দেয়ালে দেয়ালে
ক্লাসে বসলেই রাহীর কী যে হয়, কে জানে। পুরো ব্যাপারটা ওর নিজের কাছে একটা অমীমাংসিত রহস্যের মতো।
রাহী যে পেছনের দিকের বেঞ্চে বসে হা হা হি হি করে, তা কিন্তু নয়। সামনের দিকেই দেখা যায় ওকে, বেশির ভাগ সময় তো একদম ফার্স্টবেঞ্চার। ইচ্ছা করে ক্লাস থেকে মনোযোগ সরিয়ে রাখে, তা-ও না। ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর ঠিকই নজর থাকে ওর, বই–খাতা সব হাতের কাছে মজুত। কলম? একটা বুকপকেটে আর ব্যাগের ওপরের চেইন খুললে আরও দুটো। পেনসিল, শার্পনার, রাবার? তা-ও আছে। ড্রয়িং সার হুট করে কিছু আঁকতে দিলে কারও কাছে চাইতে হয় না। ও নিজেও কাউকে কিছু ধার দেয় না অবশ্য। সে যাকগে, কিন্তু এমন নিখুঁত প্রস্তুতি নিয়ে এসেও ক্লাসে কারও মন বসবে না কেন?
অথচ ছোটবেলায় এমন ছিল না রাহী। চার বছর বয়সেই বানান করে পড়তে শিখেছিল, হাতেখড়ি করিয়েছিলেন ওর আব্বু। সুকুমার রায়ের সমগ্র শিশুসাহিত্য দুবার আগাগোড়া পড়া শেষ ক্লাস থ্রিতে থাকতেই। তিন গোয়েন্দার ১০টা ভলিউম ঝরঝরে করে ফেলেছে। তখন ক্লাসের রোলও থাকত এক, না হয় দুই। এখন এই ক্লাস সেভেনে এসে বিশ পেরিয়ে ত্রিশের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে ওর রোল—চলতি ইংলিশে বলতে গেলে ‘পুশিং থার্টি’। ক্লাস ফাইভের সমাপনী পরীক্ষার রেজাল্ট কহতব্য নয়। কেন?
প্রশ্নটার জবাব রাহী যেমন খুঁজছে, তেমনি খুঁজছেন ওর ক্লাস টিচার মর্তুজা স্যার। অন্য সাবজেক্ট যদিও-বা টেনেটুনে চালানো যায়, কিন্তু গণিতে যে রাহী একবারেই ডাব্বা। আর মর্তুজা স্যার কোন সাবজেক্ট পড়ান? ঠিক ধরেছ। গণিত। ম্যাথ।
মর্তুজা স্যারের তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী চোখ রাহীর জীবন যে কেমন ছারখার করে তুলছে, তা আর কহতব্য নয়।
আজকের কথাই ধরো।
ডে শিফটের ক্লাস রাহীর। কোথায় চড়চড়ে রোদ থাকবে, অথচ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঘ ঘনিয়ে কালো থমথমে হয়ে উঠল আকাশ। জিলা স্কুল শহরের এক মাথায়, রাহীদের বাড়ি আরেক মাথায়—তাই রাহীর আম্মুই বলছিলেন, আজ আর স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। রাহী কান দিল না। স্কুলের পড়ায় ও বছর বছর যতই পিছিয়ে পড়ছে, ততই বাড়ছে ওর ক্লাসের ওপর ঝোঁক। আগে পেটব্যথা–মাথাব্যথা বলে ক্লাস কামাই করত, আর এখন রোদ-বৃষ্টি সব ঠেলে তারাশঙ্করের গল্পের ডাকহরকরার মতো ঠিকই হাজির হয় বিশাল বটগাছের নিচের জিলা স্কুলে।
রিকশায় করে আধরাস্তা এসেছে কেবল, তারপর যা হওয়ার তাই হলো। ঝমঝমিয়ে সে কী বৃষ্টি, গ্রামার বইয়ের ক্যাটস অ্যান্ড ডগস একেবারে। সঙ্গে হু হু হাওয়া। রিকশার পর্দা গলা পর্যন্ত তুলেও লাভ হলো সামান্য। ব্যাগটা কোনোমতে বাঁচানো গেলেও মোটামুটি কাকভেজা হয়ে ক্লাসে ঢুকল রাহী।
