ছোট্ট খুকিটি অসুস্থ। রোজ তার কাছে ডাক্তার আসছেন, মিখাইল পেত্রভিচ। তাঁকে সে অনেক অনেক দিন থেকে চেনে। আর কোনো কোনো দিন তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন আরও দুজন ডাক্তার, অপরিচিত। তাঁরা ছোট্ট মেয়েটিকে কখনো চিত করে, কখনোবা উপুড় করে শুইয়ে তার দেহে এখানে-ওখানে কান লাগিয়ে কী সব শোনেন, চোখের পাতা নিচের দিকে টেনে ধরেন আর দেখেন। তারপর সজোরে অর্থপূর্ণভাবে নিশ্বাস ফেলেন, মুখ-চোখ গভীর হয়ে ওঠে তাঁদের, আর নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকেন এমন ভাষায়, যা সে বোঝে না।
তার ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁরা বসার ঘরে চলে যান, সেখানে মা তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছেন। সবচেয়ে বড় ডাক্তার যিনি—লম্বা-চওড়া, পাকা চুল, সোনার ফ্রেম বাঁধানো চশমা পরা—মায়ের সঙ্গে কী নিয়ে গম্ভীরভাবে আর অনেকক্ষণ ধরেই কথাবার্তা বলেন। দরজা তো ভেজানো নেই, তাই মেয়েটি তার বিছানা থেকেই সব দেখতে পাচ্ছে, সব শুনতে পাচ্ছে। বেশির ভাগই সে কিছু বুঝতে পারছে না, কিন্তু সে জানে যে তাকে নিয়েই আলোচনা চলছে। মা ডাক্তারের পানে বড় বড় ক্লান্ত, কান্নাভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। বিদায় নিয়ে চলে যেতে গিয়ে বড় ডাক্তারটি উঁচু গলায় বলে উঠলেন:
সবচেয়ে বড় কথা, ও যেন মনমরা হয়ে না থাকে। ওর যা মন চায় তা-ই করতে দেবেন।
আঃ, ডাক্তার, কিন্তু কিছুতে যে ওর মনই যায় না!
কী করা, জানি না...আচ্ছা, মনে করুন তো, অসুখের আগে কী কী ওর ভালো লাগত। খেলনা...এটা-ওটা ভালোমন্দ খাবার...
না, না, ডাক্তার, সে কিচ্ছুটি চায় না...
ঠিক আছে, চেষ্টা করে দেখুন কোনো কিছুতে ওকে খুশি রাখা যায় কি না...হ্যাঁ, তা সে যা-ই হোক না কেন...আপনাকে সত্যি কথাটা বলে দিচ্ছি, যদি আপনারা তাকে হাসিখুশিতে, আনন্দে রাখতে পারেন তো সেটাই সবচেয়ে ভালো দাওয়াই হবে। জানবেন যে আমাদের মেয়ের যা অসুখ, তা হলো জীবনের প্রতি ঔদাসীন্য, এর বেশি আর কিছু নয়। আচ্ছা, আসি!
২.
নাদিয়া সোনা, লক্ষ্মী মামণি আমার—মা বলতে লাগলেন—কিছুতেই কি তোর মন যায় না মা?
না, মা, কিচ্ছুতেই মন যায় না।
কেন মন যায় না, তোর সব পুতুল বিছানার ওপর এনে বসিয়ে দিই, কেমন? আমরা চেয়ার-টেবিল আর চায়ের সরঞ্জাম সব এনে রাখি, পুতুলগুলো চা খাবে, গল্প করবে—আজকের আবহাওয়া কেমন, ছেলেপুলেরা ভালো আছে কি না।
থাকুক মা...আমার মন যাচ্ছে না...আমার যে কিচ্ছু ভাল্লাগে না...
আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে, আমার লক্ষ্মী মেয়ে তো এটা, পুতুল দরকার নেই নাহয়। তবে নাহয় তোর কাছে কাতিয়াকে কি জেনিয়াকে ডেকে আনি? ওদের তো তুই খুব পছন্দ করিস।
দরকার নেই, মা। সত্যি বলছি, দরকার নেই। কিচ্ছু, কিচ্ছুটি আমার চাই না। আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না যে!
তবে নাহয় চকলেট নিয়ে আসি, কী বলিস?
