সোমনাথ নদের পাশে ছোট্ট একটা মফস্সল শহর। বাবা অবশ্য বলছিলেন, নদটা আগের মতো নেই।
‘আগের মতো নেই কেন বাবা?’ ফাহাদ জানতে চায়।
‘দেখছিস না এখান থেকে পাথর তুলে নিচ্ছে সবাই। এ রকম করলে নদ কি আর নদ থাকে? আহা।’ বাবা একটা দুঃখের ভঙ্গি করলেন বলে মনে হলো ফাহাদের। আজ শুক্রবার, বাবার অফিস বন্ধ। মা, বাবা আর ফাহাদ তিনজন নদের ধারে বেড়াতে এসেছে। বাবা ঘুরে ঘুরে এলাকাটা ওদের চেনাচ্ছেন। যেহেতু বাবা আগেও একবার–দুবার এসেছেন এখানে।
‘তুমি জানো কী করে, এ নদ আগের মতো নেই?’ মা জিজ্ঞেস করেন বাবাকে।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার এখানে বেড়াতে এসেছিলাম। সে অনেক কাল আগের কথা।’
ফাহাদের বাবা এখানে বদলি হয়ে এসেছেন। তাই পুরোনো বন্ধু-স্কুল সব ছেড়ে ফাহাদকেও আসতে হলো। প্রথম দিকে বেশ খারাপ লাগছিল। এখন কিন্তু বেশ লাগছে। সুন্দর ছিমছাম একটা শহর। এখানকার স্কুলটার নাম ‘মফিদুল বয়েজ হাইস্কুল’, সরকারি স্কুল। এখানেই নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে ফাহাদ ওরফে ফাহাদ শরীফ। রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে হয়েছে। ব্যাপারটা অবশ্য বেশ ভালোই লেগেছে ফাহাদের; স্কুলের নিয়মকানুন বেশ কড়া মনে হচ্ছে।
প্রথম ক্লাসেই দু–একজন বন্ধু হয়ে গেল। একজন হচ্ছে মহীন্দ্র নাথ আর রনি; রনি আকন্দ। মহীন্দ্র ক্লাসের ফার্স্ট বয়। সে একটু চুপচাপ ধরনের। আর রনি তার উল্টো, সব সময় ফরফর করছে আর হি হি করে হাসছে। সব স্যারই ভালো, শুধু ইংরেজি স্যারটা একটু কেমন যেন! প্রথম দিনেই তাকে ধরলেন—
‘এই ছেলে, নাম কী?’
‘ফাহাদ শরীফ।’
‘ঢাকা থেইকা আসছ?’
‘জি।’
‘ঢাকার পুলাপান তো দুষ্ট হয়। সিগ্রেট খায়।’ স্যারের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় ফাহাদ। বলে কী!
‘মানে স্যার?’
‘তুমি সিগ্রেট খাও নাকি?’
‘না স্যার।’
‘আচ্ছা বসো।’ বসল ফাহাদ। পাশে বসা মহীন্দ্র কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘স্যারটা একটা ক্যারা টাইপ।’ ক্যারা শব্দটা ঠিক কী, ভাবতে লাগল ফাহাদ।
সেদিন ফেরার পথে একটা কাণ্ড হলো। সুন্দর একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল ফাহাদ। সব রাস্তা সে অবশ্য এখনো ঠিক চিনে উঠতে পারেনি। এই রাস্তা পুরোটাই মাটির, লাল মাটি। তবে রাস্তাটা কিন্তু সুন্দর। হাঁটতে বেশ লাগে। খালি পায়ে হাঁটলে আরও ভালো লাগত বোধ হয়। যখন ঢালু জায়গাটায় এল, তখন একদল ছেলে পাশের ঝোপঝাড় থেকে বের হয়ে তাকে ঘিরে ধরল।
‘এই দাঁড়াও।’ ফাহাদ দাঁড়াল।
‘কিছু বলবে?’
‘হুঁ।’ ওদের মধ্যে শুটকো ধরনের একজন সামনে এসে দাঁড়ায়। তার গলায় একটা রুমাল বাঁধা।
‘তোমরা নতুন আসছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওর বাবা ডিসি অফিসে কাজ করে।’ পাশ থেকে একজন বলল।
‘তোমার নাম ফাহাদ?’
