ঘুমাবার জায়গা
রাত দুইটা। লন্ডন। রাস্তায় ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে টম আর ডেভ। বেশ কয়েকটা হোটেলে ওঠার চেষ্টা করেছিল। মেলেনি জায়গা। শহরের সরু রাস্তায় ওদের পায়ের প্রতিধ্বনি ছাড়া এ মুহূর্তে কোনো শব্দ নেই।
‘কী কুয়াশা রে বাবা!’ বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করল ডেভ। ‘এ জন্যই এ শহরটাকে দুচক্ষে দেখতে ইচ্ছা করে না। যখন–তখন কুয়াশা পড়ে।’ গত এক ঘণ্টায় কুয়াশা আরও ঘন হয়েছে। কুয়াশার গাঢ় চাদর ভেদ করে হোটেলের নিয়ন সাইনও প্রায় পড়া যাচ্ছে না। রাস্তার ট্রাফিক বাতিও গ্রাস করেছে প্রবল কুয়াশা। কিছুই চেনা যায় না।
‘শুয়ে পড়ার কোনো জায়গা আমার চাই-ই,’ গুঙিয়ে উঠল টম। ‘শরীর আর চলে না।’
কিন্তু ঘুমাবার মতো কোনো জায়গা চোখে পড়ছে না। ওরা পিকাডিলি সার্কাস থেকে হেঁটে গ্রিন পার্কে এল। তারপর উত্তরে পা বাড়াল অক্সফোর্ড স্ট্রিটে। একটা গলিতে ঢুকে পড়ল দুই বন্ধু। এ গলির দুপাশে বড় বড় চারতলা, জরাজীর্ণ কয়েকটি ভবন। হঠাৎ সাইনবোর্ডটি চোখে পড়ল। একটি ভবনের সামনের লোহার কালো গেটে ঝুলছে সাইনবোর্ড—
‘বিক্রি হবে।’
‘দেখে মনে হচ্ছে এ বাড়িতে কেউ থাকে না,’ বলল টম। ‘একটা কাজ করি, চল। আজ রাতটা এ বাড়িতেই কাটিয়ে দিই।’
‘ঘুমাবার মতো জায়গা পেলেই হলো,’ বলল ডেভ।
লোহার গেটের মাথায় উঁচু উঁচু লম্বা, ধারালো শিক। দুই বন্ধু সাবধানে উঠে পড়ল গেটে, লোহার ক্রসবারে পা রেখে সতর্কতার সঙ্গে ডিঙাল শিক।
গেট পার হয়ে পা টিপে টিপে ভবনটির দিকে এগোল ওরা। একটা জানালায় আলো জ্বলছে। ভেতরে কেউ নেই।
‘যা ভেবেছি,’ ফিসফিস করল টম। ‘খালি।’
‘হুঁ,’ বলল ডেভ। ‘কিন্তু ভেতরে ঢুকব কী করে?’
পকেট হাতড়ে সুইস আর্মি নাইফ বের করল টম। ছুরির ডগা জানালার পেতলের লকে ঢুকিয়ে মোচড় দিল। তারপর ধাক্কা দিতেই খুলে গেল জানালা। ডেভের দিকে ফিরে সন্তুষ্টির হাসি উপহার দিল টম।
জানালা টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ল দুই তরুণ। ‘এখানে ঘুমানো যাবে না,’ চারপাশে চোখ বুলাল ডেভ।
‘ঘরভর্তি পেরেক আর হাবিজাবি যন্ত্রপাতি। এত কিছু পরিষ্কার করতে পারব না।’
‘ঠিক আছে। অন্য ঘরগুলোয় উঁকি দেওয়া যাক।’ পরামর্শ দিল টম।
পুরোনো বাড়িটির হলওয়েতে ঢুকল ওরা। নড়বড়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। টম সিঁড়ি বাইতে লাগল, পেছন পেছন ডেভ। দোতলায় চলে এল দুজনে। কিন্তু এদিকের সব কটি ঘরে তালা। তিনতলায় উঠে এল ওরা। একই অবস্থা। একটিও ঘর খোলা নেই। প্রতিটি দরজা তালা বদ্ধ।
‘আরেকটা তালা বাকি আছে মনে হচ্ছে,’ সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলল টম। ‘চলো তো দেখি।’
বাড়ির সর্বশেষ সিঁড়ির ধাপ বাইল ওরা। ডেভের পা আর চলছে না। ঘুম এবং ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর।
টপ ল্যান্ডিংয়ে একটিমাত্র দরজা। চারপাশে ঢালু হয়ে আছে ছাদ। ডোর নবে মোচড় দিল টম। ওকে স্বস্তি দিয়ে খুলে গেল কবাট।
ছোট ঘরটিতে ঢুকে পড়ল দুই বন্ধু। এক জোড়া খাট এবং একটি ড্রেসার দেখতে পেল। ঘরে একটিমাত্র জানালা, রাস্তার দিকে।
‘মন্দ নয়,’ মন্তব্য করল টম। ঘরের এক কোণে একটি স্ট্যান্ডে মোমবাতিও আছে। ওটা জ্বালাল টম। পুরোনো খাটে ধপাস করে শুয়ে পড়ল ডেভ।
এমন সময় ওদের নিচে, সিঁড়িতে দুড়ুম করে একটা শব্দ হলো।
লাফিয়ে উঠল ডেভ। ‘কিসের শব্দ?’