কিন্তু মেয়ে আর উত্তর দেয় না, স্থির বিষণ্ন চোখে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। শরীরে কোথাও তার কোনো যন্ত্রণা নেই, এমনকি জ্বর-জ্বালাও না। তবু দিন দিন সে রোগা আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তার দরকারি কোনো কিচ্ছু না করা হলেইবা কী, তার কাছে সব সমান, কিছুরই প্রয়োজন নেই তার। এভাবে সে শুয়ে আছে সারা দিন, সারারাত—চুপচাপ, মনমরা। এক-আধবার আধা ঘণ্টাখানেকের জন্য ঝিমুনি আসে বটে তার, কিন্তু ঘুমের ভেতরেও যা ধরা দেয়, তার চোখে তা ধূসর, বহু দূরের, বিষণ্ন যেন কী এক, যেন হৈমন্তী বারিধারা।
যখন তার শোবার ঘরের দরজা বসার ঘরমুখো খোলা থাকে, আর বসার ঘরের দরজা দূরের ওই ঘরটার দিকে, তখন মেয়ে তার বাবাকে দেখতে পায়। সারা ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন বাবা, আর কেবলই একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলেছেন। কখনো কখনো এ ঘরে আসেন, তিনি বিছানার একাধারে বসেন, চুপচাপ নাদিয়ার পায়ে হাত বোলান। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে যান, জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। কী একটা সুরে শিস দেন রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, কিন্তু পিঠ কেঁপে কেঁপে উঠছে তাঁর। এরপর অতিদ্রুত তিনি রুমাল বের করে একটা চোখে চেপে ধরেন, তারপর অন্য চোখটাতেও এবং নির্ঘাত রেগেমেগে নিজের ঘরের দিকে চলে যান। আবার শুরু হয় ঘরের মধ্যে পায়চারি, আর সারাক্ষণই সিগারেট, সিগারেট, সিগারেট...আর তামাকের ধোঁয়ায় সারা ঘরটা নীল হয়ে যায় তাঁর।
৩.
কিন্তু একদিন সকালে রোজকার চেয়ে একটু খুশি মনে ঘুম ভাঙল মেয়েটির। কী যেন দেখেছে সে স্বপ্নে, অথচ ঠিক যে সেটা কী, কিছুতেই মনে আসছে না, মায়ের চোখের দিকে অনেকক্ষণ ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে ভাবতে লাগল সে।
কি মা, কিছু বলবি? মা তাকে জিজ্ঞেস করলেন।
আর তখনই হঠাৎ করে স্বপ্নটা মনে পড়ে গেল তার, ফিসফিস করে ঠিক যেন কোনো গোপন কথা বলছে সেভাবে বলে উঠল সে:
মা...একটা হাতি...দিতে পারবে আমাকে? ওই যেমন ছবির বইয়ে আঁকা সে রকম না কিন্তু...পারবে?
সোনামণি আমার, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই পারব বৈকি মা।
পাশের ঘরে চলে গেলেন তিনি, মেয়ের বাপকে শোনোলেন যে মেয়ে হাতি চাইছে। বাবা সঙ্গে সঙ্গে তক্ষুনি ওভারকোট পরে নিয়ে, মাথায় টুপি চাপিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন আধা ঘণ্টা পরে, সঙ্গে খুব দামি সুন্দর এক খেলনা: একটা বিরাট ছাইরঙা হাতি, নিজে নিজেই মাথা দোলাচ্ছে সে, লেজ নাড়ছে; হাতির পিঠে লাল টকটকে জিন, জিনের ওপর সোনালি রঙের হাওদা, আর তার ভেতরে বসে আছে ছোট্ট ছোট্ট তিন মনুষ্যি। খুকি কিন্তু খেলনার দিকে তেমনি উদাসীনভাবে তাকিয়ে রইল, যেমন করে সে ছাদ বা দেয়ালের পানে তাকিয়ে থাকে; তারপর ম্লান কণ্ঠে বলে উঠল:
না, না। এ রকম না মোটেই। সত্যিকারের, জীবন্ত হাতি চেয়েছিলাম আমি, আর এটা তো মরা।
তাকিয়ে একনজর দেখবি তো আগে, বাবা বলে উঠলেন। এক্ষুনি আমরা এতে দম দেব, আর অমনি একেবারে জীবন্ত হাতির মতো হয়ে যাবে এটা।
চাবি দিয়ে দম দেওয়া হলো হাতিটায়, আর তখন সে মাথা দুলিয়ে লেজ নাড়াতে নাড়াতে এক পা এক পা করে আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করল টেবিলের ওপর। এসব মোটেই ভালো লাগল না মেয়েটির, বরং বিরক্তিকর মনে হলো। কিন্তু বাবা যাতে দুঃখ না পান, তাই ফিসফিস করে নরমভাবে বলল:
আব্বুমণি, তুমি আমার কত্ত ভালো আব্বু। আমার মনে হয়, এত সুন্দর খেলনা কিন্তু আর কারও নেই...কেবল...কেবল...মনে আছে আব্বু...অনেক দিন আগে সেই যে আমাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবে বলেছিলে সত্যিকারের হাতি দেখার জন্য...কই, নিয়ে গেলে না তো।
লক্ষ্মী মানিক আমার, শোনো একটু, সেটা কী করে হবে মা! হাতির যে বিরাট আকার, এই ছাদ পর্যন্ত উঁচু, আমাদের এই ঘরে আটবেই না...আর তা ছাড়া, তাকে আমি পাবইবা কোথায়?
