কথা বলা তোতাপাখি ও পুলিশ অফিসার
‘ছাব্বিশ লাখ টাকা!’
‘জি, ছাব্বিশ লাখ।’
‘এত টাকা ঘরে রাখে নাকি কেউ? আপনারা কি পাগল?’
এ প্রশ্নের আর কী উত্তর হতে পারে? আব্বু শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন প্রশ্নকর্তা পুলিশের দিকে।
আমাদের পরিবারের সবার মন খারাপ। মন খারাপ বললে অবশ্য পুরোটা বোঝানো যায় না, বলতে হবে, আমাদের মন ভেঙে গেছে। এই কদিন খাবার টেবিলে বসে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। আব্বু মাঝেমধ্যে একেকটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। আম্মু রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠছেন, আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। আর নায়লা আপু পড়ার টেবিলে একটা বই খুলে বসে থাকে বটে, কিন্তু তার উদাস চোখ জানালার বাইরে, যেখানে দোতলা পর্যন্ত উঠে এসেছে একটা শিউলিগাছ, গাছের নিচে সবুজ ঘাসে কমলা রঙের বোঁটার সাদা ফুল ছড়িয়ে আছে। আমি জানি, অন্য সময় হলে আপু সেই ফুল কুড়িয়ে এনে তার টেবিলে রাখত। ঘরটা ভরে যেত মিষ্টি একটা গন্ধে। কিন্তু এখন তো মন ভালো নেই।
তিন দিন আগে, মানে গত সোমবার বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমাদের বাসা থেকে ছাব্বিশ লাখ টাকা নিয়ে গেছে ডাকাতেরা। এত টাকা কেউ ঘরে রাখে নাকি? প্রশ্ন করেছিল পুলিশের লোকেরা। সে উত্তর পরে দিচ্ছি।
পরের কথা আগে বলি, ডাকাতেরা নাকি ছিল তিনজন। আমার আব্বু প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠেন খুব ভোরে। নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে বারান্দায় খানিকটা পায়চারি করা তার অভ্যাস। সেদিন শেষরাত থেকে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বাবা ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় বেরোনোর জন্য সবে দরজা খুলেছেন, অমনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই আলো-আঁধারির মধ্যে কালো কাপড়ের মুখোশ পরা তিনজন লোক তাকে জাপটে ধরে মুখে হাতচাপা দিয়েছে। তিনজনের হাতেই বড় চকচকে ছুরি। একজন পেটের কাছে ছুরির ফলাটা ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘চাবিটা দে।’
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ওয়ার্ডরোবের ভেতর থেকে চাবি বের করে দিয়েছিলেন আব্বু। একজন সেই চাবি দিয়ে স্টিলের আলমারি থেকে টাকা নিয়ে ভরে ফেলল একটি ব্যাগে। এত কিছু যে ঘটে যাচ্ছে, আমার আম্মু কিন্তু তখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। আম্মুর ঘুমটা এ রকমই। রান্নাঘরের কাজ শেষ করে বেশ রাত করে ঘুমাতে যান। সেই ক্লান্তি নিয়ে বিছানায় পড়লেই আর কোনো খবর থাকে না, দু–তিন মিনিটের মধ্যেই নাক ডাকতে শুরু করেন। আব্বু প্রায়ই ঠাট্টা করে বলেন, ‘তোমার পাশে একটা লোক মরে পড়ে থাকলেও তো খবর পাবে না তুমি।’ তার সেই ঠাট্টাই যেন সত্যি হলো। ঘরের মধ্যে তিনটা লোক ঢুকে এত কিছু করে ফেলছে, অথচ ঘুম তার ভাঙে না। টাকা নেওয়ার পর ডাকাতেরা বাবার হাত বেঁধে, চওড়া স্কচটেপ লাগিয়ে দিয়েছিল মুখে। তারপর নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই হয়তো আমার ঘুমন্ত আম্মুর মুখেও স্কচটেপ লাগিয়ে দিল ওরা। সদ্য ঘুমভাঙা চোখে ঘটনাটা স্বপ্ন না সত্যি বুঝে ওঠার আগেই তারও হাত দুটি বেঁধে বাইরে থেকে ঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে চম্পট দিয়েছিল ডাকাতেরা।