পা টিপে টিপে হলওয়েতে চলে এল টম। দাঁড়িয়ে থাকল একমুহূর্ত। তারপর ফিরল ঘরে।
‘আমরা যে জানালা দিয়ে এ বিল্ডিংয়ে ঢুকেছি সম্ভবত ওটা বাতাসের চাপে বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘তা হতে পারে,’ সায় দিল ডেভ। খাটের কিনারে পা ঝুলিয়ে বসল। ‘তবে জায়গাটা আমার ভালো লাগছে না। কেমন গা ছমছমে।’
‘আরে রাখ,’ দাবড়ে উঠল টম। ‘ঘুমাবার যে জায়গা পাওয়া গেছে এই-ই ঢের।’
ওরা দুজন দুই বিছানায় শুয়ে পড়ল। একটা সিগারেট ধরাল টম। ফুঁ দিয়ে নেভাল মোমবাতি। আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাদ থেকে ভেসে এল খলখল হাসির শব্দ।
‘তুই হাসছিস নাকি, টম?’ জিজ্ঞেস করল ডেভ, উঠে বসেছে বিছানায়।
‘না,’ অস্বস্তি নিয়ে জবাব দিল টম। ‘ছাদ থেকে শব্দটা এসেছে মনে হলো।’
‘এখানে থাকা বোধ হয় ঠিক হবে না, কী বলিস?’ জানতে চাইল ডেভ।
পাশ ফিরে শুলো টম। ‘কিন্তু এত রাতে কই যাবি?’
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল দুই বন্ধু।
‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বাড়িটা ভুতুড়ে,’ অন্ধকারে ভেসে এল ডেভের কণ্ঠ।
‘চুপ করে ঘুমা তো।’
চুপ হয়ে গেল ডেভ। হঠাৎ আরেকটা শব্দ ভেঙে দিল রাতের নিস্তব্ধতা। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ। দ্রুত ওপরে উঠে আসছে কেউ। তবে হেঁটে নয়, গড়িয়ে গড়িয়ে যেন কেউ সিঁড়ির ধাপ বাইছে।
‘এখানে আমি আর থাকব না,’ ডেভের কণ্ঠে আতঙ্ক।
‘তাহলে চল বেরিয়ে পড়ি।’ বিছানা থেকে লাফিয়ে নামল টম। মোমবাতি জ্বালল।
ঠিক তখন, নিচতলার দরজায় কেউ ধাক্কাতে লাগল। ওই দরজা বন্ধ দেখে এসেছে ওরা। একই সঙ্গে খলখলে ভৌতিক হাসিটা ভেসে এল আবার। এবারে হলওয়ে থেকে।
‘বাইরে যেতে ভয় লাগছে,’ বলল ডেভ। মুখ শুকিয়ে আমসি।
‘বাইরে না যাওয়াই ভালো,’ সায় দিল টম। দরজার সামনে হেঁটে গেল ও। লোহার ছিটকিনি টেনে দিল।
‘বাইরে যে-ই থাকুক আর ঢুকতে পারবে না এ ঘরে।’
নিজের বিছানায় ফিরে এল টম। ডেভের চোখের দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। খুব ভয় পেয়েছে ডেভ। ওরও বুক ধড়ফড় করছে অমঙ্গলের আশঙ্কায়। তবু ডেভকে সাহস দিতে বলল, ‘শোন, আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না।’
দরজায় কেউ নখ দিয়ে আঁচড়াতে শুরু করেছে। ঝট করে সেদিকে চোখ চলে গেল দুই বন্ধুর। মোচড় খাচ্ছে দরজার নব। কেউ খোলার চেষ্টা করছে।
‘না, না, না...’ বিছানায় বসে কাঁপতে লাগল ডেভ। মুখ থেকে রক্ত সরে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে চেহারা।
‘ছিটকিনি বন্ধ। খুলতে পারবে না।’ নিজেকে যেন ভরসা জোগাতেই আপনমনে কথাটা বলল টম।
তখন, যেন নিজে নিজেই দরজার ফ্রেম থেকে খুলে গেল ছিটকিনি। দুই তরুণ ভয়ে বিস্ফারিত চোখে দেখল খুব ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে কবাট। কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হওয়ার পরে আর খুলল না। মৃত্যুর নৈঃশব্দ্য নেমে এল ঘরে।
তারপর সেই রক্ত হিম করা বিকট, ভৌতিক খলখলে গলার হাসি ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকতে লাগল আকৃতিহীন সবুজ, তুলতুলে একটা বস্তু। গলে গলে পড়ছে ঘরে।