আব্বু, অত বড় দরকার নেই তো...তুমি আমাকে একটা ছোট্ট দেখে এনে দাও, শুধু যেন তা জ্যান্ত হয়। ঠিক আছে, এই এই এত্তটুকু, কেমন...হোক না বাচ্চা হাতি।
মামণি, আমার এই ছোট্ট মা’টার জন্য আমি সব করতে পারি, কিন্তু তা বলে এটা কী করে পারবে? ধর, হঠাৎ তুই আমায় বললি: আব্বু, আকাশ থেকে সুয্যিটা পেড়ে আনো তো; এটাও তো সে রকম কথাই হলো, মা।
করুণ হাসি খেলে গেল মেয়েটির মুখে।
আব্বুটা কী বোকা! আমি যেন জানি না যে সুয্যি পাড়া যায় না, কাছে গেলে পুড়িয়ে দেয়! আর চাঁদটাও তো পাড়া যায় না। না, আমি কেবল যদি একটা বাচ্চা হাতি পেতাম...সত্যিকারের।
তারপর সে চুপটি করে চোখ বুজল, আস্তে করে ফিসফিসিয়ে বলল:
হয়রান লাগছে আমার...একটু চুপ করে শুই, আব্বু...
বাবা দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলেন, দৌড়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে। কিছুক্ষণ ধরে ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পায়চারি করে বেড়ালেন। তারপর কোনো কিছু যেন সিদ্ধান্ত করেছেন এমনিভাবে হাতের সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিলেন মেঝেতে (এর জন্য তিনি সব সময় মায়ের বকাঝকা খান) চেঁচিয়ে ডাকলেন চাকরানিকে:
ওলগা! ওভারকোট-টুপি দিয়ে যা!
বারান্দায় বেরিয়ে এসেছেন তাঁর স্ত্রী।
কোথায় যাচ্ছ, সাশা? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বাবা।
জানি না, মাশেনকা, কোথায় যাচ্ছি...তবে মনে হচ্ছে সন্ধ্যার দিকে এখানে, আমাদের বাড়িতে একটা জ্যান্ত হাতি সত্যি সত্যি নিয়ে আসতে পারব।
উদ্বিগ্নভাবে তাঁর স্ত্রী তাকালেন তাঁর দিকে।
কি গো, শরীর খারাপ করল নাকি তোমার? মাথা ধরেছে? হয়তো আজ ভালো ঘুম হয়নি তোমার?
এক ফোঁটা ঘুমাইনি আমি—মেজাজ খিঁচড়ে জবাব দিলেন বাবা।
মাথাটাথা খারাপ হলো কি না জিজ্ঞেস করতে চাও তো? না, এখনো হয়নি। আচ্ছা, গেলাম! সাঁঝবেলাতেই সব দেখতে পাবে।
দড়াম করে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
৪.
ঘণ্টা দুয়েক পরে তাঁকে দেখা গেল বসে বসে সার্কাস দেখছেন, একেবারে সামনের সারিতে, দেখছেন ট্রেনিং দেওয়া পশুগুলো হুকুম অনুযায়ী কী রকম নানান কাণ্ডকারখানা করছে। বুদ্ধিমান কুকুর বটে—কেমন লাফাচ্ছে, ডিগবাজি খাচ্ছে, নাচছে, গান গাইছে, ঘেউ ঘেউ গানের সঙ্গে সঙ্গে পিচবোর্ডের বড় বড় অক্ষর গুছিয়ে রাখছে ঠিকঠাক। বাঁদরগুলো—কয়েকটা লাল ঘাগরা পরা, আর অন্যগুলো নীল প্যান্ট পরা—দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে, বড়সড় পুডল কুকুরের পিঠে চড়ে বসছে। বিশাল সব লালচে-বাদামি সিংহ জ্বলন্ত রিংয়ের ভেতর দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে লাফ মেরে মেরে। একটা কদাকার সিল পিস্তল নিয়ে গুলি ছুড়ল। শেষের দিকে এল হাতির খেলা। তিনটে হাতি: একটা বিরাট আর অন্য দুটো এক্কেবারে ছোট, বামন, কিন্তু তা হলে কী হয়—ঘোড়ার চেয়ে আকারে অনেক বড়। কী বিশাল প্রাণী, আর কী রকম ঢিলেঢালা, আনাড়ি অথচ ভারী—কিন্তু এমন কঠিন কঠিন খেলা দেখাল যে অত্যন্ত দক্ষ খেলোয়াড়ও তা পারবে না। সবচেয়ে বড়টাই সবচেয়ে সরেস। পেছন পায়ে ভর দিয়ে প্রথমে উঠে দাঁড়াল সে, আবার বসে পড়ল, তারপর মাটিতে মাথা রেখে একেবারে শীর্ষাসন—পা শূন্যে, কাঠের তৈরি বোতলের ওপর দিয়ে হেঁটে গেল, ঘুরন্ত পিপের ওপর হাঁটল, পিচবোর্ডের তৈরি বইয়ের পাতা শুঁড় দিয়ে উল্টে দিতে লাগল, আর সবশেষে টেবিলের সামনে বসে বুকের ওপর রুমাল ফেলে এক্কেবারে সুবোধ বালকের মতো লাঞ্চ করতে বসে গেল।
খেলা শেষ হলো একসময়। দর্শকেরা চলে যাচ্ছে একে একে। নাদিয়ার বাবা সার্কাসের মালিক মোটাসোটা জার্মান ভদ্রলোকটির কাছে গেলেন। তিনি কাঠের বেড়ার কাছে বিশাল এক কালো চুরুট মুখে দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
দাদা, মনে করবেন না কিছু, একটা কথা বলতে চাই, নাদিয়ার বাবা বললেন। আপনার এই হাতি কিছুক্ষণের জন্য আমার বাড়িতে একটু নিয়ে যেতে দেবেন?
