রোমাঞ্চ গল্প 'ধাবক'
আমি একজন খচ্চর। দাঁড়াও, দাঁড়াও, শব্দটা শুনেই মাথায় খুব অপরিষ্কার একজন ব্যক্তির নাম এসেছে, না? এই যে অপরিচ্ছন্নতার অপর নাম ‘খচ্চর’—এই চিন্তাধারার প্রবর্তন কীভাবে হয়েছে, আমি জানি না। বলে রাখা ভালো, খচ্চর আমার নাম নয়। এটা আমার পেশা।
কী, অবাক হলে? অবাক হওয়ার মতোই তো ব্যাপার! তোমরা নিশ্চয়ই জানো, খচ্চর আদতে একটি প্রাণী—ঘোড়া আর গাধার সংকর। একই সঙ্গে দ্রুত চলতে পারে, আবার বোঝাও বইতে পারে। অর্থাৎ ঘোড়া আর গাধা—উভয় প্রজাতিরই গুণগুলো প্রাণীটির আছে। আমার পেশাও অনেকটা এ রকম, দ্রুত জিনিসপত্র এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দিতে হয় আমাকে।
এখন প্রশ্ন করতে পারো, তাহলে তো আমি একজন ডেলিভারিম্যান। বাংলায় বিতরণকারীও বলতে পারো। এ রকম সুন্দর নাম বাদ দিয়ে আমি এই খচ্চর বা ‘মিউল’ হতে গেলাম কেন?
একজন ডেলিভারিম্যান কিন্তু জানে, সে কোথায় ডেলিভারি দেবে। কত বিল হয়েছে, সেটাও জানে। ক্ষেত্রবিশেষে এ-ও জানে, সে কী পৌঁছে দিচ্ছে।
আমি এসবের কিছুই জানি না। জানার প্রয়োজনও নেই। ছোট ভ্যাসলিনের কৌটা আকৃতির মালামাল থেকে শুরু করে একদম এসইউভি গাড়ি—সবকিছুরই স্থানান্তর করেছি আমি। আমার সঙ্গে নিয়োগকর্তারা যোগাযোগ করে এক অখ্যাত ই–মেইল সার্ভারের সাইটের মাধ্যমে। ওয়েবসাইটের ভাষাও বিজাতীয়, বুঝি না কিছু। মুখস্থ হয়ে গেছে কোথায় ক্লিক করলে ইনবক্স আসবে। সে অনুযায়ী মাউস নাড়াই, নতুন মেইল এলে খুলে পড়ি। সেখানে একদম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে দেওয়া থাকে আমার করণীয়। সেসব মেনে চলি। তিন কার্যদিবসের মধ্যে আমার অ্যাকাউন্টে চলে আসে বেশ খানিক টাকা। লাখখানেকও পেয়ে যাই মাঝেমধ্যে। কীভাবে এই কাজে জড়িয়ে গেছি, সেই গল্প আরেক দিন করব, কেমন?
ও হ্যাঁ, এই ওয়েবসাইট আছে ডার্ক ওয়েবে। সাধারণ ব্রাউজার দিয়ে খোলা যায় না।
এখন প্রশ্ন করতেই পারো, কেন সাধারণ কিছু ‘ডেলিভারি’র জন্য আমি এতটা টাকা পাই? উত্তরটা আমি দেব না। আসলে উত্তরটা আমি নিজেও জানি না। এই ‘খচ্চর’ই কিন্তু আমার একমাত্র পরিচয় নয়, আমার একটু স্থায়ী চাকরিও আছে। একটি ব্যাংকের ক্যাশে বসতে হয়। বুঝতেই পারছ, একই সঙ্গে নিরানন্দ এবং মানসিক চাপের কাজ।
তাই এই কদাচিৎ খচ্চর হতে আমার ভালো লাগে। যেন একটা রহস্যের বলয়ে ঢুকে পড়ি। নিজেকে জেমস বন্ডের চেয়ে কম কিছু মনে হয় না। টাকাটা মূল ব্যাপার নয়, আসল ব্যাপার হচ্ছে রক্তে যে অ্যাড্রেনালিন খেলা করে, তার তুলনা হয় না।
আর সব দিনের মতো সেদিনও বাড়ি ফিরে কম্পিউটারে বসেছিলাম। বিশেষ ইনবক্সে ঢোকার পর মনটা আনন্দে নেচে উঠল। নতুন কাজ এসেছে। খেয়াল করলাম, আকর্ণবিস্তৃত হাসি হাসছি।
আপাতদৃষ্টে এই কথোপকথনটুকু অর্থহীন মনে হলো না? হু হু! এখানেই তো খেলা। আমরা আদতে পাসওয়ার্ড বিনিময় করেছি। প্রতিটি শব্দ পুনর্নির্ধারিত। আমিই যে ট্রাকটা নিতে এসেছি, সেটা ও বুঝে গেছে। আর আমিও বুঝে গেছি এই লোকের কাছেই আছে আমার ট্রাকের চাবি। প্রথম দিকে খটকা লাগত, এই তৃণমূল পর্যায়ের লোকগুলোকে কীভাবে জোগাড় করা হয়, তাই ভেবে। নিজে নিজে ভেবে উত্তরটা বের করেছি, এখন স্মার্টফোন সবার হাতে হাতে। ইন্টারনেট তাই নাগালের মধ্যে। ইন্টারনেটের গভীর গিরিখাত ডার্ক ওয়েবই–বা আর কত দূরে থাকবে?
মালামাল বুঝে পাওয়ার জায়গাটা আমার বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। ডেলিভারির সময়—আগামী পরশু। এবারের বাহন একটি ট্রাক। সেটার ছবি মেইলের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সেটাকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
পরের দুই দিন বেশ উত্তেজনায় কাটল। একবার চিন্তা করলাম, ছুটির আবেদন করে ফেলব কি না। ঘুরে আসব দুনিয়ার যেকোনো কোনায়। যত দূর জানি, বলিভিয়ায় ভিসা ছাড়া চলে যাওয়া যায়। টাকা তো বেশ খানিকটা জমেছে। ভাবলাম, একবার নেব নাকি পদক্ষেপ?
এই কাজের পারিশ্রমিকটা কিন্তু একটু ভিন্নভাবে আসে আমার কাছে। আমার বাসার বাইরে একটা মেইল বক্স লাগিয়ে নিয়েছে। কাজ শেষ হয়ে গেলে একটু পরপর ই–মেইল চেক করি। মেইল বক্সে একদম স্কচটেপ আর ব্রাউনপেপারে মোড়ানো টাকার গাঁটরি চলে আসার পাঁচ মিনিট পর ই–মেইল আসে। আমি টুক করে সেটা ভেতরে নিয়ে আসি।
এদিকে ব্যাংকে টাকার হিসাব গরমিল করে সিনিয়র অফিসারের ঝাড়ি খেলাম। খুব যে খারাপ লেগেছে, তা-ও নয়। আমার মন পড়ে আছে মিশনে। এক দিন বাদে আমি হয়ে উঠব একজন স্পাই।
কাজের দিন আমি খুব পরিমিত খাবার খেলাম। দুই বেলা সবজি, ডাল আর রুটি। আর রং–চা। পানি খেলাম প্রচুর। ফুরফুরে অনুভব করলাম সারা দিন। ধীরে ধীরে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মোবাইল-মানিব্যাগ সব বাসায় ফেলে বের হয়ে পড়লাম। সম্বল কেবল কয়টা খুচরো টাকা।
যাত্রা করলাম বাসে। ই–মেইলে বলা জায়গাটাতে পৌঁছে গেলাম ৪৫ মিনিটের মধ্যে। এত সময় লাগার কথা নয়, বাদ সেধেছে ট্রাফিক জ্যাম। ভাগ্যিস, আগে আগে বের হয়েছিলাম!
যা বলা হয়েছে, সেই মতে একটা চায়ের টঙে গিয়ে দাঁড়ালাম। কাঁচা–পাকা চুলওয়ালা প্রৌঢ় চা বিক্রেতার উদ্দেশে বললাম, ‘কী অবস্থা ভাই? চাচি কেমন আছে?’
‘আছে, আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছে,’ আঞ্চলিক টানে বলল চা বিক্রেতা। কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে গেল যেন। ‘ইদানীং বাতের ব্যথাটা চিলিক দিয়া উঠতাসে।’
‘ও। চিন্তা কইরেন না। আমি সামনের মাসে আসাম যামু। শুনছি ওইখানে ভালো বাতের টোটকা পাওন যায়।’
আপাতদৃষ্টে এই কথোপকথনটুকু অর্থহীন মনে হলো না? হু হু! এখানেই তো খেলা। আমরা আদতে পাসওয়ার্ড বিনিময় করেছি। প্রতিটি শব্দ পুনর্নির্ধারিত। আমিই যে ট্রাকটা নিতে এসেছি, সেটা ও বুঝে গেছে। আর আমিও বুঝে গেছি এই লোকের কাছেই আছে আমার ট্রাকের চাবি। প্রথম দিকে খটকা লাগত, এই তৃণমূল পর্যায়ের লোকগুলোকে কীভাবে জোগাড় করা হয়, তাই ভেবে। নিজে নিজে ভেবে উত্তরটা বের করেছি, এখন স্মার্টফোন সবার হাতে হাতে। ইন্টারনেট তাই নাগালের মধ্যে। ইন্টারনেটের গভীর গিরিখাত ডার্ক ওয়েবই–বা আর কত দূরে থাকবে?
টং-টার কাছেই একটা বিশাল লোহার ফটক। একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বাস ডিপো। ইতিমধ্যে এক কাপ চা খেয়েছি আমি। দাম দেওয়ার সময়ে কৌশলে চা–ওয়ালা আমার কাছে ট্রাকের চাবি হস্তান্তর করে দিয়েছে। সঙ্গে একটা ভাঁজ করা কাগজ। আমি ডিপোর ভেতরে চলে গেলাম। দু–একজন ছাড়া পুরোটাই জনমানবহীন। কেউ আমার দিকে বিশেষ খেয়াল করল না। আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে থাকা বাসগুলোকে কেমন রহস্যজনক মনে হলো। একদম পেছনের দিকে গিয়ে আমি আমার বাহনকে পেলাম। ছোটখাটো একটা ট্রাক বা বড়সড় পিকআপ বলা যায়। কার্গো বেডটা ঢাকা। সেদিকে আমার খেয়াল নেই। ক্যাবে উঠে বসলাম। আমার নিয়োগকর্তারা যথেষ্ট সচেতন। পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় ট্রাকের কেবিনে একটা ছোট, নগ্ন বাল্ব পাওয়া গেল। আলো জ্বাললাম, এরপর খুলে ফেললাম ভাঁজ করা কাগজটা। যা ভেবেছিলাম, একটা মানচিত্র। গাড়ি কোথায় পৌঁছে দিতে হবে, সে ব্যাপারে বলা আছে।
স্কুলের কথাটা মনে পড়তেই হেসে ফেললাম নীরবে। আহ্! কী সব দিন ছিল। কাদায় মাখামাখি হয়ে ফুটবল, এরপর দল বেঁধে পুকুরে গোসল করা। তরতর করে আমগাছে উঠে যাওয়া, রাতের ক্রমাগত ঝিঁঝির ডাক। সব যেন স্মৃতির মণিকোঠায় জীবন্ত হয়ে আছে।
আলো বন্ধ করে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। ম্যানুয়াল ট্রান্সমিশনের গাড়ি চালাতে আমার বিশেষ সমস্যা হয় না। এ ধরনের কাজে ঢোকার আগে বাসার কাছের ‘বামনা ড্রাইভিং স্কুল’-এ নিয়মিত অনুশীলন করেছি। নির্বিঘ্নে ট্রাক নিয়ে রাস্তায় উঠে এলাম। শক্তিশালী ডিজেল ইঞ্জিন গজরাতে গজরাতে আগে নিয়ে চলল আমাকে। আমাকে কেন এত বাড়তি টাকা দিয়ে এ রকম কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে, এই চিন্তা এর আগে কখনো আমার মাথায় আসেনি। এবার এল।
কারণ, এবারের গন্তব্যটা আমার বেশ পরিচিত।
