ক্রিকেট কোচ গুড্ডুবুড়া
গুড্ডুবুড়ার বাবা একটা লাল রঙের আপেল নিয়ে এলেন। একটাই। অফিসের একটা মিটিং ছিল। সেখানে এই লাল আপেলটা খেতে দেওয়া হয়েছিল। কী মনে করে গুড্ডুর বাবা সেটা তাঁর ব্যাগে ভরে ফেললেন। বাসায় এসে ফলটা রাখলেন গুড্ডুর পড়ার টেবিলের ওপরে। তারপর ভুলেই গেলেন আপেলের কথা। নিজের ঘরে গিয়ে তিনি জামাকাপড় পাল্টাতে লাগলেন।
গুড্ডুবুড়া সন্ধ্যার পর টেবিলে গেল। গিয়ে দেখল, টেবিলের ওপরে একটা গোল লাল জিনিস।
এটা কী? জানা দরকার। সে তার মায়ের ফোন থেকে কল করল তার বন্ধু নাবিলকে।
নাবিল, বল তো, একটা জিনিস, গোল, লাল; আমার টেবিলের ওপরে, এটা কী?
নাবিল বলল, এটা ক্রিকেট বল। টেস্ট ক্রিকেটে পোশাক হয় সাদা, বল হয় লাল।
গুড্ডুবুড়া বলল, ধন্যবাদ। আমি তাহলে কালকে টেস্টের বল নিয়ে স্কুলে আসব। তুই দুটো ব্যাট নিয়ে আসিস। আমরা টিফিন পিরিয়ডে ক্রিকেট খেলব।
বাবাকে সে আপেলটা দেখিয়ে বলল, বাবা তোমাকে ধন্যবাদ।
বাবা বললেন, কেন?
এইটার জন্য।
বাবা বললেন, তুমি এটা পছন্দ করবে, আমি ভাবি নাই।
পরের দিন স্কুলে গেল গুড্ডু। আপেলটা স্কুলের ব্যাগে ভরে নিতে ভুলল না। নাবিল ক্রিকেট ব্যাট এনেছিল। টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের মাঠে গিয়ে খেলতে নামল তারা। গুড্ডু আপেল ছুড়ে মারল। নাবিল ব্যাট চালাল। আপেল ঠাস করে গেল ফেটে।
গুড্ডু বলল, এটা কী হলো?
নাবিল বলল, এই ফাজলামো করিস? বল না এনে আপেল এনেছিস কেন?
আপেল?
হ্যাঁ। আপেল।
গুড্ডু স্কুল থেকে ফিরে অপেক্ষা করতে লাগল কখন বাবা ফেরেন। বাবা আসতেই সে বাবাকে বলল, বাবা, তুমি আমার জন্য যে বলটা এনেছিলে, সেটা তো বল ছিল না। ছিল আপেল। আমি খেলতে গেছি। ওটা এক বাড়িতেই ফেটে গেছে।
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলেটা এত বোকা কেন।
পরের দিন বাবা আনলেন একটা ক্রিকেট বল। লাল রঙের। সেটা রাখলেন গুড্ডুর টেবিলে।
গুড্ডু যখন বলটা দেখল, সে ভাবল, এটা একটা আপেল। কাল বল ভেবে কী ভুলটাই না করেছিলাম। আজ আর একই ভুল করব না। সে একটা ছুরি আনল। আপেলটাকে কাটবে।
কিন্তু ক্রিকেট বল তো শক্ত। বল কাটতে পারল না গুড্ডু, বরং নিজের হাত সে ফেলল কেটে। রক্ত বেরিয়ে একেবারে ছ্যাড়াব্যাড়া লেগে গেল।
রক্ত দেখে ভয় পেয়ে গেল গুড্ডু। সে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল।
গুড্ডুবুড়ার বাবা ছুটে এলেন। মা রান্নাঘরে রুটি বেলছিলেন। তিনিও এলেন ছুটে। তাঁর হাতে–মুখে আটা লেগে আছে। মা বললেন, কী হয়েছে?
গুড্ডুবুড়া বলল, আপেল কাটতে গিয়েছিলাম। হাত কেটে গেছে। রক্ত...রক্ত...মা, আমি কি মারা যাব?
মা আঁতকে উঠলেন। বাবাও চিন্তিত। এই ছেলে কত ধরনের বোকামিই না করছে।
গুড্ডু ছবি আঁকতে বসেছিল একদিন। মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, এই ছবিতে কী রং দেব?
মা বললেন, চকলেট কালার দাও।
গুড্ডুবুড়া চকলেট এনে ছবিতে ঘষতে লাগল। পরে এই ছবিতে পিঁপড়া উঠে ভরে গেল। পিঁপড়ার কামড় খেয়ে গুড্ডুবুড়ার হাত গেল ফুলে।
আরেক দিনের কথা। গুড্ডুবুড়ার কাশি হয়েছে। মা বললেন, ওষুধ খাও। দুই চামচ খাবে।
গুড্ডুবুড়া একটু পরে বলছে, মা, চামচ তো খেতে পারছি না। একটা চামচই খেতে পারছি না। দাঁত ভেঙে যাচ্ছে। দুটো চামচ খাব কেমন করে।
তোমাকে চামচ খেতে হবে কেন?