কথা শুনে জার্মান বেচারি তো হতভম্ব। চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালেন, মুখ অ্যায়সা হাঁ হয়ে গেল যে চুরুটটা পড়েই গেল মাটিতে। তিনি হাঁসফাঁস করতে করতে নিচু হয়ে ঝুঁকে চুরুটটা তুলে নিলেন, মুখের মধ্যে ফের গুঁজে দিলেন সেটা, আর তারপরই কেবল মুখে কথা বেরোল তাঁর:
নিয়ে যেতে? হাতি? ঘরে? কী বলছেন, কিচ্ছু বুঝছি না।
জার্মান লোকটির চোখ দেখে মনে হলো তিনিও যেন জিজ্ঞেস করতে চাইছেন নাদিয়ার বাপের মাথার ব্যামো নেই তো...কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা যে কী সে বিষয়ে বিশদ বলেন নাদিয়ার বাবা: তাঁর একমাত্র মেয়ে নাদিয়ার এক সৃষ্টিছাড়া অসুখ হয়েছে, ডাক্তাররা পর্যন্ত ধরতে পারছে না অসুখটা কী। এক মাস ধরে মেয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী, দিন দিন রোগা আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই তার ইচ্ছে নেই, কিছুই ভালো লাগে না তার, ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে মেয়ে তাঁর। ডাক্তাররা বলেছেন, তাকে যেন বেশ হাসিখুশিতে রাখা হয়, কিন্তু কিচ্ছু যে তার ভালো লাগে না; বলেছে, ওর সাধ-আহ্লাদ সব যেন আমরা মেটাই, কিন্তু কোনো কিছুতে যে তার সাধই হয় না। আজই শুধু তার মন গেছে যে একটা জ্যান্ত হাতি দেখবে। তা, এটা কি একেবারেই অসম্ভব?
জার্মান ভদ্রলোকের কোটের বোতাম নাড়তে নাড়তে কাঁপা কাঁপা গলায় ফের বললেন:
বুঝলেন তো, এই হলো ব্যাপার...আমি নিশ্চয়ই চাই যে মেয়ে আমার ভালো হয়ে উঠুক।
কিন্তু...কিন্তু...ধরুন, হঠাৎ অসুখটা খারাপ দিকে মোড় নেয় যদি...যদি ও আর না বাঁচে?...একটুখানি অন্তত ভেবে দেখুন, সারাটা জীবন এই চিন্তা কুরে কুরে কাটবে আমাকে যে ওর শেষ ইচ্ছা, সবচেয়ে শেষ ইচ্ছাটাও আমি পূরণ করতে পারিনি!...
জার্মান ভদ্রলোক কপাল কুঁচকে কী ভাবতে ভাবতে বাঁ দিকের ভুরু চুলকাতে লাগলেন। শেষে বলে উঠলেন:
হুঁ...তা, আপনার মেয়ের বয়স কত?
ছয় বছর।
হুঁ...আমার লিজারও বয়স ছয়...কিন্তু, মানে বুঝলেন তো, খরচা যে আপনার বড় বেশি পড়ে যাবে। হাতিকে নিয়ে যেতে হবে রাত্রিবেলা, আর কেবল পরের দিন রাতেই তাকে ফেরত নিয়ে আসা সম্ভব। দিনের বেলা তো আর পারা যাবে না। লোকজনের মেলা ভিড় হয়ে যাবে। তাহলে সে এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার হবে...সে জন্যই, দাঁড়াচ্ছে এ রকম যে সারা দিনটাই আমার বরবাদ হবে, তা আপনাকে তো সেটা পুষিয়ে দিতে হবে।
নিশ্চয়ই, সে তো বটেই...তা নিয়ে আপনি ভাববেন না...
তারপর, কথা হলো: কারও বাড়িতে হাতি নিয়ে যাওয়ায় পুলিশ অনুমতি দেবে তো?
সেটা আমি দেখব। অনুমতি দেবে।
আর একটা প্রশ্ন: আপনার বাড়ির মালিক তাঁর বাড়িতে হাতি নিয়ে যেতে দেবেন?
দেবেন। কেননা, ও বাড়ির মালিক আমি নিজে।
ও, সে তো আরও ভালো! হ্যাঁ, আর একটা প্রশ্ন রয়ে গেছে। আপনারা থাকেন কোন তলায়?
দোতলায়।
হুঁ...এই তো মুশকিল হলো...আচ্ছা, আপনাদের বাড়িতে বেশ চওড়া সিঁড়ি, উঁচু ছাদ, প্রকাণ্ড বড় ঘর, খুব চওড়া দরজা আর ভয়ানক শক্ত মেঝে—এসব হবে তো? কেননা, আমার টমি সাড়ে ৭ ফুট উঁচু এবং সাড়ে ১২ ফুট লম্বা। তা ছাড়া ওর ওজনও ৪৫ মণ।
নাদিয়ার বাবা মিনিটখানেক কী ভাবলেন।
আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়? তিনি বললেন। আপনি এখন আমাদের ওখানে চলুন, নিজের চোখে জায়গাটা সব দেখে আসবেন। দরকার হলে দরজা ভেঙে ঢোকার পথ চওড়া করে নেব।
অতি উত্তম! সার্কাসের মালিক রাজি হয়ে গেলেন।
৫.