ভয়ে-বিস্ময়ে দুজন কতক্ষণ দিশেহারা বেহুঁশের মতো ছিল, বলতে পারব না। হঠাৎ আব্বু এসে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে মুখে গোঁ গোঁ শব্দ করছিলেন। নায়লা আপু থাকে পাশের ঘরে আর আমি ঘুমাই গেস্টরুম কাম রিডিং রুমে। আমিও মায়ের স্বভাবটা পেয়েছি। অনেক রাত জেগে ইন্টারনেট চালাই, ফেসবুকে চ্যাট করি, তারপর ঘুমিয়ে পড়লে মরার মতো। নায়লা আপুর গগনবিদারী চিৎকারে ঘুম ভাঙল আমার, ‘শুভ ওঠ, শুভ ওঠ, সর্বনাশ হয়ে গেছে, শুভ, ওঠ...।’
‘সর্বনাশ’ শব্দটা কানে গিয়েছিল আমার, পড়িমরি করে উঠে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে শরীরে মশারি পেঁচিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছি মেঝেতে। ব্যথা পেয়েছি কি না, সেটা দেখা বা বোঝার সময় তখন নেই।
নায়লা আপু শুধু কাঁদছে হাউমাউ করে। আব্বু যে আম্মুর হাতের বাঁধন বা মুখের স্কচটেপ খুলে দেবেন, সেই বুদ্ধিটা আসেনি তাঁর মাথায়। আমি তাড়াতাড়ি দুজনের হাত আর মুখের বাঁধন খুললাম। আব্বু হকচকিত হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে আর আম্মু তখনো কী এক ঘোরের মধ্যে যেন অদ্ভুত একটা শব্দ করছেন মুখ দিয়ে।
নিচতলা থেকে সোবহান সাহেব আর নেলী খালা এলেন। নেলী খালা আম্মুকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পানি ঢালতে লাগলেন মাথায় আর আপুকে বললেন, ‘তাকিয়ে আছিস কেন হাঁ করে? যা, দুই গ্লাস শরবত বানিয়ে নিয়ে আয়।’
আব্বু দুহাত দিয়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে সোবহান সাহেবকে বললেন, ‘আমার তো সব শেষ, সোবহান ভাই...।’
এবার ছাব্বিশ লাখ টাকার কথাটা বলি। পুলিশ এসে প্রথমেই জানতে চেয়েছিল ‘এত টাকা কেউ ঘরে রাখে?’
আসলে ফটিকছড়িতে আমাদের একটা জমি বিক্রি করে তিরিশ লাখ টাকা পেয়েছিলেন আব্বু। আমার নায়লা আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী মাসে মানে সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখ শুক্রবার বিয়ের দিন-তারিখও পাকা। আব্বু চাকরিজীবী মানুষ, জমানো টাকা তেমন নেই। বিয়ের খরচপাতির কথা ভেবেই জমিটা বিক্রি করেছিলেন। বিয়ের খরচের পর যা কিছু হাতে থাকবে, তা ব্যাংকে রাখবেন, এমন পরিকল্পনা ছিল তাঁর। চার লাখ টাকা দিয়েছিলেন জুয়েলারিতে বিয়ের গয়নার অগ্রিম বাবদ। বাকি সব টাকাই গেল ডাকাতের হাতে।
থানায় খবর দিয়েছিলেন সোবহান সাহেবই। পুলিশ এসেছিল। এসেই এমনভাবে ধমকের সুরে কথা বলছিল সবার সঙ্গে, যেন আমাদের টাকা ডাকাতির ঘটনার জন্য আমরাই দায়ী। আমাকে জেরা করছিল, কোথায় পড়ো, রাত কটায় বাসায় ফেরো, কাদের সঙ্গে মেশো...ইত্যাদি। আমার তো প্রায় কান্না পাচ্ছিল। আমার আব্বু একবার শুধু মিনমিন করে বলেছিলেন, ‘ওকে এত কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
খুব গম্ভীর মুখে পুলিশ জবাব দিয়েছিল, ‘তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছুই করতে হয়।’
আমাদের রোজিনা বুয়া আমাদের বাসায় আছেন প্রায় ছয় বছর। পুলিশের একজন তাকে ইচ্ছেমতো ধমক লাগাল, এমন সব প্রশ্ন করতে লাগল যে বুয়া হাউমাউ করে বলল, ‘এত বছর এই বাসায় আছি, কুনু দিন একটা কিছুতে হাত দিছি? আপার সোনার কানের দুল ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাইখা যায়, শুভ ভাইয়ার টাকাপয়সা তো টেবিলের ওপর, শার্টের পকেটে পইড়া থাকে, হাত দিছি কুনু দিন...? আপনে কন আম্মা...।’