ডেভ তার খাটের শেষ মাথায়, দেয়ালে গিয়ে সেঁধিয়েছে। টম লাফ মেরে নেমে পড়ল বিছানা থেকে, ঘরের এক কিনারে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল ঠকঠক করে।
দরজার ফাঁক দিয়ে গলে পড়া জিনিসটা সবুজ জেলির মতো। বিকট গন্ধ তাতে। ওদের দম প্রায় বন্ধ করে দিল। তারপর হঠাৎ করেই সবুজ জেলির মাঝ দিয়ে বেরিয়ে এল ভয়ংকর একটা মুখ। মুখটার চারপাশে ছুরির অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন। মুখটা খলখলে গলায় হেসে উঠল। তারপর যেভাবে উদয় হয়েছিল, তেমনি আকস্মিকভাবে ঘন সবুজ জেলির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা।
খাটে বসা ডেভের গলা দিয়ে গড়গড় শব্দ বেরোচ্ছে। চিত্কার করার চেষ্টা করছে, পারছে না। সবুজ জেলি বাতাসে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে গেল ওর দিকে। যেন ভয়ার্ত ডেভকে তার পছন্দ হয়েছে।
দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো টম বুঝতে পারল পালাবার এটাই সুযোগ। সে দেয়াল ঘষটে ঘষটে ধীরগতিতে এগোল দরজার দিকে। তারপর দিল ছুট। সবুজ জেলির পাশ কাটানোর সময় ঠান্ডা, পিচ্ছিল কী যেন লেগে গেল ওর হাতে। ঘুরে তাকাল টম। ডেভ ওর দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চাহনিতে মৃত্যুভয়।
আরও জোরে ছুটল টম। ঝড়ের বেগে নেমে এল নিচতলায়। যে জানালা দিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছে, ওটা এখনো খোলা। লাফ মেরে জানালা দিয়ে নেমে পড়ল টম। হাঁচড়ে–পাঁচড়ে ছুটল লোহার শিক বসানো গেটের দিকে। পাগলের মতো গেট বাইল যেন ভূতে তাড়া করেছে। রাস্তায় এসে তাকাল বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে। কিছুই দেখতে পেল না। হঠাৎ সেই ভয়ংকর হাসি ওর আত্মা কাঁপিয়ে দিল।
পড়িমরি করে ছুটল টম। কুয়াশাঘেরা রাস্তায় জান বাজি রেখে দৌড়াচ্ছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। একমুহূর্তের জন্য থামল। শুনতে পেল ডেভের মরণ আর্তনাদ।
আবার ছুটতে শুরু করল টম। দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এল সেন্ট জেমস পার্কে। কিন্তু থামল না ও। ছুটতেই লাগল।
লন্ডন, ২১ জুন। দ্য ডেইলি লন্ডন।
আজ সকালে পুলিশ ১৮ বছরের ডেভ মুরের লাশ ৫০, বার্কলি স্কয়ারের বাড়ির গেটে শিকবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেছে। চারতলা বাড়িটির জানালা খোলা ছিল। হোমিসাইড ডিটেকটিভদের ধারণা, তরুণ আমেরিকানকে চিলেকোঠার ঘর থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গী ১৮ বছরের টম ডডকে জেরা করার জন্য খুঁজছে পুলিশ। এটা আত্মহত্যার কেস নয় বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। কারণ, ডেভের শরীরে ধস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া গেছে। ৫০ বার্কলি স্কয়ারের বাড়িটি যদিও ‘ভূতের বাড়ি’ হিসেবে জানেন স্থানীয়রা। তবে হোমিসাইড স্কোয়াড সাংবাদিকদের বলেছে, ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ভূতে বিশ্বাস করে না।’
বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে