সকাল সকাল জুগনু কবিরাজ চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলল।
‘তোর জন্য। এই তোর জন্য আমার এত বড় সর্বনাশটা হইল। নেমকহারাম। গাধার বাচ্চা গাধা!’
জুগনু যাকে ‘গাধার বাচ্চা গাধা’ বলে গাল দিচ্ছিল, আদতে সে একটা মোরগ। লাল আর কালোর ছোপ ছোপ আঁকা একটা নিরীহ, সুন্দর মোরগ। মোরগের অপরাধ কী? জানতে হলে জুগনু আর কী কী বলছিল, সেটা আপনাদের শুনতে হবে।
‘...কত দিন পর। কত দিইইন পর দাদাজান আমার স্বপ্নে হাজির হইলেন। বললেন, “জুগনু রে, তর জন্য একটা উপহার আনছি। গত বছর গেরামের তাবৎ লোক চিকুনগুনিয়া না কী এক রোগে কাইত হইল। এই পাড়ে বইসা আমি বহুত গবেষণা করলাম। গবেষণা কইরা বুঝলাম, নিরাময় আছে। উপায় আছে।” এইটুক বইলাই দাদাজান গান ধরলেন। তাঁর আবার গানের শখ আছিল। সুরে সুরে দাদাজান কইলেন...’
জুগনু খাতায় দাদাজানের গাওয়া গানটা টুকে রেখেছিল। আশপাশটা চট করে একবার দেখে নিয়ে খাতা খুলে সে নিচু স্বরে গাইল:
‘অশ্বত্থগাছের ছাল,
আর কৃষ্ণচূড়ার ডাল।
বাটো এক লগে,
দিয়ো দুইটা মরিচ—ঝাল।
লাউয়ের পোকা মাখতে হইব
ভাতের লগে দুইটা,
আলগা কইরা ছুঁইয়া দিয়ো
পালং আর পুঁইটা।
সব শেষে দিবা তুমি
তিন ফোঁটা...
ঠিক এই সময়! এই সময় হারামজাদা মোরগ, তুই ডাইকা উঠলি। আমার ঘুম গেল ভাইঙ্গা। তিন ফোঁটা কী? কী দিমু তিন ফোঁটা? সেইটা আর জানা হইল না। ওরে নেমকহারাম। গাধার বাচ্চা গাধা!’
জুগনু পারে তো মোরগের গলা চেপে ধরে। আহা! একটুর জন্য চিকুনগুনিয়ার ওষুধের রেসিপিটা তার জানা হলো না। একবার ওষুধটা আবিষ্কার করতে পারলেই সারা গ্রামে তার নাম ছড়িয়ে পড়ত। চায়ের দোকানে, নৌকাঘাটে, হাটবাজারে বসে মানুষ বলত, জুগনু কবিরাজ, জিনিস একটা! যেমন দাদা, তেমন তার নাতি। জুগনুর বাড়ির সামনে রোগীর লাইন পড়ে যেত। আহা, সেই আশার গুড়ে বালি।
এমনিতেই দুই বছর ধরে দিনকাল বড় খারাপ যাচ্ছে। চণ্ডীর মোড়ে ‘মায়ের দুআ ফারমেছি’ নামে একটা ওষুধের দোকান হয়েছে। প্রতি সপ্তাহের রোববার সেখানে ডাক্তার বসে। বিরাট লাইন হয়। দূরদূরান্ত থেকে রোগী আসে ডাক্তারের কাছে। এখন সামান্য জ্বর, ঠান্ডা, কাশি হলেও গ্রামের লোকজন ফার্মেসিতে ছোটে। আর এদিকে জুগনু কবিরাজের ব্যবসায় লাল বাতি।
সারা দিন বেচারা মন খারাপ করে বসে রইল। একটু পরপর মোরগটাকে গালাগাল করল। গ্রামের লোকজন বলল, ‘জুগনুর মাথাটা এইবার গেছে।’
