডেরা উন্মোচিত হলো সবার সামনে।’ এসপি সাহেব একটা ক্লান্ত হাসি দিলেন। ‘ভেতরটা দেখে সবার চক্ষু চড়কগাছ। নানা ধরনের রাসায়নিক, বিস্ফোরক আর যন্ত্রপাতি তো আছেই, সেই সাথে আছে বিজ্ঞানের বই—রসায়নেরই বেশি আর ডজন ডজন নোটবই। সেগুলোর এক-দুইটা বাংলায় লেখা, বাকি সবই সাংকেতিক ভাষায় ঠাসা। আর হ্যাঁ, সেই টাইপরাইটারও পাওয়া গেল, যেটায় করে বোমার সাথে পাঠানো চিঠিগুলো টাইপ করা হয়েছিল।
‘তো তরুণ সেই অফিসার তখন নোটবইগুলো ঘাঁটতে গিয়ে দেখলেন...’ এসপি সাহেব বলছিলেন। সবাইকে চমকে দিয়ে মৃদু গলায় বাধা দিল ইন্সপেক্টর রইস, ‘স্যার, আপনিই সেই তরুণ অফিসার ছিলেন, তা–ই না?’
ঠা ঠা করে হেসে উঠলেন এসপি, ‘ঠিক ধরেছ, রইস। তো, আমি নোটবইগুলো ঘাঁটার দায়িত্ব নিলাম নিজে থেকেই। চল্লিশ–পঞ্চাশটা নোটবই, বিরাট কাজ! বাংলা নোটবইগুলো থেকে তেমন কিছু জানা গেল না। কীভাবে বিশ্বকে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি থেকে মুক্ত করবে, সেটা ছাড়া তার ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু লেখা নেই। বুঝলাম, আসল রহস্য লুকিয়ে আছে সাংকেতিক নোটবইগুলোর ভেতরে। উঠেপড়ে লাগলাম সেই ধাঁধার সমাধান করতে। অফিসের বাইরে তো বটেই, অফিসেও ফাঁক পেলে ওই অদ্ভুত ভাষার রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা চলতে লাগল আমার। টানা তিন-চার দিন কেটে গেল এভাবেই।
‘ইংরেজি, গ্রিক, রুশ হরফ মিলিয়ে জগাখিচুড়ি একটা ভাষায় লেখা। ডানে–বাঁয়ে, ওপরে–নিচে—কোনো দিক থেকে পড়েই কোনো মানে বোঝা যায় না। অক্ষরগুলো আসলে প্রতীক, সেটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। লাইব্রেরি থেকে বইপত্র আনিয়ে ঘেঁটে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, কোন ধরনের সাংকেতিক ভাষা হতে পারে ওটা।
‘আমার আন্দাজটাই ঠিক, বুঝতে পারছিলাম ধীরে ধীরে। প্রতিটা অক্ষর আসলে অন্য কোনো অক্ষরকে নির্দেশ করছে। যেমন, গ্রিক আলফা হয়তো ইংরেজির পি অক্ষর। ধীরে ধীরে প্রতিটা অক্ষরের মানে বেরিয়ে আসছিল। কুটির থেকে নোটবই উদ্ধারের চার দিন পর এক শুক্রবার সকালে টের পেলাম, সাংকেতিক ভাষাটার অর্থ বুঝে ফেলেছি আমি।’
শ্বাস নেওয়ার জন্য থামলেন এসপি সাহেব, কিন্তু ঘরের বাকি সবাই দম আটকে অপেক্ষা করছে। একটানে একটা পানির গ্লাস খালি করে দিয়ে আরেকটা বোমা ফাটালেন যেন এসপি সাহেব, ‘ঠিক তখনই একটা ফোন পেলাম সিলেটের ওই থানা থেকে। জেলিগনাইটের এক সহকারী আত্মসমর্পণ করেছে থানায়।’
সবাইকে ধাক্কাটা হজম করার জন্য খানিকটা সময় দিলেন এসপি মোবারক সাহেব, ‘আমি তখনো সিলেট শহরেই। ছুটে গেলাম ওই থানায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
‘গোবেচারা চেহারা জেলিগনাইটের সহকারীর। ছোকরাই বলা চলে, বয়স পঁচিশ-টচিশের বেশি নয়। শুকনো, ছোটখাটো গড়ন হওয়ায় আরও কম বয়সী মনে হয়। তাকে ঘিরে পুলিশেরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দেখে ঘাবড়ে গেছে খানিকটা, কিন্তু ধীরে ধীরে সব কথাই খুলে বলল।