‘হ্যাঁ।’
‘মফিদুল বয়েজ স্কুলে ভর্তি হইছ?’
‘হুঁ।’
‘শোনো, আমরাও মফিদুল বয়েজ স্কুলের ছাত্র। এলাকায় আমাদের একটা ক্লাব আছে। ক্লাবের নাম টেম্পার অ্যাকশন ক্লাব।’
‘এই ক্লাবের কাজ কী?’ ফাহাদ জানতে চায়।
‘আমরা দুষ্টের দমন করি আর শিষ্টের...কী যেন কথাটা?’ শুকনা ছেলেটা পাশে তাকায় আরেকজনের দিকে।
‘দুষ্টের দমন আর শিষ্টের আচরণ।’
‘হ্যাঁ দুষ্টের দমন, শিষ্টের আচরণ করি।’
হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল ফাহাদের। কষ্ট করে হাসিটা গিলে ফেলল। ছেলেটা বলতেই থাকল...
‘আমরা এলাকায় যারা খারাপ কিছু করে, তাদের সাইজ করি। ওই যে রবিনহুডের মতো আরকি।’
‘ঠিক ঠিক। আমরা সবাই এই ক্লাবের রবিনহুড।’ আরেকজন পাশ থেকে বলল।
‘তাহলে তো ভালো।’ একটা কিছু বলতে হয় বলে বলল ফাহাদ।
‘তুমি নতুন আসছ, আমাদের ক্লাবের সদস্য হইবা। এক শ টাকা চান্দা।’
‘আমার কাছে টাকা নেই।’
‘ঠিক আছে পরে দিয়ো। তবে আমাদের সব অ্যাকশনে তুমি থাকবা। তোমার বডি তো বেশ ফিট মনে হইতাছে, জিম করো নাকি?’
‘একসময় করতাম। আচ্ছা তোমাদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করব।’
‘ভেরি গুড। যাও...বাসায় যাও।’
বাসায় এসে এই ক্লাবের কথা মা–বাবার সঙ্গে আলাপ করল। বাবা পত্রিকা পড়ছিলেন। তিনি কিছু বললেন না। মা বললেন ‘ভালোই তো। পাড়ার ছেলেরা ভালো কিছু করলে তুমিও তাদের সঙ্গে কাজ করবে। এসো, হাত–মুখ ধুয়ে খেতে এসো।’
পরদিন মহীন্দ্রকে টেম্পার অ্যাকশন ক্লাবের কথা বলতেই আঁতকে উঠল মহীন্দ্র, ‘সর্বনাশ...!’
‘কী হলো?’
‘খবরদার, এই সব ছেলের সঙ্গে মিশবা না।’
‘কেন?’
‘এরা খুব খারাপ।’
‘এরা নাকি আমাদের স্কুলের ছাত্র?’
‘কে বলেছে? একজন–দুজন ছিল হয়তো। বের করে দেওয়া হয়েছে। এরা এখানে–সেখানে চাঁদাবাজি করে, নেশা করে। আরও অনেক আজেবাজে কাজ করে।’
‘কী রকম?’
‘আমি বলতে পারব না। এরা খুব খারাপ...খুব খারাপ। ওই যে সোমনাথ নদ থেকে যারা অবৈধভাবে পাথর তোলে, এরা তাদের সঙ্গেও আছে। এদের লিডারটা এলাকার কাউন্সিলরের ডানহাত। বদের বদ।’
এই সময় ইংরেজির সেই ক্যারা স্যার (মহীন্দ্রের ভাষায়) ঢুকলেন। হাতের র৵াপিড ইংলিশ বইটা খুলে চোখের সামনে ধরলেন। তারপর হঠাৎ করে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘এই ছেলে দাঁড়াও।’
‘স্যার।’
‘তুমি ঢাকা থেকে আসছ না?’
‘জি স্যার।’
‘ঢাকার ছেলেরা দুষ্ট হয়। স্কুল–কলেজের মেয়েদের বিরক্ত করে...’
‘স্যার, একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ ফাহাদ বলে।
‘তুমি আবার কী প্রশ্ন করবা?’