আম্মু বলল, ‘কথা ঠিক, ওর স্বভাব–চরিত্র ভালো...ও কোনো দিন...।’
প্রায় ধমক দিয়ে আম্মুকে থামিয়ে পুলিশ বলল, ‘তদন্তের কাজে বাধা সৃষ্টি করবেন না।’
কাজের কাজ কিছুই হলো না, শুধু শুধু যাওয়ার সময় রোজিনা বুয়াকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ। সেই রোজিনা বুয়া ফিরে এসেছিল সন্ধ্যায়। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি আর আপনেগো বাসায় কাজ করব না, জীবনে এত বড় অকমান (রোজিনা বুয়া অপমান শব্দটাকে বলে ‘অকমান’) আর হই নাই...আমারে বিদায় দেন আম্মা...।’
টাকা উদ্ধারের কিছু তো হলোই না, এদিকে নায়লা আপুর বিয়েটাও ভেঙে গেল। পাত্রপক্ষ নগদ পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিল। এত বড় ঘটনার পরও সেই টাকার দাবি তারা ছাড়ে না। আব্বু বলেছিলেন, ‘আমি তো সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। ধারকর্জ করে বিয়েটা হয়তো দিতে পারব, কিন্তু নগদ টাকা দিতে পারব না।’
পাত্রপক্ষ অনড়, নগদ না দিলে বিয়ে হবে না। সপ্তাহখানেক পর সোবহান সাহেব বললেন, ‘থানার কাজের তো কোনো অগ্রগতি দেখছি না। একটু ওপরের লেভেলে চেষ্টা করতে হবে।’
ওপরের লেভেলে তিনি কী চেষ্টা করেছিলেন, জানি না। আরও দিন দুয়েক পর এক পুলিশ অফিসার এলেন আমাদের ঘরে। নিজের পরিচয় দিয়েছেন এএসপি বলে।
‘এটা আজিম সাহেবের বাসা?’
নায়লা আপু দরজা খুলে দিয়েছিল। বলল, ‘জি, আপনি বসুন, আব্বাকে ডেকে দিচ্ছি।’
আব্বু গেলেন ড্রয়িংরুমে তার সঙ্গে কথা বলতে।
আমি আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আবার পুলিশ এসেছে?’
আপু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘না, এটা হিন্দি ফিল্মের নায়ক।’
আমি অবাক, বলে কী নায়লা আপু! ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি, সত্যিই তো, লম্বা ছিপছিপে শরীর, সুন্দর চেহারা, ভারী গোঁফের আড়াল থেকে ঝকঝকে সাদা দাঁতের হাসি, এ রকম পুলিশ অফিসারকে সচরাচর হিন্দি ফিল্ম ছাড়া দেখা যায় না। আমাকে দেখে বলল, ‘বাইরে একটা তোতাপাখি দেখলাম, ওটা তোমার?’
কথাগুলো আগের পুলিশগুলোর মতো কর্কশ নয়, বরং যেন একটু স্নেহ মেশানো আছে তাতে। বললাম, ‘জি না, আমার আপুর, পাখিটা কথা বলতে পারে...।’
‘তা–ই তো দেখলাম। কিন্তু আমাকে দেখে “সালাম, রাকিব ভাই” বলল কেন?’
আমি হেসে ফেললাম, ‘আব্বুর অফিসের ড্রাইভারটাও পুলিশের মতো ড্রেস পরে তো, তাই ভুল করেছে।’
‘ও হো।’ আবার গোঁফের আড়ালে সাদা ঝকঝকে দাঁত দেখা গেল।
পুলিশ অফিসার, যিনি নিজের নাম বললেন মাহমুদ, তিনি ডাকাতির পুরো বিবরণ শুনলেন। আমাদের সব কটি ঘর ঘুরে দেখলেন। নায়লা আপুর সঙ্গেও কথা বললেন। তারপর আবার গিয়ে দাঁড়ালেন বারান্দায়। আমাদের কথা বলা তোতাপাখি আবার তাকে দেখে বলল, ‘সালাম, রাকিব ভাই।’
এবার আপু তার পাখির কাছে গিয়ে ছোট করে বলল, ‘উনি রাকিব ভাই নন, উনি পুলিশ অফিসার।’
তোতাপাখি কিছুই শোনে না, একনাগাড়ে বলতে থাকে, ‘রাকিব ভাই, রাকিব ভাই, রাকিব ভাই...।’
অফিসার সব দেখেশুনে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ কী মনে করে ফিরে এসে আবার দাঁড়ালেন পাখিটার সামনে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তারপর গম্ভীর মুখে আব্বুকে বললেন, ‘চলুন, কথা আছে, ঘরে চলুন...।’
আমরা অবাক, অফিসার আবার ফিরে এসে বসলেন ড্রয়িংরুমে। আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার অফিসের ড্রাইভারের নাম রাকিব?’