তুমিই না বললে, ওষুধ খাও। দুই চামচ খাবে।
আরে বেটা। তোমাকে কি চামচ খেতে বলেছি। আমি বলেছি, চামচে করে ওষুধ খেতে। কাশির ওষুধ তো তুমি চেনোই।
গুড্ডুবুড়াকে বাবা ক্রিকেটের সেট কিনে দিলেন। ছোটদের ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম। তা নিয়ে সে চলে গেল তাদের কলাবাগানের মাঠে।
সে হলো উইকেটকিপার। যে–ই তার হাতে বল এসেছে, সবাই চিৎকার করে উঠল, উইকেট ভাঙ, উইকেট ভাঙ।
গুড্ডুবুড়া উইকেট ধরে আছাড় মেরে ভাঙার চেষ্টা করতে লাগল।
তারপর বলল, উইকেট তো কিছুতেই ভাঙতে পারছি না।
গুড্ডুবুড়াকে বাবা আর মা নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে।
ডাক্তার সবকিছু পরীক্ষা করে বললেন, গুড্ডুবুড়া, তুমি একদম ঠিক আছ। শুধু তোমার একটা সমস্যা।
একটা সমস্যা?
হ্যাঁ। তুমি খাও না। এই যে তোমার ওজন কম, তুমি দেশলাইয়ের কাঠির মতো হালকা–পাতলা। আর তোমার মাথার ব্রেন কাজ করছে না, এর কারণ তুমি একদম খাও না।
আমাকে কী করতে হবে?
তোমাকে খেতে হবে। তুমি ভাত খাবে, রুটি খাবে, দুধ খাবে, ডিম খাবে, মাছ খাবে, মাংস খাবে, ডাল খাবে, শাকসবজি, ফলমূল খাবে। পানি খাবে। আর প্রচুর খেলবে। ছোটাছুটি করবে। দেখবে, তুমি হবে সবচেয়ে ভালো ছাত্র। সবচেয়ে স্মার্ট ছেলে।
গুড্ডুবুড়া ঠিকঠাক খেতে লাগল।
গুড্ডুবুড়া রোজ—
ভাত খায় রুটি খায়
রোজ কলা দুটি খায়
মাছ খায় ডিম খায়
আলু আর শিম খায়
দুধ খায় দই খায়
মুড়ি আর খই খায়
ঝোল খায় ডাল খায়
টক আর ঝাল খায়
আম খায় জাম খায়
চিনি মিনিমাম খায়
কুমড়া ও কদু খায়
পাউরুটি মধু খায়
শাক নিরামিষ খায়
দুটো কিশমিশ খায়
বাদামের দানা খায়
চিনি ছাড়া ছানা খায়...
খায় আর খেলে। দৌড়ায়, সাইকেল চালায়। লুকোচুরি খেলে। ব্যাডমিন্টন খেলে।
এখন তার স্বাস্থ্য হয়ে গেল সুন্দর। সে লম্বা হতে লাগল। মাথার বুদ্ধিও গেল তার খুলে।
এখন সে আর বোকা গুড্ডুবুড়া নয়। সে চালাক গুড্ডু।
এবার সে ভর্তি হলো কলাবাগান ক্রিকেট একাডেমিতে। রোজ বিকেলে মাঠে গিয়ে সে কোচিং করে। তাদের মাঠে ক্রিকেট কোচ হলেন আশরাফ স্যার।
আশরাফ স্যার তাদের ব্যাট করতে শেখান। বল করতে শেখান। ফিল্ডিং শেখান। ত্রিশজন বালক একসঙ্গে ক্রিকেট শেখে।
গুড্ডুবুড়া সাংঘাতিক ব্যাট করে। তবে সে ভালো বল করতে পারে না। সে খুব যত্ন করে ফিল্ডিং শেখে।
আশরাফ স্যার একদিন বললেন, আমি তোমাদের ব্যাটিং শিখিয়েছি। বোলিং শিখিয়েছি। ফিল্ডিং শিখিয়েছি। কী শেখাইনি বলো তো।
গুড্ডুবুড়া বলল, ক্যাপ্টেন্সি। টসে জিতে বল নিতে হবে নাকি ব্যাটিং। কখন কাকে দিয়ে বল করাতে হবে। কাকে কোথায় ফিল্ডিংয়ে রাখতে হবে। ব্যাটিং অর্ডার কী হবে। কখন অ্যাটাকিং ব্যাটিং করতে হবে, কখন ডিফেন্সিভ ব্যাটিং।
আশরাফ স্যার বললেন, ঠিক। আমি এখন থেকে এটাই তোমাদের শেখাব। আমরা দুটো দল করে দিচ্ছি। তোমরা ম্যাচ খেলো।
গুড্ডুবুড়ার মনে পড়ল, সে যখন বোকা ছিল, তখন সে ম্যাচ বলতে বুঝত দেশলাইয়ের বাক্স।
গুড্ডুবুড়া এখন তাদের ক্লাবের সবুজ দলের ক্যাপ্টেন। আর লাল দলের ক্যাপ্টেন হলো বাবলু।
তারা ম্যাচ খেলে। কখনো গুড্ডুর দল জেতে, কখনোবা হারে।
একদিন আশরাফ স্যারের সঙ্গে গুড্ডুবুড়া গেল বিকেএসপিতে খেলা দেখতে। সেখানে জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরা দুই ভাগ হয়ে খেলছে।
জাতীয় দলের অধিনায়ক কায়সার ব্যাট করছেন।
গুড্ডুবুড়া বলল, স্যার, একটা কথা বলি?