ক্লাস কিন্তু একদম ফাঁকা পেল না রাহী। তেমনটা হয়, যদি সকাল থেকে বৃষ্টি ঝরে। ছাত্র এসেছে মোটামুটি। বেশির ভাগেরই বাড়ি স্কুলের কাছাকাছি। ইউনিফর্ম ভেজা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় কেউই, বরং ক্লাস শেষ করে কখন মাঠে ফুটবল খেলবে, সেই চিন্তায় বিভোর। উত্তেজিত আলোচনা চলছে। দু–তিনজন নিজের ভেজা শার্ট খুলে শুকাচ্ছে ফ্যানের বাতাসে। রাহীর নিজের অবস্থাও জবজবে, কিন্তু ও রকম কিছু করার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে না ও। এমনিতেই তুহিন নামের কাপ্তান গোছের ছোকরাটা কেমন যেন সরু চোখে দেখছিল ওকে, বরাবরের মতোই। তাড়াতাড়ি ওদের পাশ কাটিয়ে সামনের সারিতে একদম কোনায় বসে পড়ল ও, জানালার পাশে। ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে বসার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু হয় দখল হয়ে গেছে, না হয় এমন ছেলেদের সঙ্গে সিট, যারা টিটকারি থেকে শুরু করে চোরাগোপ্তা খোঁচা—কোনোটাই দিতে বাকি রাখবে না ওকে।
ঢংঢং ঘণ্টা পড়ে ক্লাস শুরু হলো যখন, তখনো বৃষ্টির বিরাম নেই। মর্তুজা স্যার ক্লাসে ঢুকলেন বরাবরের মতোই চোখ কুঁচকে কী যেন ভাবতে ভাবতে। টকটকে ফর্সা, চমত্কার গোঁফওয়ালা সুস্বাস্থ্যবান মানুষটা হয়তো সিনেমা লাইনে ট্রাই করলেই ভালো করতেন, কিন্তু বেছে নিয়েছেন অঙ্কের খাতায় ঝড় তুলে ছেলেছোকরাদের নাভিশ্বাস তোলার কাজ।
রোলকলের সময় প্রথম দিককার নামগুলো ধরে চেঁচাতে হলো মর্তুজা স্যারকে, নাহলে বৃষ্টির ঝমঝম ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছিল না। রাহীর রোল আসতে আসতে অবশ্য নাটকীয়ভাবে বৃষ্টি কমে গেল। ওর মিহি গলায় ‘ইয়েস স্যার’ শুনে একটা ভুরু-কোঁচকানো দৃষ্টি ছুড়ে দিলেন স্যার, অবশ্য আর কিছু বললেন না ভাগ্যিস। তবে আজও পড়াশোনা নিয়ে কোনো না কোনো কথা শোনাবেনই রাহীকে, সন্দেহ নেই। তা শোনান। কিন্তু পুরো ক্লাসের সামনে বলা হয় কথাগুলো, এটাই রাহীকে একদম দমিয়ে দেয়। স্যারের রংপুরিয়া ভাষার টানের কড়া কথাগুলোর ঝাঁজ তো আছেই, তার থেকেও বেশি ওকে কাবু করে পেছন থেকে ভেসে আসা চাপা হাসি আর টিটকারির আওয়াজ।
বৃষ্টি থেমে গেছে একদম, আকাশ থমথমে। আরামদায়ক আবহাওয়া, ক্লাসের ছেলেপেলে ঘুম ঘুম আবেশে চুপ, আর এদিকে রাহী কিন্তু খাতা সামনে নিয়ে কলম হাতে ধরে তৈরি একদম। স্যারের অঙ্ক ঝটপট তুলে নেবে খাতায়। ক্লাসে মনোযোগ না থাকাটাই রাহীর পড়াশোনা গোল্লায় যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে বহু আগেই চিহ্নিত করেছেন স্যার এবং গত পরশুও কথা শুনিয়েছেন সেটা নিয়ে।