আব্বু বললেন, ‘হ্যাঁ।’
‘অফিস কি আপনাকে ফুলটাইম গাড়ি দিয়েছে?’
‘না, শুধু অফিসে যাওয়া–আসার জন্য...।’
‘যাদের কাছে আপনি জমি বিক্রি করেছিলেন, তারা কি আপনাকে ঘরে এসে টাকা দিয়ে গেছে?’
‘না, রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল হস্তান্তরের পর সেখানেই তারা টাকা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।’
‘তারপর টাকা নিয়ে কীভাবে বাসায় এসেছিলেন?’
‘জি…মানে অফিসের গাড়িতেই…টাকা নিয়ে অফিসের গাড়িতেই বাসায় এসেছিলাম।’
হঠাৎ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল অফিসারের মুখ। হাত মুঠো করে নিজের ঊরুতে একটা কিল মেরে অফিসার বললেন, ‘ইয়েস্স্স্...।’
তারপরের ঘটনাগুলো ঘটে গেল খুব দ্রুত। আব্বুর অফিসে গিয়ে ড্রাইভার রাকিবকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে গেছেন অফিসার। সেখানে উপযুক্ত উত্তমমধ্যম কিছু দিয়েছিলেন হয়তো, রাকিব গরগর করে সব স্বীকার করেছে। জমি বিক্রির টাকা আব্বু ঘরে এনে রেখেছে জেনে কীভাবে সে ডাকাতির প্ল্যান করেছে, কীভাবে আরও দুজন মিলে সারা রাত আমাদের বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করেছে, কীভাবে আব্বু ভোরে পায়চারি করার সময় কাজ সমাধা করেছে—সব, সবকিছু ।
পরদিনই রাকিবের কথামতো শিকলবাহা গ্রামে গিয়ে বাকি দুজনকে গ্রেপ্তার করে টাকা উদ্ধার করেছে পুলিশ। টাকার ব্যাগ নিয়ে দুদিন পর আবার আমাদের বাসায় এসেছেন এএসপি মাহমুদ সাহেব। বললেন, ‘গুনে নিন, ১০ হাজার টাকা কম আছে, হারামজাদারা খরচ করে ফেলেছে। তবে ভাগ-বাঁটোয়ারা করার সময় পায়নি। হা হা হা।’
আমার আব্বু তো প্রায় অফিসারের হাত ধরে কেঁদে ফেলেন, ‘আপনাকে কী বলব অফিসার...আপনি...আপনি...!’
মাহমুদ সাহেব বললেন, ‘আমাকে তুমি করে বলবেন...।’
আম্মুর তো আবেগ একটু বেশি, বললেন, ‘হ্যাঁ বাবা, তুমি আমাদের ছেলের মতো, তোমাকে কিছু টাকা দিতে চাই বাবা, কিছু মনে করবে না তো?’
মাহমুদ সাহেব বললেন, ‘টাকা দেবেন কেন, আমি তো আমার ডিউটি করতে এসেছি। এখন তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ের আয়োজন করেন, পাত্রপক্ষকে খবর দেন...।’
এর মধ্যে আপু হঠাৎ বলে উঠল, ‘ওই বিয়ে আমি করব না।’
‘কেন?’ মাহমুদ সাহেব অবাক।
‘যারা টাকার জন্য বিয়ে ভেঙে দিতে পারে, সেই পরিবারে আমি যাব না।’
হাসলেন অফিসার, ‘দ্যাটস গুড। ভেরি গুড ডিসিশন। আপনার মতো শিক্ষিতা মেয়ের কি পাত্রের অভাব আছে?’
নায়লা আপু অফিসারের মুখে কথাটা শুনে লজ্জা পেল। লজ্জা পেলে আপুকে আরও সুন্দর দেখায়।
ফিরে যাওয়ার সময় অফিসার বললেন, ‘আপনাদের পাখিটাকে কিন্তু একটা পুরস্কার দেওয়া দরকার। পাখিটাই তো বারবার “রাকিব রাকিব” বলে আমার মনে সন্দেহটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ভেরি ইন্টেলিজেন্ট, আমাকে দেখে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল, আমি ডাকাতির ঘটনা তদন্তে এসেছি। সেদিন মুখোশ পরা রাকিবকে আপনারা না চিনলেও পাখিটা কিন্তু ঠিকই চিনেছিল।’
আমার হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘পাখিকে পুরস্কার দেব? পাখির আবার কী পুরস্কার?’
গোঁফের আড়াল থেকে সাদা ঝকঝকে দাঁতের হাসি ফুটিয়ে অফিসার বললেন, ‘পাখির জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো মুক্ত আকাশ, পাখিটাকে এবার মুক্ত করে দাও শুভ সাহেব...।’
পুলিশ এত সুন্দর করে কথা বলে! লোকটাকে খুব ভালো লেগে গেল আমার। অফিসার চলে যাওয়ার পর আমি আর আপু ঠিক করলাম, যত খারাপই লাগুক, পাখিটাকে এবার ছেড়ে দেব আমরা।
পরদিন সকালে ভাই–বোন মিলে আমরা মুক্ত করে দিলাম প্রিয় তোতাপাখিটাকে। দরজা খুলে দেওয়ার সময় পাখিটার পালকে হাত বুলিয়ে আপু বলল, ‘তোকে হয়তো অনেক কষ্ট দিয়েছি আমরা...কিন্তু ভালোও তো বেসেছি, আমাদের ক্ষমা করে দিস।’
এই আবেগময় কথা কতটা কী বুঝল জানি না, ফুড়ুত করে উড়ে গেল পাখিটা। টাকা ফিরে পাওয়ার পারিবারিক আনন্দের মধ্যেও এই একটা দুঃখ সারা দিন আমাদের মনটাকে মেঘলা আকাশের মতো কালো করে রেখেছিল। দুপুরে প্রায় খেতেই পারিনি আমরা ভাই–বোন। সন্ধ্যায় টেলিভিশনের সামনে বসে কী জানি একটা দেখছিলাম, কিছুতেই মন বসছে না, হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন ডাকছে ‘নায়লা আপু...নায়লা আপু..., শুভ...শুভ...।’
ছুটে গেলাম বারান্দায়। দেখি নিজে নিজেই খাঁচার ভেতর এসে বসে আছে আমাদের পাখিটা। খুশিতে আমরা বাক্রুদ্ধ। আপুর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। দেখাদেখি আমারও চোখ ভিজে গেল জলে। আপু বলল, ‘এবার থেকে খাঁচার দরজাটা খোলাই থাকবে, পাখি যখন খুশি উড়ে যাবে, যখন খুশি ফিরে আসবে।’
আমি বললাম, ‘দারুণ আইডিয়া!’
কথায় বলে, দুর্ভাগ্য নাকি একা আসে না, আমি তো দেখলাম সৌভাগ্যও একা আসে না। পরদিনই ঘটে গেল আরও মজার এক ঘটনা। সোবহান সাহেব এসে আব্বুকে বললেন, ‘এএসপি মাহমুদ একটা প্রস্তাব দিয়েছে আজিম ভাই, নায়লাকে বিয়ে করতে চায় সে। ভালো ছেলে, খুবই ভালো ছেলে, ইংরেজিতে মাস্টার্স করে পুলিশে জয়েন করেছে..., ফ্যামিলিটাও ভালো, আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়।’
আব্বু বললেন, ‘ভালোই তো, দেখি মেয়ের সঙ্গে কথা বলে...।’
আমি বললাম, ‘আমি জানি আপু রাজি, ফিল্মের পুলিশ অফিসার আপুর খুব পছন্দ...।’
পাশের ঘর থেকে আপু কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ভালো হবে না বলছি, শুভ...।’
আপুর মনের কথা বোঝা গেল। আব্বু হাসিমুখে বললেন, ‘আমি রাজি, আপনি যোগাযোগ করেন সোবহান ভাই।’
সোবহান সাহেব যোগাযোগ করলেন। আপুর সঙ্গে পুলিশ অফিসারের বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল। বিয়ে আগামী মাসের ১২ তারিখ, শুক্রবার।