রাত্রিবেলা অসুস্থ খুকিটির কাছে হাতি তো বেড়াতে চলল।
সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে গম্ভীরভাবে ঠিক রাস্তার মাঝখানটি দিয়ে মাথা দোলাতে দোলাতে চলেছে সে, শুঁড়টা একবার গুটিয়ে নিচ্ছে, একবার খুলছে, এমনিভাবে যাচ্ছে সে। অনেক রাত হয়ে গেলেও তার চারদিকে লোকজন ভিড় করে ছেঁকে ধরেছে। কিন্তু হাতির সেসবের দিকে কোনো নজরই নেই; সে তো রোজই সাার্কাসে শয়ে শয়ে লোক দেখতে অভ্যস্ত। কেবল একবারই মাত্তর সে একটু চটে উঠল।
কে এক রাস্তার ছোড়া হুট করে দৌড়ে তার কাছে চলে গিয়ে ট্যাংভ্যাং করে সবাইকে হাসাতে শুরু করেছিল।
তখন হাতিটা অতি শান্তভাবে শুঁড়টি দিয়ে কেবল তার মাথা থেকে টুপিটা তুলে নিল, আর পামের একটা পেরেক লাগানো বেড়া পার করে ছুড়ে ওদিকে ফেলে দিল।
একটা পুলিশ এসে ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে সবাইকে বলতে লাগল:
ভাইসব, আপনারা এবার যান তো! এতে তাজ্জব হওয়ার মতো কী এমন দেখছেন আপনারা?
কী কাণ্ড!...রাস্তায় কখনো হাতি, জ্যান্ত হাতি দেখেননি নাকি?
বাড়ি এসে গেছে। সিঁড়ির মুখ থেকে খাবার ঘর পর্যন্ত যত দরজা, সব হাতুড়ি মেরে রীতিমতো ভেঙে চওড়া করে হাতি যাওয়ার পথ করা হয়েছে।
কিন্তু সিঁড়ির মুখে এসেই দাঁড়িয়ে পড়ল হাতি, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অবাধ্যতা শুরু করল।
ভালো খাবারটাবার কিছু দেওয়া দরকার ওকে...জার্মান ভদ্রলোক বলে উঠলেন। এই মিষ্টি-রুটি কি আর কিছু...আঃ হাঃ...টমি! এগো, এগো টমি!
নাদিয়ার বাবা পাশের রুটির দোকানে দৌড়ে গিয়ে পেস্তাবাদামের তৈরি বিশাল গোলাকার এক কেক কিনে আনলেন। হাতি তো পিচবোর্ডের বাক্সসুদ্ধ সব কেক খাবার জন্য তৈরি, কিন্তু জার্মান ভদ্রলোক মাত্র সিকিটাক তাকে দিলেন। কেকের স্বাদ খুব চমৎকার মনে হলো টমির, আরও এক টুকরো নেওয়ার জন্য শুঁড় বাড়াল সে। কিন্তু জার্মান ভদ্রলোকটি এবার একটু চালাকি করলেন।
খাবারটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন তিনি, আর সেই সঙ্গে হাতিটাও শুঁড় বাড়িয়ে দিয়ে, কান ঝাপটাতে ঝাপটাতে তাঁর পেছন পেছন উঠতে লাগল। ওপরে উঠে তবে আরেক টুকরো পেল টমি।
এভাবেই তাকে খাবার ঘর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলো, সেখান থেকে আগেভাগেই আসবাব সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আর বেশ পুরু করে খড় বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে মেঝেয়...মেঝেয় গেঁথে রাখা একটা রিংয়ের সঙ্গে হাতির পা বেঁধে রাখা হলো। টাটকা গাজর, বাঁধাকপি আর শালগম তার সামনে ফেলে রাখা হলো। জার্মান ভদ্রলোক পাশেই একটা সোফায় গা এলিয়ে দিলেন। বাতি সব নিভিয়ে দেওয়া হলো, শুয়ে পড়ল সবাই।
৬.
পরের দিন ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল খুকুমণির, তার পরেই প্রথম প্রশ্ন:
হাতি কই? হাতি এসেছে?
এসেছে বৈকি, মা উত্তর দিলেন। কিন্তু তাঁর হুকুম হলো আমাদের নাদিয়া প্রথমে মুখ-হাত ধোবে, তারপর আধা সেদ্ধ একটা ডিম আর গরম-গরম দুধ খাবে।
আচ্ছা, ও কি ভালোমানুষ?
ভালোমানুষ বৈকি। লক্ষ্মী মেয়ে, খেয়ে নে এবার। এক্ষুনি তো আমরা ওর কাছে যাব।
খুব মজার দেখতে, না?