‘যা বললেন, সেটা স্যার র৵াপিড ইংলিশ বইয়ের কোন গল্পটায় আছে যদি বলতেন...’
পুরো ক্লাস একমুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তারপর হঠাৎ ক্লাসসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল হো হো করে। স্যার থতমত খেয়ে গেলেন। তার হাত থেকে বই পড়ে গেল মেঝেতে। বইটা তুলে কোনোমতে বললেন—
‘ক–কী ব-বললা?’
ফাহাদের আসলে ভয়ানক রাগ উঠে গেছে। সে এবার স্পষ্ট করে বলল, ‘আপনি আগের ক্লাসে বলেছিলেন, ঢাকার ছেলেরা দুষ্টু; তারা সিগ্রেট খায়। এখন বললেন, ঢাকার ছেলেরা স্কুল–কলেজের মেয়েদের বিরক্ত করে। এসব তথ্য কি স্যার র৵াপিড ইংলিশ বইয়ের কোনো গল্পে আছে? সেটা জানতে চাচ্ছি?’ আবার সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
স্যার ফ্যাকাশে মুখে বইটা উল্টেপাল্টে দেখলেন, যেন গল্পটা খুঁজছেন।
এই সময় ঘিয়ে যেন আগুন দিল ফজল। ফজল ক্লাসের বেশ দুষ্টু ধরনের ছেলে। ‘স্যার এসব তো সামাজিক কর্মকাণ্ড; বিজ্ঞান বইয়ে থাকার কথা...সমাজবিজ্ঞান বইয়ে মনে হয় আছে।’ আবার আরেক দফা হো হো করে হেসে উঠল সবাই। কারণ এই স্যার মাঝেমধ্যে ওদের সমাজবিজ্ঞান ক্লাসও নেন এবং বইয়ের বাইরে অদ্ভুত অদ্ভুত সব তথ্য দেন, যেগুলো নিয়ে বেশ হাসাহাসিও হয়।
হাসির রেশটা কমে এলে স্যার হঠাৎ হনহন করে বের হয়ে যান। আশ্চর্যের ব্যাপার, সেদিন আর স্যার ক্লাসে এলেন না এবং তার পরদিনও না।
তবে তাদের বিজ্ঞান স্যার পুরো উল্টো। তিনি ক্লাসে এসেই ঢাকার খোঁজখবর করেন ফাহাদের কাছে। ঢাকাকে খুব মিস করেন তিনি। তাঁর প্রথম চাকরিজীবন ঢাকায় কেটেছে বেশ কিছু বছর, তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন সেই স্মৃতি তো আছেই।
‘ঢাকার মেট্রোরেলে চড়েছিস?’
‘জি স্যার।’
‘ওহ! সত্যি অসাধারণ একটা কাজ হয়েছে আমাদের দেশে। আমি মেট্রোরেলে চড়ার জনই একদিন ঢাকায় যাব। আচ্ছা, উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে মেট্রোরেলের ভাড়া কত জানিস?’
‘জানি স্যার, ৮০ টাকা।’
‘বাহ্ চমত্কার। একদিন ঢাকায় যাব। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত একটা ট্যুর করব। কেমন হবে রে?’
সবাই একসঙ্গে চেঁচাল, ‘দারুণ হবে স্যার।’
তারপর স্যার মেট্রোরেল কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘মেট্রোরেল ডিসি সান্ট মোটরের প্রিন্সিপাল দিয়ে কাজ করে...এই রেলের লোকোমোটিভ স্পিড...’
মাঝেমধ্যে ইংরেজির সেই ক্যারা স্যারের ঝামেলা ছাড়া বেশ ভালোই চলছিল ফাহাদের। বাসা থেকে স্কুল, স্কুল থেকে বাসা...মাঝেমধ্যে স্কুলের মাঠে ভলিবল বা ফুটবল খেলা, পাড়ার লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারা। আর সোমনাথ নদের পাড় দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটা। টেম্পার অ্যাকশন ক্লাবের কথা ভুলেই গিয়েছিল একরকম। কিন্তু হঠাৎ একদিন সেই শুকনা ছেলে তার দলবল নিয়ে পথ আটকাল। দিনট ছিল শুক্রবার।
‘কী ব্যাপার?’