বলো।
স্যার, ছোট মুখে বড় কথা বলা হয়ে যাবে। আমাদের ন্যাশনাল টিমের ক্যাপ্টেন কায়সার খুব ভালো খেলেন। কিন্তু তাঁর মাথায় বুদ্ধি কম আছে।
এসব কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ, স্যার। দেখেন উনি পুল করে ৬ মারার চেষ্টা করছেন বাতাসের বিরুদ্ধে। ওই দেখেন পতাকা। কী রকম বাতাস। এই বাতাসের বিরুদ্ধে কেন উনি ছয় মারার চেষ্টা করছেন? অনসাইডে না খেলে অফে ৬ মারার চেষ্টা করতে হবে। আর না হলে পরের ওভারে গিয়ে অনে মারতে হবে। দেখেন। একটু পরই ক্যাচআউট হয়ে যাবে।
তা-ই হলো। একটু পরই কায়সার ছয় মারতে গিয়ে কটআউট হলেন।
তাহলে কী করতে হবে?
আমি কায়সার ভাইয়াকে কিছু টিপস দেব। আমি দিলে উনি শুনবেন না। কিন্তু আপনি দিলে শুনবেন। আপনি দেবেন।
আশরাফ স্যার শুনে নিলেন গুড্ডুবুড়ার টিপস। এক. কায়সার ভাইকে বলেন ছোট মাছ খেতে। দুধ খেতে। আর মধু খেতে। তাহলে ওনার বুদ্ধি খুলবে। আর ওনাকে বলেন, ক্রিকেট কেবল শরীর দিয়ে খেলে না, মন দিয়ে খেলে। কিন্তু ক্রিকেট বুদ্ধি দিয়েও খেলতে হয়। সাকিব ভাইয়াকে দেখেন। উনি বল ঘোরাতে পারেন কম। কিন্তু নিয়মিত উইকেট পান। কারণ, উনি বুদ্ধি দিয়ে বল করেন। যে বেরিয়ে এসে খেলছে, তাকে তিনি ওয়াইড বল করে স্টাম্পড করেন। দুই হলো, আপনি কি দেখেছেন, কায়সার ভাই ব্যাট করার সময় চোখ কুঁচকে থাকেন। এর মানে হলো উনি চোখে কম দেখেন। চোখ কুঁচকে লেন্স অ্যাডজাস্ট করে নেন। ওনাকে চোখের ডাক্তার দেখাতে হবে।
এক বছর পরের কথা।
বাংলাদেশের অধিনায়ক কায়সার ত্রিদেশীয় কাপে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিলেন। ম্যান অব দ্য সিরিজ হলেন। পুরস্কার নেওয়ার সময় টেলিভিশনে কায়সার বললেন, আমি আমার এই প্লেয়ার অব দ্য সিরিজ পুরস্কারটা উৎসর্গ করতে চাই গুড্ডুবুড়াকে।
গুড্ডুবুড়া? সে আবার কে?
ক্লাস ফোরে পড়া একজন ইয়াং ক্রিকেটার। এখন অবশ্য সে পড়ে ক্লাস ফাইভে।
কেন? তাকে কেন উৎসর্গ করবেন?
কারণ, আমার চোখে সমস্যা ছিল। এটা আমাকে কেউ বলেনি। গুড্ডুবুড়া আমাকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। আরও আছে!
আর কী!
আর আমি গুড্ডুবুড়ার কাছে শিখেছি, ক্রিকেট কেবল শরীরের খেলা নয়, মনের খেলা নয়, এটা বুদ্ধিরও খেলা। আমার বুদ্ধি বাড়ানোর জন্য আমি অনেকগুলো ব্যায়াম করি। আর ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করি। এই পরামর্শ আমি নিয়েছি এক্সপার্টদের কাছে। তবে এক্সপার্টদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ আমাকে দিয়েছিল গুড্ডুবড়া।