তা আছে একটুখানি। গরম জামাটা এবার পরে নে।
ডিমটা তাড়াতাড়িই খাওয়া হয়ে গেল, দুধের বেলাতেও তাই। ছোটবেলায় যখন হাঁটতে শেখেনি, তখন যে প্যারাম্বুলেটরে চড়ে সে ঘুরত ঠিক সেইটাতেই নাদিয়াকে বসিয়ে খাবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো।
ছবিতে দেখে যে রকমটি ভেবেছিল নাদিয়া, হাতিটা কিন্তু তার চেয়ে বিরাট বড় মনে হলো। উঁচুতে দরজার চেয়ে এই একটুখানি কেবল ছোট সে, আর লম্বায় খাবার ঘরের অর্ধেক। কী কর্কশ চামড়া তার, গভীর ভাঁজে ভাঁজে কুঁচকে আছে। থামের মতো মোটা মোটা পা। লম্বা লেজের আগাটা যেন একটা বুরুশ। মাথার চাঁদি খুব ফুলোফুলো। বিশালাকার কান, যেন পদ্মপাতা, লটপট করে ঝুলছে। চোখ এক্কেবারে কুতকুতে, কিন্তু বুদ্ধিমান আর মায়াভরা। তার গজদাঁত কেটে ফেলা হয়েছে। শুঁড় অবিকল যেন লম্বা একটা সাপ, আর তার আগায় নাকের ফুটো দুটো, তারি মধ্যিখানে একটা নরম আঙুল চুলবুল করছে যেন। হাতিটা যদি তার শুঁড় সবটা টানটান করে মেলে ধরে, তাহলে নির্ঘাত জানালা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাবে।
মেয়েটা কিন্তু বিন্দুমাত্র ভয় পায়নি। সে কেবল জন্তুটার বিশাল আয়তনের বহর দেখে একটু হকচকিয়ে গেছে। অথচ তার আয়া, ষোলো বছরের পোলিয়া কিন্তু ভয়ে হাউমাউ শুরু করে দিয়েছে।
হাতির মালিক, জার্মান ভদ্রলোক প্যারাম্বুলেটরের কাছে এগিয়ে এলেন, বললেন:
এসো, এসো খুকি! ভালোমতো ঘুমিয়েছিলে তো? ভয় পেয়ো না যেন। টমি আমাদের খুব ভালো মানুষ, আর ছেলেপিলে পছন্দ করে।
খুকি তার ছোট্ট ফ্যাকাশে হাত জার্মান ভদ্রলোকের দিকে বাড়িয়ে দিল।
আদাব, আপনি ভালো আছেন? উত্তর দিল মেয়েটি। আমি একরত্তিও ভয় পাইনি। ওর নাম কী?
টমি।
আদাব, টমি। বলে উঠল সে, মাথা ঝাঁকাল। হাতিটা এতই বিরাট যে তাকে ‘তুই’ বলা সংগত মনে হলো না মেয়েটির। রাত্তিরে ভালোমতো ঘুমিয়েছিলে তুমি?
সে তার দিকেও হাত বাড়িয়ে দিল। অত্যন্ত সাবধানে হাতটা তুলে নিল হাতি, তারপর নিজের চুলবুলে শক্তসামর্থ্য আঙুল দিয়ে তার ফুরফুরে নরম হাতে আস্তে করে চাপ দিল, এ কাজ সে ডাক্তার মিখাইল পেত্রভিচের চেয়েও অনেক মৃদুভাবে সম্পন্ন করল। সেই সঙ্গে মাথাটাও কিঞ্চিৎ নাড়ল সে, আর তার ছোট্ট চোখ আরও সরু হয়ে এল, ঠিক সে হাসছে তখন।
ও দেখি সব বোঝে? জার্মানকে জিজ্ঞেস করল খুকি।
নিশ্চয়ই, সব বুঝতে পারে, খুকি।
খালি কেবল কথা কইতে পারে না, তাই না?
তাই তো, শুধু কথা বলতে পারে না—এই যা। জানো তুমি, আমারও কিন্তু একটা মেয়ে আছে, এই এত্তটুকু, ঠিক তোমার মতো। তার নাম লিজা। টমির সঙ্গে তার দারুণ, রীতিমতো দারুণ ভাব।
ভালো কথা, টমি, তুমি কি চা খেয়ে ফেলেছ? হাতিকে জিজ্ঞেস করে উঠল মেয়েটি।
হাতিটা তার শুঁড় বাড়িয়ে দিল পুনর্বার, তারপর মেয়েটির মুখে জোরে গরম নিশ্বাস ছুড়ে মারল, যার ফলে খুকির নরম চুল এলোমেলো ছড়িয়ে পড়ল এদিক-ওদিক।
খিলখিল করে হেসে উঠল নাদিয়া, হাততালি দিল। জার্মানটি একগাল হাসলেন।
তিনি নিজেও তাঁর হাতির মতোই বিরাট, মোটা, আর দয়ালু—নাদিয়ার মনে হলো ওদের দুজনের চেহারায় মিল আছে। কে জানে, হয়তো ওরা আত্মীয়?