ঐকিক নিয়মের অঙ্ক করাচ্ছেন স্যার। ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর কিঁচকিঁচ করে ছুটছে ওনার চক, লাইনের পর লাইন লিখতে লিখতে স্যার এগিয়ে যাচ্ছেন বোর্ডের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। রাহীরও বিরাম নেই। যত দ্রুত সম্ভব প্রথম দুটো অঙ্ক তুলে নিল খুব সহজে।
দূরে কোথাও মেঘ গুড়গুড়িয়ে উঠল। রাহী তো জানালার পাশেই বসা, ওর চোখ চলে গেল বাইরে। স্কুলের পেছনে খানিকটা ঝোপঝাড়ওয়ালা খালি জায়গা, শেওলা আর লতাপাতায় ঢাকা একটা পুরোনো দেয়াল আর বরইগাছটার ওপরে খানিকটা আকাশ। আরও মেঘ জমল কি? আজ স্কুলে থেকে ফেরার সময়ও কি বৃষ্টিতে ভিজতে হবে ওকে? এমনিতে জ্বরজারি সহজে ধরে না রাহীকে, কিন্তু আজ কেমন যেন শীত শীত লাগছে। আবার ভিজলে নির্ঘাত সর্দি ধরবে।
বৃষ্টির কথা ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল ‘তিন গোয়েন্দা’র অথৈ সাগর বইটার কথা। ওহ, প্রশান্ত মহাসাগরের মরু-দ্বীপে আটকে পড়ে কী নাজেহালটাই না হয়েছিল কিশোর পাশা গং! পানি নেই, খাবার নেই, কিচ্ছু না। একবার একটু বৃষ্টি হলো, সেটার পানি জমানোর জন্য সবার কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। আসলে আমরা পানির দেশে থাকি তো, তাই মূল্য বুঝি না। পাশের দেশ ভারতের রাজস্থানেই নাকি এক ফোঁটা পানি আনতে দুই ফোঁটা পেট্রল পোড়াতে হয়।
পুরোনো দেয়ালটার দিকে চোখ গেল রাহীর। সীমানাপ্রাচীর ওটা। ওপাশে কী আছে সেটাও জানে ও, ব্যাপ্টিস্ট চার্চ। বিশাল এলাকা ওটার। গাছগাছালিতে ছাওয়া। তারই দু–একটার ডাল ঝুঁকে পড়েছে দেয়ালটার ওপর। কী একটা নাম না জানা লতা চিপকে আছে দেয়ালটার গায়ে। সেটা দেখতে দেখতেই মনে পড়ল, সাগরের নিচে ডুব দিয়ে সামুদ্রিক আগাছায় মুসার পা আটকে যাওয়া। কোন বইতে ছিল ওটা, অথৈ সাগর-এই কি? উঁহু। মুক্তোর দ্বীপ? না মনে হয়। অবশ্য অথৈ সাগর-এ অক্টোপাসের সঙ্গে দারুণ একটা ফাইট আছে, পানির নিচে। এই ঘন সবুজ প্যাঁচানো লতাগুলোকে খুব সহজেই অক্টোপাসের শুঁড় হিসেবে—
কে যেন ঠেলছে হাতে। বিরক্ত রাহী ভুরু কুঁচকে ঘাড় ঘোরাল ডান দিকে। ওর বেঞ্চের আরেক মাথায় বসেছে নয়ন, আঁতেল ছেলে, কিন্তু আবার হাত-পা চালায় বড্ড বেশি। তারই আবার শখ হলো নাকি ফাজলামো করার?
নয়ন কিন্তু দাঁত কেলিয়ে ঘোষণা করল ওর শমন: ‘ওই, স্যার ডাকতেছে, শুনিস না ক্যা?’
হাবার মতো দুই সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থাকল রাহী। কথাটা কানে গেছে তার, মগজেও ঢুকেছে, মানেও বুঝেছে—কিন্তু আসলে মনে মনে গালি দিয়ে নিজের ভূত ছাড়াচ্ছে সে। তাই স্যারের ডাকে সাড়া দেওয়া হচ্ছে না। কীভাবে পারল ও! আরেকবার ক্লাসের মাঝখানে দিবাস্বপ্নে হারিয়ে গেল, মর্তুজা স্যারের ক্লাসের মাঝখানে! ছি ছি ছি!