‘জেলিগনাইটের আসল নামধাম জানা গেল তার কাছ থেকে। ট্যালেন্ট লোক। ইউরোপের একটা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা করে এসেছে কেমিস্ট্রির ওপরে। বিপ্লবী চিন্তাভাবনা তার ভেতর আগে থেকেই ছিল, ইউরোপে থাকার সময় যান্ত্রিক জীবনের কারণেই বোধ হয় মাথা বিগড়ে যায় পুরোপুরি। তার মনে হয়, বিজ্ঞানই সব নষ্টের গোড়া। সুতরাং, সব রকম যন্ত্র আর প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, মানুষ বাস করবে মধ্যযুগের মতো করে। প্রকৃতির বুকে ফিরে যাবে সবাই, পৃথিবীটা আবার সবুজ হবে। গরুর গাড়ি আর পালতোলা জাহাজ ছাড়া আর কোনো যানবাহন ব্যবহার করবে না কেউ। তেলের প্রদীপ জ্বালাবে, জড়িবুটি ওষুধ খাবে, হাতে বোনা কাপড় পরবে। কিন্তু দুনিয়ার মানুষ এত সব আধুনিক সুযোগ–সুবিধা ছাড়তে চাইবে কেন? কাজেই, আঙুল বাঁকা করল জেলিগনাইট। শুরু হলো তার বোমাবাজি।
‘এই ছোকরা, নাম সম্ভবত ছিল সোহেল, জেলিগনাইট দেশে ফেরার পরপরই তার মায়াজালে আটকে যায়। সিলেটের দিককার এক ফরেস্ট অফিসারের ছেলে সে। বনের বাংলোয় থাকতে এসেছিল জেলিগনাইট। সে ভালোমতো মগজ ধোলাই করে সোহেলের, নিজের মতবাদের সবক দেয়। ছেলেটারও ভালো লেগে যায় জেলিগনাইটের কথাবার্তা। কারণ, সে নিজেও কাছ থেকে দেখেছে, কীভাবে প্রাকৃতিক বনভূমি উজাড় হচ্ছে। ধীরে ধীরে জেলিগনাইটের কাজকর্মের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায় সে। জেলিগনাইটের আর কোনো সঙ্গী ছিল না। সোহেল তাকে বনের ভেতর কুটির বানাতে সাহায্য করে, নানা জিনিসপত্র কিনে এনে দেয়। যন্ত্রপাতি জোগাড় করে দেয়। জেলিগনাইট বন থেকে বেশি একটা বেরোত না। বোমা বানিয়ে সোহেলের হাতে দিত, সোহেল ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে রেখে আসত। ডাক বা কুরিয়ারের মাধ্যমে বোমা পাঠালে আগেই ফেটে যাওয়ার ভয় ছিল, তাই হাতে হাতে রেখে আসা। কিন্তু একটা ভুল করে ফেলেছিল সোহেল, লোহার পাইপগুলো চুরি করেছিল পাশের গ্যাসের খনির বাতিল কলকবজার ভাগাড় থেকে। ওখানে প্রচুর লোহালক্কড় পাওয়া যেত বলে অনেক কিছু ওখান থেকেই সরাত সে আর জেলিগনাইট, কিন্তু এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য।’
‘জেলিগনাইটের কী হলো স্যার?’ ওসি সাহেবের আগ্রহভরা প্রশ্ন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় হেলান দিলেন এসপি সাহেব, লম্বা গল্প বলে ক্লান্ত যেন। ‘সে ব্যাটা বর্ডার টপকে পালিয়ে গেছে ভারতে, আমরা তার কুটির খুঁজে পাওয়ার ঠিক আগেই। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। হয়তো দুর্গম পাহাড়ে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করছে এখনো, কে জানে! বাংলাদেশে তো আর নেই—সেটাই বাঁচোয়া। এই যে দেখো, জেলিগনাইটের একটা ছবিও সে দিয়েছিল আমাদের। ঘোলা একটা ছবি, কিন্তু একমাত্র এটাই হাতে এসেছে আমাদের। এই দেখো।’ নিজের মুঠোফোনে একটা ছবি দেখালেন এসপি সাহেব। চশমা পরা, ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা এক লোকের ছবি। কোনোমতে চেহারা বোঝা যায়, আসলেই একেবারে ঘোলা ছবিটা।
সবাই মাথা ওপর–নিচ করল। এসপি সাহেব গল্পের শেষ টানলেন, ‘দুঃখ একটাই, আসল অপরাধী জেলিগনাইটকে ধরতে পারলাম না। যাহোক, তার ত্রাসের রাজত্ব ধ্বংস করতে পেরেছি, সেটাই–বা কম কী? আর তো কোনো বোমা হামলা হয়নি।’
এক গ্লাস পানি খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এসপি সাহেব। ঘরের বাকিরা নিজেরা নিজেরা আলোচনা করছে কেসটা নিয়ে। রইস ভাবছে নিজের সমাধান করা কয়েকটা কেস নিয়ে, ওগুলোর পেছনে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তাকে।
‘খিদে পেয়েছে নাকি সবার? নাহলে আরেকটা গল্প বলি।’ এসপি সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই সবাই সমস্বরে জানিয়ে দিল, তাদের মোটেই খিদে লাগেনি। গল্প হোক!
রইসের দিকে তাকালেন এসপি সাহেব, ‘তুমি একটা বিখ্যাত জোড়া খুনের কেস সমাধান করেছিলে না, রইস? আমার ঝুলিতেও এমন একটা কেস আছে—ট্রিপল মার্ডারের! তো, আমি তখন পাবনায়...’
‘সোহেল নামের চ্যাংড়াটার কী হইছিল, সার?’
থেমে গেছেন এসপি সাহেব। কথাটা কে বলেছে বুঝতে একমুহূর্ত সময় লাগল সবার, তারপরই সব কয় জোড়া চোখ ঘুরে গেল দরজার দিকে। কামাল দাঁড়িয়ে ওখানে।
সবার চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তি। এসপি সাহেবের গল্পে বাগড়া দিচ্ছে পুলিশের এক সোর্স! এসপি মোবারক সাহেব কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বললেন, ‘ওর কয়েক বছরের জেল হয়েছিল রে। বেশি নয়। বয়স কম ছিল ওর, তা ছাড়া সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিক্ষিত ভার্সিটিপড়ুয়া ছেলে। জেলিগনাইটের ব্রেনওয়াশের স্বীকার হয়েছিল আরকি। জজ সাহেব দয়াপরবশ হয়ে লঘু সাজা দিয়েছিলেন, বছর পাঁচেক সম্ভবত। যত দূর মনে পড়ে, ভালো আচরণের কারণে সেই সাজারও অর্ধেকটা খাটার পর মুক্তি পায় সে।’
সবাই নড়েচড়ে বসল। গল্প শুরু হবে আবার। কিন্তু কামাল ততক্ষণে বলে উঠেছে, ‘খুব কমের ওপর দিয়া বাঁচি গেছে, সার। ফাঁসি হওয়া লাগত।’
এবার বিরক্ত হয়েছেন এসপি সাহেবও, আর বাকিরা তো প্রায় ধমকেই ওঠে পারলে। ‘তোমাকে কী বললাম আমি, শুনতে পাওনি?’ এসপি বললেন। ‘কম বয়সী ছেলে, ব্রেনওয়াশের শিকার। ভুল স্বীকার করেছে, আত্মসমর্পণ করেছে জেলিগনাইট পালানোর পর। তার কেন ফাঁসি...’
‘খুনের শাস্তি তো ফাঁসিই, সার। আর জেলিগনাইট পালাইলো কুন দিন?’ শান্ত গলায় বলল কামাল, চোখ সরাসরি এসপি সাহেবের ওপর।
ওসি আর দুই সাব-ইন্সপেক্টর সরাসরি ধমকে উঠল এবার, ‘আরে ব্যাটা, কী সব বলছ পাগলের মতো? চুপ করো!’
কিন্তু ইন্সপেক্টর রইস সোজা তাকিয়ে আছে এসপি সাহেবের দিকে। রাগ তো নেই-ই, স্পষ্ট বিস্ময় ভর করেছে তাঁর চেহারায়। চোখে বিহ্বলতা। কোনোমতে বলতে পারলেন, ‘তার মানে...তুমি বলতে চাইছ...’
কামাল এবার আসল বোমাটা ফেলল, ‘সোহেলই জেলিগনাইট আছিল, সার।’
পিনপতন নীরবতা সারা ঘরে। কামাল বলে চলল, ‘সবকিছুই তার করা। জেলিগনাইটের অতীত নিয়া যা কইছে, খোঁজ নিয়া দেখবেন, সব বানায়া কইছে। সিলেটের বনে বসিয়া সে-ই বানাইত বোমাগুলান। শেষে যখন দেখল, আপনি তার আস্তানার খোঁজ পায়া গেছেন, তখন নিজে থাকিয়া ধরা দিয়া মিছা একটা গল্প কইছে। অল্প শাস্তি নিয়া পার পায়া গেছে। জেলিগনাইটের অতীত নিয়া যা যা কইছে, খোঁজ নিলে দেখবেন সব ভুয়া। ওই নামে কেউ আছিল না কুনু দিন। আর যে নোটবইয়ের কথা কইছিলেন, সাংকেতিক ভাষায় লেখা, সোহেল ধরা পড়ার পর তো আর সেটার অর্থ উদ্ধার করেন নাই, তা–ই না?’
দীর্ঘ নীরবতাটা ভাঙলেন এসপি সাহেবই, ‘ঠিক তা–ই। নোটবই দিয়ে কী হবে, অপরাধীর খোঁজ তো পেয়ে গেছি, ভেবেছিলাম। আর, হ্যাঁ, আমরা তখনই খোঁজ নিয়েছিলাম, ওই নামের কারও অতীত রেকর্ড পাইনি। তখন কিছু মনে হয়নি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি.... যাকগে, তুমি কীভাবে ধরে ফেললে ব্যাপারটা, কামাল?’
‘গল্প শুনতে শুনতেই মনে হইতেছিল, স্যার। জেলিগনাইটের বিদেশে পড়ার গল্প শুনাইছে সোহেল। কারণ, নাইলে বাংলাদেশের কোন ভার্সিটিত সে রসায়নের উচ্চশিক্ষা পাইছে, সেইটা বলতে হইত। সিলেট তো আসলে তার বাড়ি, কিন্তু সিলেটে কেন জেলিগনাইট আইল, সেটা বুঝাইতে একটা দুর্বল গল্প বানাইছে। এগুলাও কিছু মনে করতাম না, কিন্তু আপনি যে ছবি দেখাইলেন, তাতে বুঝি গেছি পুরা জিনিসটা বানায় কইছে সে।’
‘ছবি দেখে কীভাবে বুঝলে?’
কামাল এই প্রথম হাসল। হাসিও ঠিক নয়, হাসির ছায়ামাত্র। ‘স্যার, ওইটা আমেরিকার এক কুখ্যাত খুনি এডমন্ড কেম্ফারের। ছবিটা ইচ্ছা করে ঘোলা করে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি দিছে। আসল লোকটার খালি মোচ ছিল।’
কারও মুখে কোনো কথা নেই, সবাই চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে কামালের দিকে। কামাল কিন্তু সোজা ওসি সাহেবের দিকে তাকানো, ‘স্যার, আপনার জুতার কথা বলতেছিলেন তখন, যে প্রতিদিন সকালে মুজা পাল্টায় যাইত কীভাবে। খুব সহজ। আপনি রুমের সামনে জুতা খুলি রাখিয়া রুমের ভেতর ঢুকিয়া চেয়ারে বসিয়া মুজা খুলতেন, ঠিক না?’
কুখ্যাত বোমাবাজের রহস্য সমাধানের পর ওসি সাহেবের মুখ দিয়ে কথা ফুটতে চাইল না। ‘হ্যাঁ...রুমের ভেতরই দরজার পাশে একটা চেয়ারে বসে মোজা খুলতাম।’
‘তারপর মুজা দুইটা ঢুকিয়া রাখতেন দুই জুতায়। বুঝলেন স্যার, যেদিকে মুখ করিয়া রুমে ঢুকতেন, রুমের বাইরের জুতাত মুজা থোয়ার সময় তো তার উল্টা দিকে মুখ করতেন। তখনই মুজা জোড়া পাল্টায় যাইত।’
পানির মতো সহজ ব্যাখ্যা। জেলিগনাইটের রহস্য সমাধানের পর থমকে গিয়েছিল সবাই, এবার হো হো করে হেসে উঠল পুরো ঘর। এসপি সাহেব বলে উঠলেন, ‘তোমার এই ইনফরমার ছেলেটাকে আমি একটা মেডেল দেব, রইস। সাবাস!’
সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কামালও হাসছে। শিশুর সারল্য সেই হাসিতে।