না, ও চা খায়নি, খুকি। শরবত খেতে খুব ভালোবাসে ও; বানরুটিও ওর খুব পছন্দ।
ট্রেতে করে বানরুটি নিয়ে আসা হলো। মেয়েটি খাওয়াতে লাগল হাতিকে। হাতি নিপুণভাবে তার ওই আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরল বানরুটি, শুঁড় গোল করে গুটিয়ে মুখের মধ্যে কোথায় ভেতরে পাঠিয়ে দিল—সেখানে, ভেতরে বড় মজার দেখতে, তেকোনা, লোমশ তার নিচের ঠোঁট রয়ে গেছে। খসখসে চামড়ায় বানরুটি চিবুবার আওয়াজ শোনা গেল। টমি একই ভঙ্গিতে আরেকটা বান তারপর তৃতীয়টাও, এরপর চতুর্থটাও, তারপর ৫ নম্বর বানটিও পূর্ববৎ ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে ধন্যবাদের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল, আর তার খুদে খুদে চোখ দুটো তৃপ্তিতে আরও ছোট হয়ে এল। আর খুকি খুশিতে খিলখিল করে হাসতে লাগল।
সব বানরুটি যখন খাওয়া শেষ হলো, তখন নাদিয়া তার পুতুলগুলো চিনিয়ে দিতে লাগল হাতিকে:
টমি, এই যে দ্যাখো, ভালো কাপড়জামা পরা এই পুতুল—এ হলো সোনিয়া। খুব ভালো মেয়ে এ, তবে একটু খামখেয়ালি, স্যুপ খেতে চায় না। আর এ হলো নাতাশা, সোনিয়ার মেয়ে। এর মধ্যেই লেখাপড়া শিখতে শুরু করে দিয়েছে, জানো, আর প্রায় সব অক্ষরই সে এখন চেনে। আর এইটা—এ হচ্ছে মাত্রিওশকা। এ আমার সবচেয়ে পয়লা নম্বর পুতুল। এই যে দ্যাখো-না, ওর নাক নেই, মাথা আঠা দিয়ে জোড়ানো আর একদম চুল নেই মাথায়। তা বলে তো আর বুড়ি মানুষকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারি না। ঠিক বলিনি টমি? আগে সোনিয়ার মা ছিল এই মাত্রিওশকা, আর এখন সে আমাদের রাঁধুনি। আচ্ছা, এবার একটু খেলি এসো, টমি: তুমি বাবা হবে, আর আমি মা, আর এরা আমাদের ছেলেমেয়ে।
টমি রাজি। সে হাসছে, মাত্রিওশকাকে ঘাড় ধরে তুলে নিয়ে মুখের কাছে নিয়ে এল। না
এটা কেবল তামাশা। একটুখানি চিবিয়ে পুতুলটা আবার মেয়েটির কোলের ওপর রেখে দিল—হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটু ভিজে ভিজে আর তোবড়ানো অবস্থায় তো বটেই।
এরপর নাদিয়া ছবিওয়ালা এক বিরাট বই তাকে দেখাতে লাগল আর বুঝিয়ে দিতে লাগল সঙ্গে সঙ্গে:
এটা হলো ঘোড়া, আর এটা একটা ক্যানারি পাখি, আর এটা বন্দুক...এই হলো খাঁচার ভেতর পাখি, এই—বালতি, আয়না, চুলো, বেলচা, কাক...আর এইটা, দ্যাখো তো কী, হ্যাঁ, হাতি! এক্কেবারে তোমার মতো নয়, ঠিক না? হাতি আবার কখনো এত ছোট হয় নাকি, কী বলো টমি?
টমিরও মনে হলো, এত ছোট হাতি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কখনো কোথাও নেই। মোটের ওপর ছবিটা ভালো লাগল না তার। সে তার আঙুল দিয়ে বইয়ের পাতার একটা কোণ ধরে পাতা উল্টে দিল।
এদিকে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে আসছে, কিন্তু হাতির কাছ থেকে সরানোই যায় না মেয়েকে। জার্মান ভদ্রলোকই সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন:
আমার হাতে ছেড়ে দিন, সব ঠিক করে দিচ্ছি। ওরা একসঙ্গে বসে খাক।
হাতিকে বসতে হুকুম করলেন তিনি। আদেশমতো বসে পড়ল হাতি, সেই সঙ্গে ঘরের সারা মেঝে কেঁপে উঠল, আলমারিতে বাসনপেয়ালাগুলো ঝনঝন করে উঠল, আর নিচের তলার ঘরে ছাদ থেকে খসে পড়ল পলেস্তারা। হাতির মুখোমুখি খুকি বসল। মাঝখানে টেবিল পাতা হলো। হাতির বুকের ওপর ঘাড় ঘুরিয়ে একটা টেবিলের চাদর বেঁধে দেওয়া হলো। তারপর দুই নতুন বন্ধু খাওয়া শুরু করল। খুকি খেল মুরগির স্যুপ আর কাটলেট, আর হাতি—নানান রকম ফলমূূল আর সালাদ। মেয়েকে ছোট্ট একটা গ্লাসে শেরি দেওয়া হলো খেতে, আর হাতিকে—ব্র্যান্ডি মেশানো গরম পানি, সে তো মহা আনন্দে গামলা থেকে শুঁড় দিয়ে তুলে তুলে এই শরবত খেতে লাগল। এরপর দেওয়া হলো মিষ্টান্ন: মেয়েকে এক বাটি কেকো, আর হাতি পেল আধ ফালি কেক, এবার অবশ্য আখরোট দেওয়া। এতক্ষণ এই সমস্ত সময়টুকু ধরে জার্মান ভদ্রলোক বাবার সঙ্গে বৈঠকখানায় বসে তাঁর হাতির মতোই আনন্দে সময় কাটিয়েছেন, বসে বসে বিয়ার খেয়েছেন—কেবল পরিমাণটা যথেষ্ট বেশি।