অবশেষে উঠে দাঁড়াল ও। হাঁটু নড়বড়ে, মাংসপেশিতে জোর নেই—তবু দাঁড়াতে হলো। ‘জ-জ-জি স্যার।’ কণ্ঠে রাজ্যের ক্লান্তি ওর।
মর্তুজা স্যারের ভুরু এর থেকে বেশি কোঁচকানো সম্ভব নয়। ‘অঙ্ক সব তুলতে হবে খাতায়, ক্লাসে মনোযোগ থাকতে হবে, হাজারবার বলেছি। সব তো এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যায়।’ বোর্ডের দিকে একটা আঙুল তুললেন তিনি। ‘শেষ লাইনে কাটাকাটি করলে কত উত্তর আসবে? আমি এইমাত্র মুখে বলেছি। তুই যদি ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে থাকিস, তো বলতে পারবি।’
অবশ্যই, রাহী ক্লাসে মনোযোগ দেয়নি, তাই ওর মুখে কথা সরল না। বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম করে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে ওর, কান করছে ঝাঁ-ঝাঁ, কুলকুল করে ঘাম ছুটছে এই জলো আবহাওয়াতেও। সারের খরদৃষ্টি বাদ দিলেও, পুরো ক্লাস দেখছে ওকে, মজা পাচ্ছে। ফিসফিসানিটা কিসের? সবাই বলাবলি করছে যে ও কতটা আহাম্মক? চাপা হাসির শব্দও শোনা যাচ্ছে যেন। কে যেন ছোট্ট করে দুটো খোঁচা দিল ওর কোমরের নিচে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, ওই কাপ্তান ছোকরা তুহিন আজ ওর ঠিক পেছনের বেঞ্চে বসেছে। কাজটা ওরই।
রাহীর মুখ দিয়ে কথা সরছে না। এমন অবস্থায় জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকানোর চেয়ে বড় বোকামি আর হয় না। তবু আপনা থেকেই ওর চোখ চলে গেল বাইরে—হয়তো স্যারের থেকে মুখ লুকোতেই।
আর তখনই ওই শেওলা পড়া, নোনাধরা পুরোনো দেয়ালের গায়ে চিপকে থাকা লতাপাতার মাঝখানে সংখ্যাটা লেখা দেখল রাহী।
না, রং দিয়ে লেখা নয়। কেউ লেখেনি—কিন্তু লতাগুলোর মাঝখান দিয়ে স্রেফ দেখা যাচ্ছে সংখ্যাটা। মাঠে চিত হয়ে শুয়ে আকাশের মেঘ দেখতে গিয়ে যেমন দেখা যায়, অবিকল ঘোড়ার মতো, মানুষের মাথার মতো মেঘ ভেসে যাচ্ছে, ঠিক সে রকম। লতায়-শেওলায় এত স্পষ্টভাবে ফুটে আছে সংখ্যাটা, যে না দেখে উপায় নেই।
‘আঠারো,’ রাহীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। চোখ সরিয়ে এনেছে মর্তুজা স্যারের চোখে। ‘উত্তর আঠারো, স্যার।’
একরাশ বিরক্তি ভর করল মর্তুজা স্যারের চেহারায়। ‘তোর অমনোযোগটা আর গেল না, রাহী। তোকে নিয়ে কী করি আমি, বল তো?’
রাহী ঢোঁক গেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। ঠিকই তো আছে। দেয়ালের লতার মাঝখানে ভেসে ওঠা সংখ্যা দেখে—
‘খালি আঠারো বললে তো হবে না। উত্তরের জায়গায় লিখতে হবে আঠারো মিনিট। না হলে নম্বর কাটা যাবে। বোঝা গেল?’ বলে আঙুল দিয়ে বসার ইঙ্গিত করলেন স্যার।
কলের পুতুলের মতো বসে পড়ল রাহী। ধাতস্থ হতে মিনিটখানেক লেগে গেল ওর। ভাগ্যিস পুরো সময়টা কেউ তাকায়নি ওর দিকে, নইলে ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে চেহারা দেখে ভড়কে যেত।
দেয়ালের লতার মাঝখানে অঙ্কের উত্তর ভেসে ওঠে কীভাবে? কেউ বাপের জন্মে শুনেছে?