‘আজ বিকেলে অপারেশন আছে।’
‘কী অপারেশন?’
‘ওই যে বললাম, দুষ্টের দমন...শিষ্টের...’
এই সময় পাশ থেকে সজীব নামের আরেকটা ছেলে শুকনা ছেলেটার হয়ে ব্যাখ্যা করে, ‘এক লোক আরেকজনের টাকা মারছে। টাকা দেয় না। তার টাকা উদ্ধার করতে হবে।’
‘কীভাবে?’
‘গেলেই দেখবা।’ ফাহাদের কৌতূহল হলো। যাওয়া যাক না, দেখি আসলে কী করে এরা। সত্যিই ভালো কিছু করে, না এর মধ্যে কোনো ফাঁক আছে? মহীন্দ্রের কথাটা সত্যি কি না! আর ফাহাদ জানে যে তার অনেক সাহস। তার একটা কারণও আছে...সেটা এই গল্পের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে আমরা বেশ বুঝতে পারব।
আজ রাফির খুব আনন্দের দিন। তার বড় আপুর আজ বিয়ে। বিয়ের পর সে আপুর সঙ্গে ঢাকায় চলে যাবে। সেখানে তাদের নিজস্ব বাসা হবে। মানে আপু আর দুলাভাইয়ের নিজস্ব বাসা হবে। সে নতুন একটা স্কুলে ভর্তি হবে আর আপুর সঙ্গেই থাকবে। মামা-মামির সঙ্গে থাকতে হবে না আর। আপু অবশ্য আগেও বলত, ‘আমার বিয়ে হলে তোকে আমি আমার সঙ্গে নিয়ে যাব।’
‘কোথায় নেবে?’
‘আমার বর যেখানে নেয়, সেখানে।’
‘সেখানে নতুন স্কুলে ভর্তি হব?’
‘অবশ্যই। জানিস তো আমাদের মা–বাবা নেই। মামা–মামি আর কত দিন টানবে আমাদের?’ ঠিক কথা, ভাবে রাফি।
আপুর বিয়েটা যে খুব ধুমধাম করে হলো, তা নয়। নতুন দুলাভাই দুই–তিনজন লোক নিয়ে এল। খাওয়াদাওয়া হলো। তারপর বিয়ে পড়ানো হলো। বিয়ের আসরে বসা আপুকে খুব সুন্দর লাগছিল, আপু এমনিতেও সুন্দর। লাল রঙের একটা সুন্দর শাড়ি পরে ছিল সে। অবশ্য খুব কাঁদছিল। মামিও কাঁদছিল। রাফিরও কেন যেন ইচ্ছে হলো ডাক ছেড়ে কাঁদে। তবে কাঁদল না, মুখ শক্ত করে রইল।
রাত দশটার দিকে তারা ট্রেনে করে রওনা দিল ঢাকার দিকে।
তবে ঢাকায় দুলাভাইয়ের বাসায় পৌঁছে বেশ হতাশ হলো রাফি। দুলাভাইদের বাসাটা পুরোনো। ওই বাসায় দুলাভাইয়ের মা-বাবা থাকেন, এক ভাই আর দুই বোনও থাকে। এখন রাফিও থাকবে। আর আছে এক বুড়ো দাদু। বেশ বড় সংসার। রাফির থাকার জায়গা হলো দুলাভাইয়ের ছোট ভাই বরকতের সঙ্গে। শিগগিরই রাফি বুঝতে পারল যে বরকত ছেলেটা বদের হাড্ডি। প্রথম দিনই এ রকম কথাবার্তা হলো ওদের—
‘তোর নাম কী রে?’ তুই–তুই করে বলছে, ব্যাপারটা পছন্দ হলো না রাফির। বলল,
‘রাফি।’
‘এখানেই থাকবি?’ রাফি মাথা নাড়ল।
‘তাইলে তো কাম সারা। শোন, এই ঘরে থাকতে হলে কোনো রকম ট্যা–ফো করা যাবে না।’
‘ট্যা–ফো কী?’
‘ট্যা–ফো বোঝোস না?’