শহরের অদূরের জায়গাটা। ওখানে আমার নানাবাড়ি। ছোটবেলায় বাবা ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পর আমাকে দুই বছর নানাবাড়ি থাকতে হয়েছিল। একধরনের আশ্রিত বলা চলে। তবে নানা-নানু আমাকে কখনোই সেটা বুঝতে দেননি। আমার মা তাঁদের একমাত্র মেয়ে, এদিকে আমাকেও প্রচণ্ড স্নেহ করতেন। তা ছাড়া দেড় বছরের মধ্যে বাবা অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে ফেলেছিলেন। এরপরও বাড়তি ছয় মাস আমি নানুবাড়ি থেকে যাই। স্কুলে মাত্র মধ্যবার্ষিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল তখন। এর মধ্যে তো আর অন্যত্র চলে যাওয়া যায় না।
স্কুলের কথাটা মনে পড়তেই হেসে ফেললাম নীরবে। আহ্! কী সব দিন ছিল। কাদায় মাখামাখি হয়ে ফুটবল, এরপর দল বেঁধে পুকুরে গোসল করা। তরতর করে আমগাছে উঠে যাওয়া, রাতের ক্রমাগত ঝিঁঝির ডাক। সব যেন স্মৃতির মণিকোঠায় জীবন্ত হয়ে আছে।
শহর পেরোতেই আর সেভাবে জ্যামে পড়লাম না। ট্রাকের সর্বোচ্চ গতি তুলে শাঁই শাঁই করে ছুটে চললাম। আমার থেকেও দ্রুতগামী বাস-গাড়ি বাতাসের ঝাপটা লাগিয়ে আমাকে অতিক্রম করে গেল।
কাছাকাছি পৌঁছানোর পর রাস্তার পাশে ট্রাক দাঁড় করালাম। ম্যাপটা আরেকবার দেখা জরুরি। জায়গাটা চিনতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না আমার, ১০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। এই রাস্তা দিয়ে অনেক আসা-যাওয়া করেছি। আমার সেই স্কুলটা এখান থেকে বেশি দূরে নয়। মিনিটখানেক পুবে হাঁটলেই পৌঁছে যাব। অবশ্য সেটা স্কুলের পেছনের দিকটা। বিশাল একটা দেয়াল আছে সেখানে। দু–একবার স্কুল পালানোর সময়ে এই দেয়াল আমাকে টপকাতে হয়েছে। ট্রাক থেকে দেয়ালের খানিকটা দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে আমার ভ্রু কুঁচকে গেল।
এত রাতে স্কুলের ভেতর আলো কেন?
ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, শামিয়ানার একাংশ দেখা যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম, কালকে স্কুলে কোনো বড়সড় অনুষ্ঠান আছে। মনে মনে সময় মেলানোর চেষ্টা করলাম। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়। বার্ষিক ক্রীড়া দিবস এখনই হওয়ার কথা না? হ্যাঁ, তাই তো!
স্মৃতিবিজড়িত হয়ে পড়লাম। ২০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হয়েছিলাম। তখন অনেক চিকন ছিলাম, এখন তো বসে থাকতে থাকতে ভুঁড়ি গজিয়েছে...
হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় খেলে গেল আমার। ট্রাকের পেছনে থাকা অজানা মালামাল কি এই স্কুলের স্পোর্টস ডেতে অনভিপ্রেত কোনো ঘটনা ঘটানোর জন্য আনা হয়েছে? স্পোর্টস ডেতে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিও আসেন। যা আগে কখনো ভাবিনি, এবার ভাবতে বাধ্য হলাম। কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে গিয়েছি কি?
আর ভাবতে পারছি না।
স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। দরদর করে ঘাম বেয়ে নেমে এল কপালে। নিজেকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করলাম, আমি যা ভাবছি, তা হয়তো নয়। তবে কোনোভাবেই হিসাব মেলাতে পারলাম না। মাথার দুপাশ দুই হাতে চেপে ধরে বসে থাকলাম আরও কয়েক মিনিট। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আমি এই ট্রাক এখানে রেখে যাব না।
ইঞ্জিন চালু করে গিয়ার ফেললাম। যা হয় হোক, আমি এখানে থামছি না।