দেয়ালটার দিকে আবার তাকাল ও। না, এলোমেলো লতাপাতা ছাড়া আর কিছু নেই। নিজের কল্পনা লাগামছাড়া করেও ‘এক’ বা ‘আট’ সংখ্যাটা বের করতে পারল না রাহী। যেটা নেই, সেটা পাওয়ার কথাও নয় অবশ্য।
ক্লাসে মনোযোগটাই সবার আগে চাইছেন মর্তুজা স্যার। কিন্তু কী বিপদ, এমন একটা ঘটনার পরে কি আর ফুটো চৌবাচ্চার অঙ্কে মন বসে? তোমরাই বলো। ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর মনোযোগ রাখতে আর চটপট খাতায় অঙ্ক তুলতে কী যে কষ্ট হলো রাহীর, তা শুধু ও-ই জানে। অবশ্য তা ছাড়া উপায়ও নেই। দেয়াল আর শেওলাকে জোর করেই সরিয়ে রাখতে হলো মগজ আর নজরের বাইরে।
রাহীর দুঃখ বেশি এ জন্য যে ক্লাসে একমাত্র ওরই যে মনোযোগ কম, তা নয়। কিন্তু ও-ই যেন ফেঁসে যায় বারবার। আজ অবশ্য ওর ঠিক পেছনে বসা তুহিন, সেই কাপ্তানগোছের ছোকরাও স্যারের শ্যেনদৃষ্টিতে পাকড়াও হলো একবার। ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন স্যার। ‘দ্বিতীয় নলের ক্ষেত্রে কত হবে, বল দেখি? এইমাত্র বলেছি।’
আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে রাহী কিন্তু একটা মজার জিনিস দেখল। চোখেমুখে উদাস ভাব ফুটিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে তুহিন। ঠিক একই কাজ করতে গিয়ে যে একটু আগে বিপদে পড়েছে রাহী, তা যেন তার জানাই নেই। আর মর্তুজা স্যারের প্রশ্নও যেন তার কানে ঢুকেছে কি ঢোকেনি।
উত্তরটা অবশ্য ঠিকই দিল সে—বাইরে তাকিয়ে তাকিয়েই—‘ভগ্নাংশ হবে, স্যার। ছয়ের এক।’
রাহী অঙ্কটা তুলছিল, ও জানে এটা সঠিক উত্তর। ঈর্ষার একটা খোঁচা অনুভব করল ও, তুহিনের মতো ড্যাম কেয়ার ভালো ছাত্র হতে ওরও কি ইচ্ছে হয় না?
দেয়াল আর শেওলা নিয়ে বেশি ভাবনাচিন্তার ফল আবার পেল রাহী, ঘণ্টা দুয়েক বাদেই। টিফিন হয়ে গেছে, তার পরের প্রথম ক্লাসটা শারীরিক শিক্ষা। পিটি স্যার মোফাজ্জল স্যারকে আর সবার মতোই ভয় পায় রাহী। এই ক্লাসেও মনোযোগ ধরে রাখতে হবে, নিজেকে পইপই করে বলেছে সে এক শ বার। কিন্তু মানুষমাত্রই ভুল করে—তাই না?
প্রচুর কথা বলেন মোফাজ্জল স্যার। সৈয়দপুরে তাঁর এক ছাত্রের বাসায় গিয়ে কেমন খাতির–যত্ন পেয়েছেন, সেই বিবরণ শুনছিল রাহী—কিংবা ঠিক শুনছিল না, কারণ জানালা দিয়ে আসা ফুরফুরে জোলো হাওয়ায় আর স্যারের দীর্ঘ বকবকানিতে কখন যে ওর চোখের পাতা বুজে এসেছে, ও নিজেও জানে না।
ধড়মড়িয়ে জাগতে বাধ্য হলো অবশ্য। সেটাই স্বাভাবিক—ঝিমুনির জন্য উত্তম জায়গা নয় প্রথম বেঞ্চ। মোফাজ্জল স্যারের চেহারা গম্ভীর, জলদগম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খালি আলসেমির ধান্ধা, না? মাঠে তো দেখি না কোনো দিন। বল তো, একটা হকির মাঠ লম্বায় কত ফুট?’
খেলাধুলা অন্তঃপ্রাণ মোফাজ্জল স্যার। ইদানীং তার মাথায় ভূত চেপেছে, হকি খেলায় তুখোড় করে তুলবেন জিলা স্কুলের ছাত্রদের। হকির প্রশ্নের প্রেক্ষাপট এটাই।
অন্য দিন হলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সুনিশ্চিত ছিল রাহীর ভাগ্যে। ভড়কে ও গেছে ঠিকই, তবে ততটাও নয়। আপনা থেকেই জানালার বাইরে চলে গেছে ওর নজর, সেই পুরোনো দেয়ালে।
লতায় আর শেওলায় পরিষ্কার লেখা:
১-০-০ গ-জ
বলা বাহুল্য, এটাই সঠিক উত্তর।
ক্লাসের বাকি সময়টা আর কিন্তু ঝিমুনি এল না রাহীর। বড্ড গভীরভাবে ভাবছে ও। খালি সংখ্যা নয়, পরিষ্কার বাংলা লেখাও ফোটে ওই দেয়ালে। এ কোন ভানুমতীর খেল? হ্যারি পটারের মরোডার্স ম্যাপ নাকি এটা?
ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ছে ঢং ঢং করে, এদিকে পাঁজরে একটা খোঁচা অনুভব করল রাহী। আর কে? ওর পেছনে বসা তুহিন। ‘ওই, আজকে তোর সাথে কথা আছে। ছুটির পরে অপেক্ষা করবি বটগাছের নিচে।’
প্রমাদ গুনল রাহী, সেই সঙ্গে গিলল বড় একটা ঢোঁক। স্কুলের নিয়ম-কানুনে এমন আহ্বান অচেনা কিছু নয়। এর অর্থই হচ্ছে, একটা মারপিট আসন্ন। তুহিন খেপল কেন ওর ওপরে? কে জানি। রাহী মেশে না ওদের সঙ্গে, ওদের মনস্তত্ত্ব ওর কাছে পরিষ্কার নয়। এবং সেটা ঘাঁটানোর জন্য ও ব্যাকুল নয়।
কাজেই, ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ে মিশে বেরিয়ে এল রাহী, তারপরই ভোঁ–দৌড়। একেবারে স্কুলের ফটক পেরিয়ে এসে রিকশায় চড়ে বাড়ি।
ভাগ্যিস, পরদিন শুক্রবার। যদি ক্লাস থাকতও, পেটব্যথা না হয় মাথাব্যথার অজুহাতে স্কুলে যাওয়া কামাই দিত রাহী, সন্দেহ নেই। একটু সময় দরকার ওর। ধাতস্থ হতে হবে। দেয়ালের অলৌকিক ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবতে হবে। তা ছাড়া তুহিনের রহস্যময় হুমকিও একটা কারণ বটে।
শনিবার রাহী ক্লাসে গেল রাজ্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে। বসল ঠিক আগের জায়গাতেই, সামনের সারির একবারে বাঁ কোনায় জানালার পাশে। দেয়াল আর তার গায়ে চিপকে থাকা লতাপাতা আর শেওলা দেখা যাচ্ছে, বলা বাহুল্য। এবং, অবশ্যই, সেগুলোর মাঝে অনেক চেষ্টা করেও বাংলা-ইংরেজি কোনো সংখ্যা বা অক্ষর দেখা যাচ্ছে না।
চুপচাপ বেশিক্ষণ বসে থাকলে যা হয় আরকি। পুরো জিনিসটা নিয়েই একসময় সন্দেহ জাগল রাহীর মনে। সেদিন কি আসলেই ঘটেছিল ওসব ঘটনা? নাকি সব ওর কল্পনা? কিন্তু ক্লাসে মন না দিয়েও তো ও স্যারদের প্রশ্নের উত্তর পেরেছিল, তাই না? সেটাই-বা কীভাবে সম্ভব? অবচেতন মনের বহুল চর্চিত ব্যাখ্যাটা ওর মনঃপূত হচ্ছে না—
তুহিনকে একগাল হাসি নিয়ে ক্লাসে ঢুকতে দেখে এসব ভাবনার হাত থেকে মুক্তি পেল রাহী। আজকেও মারামারির হুমকি দেবে নাকি তুহিন—আপাতত এই নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে ওকে।
আশঙ্কাটা দশ গুণ বাড়ানোর জন্যই মনে হয় ওর পেছনের বেঞ্চে বসল তুহিন। ঠিক গত দিনের মতোই। বসতে বসতে চোখে চোখ পড়েছে রাহীর এবং একটা রহস্যময় হাসি হাসতে ভুল করেনি ছোকরা।
প্রথম পিরিয়ড শুরু হয়েছে। মর্তুজা স্যারের ক্লাস, বরাবরের মতোই। এবং বরাবরের মতোই গম্ভীর চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছেন উনি। পেছন থেকে কোনো চোরাগোপ্তা আক্রমণ আসে কি না বা ওর মাথায় তুহিন চুইংগাম আটকে দেয় কি না—এসব চিন্তায় ব্যস্ত থাকায় রোলকলে সাড়া দিতে দেরি করে ফেলল রাহী। স্যারের ভুরুটা কুঁচকে গেল আরও।
রোলকল শেষে ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক কষতে শুরু করলেন স্যার। খাতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাহী।
ন্যাড়া নাকি বেলতলায় একবারের বেশি যায় না। রাহী তিন বছর বয়সের পরে আর কখনো মাথা ন্যাড়া করেনি, মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলেরও অভাব নেই ওর, কিন্তু দেয়াল আর তুহিন নিয়ে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার খেসারত ওকে দিতেই হলো। ওকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখেছেন স্যার, এবং দাঁড়া করালেন। এবং অমোঘ সেই প্রশ্ন, ‘এইমাত্র কোন সংখ্যাটা বলেছি?’
কলের পুতুলের মতো মাথা ঘোরাল রাহী, বাইরে তাকাল একঝলক। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘২৩, স্যার।’
পুরোনো পলেস্তারা-খসা দেয়ালের লতাপাতার মাঝে খুব স্পষ্টভাবেই লেখা ছিল সংখ্যাটা। অবশ্যই এটা সঠিক উত্তর।
স্যার আবার ব্যস্ত হয়ে গেছেন অঙ্কের জট ছাড়াতে। রাহী খানিকক্ষণ গুম হয়ে রইল। নাহ, রহস্যটার শেষ দেখে ছাড়বে ও। আজই।
টিফিন পিরিয়ডে ছেলেপেলে শর্ট-পিচ ক্রিকেট আর টেনিস বল–ফুটবল খেলছে চেঁচামেচি করে। নাহয় দল বেঁধে ঘুরছে মাঠে। এদিক–ওদিক তাকিয়ে আস্তে করে বাঁক ঘুরে স্কুল ভবনের পেছনটায় চলে এল রাহী। ঘামছে ও। বুকটা ধড়ফড়ও করছে একটু।
এদিকটায় কারও যে পা পড়ে না, সেটা ঝোপঝাড়ের স্বাস্থ্য দেখেই বোঝা যায়। লম্বা ঘাস আর আগাছা ঠেলে এগোতে হচ্ছে রাহীকে। কানের পাশে ভনভন করছে মশা আর পোকামাকড়, সেগুলোকেও তাড়াতে হচ্ছে। ফিরেই যাবে কি না—এমন চিন্তা মাথায় আসতেই সামনে চোখে পড়ল দেয়ালটা।
কোনো লেখা দেখা যাচ্ছে কি ওখানটায়? বুকের ভেতরে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে রাহীর। কয়েক দিন ধরে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না ও রহস্যটার। আজকে যদি এত কাছ থেকে দেখেও কিছু বোঝা না যায়?
চোখ কুঁচকে দেয়ালের গায়ের শেওলা আর লতাপাতা পরীক্ষা করছে রাহী। কিছু একটা লেখা আছে মনে হয়। নাকি ওরই ভুল—
পেছনে একটা শুকনা ডাল ভাঙার শব্দে চমকে প্রায় লাফিয়ে ঘুরল ও।
‘গোদের ওপর বিষফোড়া’ বাগধারার অর্থ জানা আছে রাহীর। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—এই বাগধারারও। না জানা থাকলেও এ মুহূর্তে নিজের পরিস্থিতি দিয়ে বুঝে যেত ও ব্যাপারটা। কারণ, স্বয়ং তুহিন হাজির হয়েছে ওর সামনে। দৌড়ে যে পালাবে, সেই উপায়ও নেই।
কথা বলতে চাইল, কিন্তু মুখে আওয়াজ ফুটছে না রাহীর। তুহিন কিন্তু শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। কে জানি, এটা আক্রমণ করার আগের অবস্থাও হতে পারে। ঝড়ের আগের মুহূর্ত!
‘আম...আমি তো-তোমার সাথে লড়তে চাই না,’ কোনোমতে বলতে পারল রাহী।
তুহিন কিন্তু ওর কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। ‘আরে, এত ভড়কে যাচ্ছ কেন? পেছনে তাকাও। দেয়ালের লেখাটা দেখো।’
কানে ঢোকার পরও কথাটা বুঝতে একমুহূর্ত সময় লাগল রাহীর। বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়েছে ওর। ‘তুমি-তুমিও ওটার লেখা দেখতে পাও?’
‘পাই তো। তোমার আগে থেকেই। সে জন্যই তো জানালার পাশে বসি—তোমার ঠিক পেছনের সিটে—খেয়াল করোনি?’
করেনি বটে, এইমাত্র করল রাহী। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা কথা ঝিলিক দিয়ে উঠল ওর মাথায়। ‘সেদিন যে আমাকে পেছন থেকে গুঁতোচ্ছিলে...’
‘তোমাকে প্রশ্নের উত্তর বলে দেবার জন্য, আর কিছু না। আর স্কুলের পরে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম, ওই দেয়ালের লেখা নিয়ে কথা বলব বলেই। তুমি যে ওটার লেখা পড়তে পারো, সেটা আমি খেয়াল করেছি। ক্লাসের আর কেউ কিন্তু পারে না। পরীক্ষা করে দেখেছি।’ তুহিন বলল কানের পাশ থেকে মশা তাড়াতে তাড়াতে।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালটার দিকে তাকাল রাহী। পরিষ্কার বাংলায় একটা লেখা ফুটে আছে ওখানে।
‘বন্ধুর চেয়ে বড় কিছু নেই’
‘আমার তো কোনো বন্ধু নেই,’ প্রায় শোনা যায় না এমন নিচু গলায় বিড়বিড় করল রাহী।
‘নেই, কিন্তু হতে কতক্ষণ?’ চওড়া হাসি হাসল তুহিন।
ঝোপঝাড় মাড়িয়ে ওরা আবার ফিরে যাচ্ছে স্কুলের দিকে। রাহীর ইচ্ছে হলো, শেষবারের মতো মাথা ঘুরিয়ে দেখে নেয় দেয়ালটা। শেষমেশ কিন্তু করল না সেটা। যদিও ও মোটামুটি নিশ্চিত, আজকের পরে আর কোনো লেখা দেখা যাবে না ওখানটায়। যেভাবে ব্যাখ্যার অতীতভাবে লেখা ফুটতে শুরু করেছিল ওখানে, তেমনভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে।
ওই তো স্কুলের সুন্দর লাল-সাদা দালান। ওই তো বিরাট বটগাছ। রাহীর খুব ভালো লাগছে। এতটা ভালো ওর কখনো লাগেনি। ওর মন বলছে, স্কুলটা আবার ভালো লাগতে শুরু করবে ওর।
‘তুমি তো অনেক বইটই পড়ো। কখনো আলোচনা করা হয়নি এসব নিয়ে। জামশেদ মুস্তফির হাড় বইটা আছে কি? দিয়ো তো। বদলাবদলি করে পড়ব।’ তুহিন বলল।
রাহী মাথা ওপর-নিচ করল। ও কক্ষনো কাউকে বই ধার দেয় না, কিন্তু তুহিনের বেলায় ব্যতিক্রম হবে অবশ্যই।
কারণ, বন্ধুর চেয়ে বড় কিছু নেই।