খাওয়াদাওয়ার পরে চেনাজানা বাবার বন্ধুবান্ধব এলেন যেন কারা। বারান্দাতেই হাতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়া হলো তাঁদের, যাতে তাঁরা ভয় না পান। প্রথমে তাঁরা বিশ্বাস করেননি, কিন্তু পরে টমিকে দেখে দরজার মুখেই তাঁরা ঠেলাঠেলি করতে লাগলেন।
ভয় পাবেন না, ও খুব ভালোমানুষ! খুকি সান্ত্বনা দেয় তাঁদের।
কিন্তু পরিচিতরা সবাই তাড়াতাড়ি বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকলেন, তারপর মিনিট পাঁচেক বসেই বেরিয়ে গেলেন।
সন্ধে হয়ে আসছে। দেরি হয়ে গেছে। মেয়েটির ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে। কিন্তু হাতির কাছ থেকে নড়ানোই সম্ভব হচ্ছে না মেয়েকে। সেভাবেই সে ঘুমিয়ে পড়ল হাতির পাশে, পরে ঘুমের মধ্যেই তাকে তার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। এমনকি কাপড়চোপড় খুলে দেওয়ার সময়ও সে বুঝতেই পারেনি।
সেই রাত্রেই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল নাদিয়া যে টমির সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, আর তাদের ছেলেপুলে অনেক—ছোট্ট হাসিখুশি বাচ্চা হাতির পাল। হাতিওটাকে রাতেই সার্কাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল—স্বপ্নে এই মিষ্টি, আদুরে মেয়েটিকে দেখতে পেল। এ ছাড়া সে দেখল বিরাট বড় বড় কেক, পেস্তাবাদাম আর আখরোট দেওয়া ফটকের মতো উঁচু...
সকাল হতেই হাসিখুশি, টাটকা হরহরে—ঠিক আগে যে রকম ছিল সেই রকম সুস্থ শরীরে ঘুম ভাঙল খুকির। ভয়ানক জোরে আর অস্থিরভাবে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলল:
দুধ হবে-এ-এ?
এই চিৎকার শুনে মা খুশি হয়ে দৌড়ে এলেন।
কিন্তু গতকালের কথা মনে আছে মেয়ে, সে জিজ্ঞেস করে উঠল:
হাতি কই?
বোঝানো হলো তাকে যে দরকারি কাজে বাড়ি গেছে হাতি, তার তো ছেলেমেয়ে আছে—ওদের একা ছেড়ে রাখা যায় না, সে আদাব জানিয়েছে নাদিয়াকে এবং সে ভালো হয়ে উঠে কবে তার বাসায় নেমন্তন্ন খেতে আসবে, তার জন্য সে অপেক্ষা করে আছে।
খুকি দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল:
টমিকে তাহলে জানিয়ে দাও, আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছি!
ছোট্ট মেয়েটির বড় সাংঘাতিক অসুখ। উজ্জ্বল সোনালি রোদ্দুর তার ভালো লাগে না, ভালো লাগে না মায়ের আদর, বন্ধুবান্ধবের রংচঙে খেলনা। এমনকি ডাক্তার পর্যন্ত ধরতে পারেন না অসুখটা কী, এদিকে মেয়ে দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে...
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত ভালো হয়ে উঠল মেয়েটি; আর ভালো করল তাকে বিরাটাকার খুব ভালোমানুষ একটি হাতি। পোষ মানানো হাতি বেড়াতে এসেছিল তার কাছে। সেই রোগ সারাল শেষ পর্যন্ত।
‘হাতি’ গল্পটি ছোট ছোট খোকাখুকুর জন্য অনেক, অ-নে-ক দিন আগে লিখে রেখে গেছেন বিখ্যাত রুশ গল্পকার আলেক্সন্দর কুপ্রিন (১৮৭০-১৯৩৮)। বর্তমানে এই গল্প চিরায়ত শিশুসাহিত্যের অন্তর্গত হয়ে গেছে।
হায়াৎ মামুদ: হায়াৎ মামুদ শিশুদের জন্য লিখেছেন অনেক। ইংরেজি ও রুশ থেকে অনুবাদও করেছেন। তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচডি করেছেন ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। রাশিয়ায় ছিলেন অনেকদিন। অন্যান্য অনুবাদের পাশাপাশি মূলত শিশু সাহিত্যই অনুবাদ করেছেন সেখানে। শিশুসাহিত্য নিয়ে প্রণিধানযোগ্য বেশকিছু প্রবন্ধও লিখেছেন। কিছুদিন চাকরি করেছেন বাংলা একাডেমিতে। দীর্ঘকাল তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক। হায়াৎ মামুদের জন্ম ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলায়। ছেলেবেলা কেটেছে পশ্চিমবঙ্গেই। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। ভীষণ আমুদে এই মানুষটির লেখার ভাষা মনকাড়া। পড়লেই তা বুঝতে পারবে।