সন্ধ্যা হতেই জুগনু বাতিটাতি নিভিয়ে ঘুমের আয়োজন করল। বিছানা ঝেড়ে, দাদাজানের ছবিটা মাথার কাছে রেখে শুয়ে পড়ল। যদি আবারও স্বপ্নটা ফিরে আসে, সেই আশায়। কিন্তু হায়! স্বপ্ন তো আর ধারাবাহিক নাটক নয়, যে আগের পর্বে যেই জায়গায় শেষ হয়েছে, পরদিন আবার ঠিক সেখান থেকে শুরু হবে। সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে কাটল জুগনুর। স্বপ্ন তো দূরের কথা, ঘুমও এল না।
ভোরবেলা দেখা গেল, আবারও উঠানে বসে মোরগটাকে গালাগাল করছে জুগনু। ‘নেমকহারাম। গাধার বাচ্চা গাধা। তুই আমার সর্বনাশ করলি।’
এভাবে দুই দিন, দুই রাত গেল। তিন ফোঁটা কী মেশাতে বলছিলেন দাদাজান? ভাবতে ভাবতে জুগনুর চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে এল। একটা স্বপ্নও দেখল জুগনু। কিন্তু স্বপ্নে দাদাজান নয়, হাজির হলো তার মোরগ! জুগনু কবিরাজ দেখল, মোরগটার আকৃতি হয়ে গেছে পাঁচতলা একটা দালানের সমান। বিশাল মোরগটা বাঘের মতো গর্জন করছে। আর বলছে, ‘পিচ্চি কবিরাজ কোথাকার! আরেকবার আমাকে গাধার বাচ্চা বলে দ্যাখ। টপাক করে গিলে খেয়ে ফেলব।’
পরদিন থেকে এক্কেবারে চুপ মেরে গেল জুগনু। মোরগটাকে আর গালাগালও করল না। মোরগের পেটে যাওয়ার ভয়ে না অন্য কোনো কারণে, কে জানে!
সন্ধ্যাবেলা দেখা গেল, প্রচণ্ড গরমেও শাল দিয়ে গা-মাথা মুড়ে কোথায় যেন যাচ্ছে জুগনু কবিরাজ। মাথা নিচু করে ‘মায়ের দুআ ফারমেছি’তে ঢুকল সে। মিনমিন করে বলল, ‘এক পাতা ঘুমের ওষুধ দেন তো।’
শাল দিয়ে মুখটুখ ঢেকেও কোনো লাভ হলো না। ফার্মেসির দোকানদার শ্যামল ঠিকই জুগনুকে চিনে ফেলল। বলল, ‘কী সাংঘাতিক ঘটনা! জুগনু কবিরাজ আমার দোকানে!’
ছি ছি ছি! কী লজ্জা! মগনু কবিরাজের নাতি, জুগনু কবিরাজ শেষ পর্যন্ত ফার্মেসিতে পা রাখল! মনে মনে রাগে, দুঃখে জুগনুর মরে যেতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু এ ছাড়া উপায় কী? ঘুম না এলে স্বপ্ন আসবে কোথা থেকে।
দুটো ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল জুগনু। সেদিন ঘুম এল বটে। মরার ঘুম। এক ঘুমে জুগনু চোখ মেলল পরদিন সকালে। এতই ভালো ঘুম হলো যে স্বপ্নের দেখা নেই। মহাযন্ত্রণা!
বিকেলবেলা নদীর ধারে উদাস হয়ে বসে ছিল জুগনু। ঘরে চাল নেই, ডাল নেই। এভাবে কদিন গেলে মোরগটাকেও বিক্রি করে দিতে হবে। মনে মনে সেটাই ঠিক করল জুগনু। গাধার বাচ্চা গাধা একটা! ওকে রেখে কী লাভ?
ভাবতে ভাবতে নদীর ধারে, বালুর ওপর শুয়ে পড়েছিল জুগনু। এই সময়! এই সময় একটু ঘুম ঘুম পেল। জুগনু চোখ বুজল। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল দাদাজানকে। স্বপ্নের মধ্যে জুগনু কবিরাজ চিৎকার করে উঠল, ‘দাদাজান! আপনারে আমি কত খুঁজছি! কত ডাকছি। চিকুনগুনিয়া রোগের ওষুধ বানাইতে কী কী লাগবে, শেষটা তো আপনি বলেন নাই। তিন ফোঁটা কী? কী মিশাব? জলদি বলেন। ঘুম ভাঙার আগেই...।’
দাদাজান উদাস হয়ে তাকালেন। মনে হলো জুগনুর কথায় তাঁর মন নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জুগনু, তুই কি কামটা ঠিক করলি? আমার সাধের দোতারাটা বেইচা দিলি। অভাবে পইড়া শেষ পর্যন্ত তুই আমার দোতারা বেচলি?’
‘আহ্ দাদাজান।’ জুগনুর গলায় চরম বিরক্তি। ‘দোতারার কথা রাখো তো। তোমার দোতারা বেচছি সেই কবে। এখন তুমি চিকুনগুনিয়ার কথা কও।’
চিকুনগুনিয়ার কথা শুনে দাদাজান চিকন গলায় বলেন, ‘আহারে আমার দোতারা। কী সুন্দর বাজত! টুং টিং টং ট্যাং টোং টাং ট্রিং টুং। টুং ট্রিং টাং টোং ট্যাং টং টিং টুং।’ অদৃশ্য দোতারা হাতে মগনু কবিরাজ সারেগামাপাধানিসা বাজালেন। কিন্তু ওষুধের রেসিপি বললেন না।
জুগনু এবার অধৈর্য হয়ে পড়ল। ‘দাদাজান। তুমি কিন্তু মেজাজটা খারাপ কইরা দিতাসো। জলদি কও। তিন ফোঁটা কী?’
শুনে দাদাজান মুচকি হাসেন। আর অদৃশ্য দোতারায় বাজান, ‘টোং ট্রিং টোং ট্রিং টোং ট্রিং টোং ট্রিং।’
‘উফ্! দোতারা ফালাও। আমার কথা শোনো। তিন ফোঁটা কী দিমু?’
‘টোং ট্রিং টোং ট্রিং টোং ট্রিং টোং ট্রিং।’
‘আরে জ্বালা! তোমার দোতারার খ্যাতা পুড়ি। তুমি কও। তিন ফোঁটা কী? আমার ঘুম কিন্তু ভাইঙ্গা যাইতেসে।’
দাদাজানের এত কথা শোনার সময় নেই। তিনি তখনো চোখ বুজে, মনের সুখে অদৃশ্য দোতারা বাজাচ্ছেন। ‘টোং ট্রিং টোং ট্রিং টোং ট্রিং টোং ট্রিং।’
এই পর্যায়ে এসে জুগনুর ঘুম গেল ভেঙে। এবার আর সে রাগ করল না, চিৎকার-চেঁচামেচি করল না। অতি শোকে বেচারা পাথর হয়ে গেছে।
মন খারাপ করে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল জুগনু কবিরাজ। হঠাৎ তার মনে হলো, ‘আরে! তিন ফোঁটা কী দিতে হবে, দাদাজান তো সেটা বলেছেন। ব্যাপারটা আগে মাথায় আসেনি কেন!’
উত্তর
মগনু কবিরাজ প্রথমে অদৃশ্য দোতারায় সারেগামা বাজালেন। সা রে গা মা পা ধা নি সা, সা নি ধা পা মা গা রে সা — টুং টিং টং ট্যাং টোং টাং ট্রিং টুং, টুং ট্রিং টাং টোং ট্যাং টং টিং টুং। এরপর বারবার তিনি একই কথা বলছিলেন, ‘টোং ট্রিং টোং ট্রিং টোং ট্রিং’। লক্ষ করো, সা = টুং, রে = টিং, গা = টং, মা = ট্যাং, পা = টোং, ধা = টাং, নি = ট্রিং, সা = টুং। তাহলে টোং ট্রিং অর্থ কী দাঁড়াল? পানি! সব শেষে মেশাতে হবে তিন ফোঁটা পানি।