‘না।’
‘কাছে আয়।’ রাফি ভয়ে ভয়ে কাছে গেল। বরকত ওর কানের কাছে হঠাৎ ‘হই’ করে বিকট এক চিত্কার দিল। রাফির মনে হলো, ওর কানে যেন তালা লেগে গেছে।
‘মানে বুঝলি তো, কোনো রকম আওয়াজ করবি না। কোনো রকম আওয়াজ আমি লাইক করি না।’
‘আচ্ছা।’ কোনোরকমে বলে রাফি। তার কানের ভেতরটা ভো ভো করছে তখনো।
বরকত আরও কী সব বলল, যার একটা কথাও বুঝল না রাফি, কানেও ঢুকল না। তবে আপুর সঙ্গে এসব শেয়ার করল না। আপু যখন একফাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর সঙ্গে বরকত খারাপ ব্যবহার করেনি তো?’
‘না।’
‘ঠিক বলছিস?’
‘হ্যাঁ।’ আপু কেমন একচোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তাকানোর ভঙ্গিতে রাফির মন খারাপ হয়ে যায় কেন যেন। একসময় আবিষ্কার করল যে আপু সব সময় রান্নাঘরেই থাকে, রান্নাবান্না করে। এ বাসার সবার রান্নাবান্না তাকেই করতে হয়। দুলাভাইয়ের ছোট বোনটা অবশ্য সাহায্য করে মাঝেমধ্যে। একমাত্র ওই ছোট বোন, যার নাম রানী, তাকেই বেশি ভালো লাগল রাফির। একদিন আপুর শ্বশুর তাকে ডাকলেন। এই লোক সারা দিন বসে বসে একটা পাখির পালক দিয়ে কান চুলকায়।
‘এই ছেলে।’
‘জি।’
‘তুমি বউমার সঙ্গে আসছ?’
‘জি।’
‘নাম কী?’
‘রাফি। রফিকুল হাসান।’
‘বংশ কী?’
‘জি?’
‘কোনো বংশ নাই? সৈয়দ, চৌধুরী এই সব?’ রাফি না বুঝে মাথা নাড়ল। বুড়ো শ্বশুর হতাশ ভঙ্গিতে এদিক–ওদিক মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল, ‘কী সব সম্বন্ধ আনছে, হেরাই জানে...বংশের ঠিকঠিকানা নাই।’ তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
‘বাড়ি যাইবা না?’
‘জি, আমি এইখানেই থাকব আপুর সঙ্গে।’
‘কী কও এই সব?’ তারপর মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়ল।
সময়টা খুব ভালো কাটছিল না রাফির। টুকটাক ফাইফরমাশ খাটতে হচ্ছিল। যেমন বরকতের জন্য সিগারেট আনা। দুলাভাইয়ের জন্য ওয়ানটাইম রেজার কিনে আনা। সবচেয়ে বেশি দোকানে পাঠাত বড় বোনটা। ‘এই যাও তো লাল রঙের সুতো কিনে আনো। আর একটা সোনামুখী সুই।’ রাফি কিনে আনল। তখন বলত,
‘সুতাটা এত লাল না, আরেকটু হালকা, আর সোনামুখী সুইটা আরেক সাইজ ছোট।’
বদলে আরেকটু হালকা রং আনল, সুইও বদল হলো। তখন বলত, ‘ধুর, এটা কী? এটা তো কমলা।’ আবার ছুটতে হতো। এই এক সুতার রিল কিনতে চার–পাঁচবার দোকানে যেতে হতো রাফিকে। অবশ্য বাইরে থাকতেই ওর ভালো লাগে। ঘরের ভেতরটা কেমন দম বন্ধ লাগে! একদিন দুলাভাইকে সাহস করে বলল,
‘দুলাভাই, আমি কোন স্কুলে ভর্তি হব?’
‘স্কুল?’ দুলাভাই মনে হলো স্কুল শব্দটা জীবনে এই প্রথম শুনল।
‘জি। স্কুলে ভর্তি হব না?’
‘এখন যাও। এ নিয়ে পরে কথা হবে।’ ঠিক ওনার বাবার মতো মাছি তাড়ানোর একটা ভঙ্গি করলেন। মন খারাপ হয়ে যায় রাফির। সে বেশ বুঝতে পারছে, দুলাভাই লোকটা মোটেই সুবিধার হবে না।